বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৩

রণ-উন্মাদনার জয়!


চার দিকে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব শুরু হয়েছে বেশ ক’দিন আগে থেকেই। এক সময় সেই সাজ সাজ রবের অবসান ঘটে স্বস্তি ফিরে আসার প্রত্যাশা ছিল অনেকের। কেউ কেউ সমঝোতার আওয়াজ ক্ষীণস্বরে হলেও উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু সেই পথে হাঁটার চিন্তা যে সরকারের নেই, এ বিষয়ের জল্পনা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি দেশে নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। রাজধানী ঢাকা কার্যত দেশের অন্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গত সপ্তাহের প্রথম তিন দিন পর পর সারা দেশে হরতাল শেষে হরতাল বা অবরোধের মতো কোনো কর্মসূচি না দেয়ায় দেশের মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। মিছিল-বিক্ষোভ দেখলেই নির্বিচারে গুলি করে পাখির মতো মানুষ মারার ঘটনাও কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু বুধবার বিএনপি ও জামায়াতের শান্তিপূর্ণ দু’টি বিক্ষোভে কোনো উত্তেজনা ছাড়াই যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর বুক বিদীর্ণ করার মতো গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। বিএনপি-জামায়াতের বহু নেতা গুলিবিদ্ধ হন। পরিণামে আবার শুরু হয় হরতালের কর্মসূচি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই রণ-উন্মাদনার আগের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত তাণ্ডবে জামায়াত-বিএনপি জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর মধ্যে অপারেশন কিনহার্টের অনুকরণে ‘অপারেশন ফ্রিডম’ নামের একটি যৌথ অভিযান সারা দেশে পরিচালনার আয়োজনের কথাও ছড়িয়ে পড়েছে। এত দিন রাস্তায় যারা বিক্ষোভ করতে এসেছিল তাদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি করেছে। এ অপারেশনে হয়তো বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে প্রতিপক্ষকে ধরে আনা হবে। পরে কেউ হয়তো গুম হবেন, কারো হার্টফেল করবে, কেউ হয়তো ক্রসফায়ারের শিকার হবেন। শাহবাগের শক্তিমান সরকারের কর্তাদের মতো পাড়ায় পাড়ায় ব্রিগেড করার কথা বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগেই জানান দিয়েছেন এ উদ্যোগের। প্রধানমন্ত্রী পরদিন সংসদে দাঁড়িয়েও সেই প্রতিরোধ কমিটি গঠনের কথা বলেছেন।
দেশে অদ্ভুত এক ঘৃণাঝরানো উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। শাহবাগে সরকারের নিরাপত্তা প্রহরায় রহস্যজনক এক জাগরণ মঞ্চ তৈরি করে ফাঁসি আর জবাইয়ের রব তোলা হয়েছে। সেই রবের ঝড়ে বেশির ভাগ মিডিয়া এমন এক ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করে যেন মনে হয় কিছু মানুষের গলা না কাটাই বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা। কিন্তু দেলু শিকদার নামের এক রাজাকারের দায় চাপিয়ে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি ঘোষণার পর অন্য এক প্রতিরোধ জাগরণ ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে আসে বাড়িঘর থেকে। ক্ষোভ জানায়, প্রতিবাদ করে, প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ঝাড়– নিয়ে রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার দরিদ্র মহিলা। লাখো মানুষ রাজপথে অবস্থান করতে থাকে দিনের পর দিন। এই প্রতিবাদ কোনো কোনো স্থানে অবরোধও তৈরি করে। গুলি করে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ভাঙার চেষ্টা করলে থানা ঘেরাওয়ের মতো ঘটনাও ঘটে। গুলিতে এক দিনেই ৬০ জনের বেশি মানুষের প্রাণ হারায়। পুলিশের মৃত্যু হয় চারজনের বেশি। দিনের পর দিন হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়ে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
মঙ্গলবার পর্যন্ত টানা কর্মসূচি শেষে হরতাল না থাকায় মনে করা হয়েছিল, এখন রাষ্ট্রকে শান্তি ও স্বস্তি ফেরানোর পথে নেয়া হবে। আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি ও সমাধানের পথ সন্ধান করা হবে। কিন্তু সরকারের শীর্ষনেতাদের পদক্ষেপে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তারা কোন দিকে নিয়ে যেতে যাচ্ছেন রাষ্ট্রকে। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘অনেকে আওয়ামী লীগের কাছে এসে বলেছে আওয়ামী লীগ কেন মাঠে নামে না কিন্তু এটা করলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যাবে। একটা গৃহযুদ্ধ কিংবা ১/১১ তৈরি করে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না।’ সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্যে ইতিবাচক বেশ কিছু দিক আছে। প্রথমত, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর দেশের অধিকাংশ স্থানে যে গণবিস্ফোরণ ঘটেছে তাতে আওয়ামী লীগ বিপক্ষে দাঁড়ালে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যেত। বাস্তবে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের পক্ষে সৃষ্ট গণবিস্ফোরণের বিপক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল কি না, সে তর্কে না গিয়েও বলা যায় সৈয়দ আশরাফ ঠিক কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ এ সময়ে মাঠে নামলে গৃহযুদ্ধ বেধে যেত অথবা রক্ত আরো বেশি ঝরত। দ্বিতীয় বিষয়টি হলোÑ এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা ভেঙে যেত এবং ১/১১-এর মতো সরকার এসে যেত। সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্যকেও যুক্তিসঙ্গত মনে করার কারণ আছে। তিনি বলেছেন, সরকার এখন পর্যন্ত দক্ষতার সাথে সঠিক অবস্থায় রয়েছে। সরকার এমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি যাতে হত্যাকাণ্ড আরো উৎসাহিত হয়। সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্য আওয়ামী লীগের অবস্থান থেকে অবলোকন করলে সঠিক বলে মনে হয়।
কিন্তু সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা দায়িত্বে নিয়োজিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেয়া পদক্ষেপে পাওয়া যাচ্ছে ভিন্ন বার্তা। শাহবাগীদের ব্রিগেড গঠনের আহ্বান জানানো, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরোধ কমিটি গঠনের কথা বলা এবং ‘অপারেশন ফ্রিডম’ নামে সম্মিলিত অভিযান চালানোর উদ্যোগের সাথে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য ও অবস্থানের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে সারা দেশে হাজার হাজার মামলা করে লাখ লাখ লোককে আসামি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে পুরো ঘটনাকে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব হিসেবে বর্ণনা করেন। ৫০ মিনিট ধরে ১৭ পৃষ্ঠার বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। উচ্ছৃঙ্খল জামায়াত-শিবিরের প্রকাশ্য তাণ্ডবে সমর্থন দেয় বিএনপি। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা এতে অংশ নেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের নিরাপত্তা, সরকারি সিদ্ধান্ত এবং নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে গুলি ছোড়ে।’ এ কাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশংসা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতেও রাজারবাগে পুলিশ বাহিনী ত্যাগ স্বীকার করেছে। ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জীবন দিতেও তারা কুণ্ঠা বোধ করেননি।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুসিদ্ধান্ত হলো, ‘বেআইনি কার্যকলাপ চালাতে উসকানিদাতা জামায়াত ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের এই ৬৭ জনের মৃত্যুর দায় নিতে হবে।’ সবশেষে ধৈর্য ও সাহস নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে একযোগে কাজ করে পাড়ায় পাড়ায় ব্রিগেড গড়ে তোলার আহ্বানও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। সংসদের অধিবেশনের সমাপনী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীও একই ধারার বক্তব্য রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী দলীয় সংসদ সদস্য, নেতাকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও সর্বস্তরের জনতার উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা এলাকায় যান। জেলা, উপজেলা, থানা, ওয়ার্ড ও পাড়া-মহল্লায় সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলুন। যারা দেশব্যাপী তাণ্ডব শুরু করেছে, রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করছে, মানুষ হত্যা করছে, বাড়িঘরে আগুন দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। বিরোধীদলীয় নেতা যতই বলুন না কেন, পুলিশ হত্যা, মানুষ হত্যার দায় তাকেই নিতে হবে।’
সৈয়দ আশরাফ দলের সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ যে কারণে গণবিস্ফোরণের সময় মাঠে নামেনি বলে উল্লেখ করলেন, সেটার সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নতুন উদ্যোগ মিলছে না। বুধবার বিএনপি-জামায়াতের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার সাথে মিল রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে। সরকারের বাহিনীগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের দলীয় জনবলের সমন্বয়ে যে ব্রিগেড গঠন করে জামায়াত-বিএনপি নির্মূল অভিযান চালানোর কথা বলা হচ্ছে, এর পরিণতি কী দাঁড়াবে? সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এ ধরনের নির্মূল অভিযানে অংশগ্রহণ করবে কি না, বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। যদি সে অভিযান চালানো হয়, তবে তা যে সর্বাত্মক রক্তক্ষয়ী হবে তাতে সন্দেহ নেই। সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও সুশীলসমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধি এত দিন যে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কার কথা বলছেন, সেটি এ ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করবে।
মাত্র কয়েক দিন সময়ের মধ্যে দেড় শতাধিক মানুষের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারানোর বিষয়টি গণহত্যা কি না, এ নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। জেনোসাইড বা গণহত্যার পারিভাষিক ও আইনি অর্থ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন চিন্তাবিদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফরহাদ মজহার। কোনো নৃতাত্ত্বিক ধর্মীয় বা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্র বা অন্য কোনো পক্ষ সহিংস অভিযান চালালে আইনি ব্যাখ্যা অনুসারে সেটাকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হয়। জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশ হিসেবে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌক্তিক কারণ ছাড়া দেখামাত্র গুলি করতে পারে না। কোন্ কোন্ কারণের উদ্ভব হলে মৃত্যু ঘটার মতো গুলি করা যাবে তার সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে জাতিসঙ্ঘ সনদে। ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় যে গণবিদ্রোহ দেখা গেছে তাতে বিক্ষোভকারী কারো হাতেই লাঠি বা ইটের বাইরে অন্য আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়নি। এ ধরনের বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠলেও তা দমনের জন্য লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস বা ফাঁকা গুলি করার কথা। কিন্তু টেলিভিশন ও অন্য ফুটেজে সরাসরি গুলি করতেই দেখা গেছে। এসব বিষয়ে তদন্ত না করেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে রাখা বক্তব্যে এ জন্য বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবং জামায়াত-শিবির ও বিএনপি দায়ী বলে ঘোষণা করেছেন। অতীতে দেখা গেছে, যেসব ক্ষেত্রে এজাতীয় ঘোষণা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চপর্যায় থেকে এসে যায়, সেখানে নিরপেক্ষ কোনো তদন্তের অবকাশ থাকে না। বাস্তবে তা হয়ও না।
এখন ঘটনাপরম্পরাকে যে দিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে, সৈয়দ আশরাফ সেটিকে প্রকারান্তরে গৃহযুদ্ধ ও গণতন্ত্র নস্যাৎকারী ১/১১-এর পুনরাবৃত্তির ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। অনিবার্য এ অবস্থা সৃষ্টিতে অগ্রণী পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে সরকারপক্ষের। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার জনগণের রায়ে ক্ষমতায় যায় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। বাংলাদেশে এই মেয়াদ পাঁচ বছর। সরকারকে সংবিধান ও আইনের কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে সরকারের ক্ষমতায় থাকার যে আইনানুগ অধিকার রয়েছে সেটি আর থাকে না। এ কারণে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখন জাতীয় পার্টি ও বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার আইনসঙ্গত অধিকার হারিয়েছে বলে উল্লেখ করে সরকারের বারবার পদত্যাগ দাবি করতে দেখা গেছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কিন্তু সরকারে আসার পর আওয়ামী লীগের সে মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এই মনোভঙ্গির পরিবর্তনকে অনেকে নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন।
মাস ছয়েক সময়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটি দৃঢ় আস্থা তৈরি হয় যে, দলটি আবার ক্ষমতায় আসছে। ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার হিসাবকে সামনে রেখে ভিশন-২০২১ উপস্থাপন করেছিল। কিন্তু ক্ষমতার দ্বিতীয় পর্বে এসে সে আশাবাদে অনেকখানি চিড় ধরে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাপক ভিত্তিক দুর্নীতির অভিযোগ, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যর্থতার কারণে নতুন করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে কি না তাতে সংশয় সৃষ্টি হয়। এটাকে সামনে রেখে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাদ দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দলের অনমনীয় অবস্থান ও সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণার মুখে পশ্চিমা দেশগুলো সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। তারা বিরোধীপক্ষের সাথে সমঝোতায় আসার জন্য চাপও তৈরি করে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায়। এর অংশ হিসেবে নয়াদিল্লী বিরোধীদলীয় নেতাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে সেখানে তাকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করে এবং মুগ্ধ হওয়ার মতো আতিথেয়তা প্রদর্শন করে। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকায় প্রণব মুখার্জি বিরোধীদলীয় নেতার সাথে সাক্ষাতের সময় সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত মত হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষেও কথা বলেন তখন। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপরম্পরায় বিষয়টি অন্য রকম মনে হতে থাকে। শাহবাগে আকস্মিকভাবে গণজাগরণ মঞ্চ হওয়ার পর তা নিয়ে মিডিয়ায় নজিরবিহীন উচ্ছ্বাস এবং সেই মঞ্চ থেকে দাবি উঠিয়ে সেটাকে কার্যকর করার সরকারি উদ্যোগে নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ায় বলা হয়, ভারতের মদদে শাহবাগ আন্দোলনের সৃষ্টি। শাহবাগ উত্তেজনায় এক দিকে বিএনপিকে শামিল করার চেষ্টা হয়, অন্য দিকে আওয়ামী লীগকে আরেক দফা ক্ষমতায় আনার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিনিময়ে কিছু আসনের নিশ্চয়তা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় বিএনপিকে। বলা হয় পরবর্তী দফায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসাকে মেনে নেয়ার প্রস্তাবে বিএনপি সম্মতি দিলে পরের বার ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করা হবে বিএনপিকে। এ প্রচেষ্টার সাথে ভারতীয় প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক আছে কি না সেটি স্পষ্ট নয়। তবে প্রণবের সাথে বিরোধীদলীয় নেতার সাক্ষাৎকারে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের সাথে এর একটি সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে অস্বাভাবিক এক নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসার বৈধতা দেয়ার মতো ফাঁদে হয়তো তিনি পা দিতে চাননি। আর এটি যে বিরোধী দলের জন্য রাজনৈতিক আত্মহননের পথ হবে, সেটি বোঝার মতো যথেষ্ট প্রজ্ঞাও বেগম খালেদা জিয়ার রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট মোচনের জন্য সমঝোতার যে রাস্তা তা যে এক প্রকার রুদ্ধ হয়ে গেছে, সেটি প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক গণবিস্ফোরণ প্রতিরোধে ব্রিগেড বা কমিটি গঠনের ডাক দেয়ার মধ্যে অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখন জাগরণ মঞ্চের হুঙ্কার আর প্রতিবেশীদের সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করে নির্দেশিত রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত করে আওয়ামী লীগকে আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় বসানোর প্রচেষ্টার সুযোগ নেই। তবে কি ১/১১-এর পথেই হাঁটতে চাইছে সরকার? গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির অনিবার্য পরিণামও সেই ১/১১ মার্কা সরকারই। জরুরি অবস্থা সৃষ্টির যে কথা বলা হচ্ছে এর পেছনেও কি এ বিষয়টি কাজ করছে, যার ইঙ্গিত বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দিয়েছেন। সেই পরিস্থিতি কারো নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ করে দেবে কি না, তা বলা যাবে না। তবে দেশ ও জাতির সঙ্কট থেকে মুক্তির কাক্সিত কোনো পথ হতে পারে না হানাহানি আর গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রক্তসাগর তৈরির বিষয়টি। এটি কারো জন্য কল্যাণও বয়ে আনবে না। দেশের মানুষের মধ্যে কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি, কেউ জামায়াত বা জাতীয় পার্টির সমর্থক হতে পারেন; তবে এ দেশ সবার। এর যেকোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অথবা অন্য বিপত্তির জন্য দল-মত নির্বিশেষে এর শিকার হতে হবে সবাইকে। এই রূঢ় বাস্তবতা যেন আজ অনেকেই ভুলতে বসেছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads