শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৩

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সঙ্কটের কারণ


বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে শুরু থেকেই অব্যাহত সঙ্কটের মূলে দুটি বড় কারণ আছে। দু’র জন্য কোনো স্থিতিশীলতা ও শান্তি আসছে না দেশে। সঙ্ঘাত ও অস্থিরতায় জর্জরিত হচ্ছে আমাদের জীবন। বাংলাদেশের জন্ম থেকেই আছে দু’টি কারণ। উভয় ক্ষেত্রে কেন্দ্রে রয়েছে আওয়ামী লীগ।

এক. আওয়ামী লীগ ভাবে বাংলাদেশের মালিক একমাত্র এরাই। এরাই দেশ স্বাধীন করেছে। অতএব দেশটাও কেবল তাদেরই। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর এই মনোভাব নিয়েই ভারত থেকে এরা দেশে ফেরে। এটা তাদের চেতনার একেবারে গভীরতম জায়গায় ভয়ানক শক্ত হয়ে গেড়ে বসেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। তাদের হাবভাবে, প্রতিটি কথা ও কাজে সবসময় এই মনোভাবই প্রকাশ পায়। অনেক সময় কোনো রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই এরা তা জানিয়েও দেয়। এরা চায় দেশের সবাই তাদের মালিকানা মেনে নিক। তাদের এই অনড় অবস্থান থেকে একবিন্দুও এদিক-ওদিক হবে না বলে ঠিক করে নিয়েছে এরা। এমন মনোভাব যে ন্যায্য নয় বা এ থেকে রাষ্ট্র ও সমাজে যেকোনো মারাত্মক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে, এটাও আওয়ামী লীগ আমলে নিতে নারাজ।
তাদের মালিকানার এই মনোবৃত্তির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ একবার ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে, বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথমে তারা করেছে শরিক হিসেবে ঘরের মধ্যে ঢুকে নিজেদের বসবার মতো একটা জায়গা করে নেয়ার রাজনীতি। সেটা হওয়ার পর এরা শুরু করে তাদের আসল রাজনীতি। এখন তাদের চলছে অন্য শরিকদের উচ্ছেদ করে মনের বাসনা অনুযায়ী স্থায়ীভাবে একক মালিক হয়ে যাওয়ার রাজনীতি। এজন্য এরা শাসনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দেয়া থেকে হামলা, মামলা, ভয়ভীতি দেখানো, শাহবাগ মঞ্চ, একে-ওকে নিষিদ্ধ করা, পর্যন্ত যত রকম কলাকৌশল অবলম্বন করা যায় করে যাচ্ছে।
সমস্যা বেঁধেছে, দেশের সব মানুষই নিজেদের জন্মভূমির ওপর আওয়ামী লীগের বা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের এ ধরনের একক মালিকানা মেনে নিতে কখনো রাজি নয়। আওয়ামী লীগ অনেক চেষ্টা করেছে, মানুষকে তা মেনে নিতে বাধ্য করতে। কিন্তু পেরে ওঠেনি। তবু এরা হাল ছাড়তে রাজি নয়। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সঙ্ঘাত সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজে। দেশ এখন হয়ে উঠেছে একটা বারুদের স্তূপ। যেকোনো সময় একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে গিয়ে দেশটা একেবারে ছারখার হয়ে যেতে পারে তাতে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে মোটেই ভীত বা উদ্বিগ্ন মনে হয় না সেজন্য। তাদের ধারণা, যেকোনো সঙ্ঘাতে এরাই জিতবে। অতএব সঙ্ঘাত বাধলে তাদেরই লাভ। মালিকানা নিরঙ্কুশ করা যাবে তাতে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করেছে তা হচ্ছেÑ পরিচ্ছন্ন রাজনীতির কোনো সুযোগই সৃষ্টি হতে পারেনি বাংলাদেশে। শুরুতেই সে সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়া হয়। যেকোনো দেশের রাজনীতির মাঠকে একটা খেলার মাঠের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পরিচ্ছন্নভাবে যাতে খেলা চলতে পারে সেজন্য খেলার মাঠে কিছু সুষ্ঠু নিয়মকানুন লাগে। নিয়মকানুনগুলোর মধ্যে সুযুক্তি ও সুবিবেচনা থাকতে হয়। সবাইকে সেসব নিয়মকানুন মানতে হয়। তা না হলে খেলা আর খেলা থাকতে পারে না, খেলাটা হয় কেবল ফাউলেরই খেলা।
বাংলাদেশের জন্য একটা অপূর্ব সুযোগ এসেছিল রাজনীতির মাঠকে একেবারে ঢেলে নতুন করে, সুন্দর করে সাজানোর, যাতে সবাই ঠিকমতো দেশের রাজনীতির এই মাঠে খেলতে পারে। সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ জন্মের সাথে সাথেই। এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগেরই। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে দায়িত্ব ঠিকমতো পালন তো করেইনি, উপরন্তু এরা খেলার মাঠের অবস্থা এমন করে ফেলে যে, সেখানে ফাউল না করে খেলার আর কোনো উপায় থাকে না। আওয়ামী লীগ যে বাংলাদেশের রাজনীতির খেলার মাঠকে একটা পরিচ্ছন্ন রূপ দেয়নি। তখন এর মূলেও কাজ করেছে নিজেদের এ দেশের একমাত্র মালিক গণ্য করার মনোভাব।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ফাউল করে খেলার সেই ধারাবাহিকতাই এখনো চলছে। আওয়ামী লীগ এখন খেলার মাঠের মালিক, একমাত্র স্বাধীন খেলোয়াড়, তারা তাদের যেমন ইচ্ছা খেলবে, কোনো নিয়মকানুন এদের মানতে হবে না, এরাই বলে দেবে অন্যেরা কে কিভাবে খেলবে এবং খেলতে চাইলে তাদেরও সেভাবে খেলতে হবে। আর আওয়ামী লীগই হবে এ মাঠের প্রধান খেলোয়াড়, নিয়ন্ত্রক এবং একই সাথে একমাত্র আম্পায়ারও। বন্দী দর্শকদের যেমনই লাগুক না কেন, বসে বসে কেবল হাততালি দিয়ে যেতে হবে।
কিছু দিন আগে একজন প্রবীণ কলাম লেখক আক্ষেপ করে লিখেছেন যে, এরা যখন ছাত্র ছিলেন তখনো ছাত্ররাজনীতি ছিল, কিন্তু এখনকার মতো ভিন্ন মতের জন্য একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলতে চাইত না। এর কারণ তখন যে কেউ অন্য শরিকদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে একাই নিজেকে বাড়ির মালিক হয়ে যেতে চাইত না। সমস্যাটা তো হয়েছে এখানেই।
শরিকেরাই বা এখন কী করবে? বারবার ঘুরেফিরে কেউ যদি অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেকেই একক মালিক বলে দাবি করে, তাকে কী করে আর বিশ্বাস করা যায় এবং ভয় না করে পারা যায়? তাকে ঠেকাতে না পারলে তো এসব শরিকের একেবারে বাস্তুহারা হয়ে পড়তে হয়। আরেকটি কারণে তাদের আরো ভয়। সাধারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হলে তার ঠাঁই মিলতে পারে রাস্তায়, গাছতলায় বা পার্কের বেঞ্চে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এসব শরিক বাস্তুচ্যুত হলে তাদের কি ঠাঁই মিলবে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশে কোথাও? কারণ রাস্তা, গাছতলা বা পার্ক সব কিছুরই যে মালিকভাবে আওয়ামী লীগ নিজেকে। কবরেরও তো জায়গা মিলবে না তাদের জন্য। ১৯৭৫ সালের বাকশালের মর্ম তো ছিল এটাই। বাকশাল মানেই তো প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এবং দেশজুড়ে তাদের অগণিত সমর্থকের আওয়ামী খাঁচায় বন্দী হয়ে পড়া। চরম বিপর্যয়কর সেই বাকশালের ফিরে আসার পদধ্বনিই তো শোনা গেছে অবিরত চার বছর ধরে। আওয়াজ তার ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে হতে এখন তো তা একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ার উপক্রম। যারা নিশ্চিহ্ন বা বন্দী হয়ে পড়ার ভয়ে ভীত তাদের পিঠ তো আজ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন হয় তাদের আওয়ামী লীগের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে অথবা আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে। সংক্ষেপে এই তো হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আজ।
এ অবস্থায় দেশের যে দশা হওয়ার কথা তাই হয়েছে। দেশ থেকে শান্তি, সম্ভাব ও সদাচার একেবারে নির্বাসিত হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অবর্ণনীয়ভাবে কলুষিত হয়ে পড়েছে, দেশটা শুধু উপর্যুপরি সঙ্ঘাত, সহিংসতা, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশের একক মালিক বলে নিজেদের গণ্য করার আওয়ামী লীগের যে মনোভাব তার পরিবর্তন না হলে আমাদের এ দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সহজে সম্ভব নয়। fonm � m l �w � p mso-ascii-font-family:SutonnyMJ; mso-fareast-font-family:”Times New Roman”;mso-hansi-font-family:SutonnyMJ; mso-ansi-language:EN-US;mso-fareast-language:EN-US;mso-bidi-language:HI’>। দায়টা কারো কম নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দায় ছিল বেশি। জাতি সবই প্রত্যক্ষ করল। প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা জনগণের নেই। থাকলে তাৎক্ষণিক অভিশাপ ঢেলে দিত। তবে সেই অভিসম্পাত মনে পুষে রেখেছে, কখন যে জনগণের দীর্ঘনিঃশ্বাস ক্ষমতা কাঁপিয়ে দেয় বলা কঠিন। তার আগেই বিভক্ত জাতির সামনে ঐক্যের সুর তুলে সঙ্কট উত্তরণের বাঁশি বাজিয়ে দেশ, জাতি ও গণতান্ত্রিক ধারাকে রক্ষা করুন। তবেই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপতির আত্মা শান্তি পাবে। গণতন্ত্রও মুক্তি পাবে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার দলনের পরিবর্তে শপথে বলীয়ান ও সমঝোতায় বিশ্বাসী জাতিও দিশা খুঁজে পাবে। তা না হলে জিল্লুর রহমানের মতো মরে প্রমাণ করতে হবে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। দলীয় ক্ষমতা তাকে দলের ঊর্ধ্বে নেয়নি, তবে মৃত্যু তাকে সেখানে নিয়ে গেছে। HI’� � / �w � p n lang=BN style=’font-family:Vrinda;mso-hansi-font-family: SutonnyMJ;mso-bidi-language:BN’>গত কয়েক দিনে সরকার ১৭০ জন লোককে হত্যা করেছে। এক দিনেই করেছে ৬৬ জনকে হত্যা। এ রকম ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। আর রক্তাক্ত হাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বলে বসেছেন, এ হত্যার জন্য দায়ী বিরোধীদলীয় নেত্রী। মসজিদে মসজিদে তালা লাগিয়ে দিয়ে মুসল্লিদের লাঠিপেটা করে তিনি বলেছেন, বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন মানুষ নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারেনি। এটাকে প্রলাপ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বলতে তিনি কসুর করছেন না। এতে মানুষ আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads