বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৩

সরকার কি ভয় দেখিয়ে জয় করতে চাইছে



দেশে এখন স্বাভাবিক অবস্থা নেই। কিন্তু এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? এ প্রসঙ্গে সরকারের বক্তব্য একরকম, বিরোধীদলের বক্তব্য আরেকরকম। কিন্তু সত্য তো দু’রকম হতে পারে না। আসলে প্রকৃত সত্য কি তা ঘটনাপ্রবাহ বিশে­ষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। গত সোমবার ১৮ দলীয় জোটের বিক্ষোভ সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মহাজোট সরকারের পুলিশ বাহিনী যে তান্ডব চালিয়েছে, তাতে পুরো জাতি হতবাক। এমন অস্বাভাবিক পুলিশী অ্যাকশন স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত ৪২ বছরে কেউ লক্ষ্য করেনি। পর্যবেক্ষক মহলের মতে সোমবার ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে পুলিশ বাহিনী। পুলিশের জঘন্যতম তান্ডবে পুরো জাতি যখন সমালোচনা মুখর, এমন কি বর্তমান মহাজোট সরকারের শরিক এরশাদ যখন ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফও যখন যৎকিঞ্চিত লজ্জিত হয়েছেন, তখনও সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশী তান্ডবের সমর্থনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় দমন-অবদমনের পক্ষে কথা বলছেন, তাতে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বিরোধীদলকে কষ্ট করে আর কোনো বক্তব্য রাখতে হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার পুলিশ বাহিনী হামলা-মামলা ও অস্বাভাবিক আচরণের মাধ্যমে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে কি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবগত নন? নাকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনেই বিতর্কিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতটা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে চলেছেন? পর্যবেক্ষক মহলে এমন প্রশ্ন জাগার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গত সোমবার কোনো মামলা বা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরচল ইসলাম আলমগীরসহ বহুসংখ্যক নেতা ও কর্মীকে যেভাবে গ্রেফতার করা হয় এবং সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপী তান্ডবে্ পুরো বিএনপি কার্যালয় যেভাবে তছনছ করা হয়, তেমন বর্বরতা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে কল্পনা করা যায় না। পুলিশের বর্বরতায় আর্তচিৎকার করতে দেখা যায় নারী কর্মীদের। উন্মত্ত পুলিশ বাহিনী লুট করে নিয়ে যায় বিএনপির মূল্যবান নথিপত্র ও অফিস-সরঞ্জাম। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের পুলিশ বাহিনী কি এমন অস্বাভাবিক ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে? সরকার কি ভয় দেখিয়ে দেশ শাসন করতে চাইছে বাংলাদেশের জনগণতো এমন অবমাননাকর শাসন কখনো মেনে নেয়নি। আইয়ুবশাহী ও মোনায়েমশাহীর বিরচদ্ধে জানগণের দ্রোহ, তারই বড় প্রমাণ। ইতিহাসে এই অধ্যায়গুলো কি বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা একেবারেই ভুলে গেছেন?
সরকার ও তার পুলিশবাহিনীর দায়িত্ব আতঙ্ক সৃষ্টি নয়, বরং স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, আতঙ্ক সৃষ্টির যেন এখন সরকারের পুলিশ বাহিনীর কাছে গুরচত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এ কারণেই পত্রিকা শিরোনাম হয়েছে ‘শিবির ধরার’ আতঙ্কে মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ দেখলেই অাঁতকে উঠছে মানুষ। সবচেয়ে বেশি ভয়ে আছে যুব-সমাজ। তাদের পরে আতঙ্কে আছে দাড়িওয়ালা নাগরিকরা। এই দুই বৈশিষ্ট্যের সাধারণ মানুষ এখন পারতপক্ষে পুলিশের মুখোমুখি হতে চান না। কি কলেজ পড়ুয়া আর কি মসজিদমুখী মুসল­xরা, কারো কথাকেই গুরচত্ব দেয় না পুলিশ। একবার সন্দেহ হলেই তাদের জামায়াত-শিবির্ না বানালে যেন পুলিশের কর্তব্য শেষ হয় না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অভিভাবকরা তাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানদের একা রাস্তায় বের হতে দিতে ভয় পাচ্ছেন। ছাত্রত্বের পরিচয়পত্র দেখালেও তাদের ছাড় দিচ্ছে না। পুলিশ। ফলে অনেক স্কুল-কলেজেই ছাত্রদের উপস্থিতি কমে গেছে। যুবকরা পুলিশের হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের ব­গার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। অনেকেই ব­গারদের বেশভুষা ধারণের চেষ্টা করছেন। তাই অনেকের থুতনিতে দাড়ি এবং লম্বা জুলফি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকের হাতে বালা, গলায় মাদুলি, রংচটা জিন্স প্যান্ট, গ্রামীণ চেকের শর্ট-ফতুয়া পরে রাস্তায় বের হচ্ছেন। রাজধানীতে এ যেন নিরাপত্তা  লাভের এক অভিনব কৌশল। যুবকরা ভাবছেন, আর যাই হোক না কেন, এমন বেশভুষার মাধ্যমে হয়তো ‘শিবির ধরা’র হাত থেকে বাঁচা যাবে। এ প্রসঙ্গে উত্তরা নিবাসী এক কলেজ ছাত্রের অভিভাবক মোর্শেদুল আলম বলেন, ছেলে যখন ছোট ছিল তখন তাকে ছেলে ধরার ভয় দেখাতাম, অথচ এখন ছেলে নিজেই ‘শিবির ধরার’ আতঙ্কে ম্রিয়মান আমি আমার ছেলেকে অকালে হারাতে চাই না। পরামর্শ দিয়েছি বেশভুষা পরিবর্তনের। দু’একবার শাহবাগেও যেতে বলেছি। আরো বলেছি, রাস্তায় কেউ পরিচয় জানতে চাইলে যেন নিজেকে ব­গার পরিচয় দেয়। এটাই সমাজে একমাত্র বাস্তবতা নয়। সরকারের প্রশ্রয়ে ও সমর্থনে শাহবাগ মঞ্চের নায়কদের ঔদ্ধত্যের বিরচদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনও শুরচ করেছে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামক একটি সংগঠন। তারা বলেছেন, পীর-আউলিয়ার পুণ্যভূমি ও ইসলামের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামে খোদাদ্রোহী শাহবাগের নাস্তিক-ব­গারদের ঠাঁই নেই। তারা বুধবার চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহবান জানিয়েছেন। তারা আরো বলেছেন, চট্টগ্রামের যেখানেই নাস্তিক ব­গারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাবে সেখানেই গড়ে তোলা হবে তীব্র প্রতিরোধ। নবীপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কাফন পরে তাদের প্রতিরোধে প্রস্ত্তত। এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শাহবাগ মঞ্চের নায়কদের আর চট্টগ্রামে যেত হলো না। শাহবাগীদের বুধবারের নির্ধারিত সমাবেশ স্থলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। শাহবাগীদের পাশাপাশি জনপ্রিয় সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলামের’ ঘোষিত সমাবেশ স্থলেও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এতে শাহবাগীদের মুখরক্ষা হলেও আসলে বিজয় হয়েছে হেফাজতে ইসলামের। শাহবাগীদের প্রতিহত করার ঘোষণার মুখে এই প্রথম সরকারের মদদপুষ্ট গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। শাহবাগ মঞ্চের রাজনৈতিক নাটক ক্রমেই জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফলে শাহবাগীদের গণজাগরণ মঞ্চে ভাটা লেগেছে। তাদের আহবানে গণসমাবেশে ক্রমেই উপস্থিতি হ্রাস পাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও শুরচ হয়েছে নতুন হিসেব নিকেষ। ফলে বর্তমান মাহজোট সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মুখেও শোনা যাচ্ছে নতুন কথা। তিনি বলেছেন, ইসলাম আজ বিপন্ন। সব ইসলামী দলের মধ্যে ঐক্য করার আহবান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘‘ইসলামের বিরচদ্ধে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র আমরা মেনে নেবো না। ইসলামকে হেয় করে যারা কথা বলছে তাদের বিরচদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে। দেশে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। কিছু ধর্মবিরোধী মানুষ ইসলামের বিরচদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। রাসূল (সাৎ), কোরআন এবং ইসলামকে অবমাননা করে কথা বলছে, এদের বিরচদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’’ জনাব এরশাদ ইসলাম বিপন্নের কথা বলেছেন, ইসলামের বিরচদ্ধে ষড়যন্ত্রকে বরদাস্ত না করার কথা বলেছেন, তার কথায় তিনি কতটা আন্তরিক তা আগামী দিনে তার কার্যকলাপ থেকেই উপলব্ধি করা যাবে। তবে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, তিনি জনগণের মনোভাব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই ইসলামের বিপক্ষ-শক্তির বিরচদ্ধে জেহাদ ঘোষণার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন। প্রসঙ্গত উলে­খ করতে হয় যে, ইসলামের জেহাদ সন্ত্রাসের সমার্থক নয়, ইসলামের জেহাদ হলো সুশৃঙ্খল প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টা নানাভাবে, নানা মাত্রায় হতে পারে।
শুরচতেই বলেছিলাম, দেশে এখন এক অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। অস্বাভাবিক অবস্থা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের উদাহরণ হতে পারে না। কিন্তু সমাজে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য মানবাধিকার রক্ষার শর্ত তো সরকার পালন করছে না। বরং সরকারের প্রণোদন পুলিশ বাহিনীর দমন-অবদমনের নিষ্ঠুর আচরণ দেশকে এক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের পরিচিতি দিচ্ছে। এমন পরিচিতি জনগণের কাম্য নয়। জনগণ তো সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু দুঃশাসনের নানা উদাহরণ সৃষ্টি করে সরকার প্রতিশ্রচতি ভঙ্গ করেছে। বাংলাদেশের জনগণ সব সময় ফ্যাসিবাদের বিরচদ্ধে রায় দিয়েছে। যারা গণতন্ত্রের কথা বলে চাতুর্যের কলাকৌশলে প্রতারণা করেছে জনগণ কখনো তাদের পক্ষে যায়নি। যারা প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির কথা বলে ধর্মের অবমাননা করেছে, তাদেরও জনগণ সব সময় প্রত্যাখ্যান করেছে। ইতিহাসের এইসব সত্যকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সম্মান করা প্রয়োজন আর এইসব সত্যকে সরকার যদি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তা শুধু দেশের সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর হবে না, এর খেসারত গুণতে হবে সরকারকেও। বিষয়টি সংশি­ষ্ট সবাই উপলব্ধি করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads