সোমবার, ১১ মার্চ, ২০১৩

বিদ্বেষ বিভক্তি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ নয়



রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত একটি বিচার যে একটি জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসতে পারে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা। একটি সহিংস ও অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা এখন দিন যাপন করছি। কারোর মনে স্বস্তি নেই, নিরাপত্তা নেই। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সরকারি দল ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উন্মত্ত উল­vসে বিরোধী দল নিধন, সরকারিভাবে নাস্তিক ব­গার ও ইসলাম, আল-কুরআন, আল্লাহর রাসূল (সা:) ও তার সহধর্মিনী এবং সাহাবায়ে কেরামদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল ও অবমাননাকারীদের লালন ও পৃষ্ঠপোষকতায় ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে সাধারণ মানুষের বুকে যে আঘাত লেগেছে তা প্রশমনে সরকার কার্যকর কোন উদ্যোগ না নিয়ে প্রতিবাদকারী আলেম ওলামা ও সাধারণ মুসলমানদের ওপর পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও দলীয় গুন্ডাদের লেলিয়ে দেয়ায় দেশের মাটি এখন এক অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করেছে। এই অবস্থায় বিশ্ববিখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন, নন্দিত আলেমে দ্বীন ও আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ মর্দে মুমীন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করেছে বলে মনে হয়। সরকার দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফলপ্রসূ কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করে বিরোধী দল বিশেষ করে দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নির্মূলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই দলটির বিরচদ্ধে এখন সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বত্র একটি Hate Campaign চালানো হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয় বাংলাদেশে জামায়াত ছাড়া আর কোন সমস্যা নেই। যত অপরাধ হত্যা, খুন, রাহাজানি, দুর্নীতি, দুষ্কৃতি, অগ্নিসংযোগ, সরকারি স্থাপনায় হামলা সবকিছুর জন্যেই একমাত্র জামায়াতই দায়ী। সুপরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর করে তার দায় জামায়াতের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। কোথাও যদি পুলিশের উপর হামলা হয় তদন্ত না করেই তখন বলা হয় যে, জামায়াত এটা করেছে। গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, রেললাইন উৎপাটন, অবরোধ সৃষ্টি সবকিছুর জন্য জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে। কোন ব্যক্তির যদি অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, কারো সন্তান যদি মারা যায় এবং মৃত ব্যক্তিরা যদি নাস্তিক ব­গার হয় অথবা সরকারের সাজানো মামলায় সাক্ষীর কোন আত্মীয়-স্বজন হয় তাহলে সেই মৃত্যুর জন্য জামায়াত দায়ী না হয়ে পারে না। নাস্তিক ব­গাররা এখন সরকারের নির্দেশনা ও অর্থানুকূল্যে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ-মহাসমাবেশ করছে। এই মহাসমাবেশে স্কুল, কলেজ এবং এমনকি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছোট ছোট শিশুদেরও আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের মুখ দিয়ে জামায়াত বিরোধী শ্লোগান, জামায়াত নেতাদের ফাঁসি এবং তাদের জবাই করার শ্লোগান তোলা হচ্ছে। এইসব সমাবেশ থেকে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা এবং এলাকাবাসীদের জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বাড়িভাড়া না দেয়ার আহবানও জানানো হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাড়া-মহল্লায় জামায়াত-শিবিরের লোক বলে সাধারণ টুপি-দাড়িধারী ব্যক্তিদের মারধর করে পুলিশে হস্তান্তর করা হচ্ছে। জাতীয় মসজিদসহ দেশের গুরচত্বপূর্ণ মসজিদসমূহে শুক্রবার মুসলি­দের আগমন রোধ করার জন্য পুলিশ তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। তাদের মারধর ও গ্রেফতারের শিকার বানানো হচ্ছে। দাড়িধারীদের মুখে লাথি মারা হচ্ছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন ভারতবর্ষের পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগনা জেলার নারিকেলবাড়িয়ার জমিদার কেদার রায় তার জমিদারী এলাকায় মুসলমানদের দাড়ি রাখার উপর কর আরোপ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তার জমিদারীতে মুসলমানদের দাড়ি রাখতে হলে দাড়ি প্রতি ৫ সিকি করে (১ টাকা ২৫ পয়সা) কর দিতে হবে। মাওলানা নিসার আলী তিতুমীরের বিরচদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের এদেশেও হয়ত আগামী দিনে দাড়ি-টুপির উপর কর দিতে হবে। আবার জাতীয় মসজিদে জু’মার নামায আদায়ে পুলিশী অনুমোদন হয়ত টিকেট সিস্টেমেও রূপান্তরিত হতে পারে। কেননা সরকারের মন্ত্রী এবং শীর্ষ মহলের দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করার পর নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করতে হলে মুসল­xদের উপর করারোপ করা অর্থ সংগ্রহের একটি সহজ পন্থা হতে বাধা কোথায়?
আমি আগেই বলেছি জামায়াত-শিবির নিধনে দেশে এখন একটি উন্মত্ততা চলছে। পাঠকদের ভুললে চলবে না যে, এই সেই জামায়াত যার শতকরা ৯৮ ভাগ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সরকার এখন জেলে পুরে রেখেছেন। জামায়াতের এখন এমন কোন নেতা নেই যার বিরচদ্ধে মামলা নেই। কেন্দ্রীয় জামায়াতের অফিস তালাবদ্ধ। মহানগর এবং জেলা জামায়াতের অফিসগুলোরও প্রায় একই অবস্থা। জামায়াত এবং জামায়াত সংশি­ষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানের নেতা-কর্মীরাই এখন নিরাপদে চলাফেরা করতে পারেন না। ঘরোয়া এমনকি পারিবারিক বৈঠকে বসলেও তাদের ‘নাশকতার’ আশংকায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরচদ্ধে এখন প্রায় ৪০ হাজার মামলা ঝুলছে। আসামীর সংখ্যা কিছুদিন আগ পর্যন্তও সাড়ে চার লাখ ছিল। এখন তা সাত লাখ অতিক্রম করেছে। এই অবস্থায়ও জামায়াত-শিবির আতঙ্ক সরকারের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে বলে মনে হয়। দিনেও তারা স্বস্তিতে থাকতে পারেন বলে মনে হয় না। তারা এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা ও তার নিবন্ধন বাতিলের চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়ে পড়েছেন। সাধারণ মানুষও এখন জামায়াতকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। এদের বৃহত্তর একটি অংশ বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতিতে জামায়াতকে একটি ব্যালেন্সিং পাওয়ার বলে মনে করতেন। তারা এখন সরকারি আচরণে হতাশ। গত পরশু আমি এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলাম। দৈনিক সংগ্রাম অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে টাঙানো পত্রিকার হেডলাইন দেখছিলাম। পাশের রাস্তা দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী এক যুবক গাড়ী থামিয়ে এসে আমাকে বললেন যে এখানে দাঁড়াবেন না। গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করতেই আরো কয়েকজন পথচারী বললেন যে, আমরা কোন দেশে বসবাস করছি তা কি জানেন না? এদের কাউকেই আমি চিনি না। কিন্তু তাদের কথা আমার কানে বাজছে এবং আমরা যে একটি ফেরাউনী শাসন ব্যবস্থার অধীনে দিন কাটাচ্ছি তা আমি উপলব্ধি করছি। কিন্তু এর শেষ কোথায়?
দুই.
একশ্রেণীর ইসলামবিদ্বেষী গণমাধ্যম জামায়াত নির্মূলে সরকারকে উৎসাহিত করছে। তাদের কাউকেই সরকারি নিপীড়ন ও পাখির মতো গুলী করে মানুষ হত্যার নিন্দা করতে দেখা যায় না। তাদের কেউ কেউ আবার সহিংসতার পথে রক্তাক্ত জনগণের রাজনীতি এখন পয়েন্ট অব নো রিটার্নে এসে দাঁড়িয়েছে বলেও মনে করে। তাদের মতে লাশের মিছিল সামনে রেখে গোটা দেশবাসীর মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও জাতীয় রাজনীতিতে সমাধানের কোন পথ বেরিয়ে আসছে না। সরকার দেশকে এমনভাবে বিভক্ত করে ফেলেছেন যে, দেশ ও মানুষের চিন্তাই এখন গৌণ হয়ে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে রাজনৈতিক বিচারের একটি প্রহসন এবং সরকারি দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার অদম্য স্পৃহা এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সরকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এবং আলেম ওলামাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। মানবাধিকারকে পদদলিত করা হচ্ছে। সরকার নিজেই সংবিধান লংঘন করে তাকে খেলার সামগ্রীতে রূপান্তরিত করেছেন। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছেন, নিমণমানের ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের কিনারায় নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকা ‘‘দ্যা ইকোনমিস্ট’’ তার ৯ মার্চ প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ত্রচটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করে বলেছে যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ট্রাইব্যুনাল পুরোনো ক্ষতকে উন্মুক্ত করে দিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে। মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর তিনদিনে শতাধিক লোকের মৃত্যুর কথা উলে­খ করে ইকোনমিস্ট বলেছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের ৪২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছে। এই সহিংসতার শেষ কোথায় আমি জানি না। তবে আমি উপলব্ধি করি যে, আমাদের সরকার এর জন্য শতভাগ দায়ী। তারা পরিস্থিতির উন্নতি চান না অবনতি চান। কাজেই দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দেশপ্রেমিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। হিংসা, বিদ্বেষ ও বিভক্তি দেশকে রক্ষা করতে পারে না বরং ধ্বংস করতেই পারে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নটি এসে যায়। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, নিউইয়র্ক টাইম্স। ওয়াশিংটন পোস্ট, খালিজ টাইমস, আলজাজিরা, সৌদি গ্যাজেট, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দ্যা ইকনোমিস্টসহ বিশ্বের খ্যাতনামা গণমাধ্যম মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের এই সহিংসতার জন্য ত্রচটিপূর্ণ ট্রাইব্যুনালে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিচারকে দায়ী করেছেন। সারাবিশ্ব এ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনায় মুখর, ইকনোমিস্ট পত্রিকা সর্বপ্রথম ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের স্কাইপি সংলাপের তথ্য ফাঁস করে দিয়ে বাংলাদেশে বিচার বিভাগীয় কেলেংকারির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ তুলে ধরে এবং এর ফলে দেশে বিদেশে ট্রাইব্যুনাল তার বিশ্বস্ততা হারায়। ট্রাইবুন্যালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের এই কেলেঙ্কারির দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ মানুষের অনাস্থার ভিত্তিতে আরও মজবুত করে তোলে। সাধারণ মানুষ এর ফলে বিক্ষুব্ধ হয়। সরকার কর্তৃক শাহবাগ চত্বরে মঞ্চ বানিয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র মৈত্রীর নেতা-কর্মী এবং নাস্তিক ব­গারদের দিয়ে কাদের মোল­vর যাবজ্জীবন রায় প্রত্যাখ্যান এবং ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসির রায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে না যাবার ঘোষণা, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মন্ত্রী এমপিদের তাদের দাবির প্রতি সমর্থন ও সংহতি ঘোষণা এবং আইনমন্ত্রী কর্তৃক ‘‘কাদের মোল­vর  রায়ের আগে শাহবাগ চত্বরে সমাবেশ হলে রায় ভিন্নতর হতে পারত’’ প্রভৃতি মন্তব্য এবং পরবর্তীকালে মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায় মানুষের মনে এই ধারণার সৃষ্টি করেছে যে, ট্রাইব্যুনাল চাপের মুখেই এই রায় দিতে বাধ্য হয়েছে। এতে মানুষের ক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়েছে এবং রাস্তায় তার প্রতিফলন ঘটেছে। যারা মনে করেন যে, ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করা যায় না তারা সমালোচনার সড়ক মহাসড়ক পেয়ে গেছেন। এখন দেশী-বিদেশী নানা সংস্থা-এর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। অবশ্য আগেও ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা হয়েছে এবং বিশ্বের খ্যাতনামা মানবাধিকার সংস্থাসমূহ, যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক আইনজীবী সংস্থাগুলো এই ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রণালী, বিচার প্রক্রিয়া এবং মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা পরিষ্কার করে বলেছেন যে, এই ট্রাইবুন্যাল আন্তর্জাতিক মানের নয় এবং এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ন্যায়বিচার পেতে পারে না। তারা তাদের বক্তৃতা বিবৃতি এবং প্রবন্ধ নিবন্ধে এর সমালোচনা করেছেন। আবার শাহবাগীরা প্রকাশ্য কর্মসূচি দিয়ে এর সমালোচনা করেছে। এটা আদালত অবমাননা কিনা আমি জানি না। তবে আমার বিশ্বাস যারা তা করছেন তারা সরকারেরই সমালোচনা করছেন ট্রাইব্যুনালের নয়। কেননা ট্রাইব্যুনাল সরকারেরই সৃষ্টি। দেশী ও বিদেশী অনেকেই ট্রাইব্যুনাল আইনকে অসাংবিধানিক বলেছেন। তাদের কথা হচ্ছে- এই আইনটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং অপরাধ সংঘঠনের পর প্রণীত যা বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদের সাথে সংগতিশীল নয়।
ফৌজদারী আইনের ভূতাপেক্ষ প্রয়োগ জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১১(২) এবং বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৫(১) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এই আইনের অধীনে বিচারক নিয়োগের বৈধতা নিয়েও কোন প্রশ্ন তোলা যায় না, বিচারক যদি দলীয় এবং পক্ষপাতদুষ্টও হন। এ অবস্থায় সরকার তার প্রণীত আইনের পরিপূর্ণ সুযোগ নিতে পারেন। এটা বাংলাদেশের আইন ও বিধিমালার সকল নিয়মনীতির পরিপন্থী। প্রচলিত আইনে বিচারকের উপর আস্থা না থাকলে আদালত পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা নাই। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনসমূহে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নিরপরাধ এবং ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী সরকার পক্ষকে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করতে হয় এবং সেখানে আলামতসহ অন্যান্য দালিলিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল আইনের বেলায় এ কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। কেন না সাক্ষ্য আইন এখানে প্রযোজ্য নয়। একইভাবে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী দন্ডবিধিও ট্রাইব্যুনাল আইনের বেলায় অকার্যকর রাখা হয়েছে। ফৌজদারী দন্ডবিধির ২টি ধারা বিশেষ করে ২৬৫(গ) এবং ৫৬১(ক) অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত গুরচত্বপূর্ণ। অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য এগুলো রক্ষাকবচের কাজ করে। CRPC বা ২৬৫ গ ধারায় বলা হয়েছে, 'If upon consideration of the record of the case and documents submitted therewith and after hearing the submission of the accused and the prosecution in this behalf, the court considers that there is no sufficient ground for proceedings against the accused it shall discharge the accused and record the reasons for so doing. এই ধারাটি এখানে প্রযোজ্য নয়, আবার অভিযুক্তের প্রতি অবিচার কিংবা আদালত প্রক্রিয়ায় আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা থাকে, তাহলে ফৌজদারী দন্ডবিধির ৫৬১ ক ধারায় আপত্তি করার অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল আইনে তা নেই। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। ফৌজদারী আইন অনুযায়ী নিমণ আদালত প্রদত্ত মৃত্যুদন্ডকে হাইকোর্ট অনুমোদন করতে হয় এবং সুপ্রিম কোর্টে আপিলের বিধান রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আইনে এর কোন বিধান নেই, হাইকোর্টের এখানে কোনও ভূমিকা নেই, সুপ্রীম কোর্টই আপিলের একমাত্র জায়গা। তাও আপিল নিষ্পত্তির সময়সীমা মাত্র ৬০ দিন। যা দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। অন্যদিকে আমাদের সংবিধানের ১০২ ধারা আইনসভা সতর্ক প্রণীত যে কোন আইনের 'Judicial Review'-এর দায়িত্ব মহামান্য হাইকোর্টকে দিয়েছে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল আইনের ক্ষেত্রে তার এই দায়িত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং যখন তখন ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন বিচার বিভাগের ওপর সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রভাব সৃষ্টিতে সহায়তা করছে। এটা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশন এই অবস্থায় আইনটিকে মানবাধিকার বান্ধব এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেছে। সরকার তা গ্রহণ করেননি। ফলে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এই রায়ের সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, যে আইনের বলে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে তা যদি ত্রচটিপূর্ণ হয় এবং যে পদ্ধতিতে বিচার করা হয়েছে তা যদি ন্যায়বিচারের মানদন্ড পূরণ না করে তাহলে এই বিচার বাতিল এবং অভিযুক্তদের মুক্তির দাবি অসঙ্গত নয়। এই দাবি সরকারের কাছে নাগরিকরা করতেই পারেন। সরকার যেমন শাস্তি মওকুফ করতে পারেন, জঘন্য অপরাধীর ফাঁসির রায়ও মওকুফ করার নজির আমাদের দেশে আছে। তেমনই এ শাস্তিও তারা মওকুফ করতে পারেন। শাস্তির বিরচদ্ধে আপিলও হতে পারে। আবার সরকার তার জেদ থেকে সরে এসে মামলা তুলেও নিতে পারেন। এ ধরনের মামলা তুলে নেয়ার ঘটনা ও দৃষ্টান্ত বহু আছে। পাকিস্তান আমলে গণদাবির প্রেক্ষাপটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল বাতিল দাবির একটি প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন। এ বিষয়টিকে আমি অস্বাভাবিক বলে মনে করি না। যেখানে মান এবং বিচার পদ্ধতির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দেয়ার জন্যে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সেখানে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবি উঠতেই পারে। এর সমাধান হিসেবে এ দাবি যারা তুলছেন তারাই বলেছেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হতে পারে। তাদের কেউই এমনকি জামায়াতও বিচারের বিরোধী নন। তাদের ক্ষোভ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিরচদ্ধে। এখানে আদালত অবমাননার কিছু প্রশ্ন উঠেছে। দেখা গেছে যে, যারা ট্রাইব্যুনাল ও তার বিচারের মানের সমালোচনা করছেন তাদের কেউ কেউ আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন। আবার যারা ফাঁসি ছাড়া কিছুই মানেন না তারা কোন নোটিশও পাচ্ছেন না। এ বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমি মনে করি, আদালত একটি আস্থার জায়গা। তার অবমাননা করা উচিত নয়। করলে আইনের শাসন থাকে না। কিন্তু তথাপিও সকল পক্ষের এব্যাপারে সংযমী আচরণ কাম্য। একটি আদালত এবং তার রায়কে নিয়ে দেশ অস্থিতিশীল হোক তা যেমন আমরা চাই না তেমনি বিক্ষুব্ধ জনতার উপর সরকারি বাহিনী বৃষ্টির মতো গুলী করে মানুষ হত্যা করচক তাও কারোর কাম্য হতে পারে না। একটি দলের জমিদারী মনোবৃত্তি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী নির্মূল প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতিকে দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের অনুমতি দেয়া যায় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads