শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৩

বিস্ফোরণোন্মুখ বাংলাদেশ ও ভারতের ভূরাজনীতি


২৩ ফেব্র“য়ারি দিল্লির হিন্দুস্তান টাইমস  পত্রিকার একটি সংবাদ শিরোনাম ‘সিভিল ওয়ার ইরাপ্টস্ ইন বাংলাদেশ, ফোর কিলড’; তথা, বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের বিস্ফোরণ ঘটেছে, চারজন নিহত। সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ছত্রছায়ায় ফাঁসির রজ্জু ঝুলিয়ে শাহবাগ চত্বরে প্রতিহিংসামুখর ‘নির্দলীয়’ তরুণ প্রজন্মের দলবাজি আর দুরাচারের প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের যে ধিক্কার ও প্রতিরোধ সহসাই জাগ্রত হয়েছে, সেই সত্য ঘটনার সহজ বিবৃতি এসেছে ওই শিরোনামে। অন্তত এ দেশের নয়া ধনকুবের ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর মুখপত্রগুলোর মতো পরিস্থিতিকে এক পরে ‘তাণ্ডব’ আর পুলিশের সহায়তায় অন্য পরে (সাধারণ জনগণের সংস্রব কিংবা জনকল্যাণ ভাবনা বিবর্জিত) ‘স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ’ বলে ঘোর মিথ্যাচার করা হয়নি। তবে সংবাদ বিবরণীটি ছিল স্বভাবতই শাহবাগ হুজুগের তত্ত্ব¡াবধায়কদের প্রভাব ও পপাতদুষ্ট। হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদক ইন্দ্রজিত হাজরা ওই রিপোর্টে লিখেছেন : ‘১২টি ইসলামপন্থী সংগঠন তাদের বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামীকে টার্গেটে পরিণত করতে গিয়ে (ইসলাম বিরোধিতার দায়ে) সরকার ও মিডিয়াকে দায়ী করছে। তারা শুক্রবার যে প্রতিবাদ বিােভ করে তার মূল টার্গেট ছিলেন সংবাদকর্মীরা। ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভিতর থেকে তারা পুলিশ ও টেলিভিশন ক্যামেরাম্যানদের ইট-পাটকেল নিপে করে হামলা চালায়।’

এ কথা তিনি লেখেননি বা হয়তো জানতেন না যে, জুতা পরে মসজিদে ঢোকার কারণে এবং ‘শাহবাগ’-এর জন্য দোয়া পাঠের সাজানো চিত্রগ্রহণের পীড়াপীড়িতে ুব্ধ হয়েই মুসল্লিরা নামাজ আদায়ের তাগিদে ওই টেলিচিত্রগ্রাহকদের মসজিদ থেকে বের করে দেন। মসজিদের ভেতরে জবরদস্তি আর জুতার ধুলায় মসজিদ নোংরা করার দুষ্কৃতিতে লিপ্ত হয়েই পাল্টা মার খেয়েছিল সংবাদমাধ্যমে নিযুক্ত ওই অকাল কুষ্মাণ্ডের দল।
ইন্দ্রজিত হাজরা মুসল্লিদের সম্পর্কে আরো লিখেছেন : (জুমার নামাজের পর) ‘তারা বাইরে এসে যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের বিভিন্ন শহরে শহীদ মিনারে ভাঙচুর চালায়। ঢাকায় পুলিশের এক মুখপত্র বলেছেন, তারা ১৬৬ জনকে আটক করেছেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতবিরোধী প্রতিবাদ চলছিল শাহবাগে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি সেখান থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি দেয়া হয়। এই শাহবাগ স্কয়ার থেকে কয়েক গজ দূরেই পুলিশ স্টেশন। মাহবুবুল খুররম নামে এক ব্যক্তি সেখানে গিয়ে দাবি করছিলেনÑ তার ভাই নিরপরাধ। পুলিশ তাকে পায়ে গুলি করে আহত করেছে। সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। সেখানেই তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। খুররম আরো বলেন, তার ভাই রেজাউল জামায়াত করে না। শুক্রবার মসজিদে নামাজ আদায় করে সে সবেমাত্র বেরিয়েছিল।’
ইসলাম ও মহানবীর অবমাননায় মুসল্লিদের বিােভ দমনে পুলিশের অবরোধ এবং মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের কথা বলা হয়নি, উল্টো মসজিদ থেকে বেরিয়ে নামাজিরা সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে, প্রতিবেদকের এমন একতরফা বর্ণনা সত্ত্বে¡ও থানায় পুলিশের আচরণ সম্পর্কে ওই প্রতিবেদনেই ফুটে উঠেছে, পুলিশের গুলিতে আহত নির্দোষ এক নামাজিকে কিভাবে হাসপাতালেই ‘গ্রেফতার’ দেখিয়ে পুলিশি নির্যাতনের স্যা কিভাবে লোপাট করা হচ্ছে।
অন্য দিকে ঘোর ইসলামবিদ্বেষী ও মহানবীর জীবন নিয়ে কুৎসা-প্রচারক ব্লগার রাজিবকে শুধু ‘জামায়াতবিরোধী’ বলে সাফাই গেয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘জামায়াতবিরোধী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হত্যা করা হয় ঢাকায়। এ জন্য জামায়াত-শিবিরকে সন্দেহ করা হচ্ছে। শুক্রবার সকাল থেকেই শাহবাগ স্কয়ার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ প্রতিবাদী তরুণেরা ফিরে আসেন সেখানে। এখানে গণজাগরণের অন্যতম প্রধান আয়োজক ইমরান সরকার বলেন, ইসলামপন্থী দলগুলোর সহিংসতা দেখে জনগণের ভীত হওয়া উচিত নয়। শুক্রবারের সহিংসতার পর শাহবাগ স্কয়ারের প্রতিবাদী জনতা প্রতিবাদ বিােভের ডাক দিয়েছে এবং একই সাথে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের দাবি জানান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ১-এর সাবেক চেয়ারম্যান মো: নিজামুল হক ও ব্রাসেলসে বসবাসকারী যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে স্কাইপ কথোপকথন তার পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন।’
বস্তুত, ‘স্কাইপ কেলেঙ্কারি’ ফাঁস করে ১ নম্বর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে লন্ডনের বিখ্যাত দি ইকোনমিস্ট পত্রিকা। কেন ওই বিচারকের একান্ত স্কাইপ কথোপথন ও বিচারকার্য নিয়ে আদালতবহির্ভূত অনৈতিক পরামর্শের ই-মেইল হ্যাকিংসূত্রে পেয়েও সংবাদমাধ্যমে জনস্বার্থে প্রকাশ করা হলো, সে সম্পর্কে সুযুক্তিসহকারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার সম্পাদক। তাকে নোটিশ দিয়েও তার বিরুদ্ধে কোনো পদপে নিতে ব্যর্থ হয়েছে ওই ট্রাইব্যুনাল। বাংলাদেশ সরকারও তাকে আর ঘাটায়নি। আমার দেশ পত্রিকা অনলাইন থেকে দি ইকোনমিস্টে প্রকাশিত স্কাইপ কেলেঙ্কারির রিপোর্ট তর্জমা করে পুনঃ প্রকাশ করেছে মাত্র। সরকারপ এ নিয়ে আমার দেশ  সম্পাদককে হুমকিধমকি দিলেও এবং হয়রানিমূলক ‘রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা’ দায়ের করলেও এত দিন তাকে গ্রেফতারে অগ্রসর হয়নি; গ্রেফতার এড়াতে একরকম ‘অফিসবন্দী’ হয়েছিলেন তিনি। এখন সরকার অন্য সুর ধরেছে। ইসলাম-অবমাননাকারী নিহত ব্লগার রাজিবের লাশ শাহবাগ চত্বরের ‘নোংরা পরিবেশে’ রাষ্ট্রীয় পতাকায় জড়িয়ে ‘অনৈসলামিক কায়দায় নামাজের নিয়ম ভঙ্গ করে’ নামাজের জানাজার দায় ঘাড়ে নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে সরকার (কোটেশনগুলো বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম-এর কণ্ঠের ধিক্কার)। তাই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে সরকারপ। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের এক সদস্য দাবি করেছেন, রাসূল সা: আর ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তিগুলো নিহত রাজীবের লেখা নয়, সরকারবিরোধীরা চক্রান্ত করে সেগুলো নিজেরাই লিখে রাজীবের ব্লগে ঢুকিয়েছে আর খবরের কাগজে দিচ্ছে : তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নেয়া হোক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন : ওই সব ব্লগ ফাঁস করে দিয়ে কাগজে ছাপিয়ে ‘ধর্মোন্মদনা সৃষ্টি’র জন্য আমার দেশ পত্রিকা সম্পাদকের বিরুদ্ধে কিভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যায় এবং শাহবাগ প্রজন্মের দাবি অনুযায়ী কিভাবে সত্বর তাকে গ্রেফতার করা যায়, তা খতিয়ে দেখছে সরকার। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা অশ্লীল ব্লগে ইসলাম আর মহানবীর অবমাননা করেছে এবং যারা সেসব পত্রপত্রিকায় পুনঃপ্রকাশ করেছে, দেশবাসীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার দায়ে তারাও সমভাবে দায়ী; তাদের সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২৩ ফেব্র“য়ারি এক সংবাদ সম্মেলন করে এ সম্পর্কে পাল্টা জবাবে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন : ‘শাহবাগের আন্দোলনে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে। সেখানে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে। কিন্তু আমার দেশ পত্রিকা আমাদের নিজস্ব পরিচয় তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ভিন্ন দেশের সংস্কৃতি এক হতে পারে না। এসব বিষয় তুলে ধরায় আমার দেশ পত্রিকা দেশের সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো আমার দেশ পত্রিকার সাথে করপোরেট স্বার্থ (ইন্টারেস্ট) নেই। এখন যেকোনো সময় আমার দেশ কার্যালয়ে পুলিশ আসবে, আমাকে গ্রেফতার করবে। আমাকে গ্রেফতার করা হলেও বিজয় আমাদের হবেই।
ব্লগের লেখাগুলো জনস্বার্থে প্রকাশ করেছি। এর ফলে শাহবাগে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো বন্ধ করে এখন নামাজ পড়া শুরু হয়েছে। সরকার এসএমএস দিয়ে ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে প্রচার করছে। অভিভাবকেরা ব্লগে তরুণদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন। সুতরাং যা করা হয়েছে তা জনস্বার্থে করা হয়েছে। ব্লগের অশ্লীলতা নিয়ে প্রথমে ইনকিলাব পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। শাহবাগে আন্দোলনকারীরা ওই পত্রিকার কথা না বলে শুধু আমার দেশ সম্পাদকের গ্রেফতার দাবি করছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে তারা বিশেষ উদ্দেশ্যে এই আন্দোলন করছে।’
বাস্তবিক সরকারের জন্য আরো বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের এই অভ্যন্তরীণ বিবাদে নাক গলাতে ভারত সরকারের প্রতিনিধি মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের প্রকাশ্য উৎসাহ। ১৭ ফেব্র“য়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ঢাকার জনজোয়ারকে কুর্নিশ জানাল ভারত : নিজের ব্লগে রাজাকারদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে খুন হওয়া তরুণ স্থপতি রাজীব হায়দারের দেহ বিকেলে এসে পৌঁছল এই ‘স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বরে’। সেই দেহকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় মুড়ে রাখা হয়েছে। শোকস্তব্ধ নিস্তব্ধ জনতা। নামাজ-ই-জানাজার পরে হলো শেষ প্রার্থনা সভা। হাজার হাজার মানুষ।…. ফুটপাথে সন্তানকে বসিয়ে মা তার সন্তানের মাথায় ফেট্টি বেঁধে দিচ্ছেন, তাতে লেখা ‘ফাঁসি চাই’। তাহরির স্কয়ারে গণবিােভ দেখেছে মানুষ। তিয়েন আন মেন স্কয়ারের বিদ্রোহও দেখেছে। দিল্লির যন্তরমন্তর বা ইন্ডিয়া গেটেও দেখা গিয়েছে মোমবাতি মিছিল। কিন্তু গত দু’দশকে মানুষ এমন বিােভ দেখেনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ছুটে গিয়েছেন নিহত রাজীবের বাড়িতে। তারপর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। সন্ত্রাসই তাদের পথ। বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার জামায়াতের নেই। হাসিনা বলেছেন, ‘এই সন্ত্রাসীদের যা করা দরকার, আমরা সেটাই করব।’ তার এই মন্তব্যের পরেই প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি বাংলাদেশ সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চলেছে? বৈঠকের পর দুই বিদেশমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ও দীপু মনি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই গণ-আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। …. আর সালমান খুরশিদ এই রকম একটি দিনে ঢাকায় এসে যেভাবে একাত্তরের বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সালমান বলেছেন, ‘নবীন প্রজন্মের দাবিও যুক্তিসঙ্গত।’ সন্ত্রাসের বিরোধিতা করে ধর্মনিরপেতার অভিমুখে দু’দেশের এগিয়ে চলার অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
প্রধান বিরোধী দল (বিএনপি) অভিযোগ করছে, বিরোধীদের জোট ভাঙার জন্য এই সমাবেশ আসলে এক সরকারি চক্রান্ত। কিন্তু ১৩ দিন ধরে চলা এই আন্দোলনে যেভাবে সাধারণ মানুষ যোগ দিচ্ছেন, এই অভিযোগ তাতে নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে।…. (ভারতের) আন্না হাজারে বা রামদেবের নেতৃত্বে নাগরিক বিােভ যেমন সরকারবিরোধী ছিল, এখানে কিন্তু তা নয়। সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এই বিােভ মঞ্চে এসে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘আমি এখানে, কিন্তু আমার মন পড়ে রয়েছে ওখানে (শাহবাগ স্কয়ারে)।’ শনিবারেও বিােভ সমাবেশে এসে স্লোগান দিয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রবাসী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। বিােভকারীদের সাথে দেখা করে সংহতি জানিয়ে আসছেন মন্ত্রীরা।
এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে সনস অব বাবর নাটকের নাট্যকার সালমান খুরশিদ আন্দোলন প্রাঙ্গণ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে একটি হোটেলে মধ্যাহ্নভোজন করতে করতে বললেন, ‘আধুনিক বিশ্বে ধর্মনিরপেতা ছাড়া বিকল্প পথ নেই।’ আন্নার আন্দোলন নিয়ে নয়া দিল্লি যে অবস্থানই নিক, বাংলাদেশের এই গণজোয়ারের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সহানুভূতি জানাতে কিন্তু গলা কাঁপেনি খুরশিদের।
২৬ ফেব্র“য়ারি দিল্লির টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি সংবাদভাষ্যে বলেছে : ‘বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম শাহবাগ মোড়ের আন্দোলনকারীদের প্রতি ভারতের জোরাল সমর্থন রয়েছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন গত শুক্রবার পুনেতে বলেন : ‘উগ্রপন্থী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে শাহবাগের চলমান আন্দোলনে হাজার হাজার তরুণের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি থেকে বাংলাদেশী তরুণদের দৃঢ় অনুভূতি, রাজনৈতিকভাবে জনগণকে সমবেত করার মতা ও তাদের মুক্তমনের পরিচয়ই ফুটে উঠেছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বাংলাদেশে তার সাম্প্রতিক সফরকালে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। ঢাকায় সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে খুরশিদ বলেছেন, তরুণসমাজকে যেকোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে দেখা সবসময়ই আনন্দের বিষয়। তারা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে, আন্দোলনে জড়িত হচ্ছে, তাদের আকাক্সার কথা তুলে ধরছে, আমি তাদের এই মনোভাবের প্রশংসা করি। গণতন্ত্রে এভাবেই আপনার জোরাল অনুভূতি ও বিশ্বাস প্রকাশ পায়।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের পর শাহবাগে এই আন্দোলন শুরু হয়। তারা তখন থেকেই রাজপথে আছে এবং সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবি করছে। একই সাথে তারা ইসলামি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করারও দাবি জানাচ্ছে।’
এভাবে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের যৌথ সমর্থনপুষ্ট এবং সাদা পোশাকে পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনী রতি অভিজন সমাজভুক্ত তারুণ্যের শাহবাগে দিনভর ‘পবিত্র ঘৃণা’র আনন্দোৎসব আর রাত্রি জাগরণের হুজুগকে কোনো কোনো বিশ্লেষক দেখছেন, ‘পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার ভারাক্রান্ত’ মহাজোট সরকারের একটা সার্থক নির্বাচনী নীতিকৌশলের ‘ব্লিজ ক্রিগ’ বা ঝোড়ো অভিযান হিসেবে। আকস্মিক এই ‘জয় বাংলা’ উদ্যমের জোয়ার তুলে সরকারপ তাদের সংশোধিত সংবিধান মোতাবেক দলীয় সরকারের অধীনে এ বছরই আগাম নির্বাচন দিয়ে মতায় ফেরার পাঁয়তারা করছে, ওই বিশ্লেষকেরা এমনই মনে করছেন। অন্য দিকে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মনে করছেন, শাগবাগ মঞ্চ আরো সুদূরপ্রবাসী ভারতীয় ভূরাজনৈতিক নীতিকৌশলের একটি অপরিণামদর্শী পদপে হিসেবে। ২৩ ফেব্র“য়ারির সংবাদ সম্মেলনেই তিনি বলেছেন : ‘রাষ্ট্রের মধ্যে শাহবাগ নামের আরেক রাষ্ট্র হয়েছে। কেননা, শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা জাতীয় পতাকা ওড়ানো, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, স্কুল বন্ধ রাখার কর্মসূচি, দিনের পর দিন আদালত অবমাননা করা হয়েছে। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা মানুষকে হত্যার হুমকি দিতে পারে, জবাই করো, জবাই করো বলে সন্ত্রাসবাদের উসকানি দিতে পারে। প্রচলিত আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন উপো করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন বা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের সিদ্ধান্ত কী কোনো নাগরিকগোষ্ঠী দিতে পারে? এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, শাহবাগ নামক রাষ্ট্র কার? কে এই রাষ্ট্র চালাচ্ছে? রাষ্ট্রের মালিক কী দেশের ভেতর নাকি সীমানার বাইরে? আমার দেশ পত্রিকা এ দেশের নিজস্ব পরিচয় তুলে ধরেছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্ম আছে তা প্রমাণ করেছে। ফলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। আমাকে গ্রেফতার করা হলেও অপ্রতিরোধ্য এ বিপ্লব কেউ থামাতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।’
এ দিকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা নিতে ৩ মার্চ সস্ত্রীক ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তিন দিনের সফরে ঢাকা আসছেন। ৪ মার্চ বঙ্গভবনে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য’ তাকে এই সম্মাননা দেয়া হবে। কথা উঠেছে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের একটি বিশেষ অধিবেশনে সরকারি আসন এবং বিরোধী আসন উভয়পরে উপস্থিতিতে তার ভাষণ দেয়ার ব্যবস্থা বা সুযোগ হতে পারে কি না। সফররত ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সাথে সৌজন্য সাাতের জন্য বিরোধী জোটনেত্রী প্রস্তুত কিন্তু সংসদের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেও তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সংসদবর্জন কর্মসূচি ব্যাহত হবে। তাকে সামান্যতম ছাড় দিয়ে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করার কোনো উদ্যোগই সরকারের নেই, উল্টো তার ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি উসকানিমূলক প্রচার আরো চাগিয়ে দিয়েছে মতাসীন দল। এ ছাড়া মাহমুদুর রহমান যেমন রাষ্ট্রের ভেতরে ‘শাহবাগ’ রাষ্ট্রের কথা তুলেছেন, তেমনি সরকারের ভেতরেও ‘জিলিপির প্যাঁচকষা’ সরকার রয়েছে বলে অনুমান করছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাদের প্রশ্ন, ভারতের রাষ্ট্রপতির পূর্বনির্ধারিত তারিখে আগমনের মাত্র চার দিন আগে কর্মসপ্তাহের শেষ দিনে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় প্রদানের দিনণ ঘোষণা দেয়া হলো কেন? প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত আবারো হরতালের ঘোষণা দিয়েছে। একই দিনে বিএনপিরও রয়েছে দেশব্যাপী জনসমাবেশের ঘোষণা। আর হেফাজতে ইসলাম দিয়েছে ওই দিন গণমিছিলের ডাক। শাহবাগ প্রজন্ম আবারো দুই হাসপাতালের স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ নষ্ট আর চৌরাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে ‘দিবারাত্রি জাগরণ’-এর জন্য ওই চত্বরে ফিরে এসেছে। তারা শুধু হরতাল প্রত্যাখ্যান নয়, প্রতিহত করার ডাক দিয়েছে। শিবির প্রজন্ম হরতালের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল আর অত্যাচারী পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলার শক্তি প্রদর্শন করছে। সরকার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-এর আধাসামরিক বাহিনী রাস্তায় নামিয়েছে।
আল্লামা-মাশায়েখরা আগেই ‘নির্দোষ’ সাঈদীর মুক্তি দাবি করে সোচ্চার হয়েছিলেন। স্বদেশে ও প্রবাসে ধর্মীয় ওয়াজ নসিহতের ক্যাসেটের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও রয়েছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর। ধর্মপ্রাণ দেশবাসী ও প্রবাসীদের মধ্যে দলমত নির্বিশেষে অগণিত ভক্ত রয়েছে তার। ফাঁস-হওয়া স্কাইপ কথোপকথন থেকে এটাও সাব্যস্ত হয়েছে যে, সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা অত্যন্ত দুর্বল, কোনো কোনো সাী স্পষ্ট বলেছেন একই নামের যে অপরাধীকে মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলেছিল, মাওলানা সাঈদীকে সেই মৃতব্যক্তির অপরাধের জন্য মিথ্যা অভিযোগ খাড়া করা হয়েছে। নাম বিভ্রাট, সংশয়ের অবকাশ বা সা্েযর পরস্পরবিরোধিতা সত্ত্বেও তার ‘সর্বোচ্চ’ দণ্ডই দাবি করেছে সরকারি উকিল। ‘শাহবাগ প্রজন্ম’ও বাঁশ গেড়ে বসেছে, ‘ফাঁসির আদেশ’ না নিয়ে তারা ঘরে ফিরবে না। আদালত স্বাধীনভাবে রায় দেয়ার সাহস পাবে না বলেই বিশ্লেষকেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিএনপির নেতারা বলেছেন, সরকার ইসলামবিদ্বেষীদের আশকারা দিয়ে ভয়াবহ আগুন নিয়ে খেলছে। বাস্তবিক সাঈদীর ফাঁসির রায় হয়েছে, এখন তার প্রতিক্রিয়ার আগুন কখন কিভাবে নেভাবে সেটা বলা কঠিন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads