বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৩

সংলাপ ও রাষ্ট্রপতির খোয়াব


ডিম আগে না মুরগি আগে, তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। বিতর্কের শেষ নেই বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে। নির্বাচনকালীন সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ হবে, নাকি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে তা নিয়ে সারা দেশে সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিতর্ক রয়েছে নির্বাচনের সময় সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে তাদের বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হবে কি না, তা নিয়ে। বিতর্ক রয়েছে লাগাতার হরতালের নামে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর করো, বোমাবাজি করো বলে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো নিয়ে। বিতর্ক রয়েছে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার মোহে, রাজনৈতিক প্রয়োজনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা নিয়ে। তবে বিতর্ক নেই জনপ্রতিনিধি হিসেবে একটানা কত দিন জাতীয় সংসদে অনুপস্থিত থাকলে সদস্যপদ বাতিল করা হবে তা নিয়ে। বিতর্ক নেই সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় নামী-দামি ও লোভনীয় গাড়ি কেনার হিড়িক নিয়ে। রাজধানীর গুলশান, বনানী কিংবা ধানমন্ডিতে আলিশান বাড়ি থাকলেও বিতর্ক নেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরকারি কোটায় প্লট-ফ্যাট বরাদ্দ নেয়া, রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য গ্রহণ করা নিয়ে। বিতর্ক নেই দেশটির আর্থসামাজিক খাতের কোনো সাফল্য নিয়ে। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের রাষ্ট্রপতির জীবনাবসান হওয়ায় কে হবেন পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রপতি তা নিয়ে ইতোমধ্যে জল্পনা-কল্পনা ও নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে গুঞ্জন শোনা যায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, বর্তমান স্পিকার ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নাম। বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম অংশীদার জাতীয় পার্টির প্রধান দাবি ছিল সাবেক সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কিছু সময়ের জন্য হলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা। রাজনীতিতে কানাঘুষা রয়েছে যে, পরলোকগত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করার পর এরশাদ অভিমান করে বলেছিলেন, ‘আমার বুকটা ফাইটা যায় যে জিল্লুর রহমান আমার সামনে দিয়া পতাকা উড়াইয়া চইল্যা যায়।’ তাই সেই জিল্লুর রহমানের ইন্তেকালের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের রাষ্ট্রপতি হওয়ার খোয়াব কিছুটা হলেও আশাবাদের সৃষ্টি করে থাকতে পারে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অবশ্য বলেছেন, যিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আছেন তিনিই ভালো। সেটি তার মনের কথা কি না, জানি না। বর্তমান রাজনৈতিক দুর্যোগে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী যখন নিজের ছায়াকেও ভয় পান বলে ধারণা করা হয়, তখন বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা থেকে হটানো সাবেক সেনাশাসক এরশাদকে রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর মতো ঝুঁকি নিশ্চয়ই তিনি নেবেন না। কথায় আছেÑ ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। অবশ্য রাজনীতিতে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। থাকতে পারে শাহবাগের মতো নতুন কোনো চমক। প্রধানমন্ত্রী নিজেই রাষ্ট্রপতি বনে যেতে পারেন। এমন ধারণাও অমূলক নয়। কোনো কিছুই উড়িয়ে দেয়া যায় না।

দেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা নিরসনে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেকোনো ধরনের সংলাপ কিংবা সমঝোতার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটির সভাপতির মতে, সারা দেশে এক দিনের হরতালে ক্ষতির মোট পরিমাণ তিন দিন ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ থাকার সমান। এক দিনের হরতালে দেশে দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে তিনি জানিয়েছিলেন, যা নাকি দেশটির মোট জিডিপির দশমিক ১২ শতাংশ বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। চা-নাশতার নামে দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও সংলাপের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ভোটের সময় ছাড়া দুই পয়সার দামও নেই আমজনতার মনে তখন কিছুটা হলেও আসার সঞ্চার হয়েছিল। দুই শীর্ষ রাজনৈতিক দলের প্রধানের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চেও শুনানি হয়েছে। মাননীয় আদালত রিট আবেদনকারীকে জানিয়েছেন, সংবিধানেই সংলাপের কথা উল্লেখ করা আছে। আর সংলাপের উপযুক্ত স্থান হচ্ছে জাতীয় সংসদ। আদালত রাজনৈতিক দলকে সংলাপে যেতে বাধ্য করতে পারেন না। সংলাপ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রধান দুই নেত্রীকে একটি ভ্রমণ জাহাজে তুলে দিয়ে তাদের মাঝে বিদ্যমান প্রতিহিংসার দেয়াল  নিরসনের তাগিদ দিয়েছেন দেশবরেণ্য প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। প্রয়োজনে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকেও সংলাপ করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন এই বলে যে, আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আর তাই সরকারের পক্ষ থেকে লিখিত বা আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের প্রস্তাব দেয়া হলে দলীয় ফোরামে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। এরপর হঠাৎ করেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেভাবে পুলিশি তাণ্ডব চালানো হয়েছে ও নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাতে অর্থবহ সংলাপের পরিবেশ আপাতত নষ্ট হয়েছে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে হামলা করে উল্টো পুলিশই মামলা করেছে। পুলিশের ওপর হামলা ও হাতবোমা বিস্ফোরণের দায়ে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী, আমানউল্লাহ আমান ও জয়নুল আবদিন ফারুককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের মতে, সংলাপ নিয়ে যারা কথা বলছেন তার কতটা লোক দেখানো আর কতটা আন্তরিক তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তার মতে, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সংলাপের গুরুত্ব সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিশ্চিন্ত না হবেন সংলাপে তাদের লাভ হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা সংলাপে বসবেন না। আর সমঝোতা হতে হলে কিছু দিতে হবে এবং কিছু নিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই দেয়া-নেয়ার মনোবৃত্তি না তৈরি হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থবহ সংলাপ বা সমঝোতা সম্ভব হবে না।
এ কথা দুধের শিশুও বোঝে যে, কিছু পেতে হলে কিছু ছাড় দিতে হয়। দেশের বর্তমান সঙ্ঘাতমুখর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেকোনো সমঝোতায় পৌঁছতে হলে দু’টি শীর্ষ রাজনৈতিক দলকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে।  বিচার মানি তবে তালগাছ (ক্ষমতা) আমারÑ এমন মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কোনো অর্থবহ সংলাপ আশা করা যায় না। বেশ কিছুদিন আগে বিশিষ্ট কেউ বলেছেন, রাজনৈতিক সমস্যার অর্থনৈতিক বা সামাজিক সমাধান হয় না। খুবই খাস কথা। রাজনৈতিক সমস্যার কেবল রাজনৈতিক সমাধানই হতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই রাজনৈতিক মতভেদ রয়েছে। সব বিষয়েই রয়েছে যুক্তি ও তর্ক-বিতর্ক। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে বিশ্বের অন্য সব দেশে আমাদের মতো হরতাল-ধর্মঘট পালন করা হয় না। সংসদে কিংবা সংসদের বাইরে চলে বিরামহীন আলাপ-আলোচনা, গঠনমূলক অর্থবহ সংলাপ ও তর্ক-বিতর্ক। দেশ ও জাতি আজ বিভক্ত। এ অবস্থায় কে হবেন পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রপতি, তা আমাদের জানা নেই। জানার কথাও নয়। রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যেমনÑ জাতীয় সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সর্বশেষ দেখভাল করার অধিকারী আমাদের রাষ্ট্রপতি। শুধু অন্যের পরামর্শে শীর্ষস্থানীয় ও খুনিদের মাফ করে দেয়া তার কাজ নয়। তাই ওই পদে একজন নির্দলীয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির খুব বেশি প্রয়োজন এখন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর খাটিয়ে এ মুহূর্তে জাতীয় সংসদে কোনো রকম তুঘলকি কাণ্ড মোটেই আশা করে না জাতি। বরং একজন সৎ, নির্দলীয়, দেশপ্রেমিক (আবুল হোসেন ব্যতীত) ও সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দিয়ে জনমতের সমর্থন আদায়ের একটি মোক্ষম সময় এখন। আমাদের দেশের রাজনীতিকদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। শান্তিতে থাকুক দেশ ও দেশবাসীÑ এই প্রত্যাশায়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads