শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০১৩

রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্রের নায়ক কারা?


পাকিস্তান টিকে নাই। কারণ সরকার মানুষ, নাগরিক বা জনগণের চেয়ে রাষ্ট্র রা বা বাঁচানোর কথা বলে মানুষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে মুখোমুখি করেছে। পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার অস্বীকার করেছে। এভাবেই পাকিস্তান গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে অস্বীকার করেছে। ফলে মানুষ টিকে আছে, পাকিস্তান টিকে নাই। তি হয়েছে দেশের বা রাষ্ট্রের। তি করেছে কে? সরকার। কারণ রাষ্ট্রের নাম ব্যবহার করে বা রাষ্ট্র রার কথা বলে সরকার জনগণের স্বার্থকে পদদলিত করে নিজেদের হীন স্বার্থকে রা করতে চেয়েছিল। আজ আর ’৪৭-এর পাকিস্তান নেই। ভারত কখনই পাকিস্তানের সৃষ্টিকে মেনে নেয়নি। পাকিস্তানের সামরিক সরকার বুঝতে পারেনি ’৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে বা সামরিক অভিযান চালালে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আকাক্সা বাস্তবায়িত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে। প্রসঙ্গত একটি বিষয় স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে, তা হলো ’৭১-এর ৯ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে কী হয়েছে সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সরাসরিভাবে লব্ধ কোনো তথ্যজ্ঞান ছিল না। ফলে তিনি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে নিজ দলের অতি আপনজন থেকে যে ব্রিফিং পেয়েছেন তাই ধারণ করেছেন। এর কারণ ছিল তিনি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে ২৫ মার্চ রাত ১২টা পর্যন্ত স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দেননি। বরং তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটি সমঝোতা চেয়েছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সে সমঝোতা চায়নি। তারা আলোচনার কথা বলে বঙ্গবন্ধুর সাথে বেঈমানি করেছে। নিজ জনগণের আশা-আকাক্সা পূরণ করতে না পারলে কোনো রাষ্ট্রই টিকে থাকতে পারে না। যেমন অখণ্ড ভারতের আকাক্সা টিকেনি কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতার কারণে। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানদের দাবি না শুনেই কংগ্রেস অখণ্ড ভারত চেয়েছিল। এর ফলে ভারত ভেঙে গেছে আর পাকিস্তান নামক আরেকটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে যুদ্ধের মাধ্যমে, লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি, সম্পদ ধ্বংসের বিনিময়ে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম ঢাকাতেই হয়েছে। লাহোর প্রস্তাবও পেশ করেছেন শেরেবাংলা বা বাংলার বাঘ এ কে ফজলুল হক। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল ধর্ম। কিন্তু জাতি হিসেবে ভৌগোলিক কারণে এখানকার অধিবাসীরা বাঙালি বলে পরিচিত। তাদের ভাষা বাংলা। সংস্কৃতি বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। পাকিস্তানের শাসকেরা বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে শুরু থেকেই বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে। এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য বিদেশ থেকে বহু ফকির-দরবেশ এসেছেন। তারা এখানে বসতি স্থাপন করে এখানেই রয়ে গেছেন। ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে বাংলার নিম্নবর্ণের লাখ লাখ মানুষ বিপ্লবী সাম্যবাদের নতুন ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ফলে বাংলার মুসলমানদের সংস্কৃতিতে স্থানীয় সনাতনী ভৌগোলিক আচার- আচরণের প্রভাব রয়ে গেছে। ইসলাম যেখানেই গেছে সেখানকার আদি সংস্কৃতিকে ষোলআনা পরিহার করেনি। এটা ছিল ইসলামের উদারতা। ফলে সব মুসলমান মৌলিক বিশ্বাসে এক হলেও আচার-আচরণ, পোশাক-আশাকে, ভাষায়, রঙে এক নয়। সারা বিশ্বের মুসলমানের স্লোগান হলো, নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:। এটাই ঐক্যের একমাত্র রশি। এর ব্যতিক্রম হলেই কোনো ব্যক্তি বা জাতি ইসলামের অধীনে থাকে না। শুধু আরবি বা ফার্সি থাকলেই কেউ মুসলমান থাকে না বা মুসলমান হয় না। আরবি হচ্ছে মুসলমানদের ল্যাংগুয়াফ্রাঙ্কা, ধর্মীয় ভাষা। আরবি ভাষাতেই নামাজ আদায় করতে হবে। বিসমিল্লাহকে অনুবাদ করে নামাজ পড়া যাবে না। বিশ্বব্যাপী সব মুসলমানকেই এ নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো মুজিবনগর সরকার দিল্লিকে ওয়াদা করে এসেছে একটি সেকুলার বা ধর্মনিরপে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। বঙ্গবন্ধু ভেতরের বিষয়গুলো অত বিস্তারিত জানতেন না বা তাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বোঝানো হয়নি। বা তিনি বুঝতে চাননি। ফলে শুরুতেই আপন ভাগিনা শেখ মনি ও মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সাথে নীতিগত দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। সেই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয় ’৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসি দীর্ঘ সম্মেলনের সময়। বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যাবেন, কিন্তু ভারত, শেখ মনি, তাজউদ্দীন ও ড.কামাল তা চাননি। দিল্লির কথা হলো, তুমি তো সেকুলার বাঙালি, ইসলামি সম্মেলনে যাবে কেন? তোমার সংবিধানেও সেকুলারিজম রয়েছে। নিজেকে মুসলমান দেশ হিসেবে চিহ্নিত করলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেতা ও সমাজতন্ত্র। প্রধানতম বন্ধু ছিল ভারত আর রাশিয়া। বঙ্গবন্ধু ভারত ও রাশিয়ার চাপকে উপো করে বঙ্গবন্ধু
পাকিস্তানের লাহোর গিয়েছিলেন। তার আগেই তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পাকিস্তানকে বাধ্য করেছিলেন। জানি না, আপনারা ভুলে গেছেন কি না? পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে ১০ জানুয়ারির বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান। আমি দ্বিতীয় মুসলিমপ্রধান দেশের নেতা। আমি বিশ্বাস করি, তিনি জীবিত থাকলে মুসলিম বিশ্বের নেতা হতে পারতেন। জিয়াউর রহমান সাহেব মুসলিম বিশ্বের নেতা হতে পেরেছিলেন।
ভারত আবার বাংলাদেশের কাঁধে চেপে বসেছে খুবই কঠিন কঠোরভাবে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশকে তথাকথিত সেকুলার (ধর্মহীন) রাষ্ট্রে পরিণত করা। ভারতীয় পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে শাহবাগের আন্দোলনকে ভারত সরকার সমর্থন করছে। এর সাথে রয়েছে বুঝে হোক না বুঝে হোক বাংলাদেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। ধর্মহীনতা যাদের একটা ফ্যাশন। শাহবাগের তরুণ প্রজন্মও ভারতের খপ্পরে পড়েছে। সুযোগটা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু। কাদের মোল্লার আজীবন কারাদণ্ডকে পুঁজি করে শাহবাগের নতুন প্রজন্ম নামে একটা আন্দোলন চালু করে দিয়েছে ভারত। শেখ হাসিনার সরকার না বুঝেই শাহবাগের ট্র্যাপে পড়ে গেছে। সরকার, সংসদ, সেকুলার নামে পরিচিত গায়ক, নাচিয়ে, আঁকিয়ে, বিজ্ঞাপনী সংস্থা শাহবাগের তরুণদের নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি মুম্বাইয়ের কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থা প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিচ্ছে। এখন শাহবাগে স্থায়ী মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। উদ্দেশ্য, সরকারকে চাপের মুখে রাখা। বিচারব্যবস্থাও শাহবাগীদের চাপের মুখে পড়ে গেছে। অনেকেই মনে করেন, শাহবাগ তৈরি না হলে সরকার আপিল করার আইন সংশোধন করত না। কাদের মোল্লাকে নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও এখন শাহবাগ থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন ফরমান জারি হচ্ছে। ’৭১ সালের ১ মার্চ থেকে আওয়ামী লীগ অফিস থেকে নির্দেশ জারি হতো। সেই নির্দেশ দেশবাসী মেনেছে। ওই নির্দেশের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন নির্বাচিত মেজরিটি দলের নেতা। কিন্তু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ডা: ইমরান কে? তিনি তো সরকারকেও নির্দেশ দিচ্ছেন। সরকার পুলিশ প্রটেকশন দিয়ে শাহবাগ চত্বর জমায়েতকে চালিয়ে যেতে দিচ্ছে। ডা: ইমরান নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন তাদের আর টাকা-পয়সা লাগবে না। শাহবাগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থ এখন তাদের আছে।
মাওলানা সাঈদী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুরআনের তাফসিরকারক বা মোফাসসির। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো তেমনভাবে প্রমাণিত হয়নি। সাঈদী বার বার বলেছেন, তিনি দেল্লা রাজাকার নন। ’৭১ সালে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলেন না। দেল্লা রাজাকার আর মাওলানা সাঈদী যে এক ব্যক্তি নন তা প্রমাণ করার কোনো সুযোগই আসামিপকে দেয়া হয়নি। মাওলানা সাহেবের ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর দেশে-বিদেশে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তাও সরকার অনুধাবন করতে পারেনি। গত কয়েক দিনে ১ শ’র বেশি সাঈদী ভক্ত, জামায়াত-শিবিরকর্মী ও সাধারণ মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। বিুব্ধ মানুষ ােভ প্রকাশ করতে গিয়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করেছে। সরকারও মনে করছে যে, শক্তি দিয়ে তারা এ বিােভ দমন করতে পারবে। মন্ত্রীরা বলেই চলেছেন, সরকার কঠোর হস্তে এই বিােভ দমন করবে। সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন সরকার নাকি এখনো কঠোর হয়নি।
’৪৭ সালে মুসলমান বা ইসলামের নামে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হলেও শাসকেরা ছিলেন সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরি করতেই লেগে গেছে ৯ বছর। আর যা তৈরি হয়েছিল তাও টিকতে পারেনি সামরিক শাসনের কারণে। পাকিস্তানি শাসকেরা মুখে ইসলামের কথা বলতেন, বাস্তব আচরণে তারা সবাই ছিলেন ইসলামবিরোধী। জনগণের সেন্টিমেন্ট বা আবেগকে কাজে লাগানোর জন্যই তারা ইসলামের কথা বলতেন। জেনারেল ইয়াহিয়া ছিলেন একজন মদ্যপ। বেশির ভাগ সময়ই এই জেনারেল হুঁশে থাকতেন না। বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবী এই মদ্যপ ব্যক্তির তাঁবেদার ছিলেন। এক কথায় বলা যেতে পারে পাকিস্তান কখনই ইসলামিক দেশ ছিল না।
একই অবস্থা আজ বাংলাদেশের। মৌলিক বিষয়গুলো সুরাহা না হওয়ায় রাষ্ট্রটির অস্তিত্বই আজ হুমকির সম্মুখীন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু জাতিকে সীমাহীন অস্থিরতায় নিমজ্জিত করে ফেলেছে। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে ’৭১ সালে বাংলাদেশ কিভাবে কী কারণে স্বাধীন হয়েছিল। আপনারা নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করুন। দেখুন, উত্তর পান কি না। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের ঐক্যবদ্ধ ঐকমত্যের উত্তর নেই। কেউ বলেন মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপে। তাই ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র নিরপে থাকবে। মুজিবনগর সরকার ঢাকায় ফিরে আসার সময় চারটি বিষয় সাথে করে নিয়ে এসেছেন। ধর্মনিরপেতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও সব নাগরিকের সমান অধিকার। সংবিধানে বলা হয়েছে জনগণই সার্বভৌম এবং সকল মতার অধিকারী। ধর্মনিরপে কথাটা শুনতে খুবই আকর্ষণীয়। এ কথাটা ব্যাখ্যা হলো রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারে আগ্রহী থাকবে না। স্লোগান হলো ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। মানে ৯০ শতাংশ মুসলমান নাগরিকের যে অধিকার ১০ শতাংশ ভিন্ন ধর্মীদেরও একই অধিকার। এই চিন্তা বা স্লোগান গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী। ৯০ শতাংশ মুসলমান নাগরিকের অধিকারকে অস্বীকার করা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এখন সাংবিধানিকভাবে গোঁজামিল ও ঠগবাজি ব্যবস্থায় আছে। বলা হচ্ছে রাষ্ট্রের নীতি ধর্মনিরপে। অপর দিকে বলছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এ তো হচ্ছে রাজনীতিকদের জুয়াচুরি। সাধারণ ভোটারদের ঠকানোর জন্য একটি কৌশল। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র আর ধনবাদী গণতন্ত্র এক নয়। তবুও জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্যই সংবিধানে এই নীতি সংযোজিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে ফিরে এসে এখন বহুদলীয় শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। কিন্তু তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর সাথে জোটে আটকা পড়ে আছে। বাংলাদেশে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর দুই লাখ ভোটার নেই। এখন মন্ত্রিসভায় এমন লোকও আছেন যিনি নির্বাচনে নিজ দল থেকে দাঁড়িয়ে পাঁচ শ’ ভোটও পাননি। ভোটহীন রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশকে ধর্মনিরপে বা ধর্মহীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোও বাংলাদেশকে ধর্মহীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ল্য ও নীতি কী ছিল? যারা যুদ্ধ করেছেন তারা কী বলেছেন তারা একটি ধর্মহীন বা ধর্মনিরপে রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থা চান? যুদ্ধটা ছিল পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে। দুই ভাইয়ের মধ্যে অধিকার নিয়ে যুদ্ধ। পাকিস্তানি শাসকেরা যদি বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী মানত তাহলে কি যুদ্ধটা হতো? আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত। যেমন ভারত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছে। ইংরেজের শোষণ-শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্যই ভারতবাসী স্বাধীনতা চেয়েছে। ঠিক একইভাবে মুসলমানেরা হিন্দু শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তিলাভের জন্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছে। ’৪৭ সালেই অখণ্ড বঙ্গদেশ একটি আলাদা রাষ্ট্র হতে পারত। অখণ্ড বঙ্গদেশে মুসলমানেরা মেজরিটি হওয়ার কারণে বাঙালি হিন্দুরা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র চায়নি। ফলে অর্ধেক বাংলা মানে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের সাথে আসে।
পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ ছিল পূর্ব বাংলায়। পাকিস্তানের দুই অংশের এক থাকার প্রধান উপাদান ছিল ইসলাম বা মুসলমানিত্ব। বাস্তবে দেখা গেল মাইনরিটি মুসলমানেরা সব েেত্রই শক্তিশালী এবং সব দিক থেকে মেজরিটি মুসলমানকে অবহেলা করতে শুরু করেছে। এমনকি অনেকেই পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বিশ্বাস নিয়েও কটূক্তি করতে শুরু করে। এর ওপর ছিল প্রচণ্ড অর্থনৈতিক শোষণ। এর ফলে উভয় অঞ্চলের ভেতর বিরাট বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমেও বৈষম্য দূর করা যায়নি। বাংলা ভাষার ব্যাপারেও জিন্নাহ সাহেব বা মুসলিম লীগ নেতাদের চিন্তা ও ভূমিকা সঠিক ছিল না। ’৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমেই বাঙালি মুসলমান নিজেদের সেন্টিমেন্ট ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। জাতীয় সংসদের মেজরিটি দলের নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধু একটা সমঝোতা চেয়েছিলেন শুধু শান্তির জন্য। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া ও ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সরলতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ২৫ মার্চ রাতে সামরিক অভিযান চালিয়ে।
তাহলে খুবই ন্যায্যভাবেই প্রশ্ন ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি শুধুই বাঙালি হওয়ার চেতনা? ইসলাম ও মুসলমানিত্ব ত্যাগের চেতনা? একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও বাম চেতনার নাগরিক ’৭২ সাল থেকেই আমাদের বোঝাতে চাইছে ’৭১-এর চেতনা হলো অসাম্প্রদায়িক ধর্মহীন চেতনা। এই চেতনা হচ্ছে শুধুই বাঙালি হওয়ার চেতনা। তাই তারা ’৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বে তারা হার মেনেছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের নেতা। তিনি বলেছিলেন, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান। সুতরাং এ ব্যাপারে আর কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। কিন্তু বিতর্ক যাচ্ছে না। কারণ ৯০ শতাংশ মুসলমানের অধিকারকে অস্বীকার করার জন্যই তথাকথিত চেতনার কথা বলা হচ্ছে। আমরা মসজিদে বলি আল্লাহু আকবার, মানে আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহই সার্বভৌম, আর সংসদের ভেতরে বলি মানুষহু আকবার, মানে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ বা সার্বভৌম। এটা এক ধরনের মুনাফেকি। মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। এই মানুষ বা খলিফার কাজ হচ্ছে সৃষ্টিজগতের খেদমত করা। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দ্বিমুখী। মানুষ কখনই সার্বভৌম নয়। মানুষের সার্বভৌমত্ব মানা মানেই আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা। মাত্র কয়েক হাজার মানুষ স্বাধীনতার শত্রু, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বাংলাদেশকে একটি তথাকথিত প্রগতিশীল ধর্মহীন রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে চায়। এর পেছনে রয়েছে ইসলামবিরোধী ইজরাইল, ভারত ও পশ্চিমা শক্তি।
বাংলাদেশের চলমান রাষ্ট্র বনাম নাগরিক সংঘর্ষের পেছনে একটি শক্তি রয়েছে যে শক্তি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ও নাগরিক ঐক্যের উপাদানকে মুছে দিতে চায়। এখনই মৌলিক বিষয়গুলো সমাধানের সময়। এ জন্য আজ কঠোর জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। আমরা আমাদের ঈমানি ঐক্যকে বিসর্জন দিতে পারি না। কয়েক হাজার যড়যন্ত্রকারীর কৌশল ও শয়তানির কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করতে পারি না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads