রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

হলুদ সাংবাদিকতার স্বর্ণযুগ



 সাংবাদিকরা যখন তাদের পরিবেশিত সংবাদে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করেন, তখন তাকে হলুদ সাংবাদিকতা বলে। সাংবাদিকরা যখন সংবাদের বস্ত্তনিষ্ঠতা রক্ষা না করে ব্যক্তিগত আবেগ বা মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অথবা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাপে নয়তো বা তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে পাঠক ও দর্শকদেরকে প্রতারিত করতে ছলচাতুরি ও বাকচাতুর্যের আশ্রয় নেয় তখন তাকে বলে হলুদ সাংবাদিকতা। এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অনেকটা সময় সংগৃহীত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ উপস্থাপনের সময় তিলকে তাল ও তালকে তিল করে দেখানোর চেষ্টা করেন যা গত কয়েকদিন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশে হলুদ সাংবাদিকতা ও স্বাধীনতা প্রায় সমবয়সী। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার তাদের পক্ষে সংবাদ প্রচার করতে ও সরকারবিরোধী সংবাদ প্রচার না করতে সংবাদপত্রগুলোর ওপরে চাপ সৃষ্টি করে সরকারের সাথে আপোষ না করায় সরকার সমর্থক চারটি পত্রিকা চালু রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। সেদিন সরকারের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি সাংবাদিকরা। পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের আন্দোলনেও সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল সাংবাদিকদের কর্মবিরতি। কিন্তু এরশাদের পতনের পর বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নক হিসেবে হলুদ সাংবাদিকতাও ধীরে ধীরে বিকশিত হতে শুরচ করে। বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশে হলুদ সাংবাদিকতা সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা অর্জন করেছে। তাই বর্তমান সময়কে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে হলুদ সাংবাদিকতার স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা চলে।
গত ৫ ফেব্রচয়ারী মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা কাদের মোল­vর যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দেয় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ এ রায়ের বিরোধিতা করে কাদের মোল­vর ফাঁসির দাবীতে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে সমাবেশ শুরচ করে সরকার সমর্থক কিছু ব­গার। আর এ সমাবেশকে ঘিরেই শুরচ হয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ হলুদ সাংবাদিকতার মহড়া।
সরকারের কার্যক্রমকে সমর্থন করতে, সরকারের পক্ষে জনমত জানান দিতে সরকার সমর্থকরা সমাবেশ করতেই পারে, শাহবাগের সমাবেশও এ ধরনের একটি সমাবেশ। যদিও সমাবেশকারীদের দাবীর বিষয় অনুযায়ী এটা সরকারবিরোধী আন্দোলন। কারণ কোন দাবী আদায়ের আন্দোলন হয় তাদের বিরচদ্ধে যারা ঐ দাবী পূরণের ক্ষমতা রাখেন অথবা যাদের ব্যর্থতার কারণে দাবীটি উত্থাপন করতে হচ্ছে। যেহেতু কাদের মোল­vর ফাঁসির রায় না হওয়ার জন্য সরকারই দায়ী এবং যাতে ফাঁসির রায় না হয় এ পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে তাই এ দাবী সরকারের প্রতি অর্থাৎ দাবী আদায়ের এ আন্দোলন হওয়া উচিত ছিল সরকার বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু কোন দাবী নিয়ে আন্দোলনকারীরা আন্দোলন শুরচ করার আগেই সরকার যদি সে দাবীর সাথে একমত থাকে তাহলে তা আর সরকার বিরোধী আন্দোলন থাকে না। বরং হয়ে পড়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সমর্থনে নিছক সমাবেশ বা আনন্দ উৎসব। শাহবাগের সমাবেশের ক্ষেত্রে একথা পুরোপুরি প্রযোজ্য। কারণ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী অনেক আগে থেকে বলে আসছিলেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি তথা মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে।
অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধূীদের ফাঁসি কার্যকর করা সরকারের একটি এজেন্ডা এবং এটিই সমাবেশকারীদের দাবী। অর্থাৎ সমাবেশকারীদের এজেন্ডা ও সরকারের এজেন্ডা এক, তাহলে সরকার ও সমাবেশকারীরা একই পক্ষ। কিন্তু সমাবেশটি শুরচ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় শতকরা নববই ভাগ মিডিয়া সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে শাহবাগের সমাবেশটিকে সরকার পক্ষের শাহবাগের সমাবেশটিকে সরকার পক্ষের সমাবেশ না বলে নিরপেক্ষ বলে প্রচার করছে।
আবার সাধারণ মুসলি­দের মিছিলেও যে মিডিয়া জামায়াত-শিবিরের ভূত দেখতে পায় তারাই শাহবাগীদের  দাবীর সাথে সরকারের ৯০জন এমপি এমনকি প্রধানমন্ত্রীসহ সব প্রভাবশালী মন্ত্রীর একাত্মতা ঘোষণা করার বিষয়ে, তোফায়েল আহমেদ ও সাজেদা চৌধুরীসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সমাবেশে যাওয়ার বিষয়ে এবং ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু ও ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সার্বক্ষণিক উপস্থিতির বিষয়ে জানার পরও না জানার ভান করে এ সমাবেশকে অরাজনৈতিক বলে প্রচার করছে। সমাবেশের দাবী রাজনৈতিক, সমাবেশকারীরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাবেশটির আয়োজন করা হয়েছে একটি রাজনৈতিক সরকারের সমর্থনে, এর পরও বলা হচ্ছে অরাজনৈতিক। ঐসব হলুদ সাংবাদিকের কাছে জানতে চাই- আর কত রাজনীতিকরণ হলে সমাবেশটিকে রাজনৈতিক বলা যাবে।
পৃথিবীর কোন দেশে কখনও সরকারের পক্ষে গণজাগরণ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অথচ শাহবাগীদের সকল এজেন্ডা ও সরকারের এজেন্ডা এক হওয়ার পরও মিডিয়াকর্মীরা শাহবাগের সমাবেশকে গণজাগরণ ও গণবিস্ফোরণ বলে অভিহিত করছে। এসব হলুদ সাংবাদিকদের হলুদ চোখে সরকারের সব সমর্থক, জনগণ, জনতা, গ্রামবাসী ইত্যাদি হিসেবে অভিহিত হয়। জামায়াত-শিবির নিধন করার জন্য পুলিশের সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা সশস্ত্র অবস্থায় অংশ নিয়ে তারা হয়ে যায় বিক্ষুব্ধ জনতা। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ইসলামী ব্যাংক, অফিস, নয়া দিগন্ত অফিস, আমার দেশ অফিস, জামায়াত অফিস, মাদরাসা ইত্যাদি হামলা করলে তারা হয়ে যায় বিক্ষুব্ধ জনতা অথবা গ্রামবাসী। আর আওয়ামী পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত ও আহতরা হয়ে যায় সন্ত্রাসী অথবা জামায়াত শিবির ক্যাডার। আবার শাহবাগীদের সমাবেশ গণজাগরণ বলে অভিহিত হলেও লাখ লাখ আলেম যখন প্রায় লক্ষাধিক মসজিদ থেকে একযোগে মিছিল বের করে তখন তাদের এ আন্দোলন, আন্দোলন ও গণজাগরণ হিসেবে অভিহিত হওয়া দূরের কথা এসব হলুদ মিডিয়ার চোখে তারা জনগণ ও জনতা হতে পারে না হয়ে যায় জামায়াত শিবির ক্যাডার অথবা রাজাকারের সহযোগী। এইসব হলুদ সাংবাদিকের কাছে জানতে চাই আর কত লোক যোগদান করলে আন্দোলনকারী আলেমরা জনতা হয়ে উঠবে, নাকি কলকাতার দু’চার জন লোক যোগদান না করলে অথবা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমর্থন না দিলে তারা মিডিয়ার চোখে বাংলাদেশের জনগণ হতে পারবে না। কর্মী ও সদস্যদের মাসিক ও এককালীন দানের ভিত্তিতে জামায়াতের অর্থসংগৃহীত হয় এই সত্যটা দেশের সবাই জানে তার পরও জামায়াতের অর্থদাতা হিসেবে ইসলামী ব্যাংককে জড়ানোর চেষ্টা করে অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকে এ ধরনের অভিযোগ কেউ দিতে পারেনি। অন্যদিকে শাহবাগে কারা খাবারের প্যাকেট দিচ্ছে, কারা কোমল পানীয় সরবরাহ করছে, কারা বিশুদ্ধ পানি ও ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের ব্যবস্থা করেছে এসব চোখের সামনে ঘটলেও হলুদ সাংবাদিকরা তখন জন্মকানার অভিনয় করেন। তাদেরকে বলতে চাই কানা চোখ দিয়ে আর যাই চলুক সাংবাদিকতা চলে না। শাহবাগে অবস্থানকারী কোলের শিশু থেকে শুরচ করে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত তরচণ প্রজন্ম হলে আন্দোলনকারী শিবিরের লক্ষাধিক কর্মী তরচণ প্রজন্ম নয় কেন? সাংবাদিকদের কাছে এটা আজ জাতির জিজ্ঞাসা।
হরতালে বাস না পেয়ে পায়ে হেঁটে অথবা কোন কোনদিন সিএনজি লেগুনায় দশ টাকার ভাড়া বিশ টাকা দিয়ে অফিসে গিয়ে যখন টিভিতে বলতে শুনি জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে, সত্যিই অবাক হতে হয়। অথবা ওইসব সাংবাদিকরা তাদের ধারণকৃত ফুটেজে একমাত্র রাজধানী ঢাকা ছাড়া বিভাগীয় কোন শহরে এমনকি জেলা শহরগুলোতে কোন যানবাহন চলাচল বা দোকান খোলা দেখাতে পারে না। কিন্তু তারপরও মানুষকে প্রতারিত করতে রাজনৈতিক নেতাদের মতো বক্তব্য দিতে থাকে জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। হরতালে জনজীবনের উপরে কোন প্রভাব পড়েনি ইত্যাদি ইত্যাদি। জনগণ তাদের এই ছলচাতুরী বিশ্বাস করেছে কিনা সেটা অন্য কথা, মানুষের ব্যর্থতা সফলতা উভয়ই থাকতে পারে কিন্তু এতক্ষণের আলোচনায় একথা পরিষ্কার যে হলুদ সংবাদ পরিবেশনে এসব হলুদ সাংবাদিকদের চেষ্টা ও আন্ততরিকতায় কোন ত্রচটি ছিল না। এক্ষেত্রে তারা সফল। আর তাদের এই সফলতায় নিজের রেকর্ড ভঙ্গের দুঃখে ইবলিশ আত্মহত্যা করেছে কিনা সে বিষয় একটা তদন্ত হওয়া দরকার।
আওয়ামী নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে একে একে সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ ধ্বংস করে ফেলেছিল। বাকি ছিল সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যম যেহেতু বেসরকারি সেহেতু জনগণ ভেবেছিল বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু জনগণের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে সাংবাদিকরা নিজেদেরকে শুধু সরকারের পায়ের নিচে সঁপে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা সরকারের তথা মহাজোটের মিডিয়া পার্টনারের দায়িত্ব নিয়েছেন সানন্দে। এবং সরকারের এই মিডিয়া পার্টনারেরা জনগণের আর একটি প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ালো।
দেশবাসীকে অনুরোধ জানাবো সঠিক অবস্থা জানতে হাতে গোনা কয়েকটি নিরপেক্ষ পত্রিকা ও টিভিতে চোখ রাখুন এবং আপনার নিজ এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করচন এবং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করচন তাহলেই আপনারেদকে কেউ বিভ্রান্ত করতে পারবে না। ইনশাল্লাহ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads