রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৩

বেগম জিয়ার বক্তব্য নিয়ে কুতর্ক


‘দু’জন ইংরেজ এক হলে গড়ে একটি কাব, দু’জন স্কচ একত্র হলে খোলে একটি ব্যাংক, দু’জন জাপানি করে একটি সিক্রেট সোসাইটি। দু’জন বাঙালি একত্র হলে করে কী? দলাদলি? তা করে এবং বোধ হয় একটু বেশি মাত্রায়ই করে।’Ñ এই কথাগুলো আমার নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলা সাহিত্যে যাযাবর নামের এক লেখকের আবির্ভাব হতে দেখেছি। বলা যায়, এই লেখকের আবির্ভাব ছিল বাংলা সাহিত্যের একটি স্মরণীয় ঘটনা। এ লেখকের প্রথম বই ‘দৃষ্টিপাত’ প্রকাশিত হওয়া মাত্র বাঙালি শিক্ষিত সমাজে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল তা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি অভূতপূর্ব। তার বিমুগ্ধ পাঠক সম্প্রদায়ের অনেকেই আজো এই বইয়ের অনেক লাইন, অনেক অংশ প্রসঙ্গক্রমে উদ্ধৃত করেন। বস্তুত, তার নতুন গদ্যরীতি ও অভিনব রচনাশৈলী ও সেই সাথে তার সমাজদর্শনের চমৎকারিত্বে ভরপুর, ‘দৃষ্টিপাত’ বাংলা রম্যরচনার ক্ষেত্রে এক ট্রেন্ডসেটার পথিকৃতের আসন দখল করে আছে। ওপরের লাইন কয়টি যাযাবরের সেই ‘দৃষ্টিপাত’ বই থেকেই নেয়া। তার এই লাইন কয়টি বাঙালি চরিত্রের যথার্থ উন্মোচন বললে ভুল হবে না।

এই লাইন কয়টি মনে পড়ল সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার সেনাবাহিনী সম্পর্কিত একটি বক্তব্য নিয়ে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এর অহেতুক দলান্ধ প্রতিক্রিয়া আর বিতর্কের ঝড় দেখে। ঘটনার সূত্রপাত গত ২৪ মার্চ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এতে সাঈদী ভক্তরা এই রায় ঘোষণার পরপর সারা দেশে বিুব্ধ হয়ে ওঠেন। দলমত নির্বিশেষে সাঈদী ভক্তরা রাস্তায় নেমে এলে সারা দেশে দেড় শতাধিক মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ছয়-সাতজন পুলিশও মারা যায় পুলিশ-জনতার সংঘর্ষের সময়। এ সময় পুলিশের গুলিতে বগুড়ায় ১৪ জন এবং জয়পুরহাটে সাত জন নিহত হন। বিুব্ধ জনতার ওপর নির্বিচারে পুলিশের গুলি চালিয়ে এই দেড় শতাধিক মানুষ হত্যাকে বিরোধীদলীয় নেতা গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। পুলিশি নির্যাতন এখনো থামেনি। তখন এসব বিক্ষোভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীসহ অজ্ঞাতনামা কয়েক লাখ সাধারণ গ্রামবাসীকে আসামি করে বিুব্ধ এলাকায় চলছে পুলিশের মামলা-হামলা ও ধরপাকড়ের বাণিজ্য। সাথে সরকারি দলের ক্যাডারদের উপস্থিতিও রয়েছে সেখানে। এভাবে গণহারে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর পুলিশি হামলার ফলে এখনো অনেক স্থানে গ্রামবাসী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। নিহত হচ্ছে নিরীহ গ্রামবাসী। সর্বশেষ ঘটনায় গত পরশু চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে তিনজন এবং সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে দুইজন নিহত হয়েছেন। পুলিশের নির্বিচারে ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে জনতার প্রতিরোধের সময় তারা পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানাতে সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া উত্তরাঞ্চল সফর করেন। তিনি গত ২৪ মার্চ বগুড়া ও জয়পুরহাটে বেশ কয়েকটি শোকসভায় যোগ দেন। ওই দিন দুপুর ১২টায় বগুড়ার মাটিঢালি বিমান মোড়ে এক বিশাল শোক সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, গত ৩ মার্চ এ সরকারের পেটুয়াবাহিনী নৃশংসভাবে এই এলাকার নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। পুলিশ যাদের হত্যা করেছে, তারা কোনো দলের নয়। তারা সাধারণ মানুষ। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৭০ জনকে হত্যা করেছে। এ এক গণহত্যা।
আমরা জানি, মার্চের প্রথম সপ্তাহে বগুড়ায় এই জনবিক্ষোভ ছিল খুবই পরিব্যাপক। সরকারের র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেদিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। মূলত বগুড়ার জনসভায় সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করতে গিয়েই খালেদা জিয়ার সেদিনের ভাষণে সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গটি আসে। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘এ সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বগুড়ার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। মা-বোনেরা লাঠি-ঝাড়– নিয়ে নেমেছিল। তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। সেনাবাহিনী এসেছিল। তারা জনগণের পক্ষে ছিল। তাই তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। কারণ তারা গুলি করেনি। দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব আছে। এভাবে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। তারা সঠিক সময়ে তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করবে। বিদেশে শান্তি মিশনে তারা দায়িত্ব পালন করেছে। অন্য দেশের শান্তি রক্ষায় তারা বিদেশে যায়। যে দেশের সেনাবাহিনী অন্য দেশের শান্তি রক্ষায় বিদেশে যায়; কিন্তু নিজ দেশে শান্তি নেই বিষয়টি দেখে বিদেশীরা বলবে, তারা শুধু বিদেশীদের শান্তি রক্ষা করতে পারে। কাজেই চিন্তার বিষয় আছে। সবাইকে চিন্তা করতে বলব। সেনাবাহিনী দেশের শান্তি রক্ষায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় না থেকে সঠিক সময়ে সঠিক দায়িত্ব পালন করবে।’
সেদিন সেনাবাহিনী সম্পর্কে বেগম জিয়ার এটুকুই বলা। এখানে বেগম জিয়ার বক্তব্যের মর্মার্থ হচ্ছে, সম্প্রতি সারা দেশে পুলিশ ও র‌্যাবের গুলিতে দেশের দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণ গেল, সেখানে বগুড়ায় বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী নামলেও তারা জনগণের ওপর পুলিশের মতো গুলি চালায়নি। তারা সঠিক ভূমিকা পালন করে জনগণের ওপর গুলি না চালিয়েও সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে। বেগম জিয়া বলেছেন, সেনাবাহিনী সঠিক কাজটিই করেছে। এ জন্য তিনি সেনাবাহিনীর প্রশংসাও করেছেন এবং তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, সেনাবাহিনী দেশের শান্তি রক্ষায় সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করবে। তার এ আশাবাদ প্রকাশে দোষটা কোথায়? কিন্তু সরকারি দলের নেতারা এবং সেই সাথে সরকার-সমর্থক কিছু গণমাধ্যম বেগম জিয়ার বক্তব্যের মনগড়া মর্মার্থ উদঘাটন করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নানা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরা বলছেন, বেগম জিয়া তার এ বক্তব্যের মাধ্যম সেনাবাহিনী উসকে দিচ্ছেন। কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানল শুধু এই বিষয়টিকে টকশোর একমাত্র অনুষঙ্গ করে শুধু সরকার সমর্থক আলোচকদের এনে একতরফাভাবে এ কথা প্রমাণ করার অপপ্রয়াসও চালিয়েছে যে, বেগম জিয়া তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়েছেন। জনৈক আওয়ামী ভক্ত লেখক একটি ইংরেজি দৈনিকে কলাম লিখে বলার চেষ্টা করছেন, বেগম জিয়া স্পষ্টত ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের ৩১তম বর্ষপূর্তির এই সময়ে সেনাবাহিনীকে বর্তমান নির্বাচিত সরকারের ওপর হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জালিয়েছেন এবং এটি ডেমোক্র্যাসির জন্য একটি প্যাটেন্ট থ্রেট। তার ভাষায়  Khaleda Zia tells the courts that the army is there to sort out the present elected government ….. This pretty clear invitation to the army to step in, and that too on the thirty first anniversary of the coup d’etat which brought general Hussein Mahammed Ershed to power in 1982, is a patent threat to democracy.)। তিনি এখানেই থামেননি। তিনি আরো লিখেছেনÑ গণতন্ত্রের প্রতি এ ধরনের হুমকি ১৯৭৫ সালে উচ্চারণ করেছিলেন ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ জয় প্রকাশ নারায়ণ। তখন গান্ধীবাদী এই রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ভারত সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য। এই লেখকের মতে, কোনো পপুলার ম্যান্ডেট পাওয়া সরকার এ ধরনের হুমকি উপেক্ষা করতে পারে না। তাই মিসেস গান্ধী প্রয়োজনীয় কাজটি করেছিলেন। তিনি এই হুমকির কারণে জরুরি অবস্থা জারি করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি জয় প্রকাশ নারায়ণকে গ্রেফতার করেছিলেন। অনেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা সঠিক ছিলেন। সে ব্যক্তি যত বড়ই হোন, কোনো বিবেচ্য নয়। (এ কথাগুলো তিনি বলার চেষ্টা করেছেন এভাবেÑ  It was just such a threat to democracy which the elderly Joyprokash Narayan held out in India in 1975 that impelled Indira Ghandi in to impose a state of emergency in the country. JP, as the Gandhian was popularly known, had publicly used the Indian army to act against the government. Since no government based on a popular mandate and underpinned by self esteem can ignore such a threat, Mrs. Gandhi did what she needed to do : She placed JP under arrest. There were many who protested the action, butIndia’s Prime Minister was right; no matter highly placed, how powerful a historical icon, the moment he incited on organised force against a legitimate government, he had to be stopped. Joyprakash Narayan was stopped to every ones relief.)।
এটুকু লিখে এই লেখক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্পষ্টত দু’টি ব্যাপারে প্ররোচিত করেছেন কিংবা উসকে দিয়েছেন: এক. এই মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাতে হবে এবং দুই. আর দেরি না করেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে। জয়প্রকাশ নারায়ণের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে জয়প্রকাশ নারায়ণকে গ্রেফতার করে এবং ভাবতে জরুরি অবস্থা জারি করে যেমন সঠিক কাজটি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, ঠিক তেমনি শেখ হাসিনাকেও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার ও জরুরি অবস্থা জারির কাজটি করতে হবে। খালেদা জিয়াকে অবশ্যই থামাতেই হবে। জয়প্রকাশকে থামিয়ে ইন্দিরা গান্ধী যেমন জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন, তেমনি শেখ হাসিনাকে খালেদা জিয়াকে থামিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার তাগিদটিই দিলেন। ওই লেখকের উদ্দেশে বলা দরকারÑ ইন্দিরা গান্ধীর ওই জরুরি অবস্থা জারি ও জয়প্রকাশ নারায়ণের গ্রেফতারের কাল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ইন্ধিরা গান্ধীর কংগ্রেসের কী ধরনের ভরাডুবি ঘটেছিল, তা কী ওই লেখকের স্মরণে আছে। তখন তার ‘পপুলার ম্যান্ডেট’ জনরোষে ভেসে গিয়েছিল। আজ ওই লেখক বর্তমান সরকারের পপুলার ম্যান্ডেটের জনপ্রিয়তার পারদমাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে; তা উপলব্ধিতে আনলে ভালো হয়। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, কুমিল্লা আইনজীবী সমিতি ও এলেঙ্গা পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল চিত্র লক্ষ করলে সে উপলব্ধি করার বিষয়টি সহজ হবে। এসব নির্বাচনের ফলাফল দেখলে বুঝতে অসুবিধা হবে না সরকারের জনপ্রিয়তা আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আরেকটি বিষয়, ওই লেখক এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রসঙ্গটি এখানে টেনে এনে তিনি বোঝাতে চাইছেন,  এরশাদ তখন ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রের ওপর যে আঘাত করেছিলেন, আজ এর ৩১ বছর পর বেগম জিয়া সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়ে গণতন্ত্রের ওপর তেমনি হুমকি সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ওই লেখকের স্মরণে থাকা উচিত, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরশাদ সরকারের ক্ষমতা দখলের সময় তিনি অখুশি নন বলে দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন।
এই লেখক আরো অনেক কিছুর মাঝে সবশেষে বলতে চেয়েছেন, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এ ধরনের উসকানিদাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। সেই সাথে তিনি এ-ও উল্লেখ করেছেন, সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশকে এটুকু নিশ্চিত করা যে, তারা চান কোনো দায়িত্বশীল পদে থেকে কেউ যেন দায়িত্বহীন বক্তব্য না দেন কিংবা কোনো দায়িত্বহীন কাজে লিপ্ত না হন। ওপরে উল্লিখিত বক্তব্যে বেগম খালেদা জিয়া ‘সেনাবাহিনীকে দেশের শান্তি রক্ষায় নীরব দর্শকের ভূমিকা না থেকে সঠিক সময়ে সঠিক দায়িত্ব পালন করবে’ এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে কোনো অপরাধ করেছেন বলে মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, তিনি এখানে সেনাবাহিনীকে শান্তি রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা পালনের প্রত্যাশাটুকুই কামনা করেছেন। কিন্তু আমরা দেখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী নিয়ে কিংবা সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ করে যেসব কথা মাঝে মধ্যেই বলেন, তাতে এক ধরনের উসকানির উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। গত ২৮ মার্চ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাকুঞ্জে সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সময় বলেছেনÑ ‘আর যেন কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তি সশস্ত্রবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকার সশস্ত্রবাহিনীকে কোনো অবস্থাতেই কোনোরূপ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার হতে দেবে না। আপনারা দেখেছেন, কিছু রাজনৈতিক দল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে সমগ্র দেশে হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে একাত্তরের মতো তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। জাতির এই যুগসন্ধিক্ষণে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র চাই, নাকি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাষ্ট্র চাই।’
বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের বিরোধী দলগুলো সম্পর্কে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির জন্য এক ধরনের উসকানি দেয়ার প্রয়াস চালিয়েছেন। এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর জেনারেল কনফারেন্সে সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধীদের যেকোনো কর্মকাণ্ড সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে। তিনি সেনাকর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, স্বার্থান্বেষীরা যেন আপনাদের পিঠে সওয়ার হতে না পারে।
এ ধরনের বক্তব্য সেনাবাহিনীতে বিরোধী দল সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরনের বক্তব্য নিশ্চিতভাবেই অনাকাক্সিত। একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কী করে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এ ধরনের বক্তব্য রাখতে পারেন? আসলে এ ধরনের বক্তব্য কার্যত সেনাবাহিনীকে দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের খোলাখুলি আহ্বানের শামিল নয় কি? তার এ ধরনের বক্তব্য সেনাকর্মকর্তাদের বিরক্তির কারণ হয়নি, তাই বা কী করে বলা যায়। তবে এটুকু আন্দাজ করা যায়। সেনাবাহিনী একটি পেশাদার, সুশৃঙ্খল বাহিনী বলেই সেনাকর্মকর্তাদের কারো পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের অনাকাক্সিত বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই।
দেশের মানুষ চায় দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক। সেনাবাহিনী তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পেশাদারির ভিত্তিতে পালন করুক। রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ কারো কাম্য নয়। সেনাবাহিনী কোনো দলের পক্ষে নয়, আবার কোনো দলের বিপক্ষেও নয়! তাই সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল কারো পক্ষেই সেনাবাহিনী নিয়ে এমন কিছু বলা উচিত নয়, যা সেনাবাহিনী নিয়ে অহেতুক কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে।
কখনো কখনো গণমাধ্যমে কিছু কিছু অতি উৎসাহীজনেরাও অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা চালান। বেগম জিয়ার বগুড়ায় দেয়া সেনাবাহিনী সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক তেমনি একটি অপপ্রয়াস। এ ক্ষেত্রে সমালোচনার উপাদান প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে থাকলেও সে সম্পর্কে তারা নীরব। স্পষ্টত সেনাকর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন সব বক্তব্য রাখেন, যার মাধ্যমে তিনি সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন যে, বিএনপি একটি অগণতান্ত্রিক শক্তি। এই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ঠেকাতে সেনাবাহিনীকে সতর্ক ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ধরনের বক্তব্য সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের পরোক্ষ আহ্বান বললে ভুল হবে না। গত ২৮ মার্চ ও ৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এর প্রতিফলন রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আওয়ামীপন্থী বিভিন্ন মহল সব সময় নানাভাবে তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে জনমনে এমন একটি ধারণা দিতে চেষ্টা করেন, এ দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তি হচ্ছে বিএনপি আর একমাত্র গণতান্ত্রিক শক্তি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা বলার চেষ্টা করে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এ দেশে সামরিক শাসন আনার জন্য দায়ী শহীদ জিয়াউর রহমান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন তার নিজ দলের লোকদের হাতেই। তখন জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানও ছিলেন না। সেনাপ্রধান ছিলেন এমন ব্যক্তি, যিনি এখন আওয়ামী লীগের শীর্ষসারির নেতা। বঙ্গবন্ধু হত্যা-উত্তর সময়ে তাদের দলের লোকেরাই সরকার গঠন করে, দেশে সামরিক শাসন জারি করে। আর বঙ্গবন্ধুই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করে কার্যত গণতন্ত্রের ওপর কুঠারাঘাতের সূচনা করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টের পটপরিবর্তনের আরো পরে সিপাহি জনতার এক অভ্যুত্থানের সূত্রে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। উত্তরাধিকার সূত্রে কার্যত তিনি সামরিক শাসনের অংশে পরিণত হন। এরপর তিনিই তার প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এ দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনেন। অবসান ঘটান সামরিক শাসনের। তবুও আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের কাছে জিয়াউর রহমান ও তার অনুসারীরা অগণতান্ত্রিক শক্তি। কারণ, তিনি জাতিকে শুদ্ধ রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ভুল জাতীয়তাবাদের বেড়াজাল থেকে জাতিকে বের করে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের শুদ্ধ সূত্রের সূচনা করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির শুদ্ধায়নের নেতা।
আজ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকেও চিহ্নিত করার প্রয়াস চলছে অগণতান্ত্রিক শক্তির চর্চাকারী এক নেত্রী হিসেবে। বলা হচ্ছে, বেগম জিয়া সেনাবাহিনীর পিঠে চড়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছেন। বেগম জিয়া সামরিক শক্তিকে রাজনীতিতে ডেকে আনছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। তিনি আপসহীন নেত্রী বলে খ্যাত হয়েছেন জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের আপসহীন বিরোধিতা করে। অথচ যে আওয়ামী লীগ আজ নিজেকে গণতান্ত্রিক শক্তি বলে প্রমাণ করতে ব্যস্ত, সেই আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার হাত মিলিয়েছেন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের সাথে। আগের দিন ‘যারা এরশাদের নির্বাচনে যাবে’ তারা ‘জাতীয় বেঈমান’ উক্তি করে পরের দিন এরশাদের নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার ইতিহাস তো শেখ হাসিনারই সৃষ্টি। তা এ দেশের মানুষের কাছে এখনো জায়মান উদাহরণ। আর আজ যখন বলা হচ্ছে, বেগম জিয়া সেনাবাহিনীর পিঠে চড়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছেন, তখন জনধারণা হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বেগম জিয়া ক্ষমতাসীন হবে। তা ছাড়া এর আগেও তিনি তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তো নির্বাচনের মাধ্যমেই। অতএব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেÑ বেগম জিয়া কেন সেনাবাহিনীর পিঠে চড়ে ক্ষমতায় যেতে চাইবেন? আজ যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বেগম জিয়া ও তার দল বিজয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার মুখে, তখন তিনি কেন সেনাবাহিনীকে উসকে দেবেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আছে কি? অতএব সেনাবাহিনীকে অনুষঙ্গ করে কেন নানামাত্রিক অপপ্রচার বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে?
সবশেষে একটি ছোট্ট কথা, আজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের য়িষ্ণু জনপ্রিয়তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা সত্যি সত্যিই শঙ্কিত। তাই তাদের মুখে আজ উচ্চারিত হচ্ছে, কেয়ামত হয়ে গেলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়া হবে না। দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। অথচ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আজ পরিণত হয়েছে এক জনদাবিতে। জনদাবি উপেক্ষিত হচ্ছে বলে আজ চার দিকে সরকারের বিরুদ্ধে লক্ষ করা যাচ্ছে জনপ্রতিরোধ। জনতা গুলি খেয়ে মরছে, তবু তাদের প্রতিরোধ থামছে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads