রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৩

রাজনীতির নতুন লাঠিয়াল


বাংলাদেশের একশ্রেণীর গণমাধ্যম সাংবাদিকতার নীতিবর্জিত এমন সব উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছে, যা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। কয়েক সপ্তাহ ধরে পুলিশের গুলিতে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যম এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে। যারা হত্যার শিকার হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে ‘তাণ্ডবের’। তাণ্ডবকারীরা নিজেরা কিভাবে মারা যাচ্ছে তার উত্তর নেই কোথাও। অন্য দিকে কথিত তাণ্ডবকারীদের কেউ হত্যার শিকার হচ্ছে না; এরা ‘মৃত্যুবরণ’ করছে। অর্থাৎ পুলিশের গুলিতে মারা গেলে সেটা হত্যা নয়; তাদের ভাষায় ‘মৃত্যু বা নিহত’ হওয়া।

‘তাণ্ডব’ শব্দটি যখন স্বরূপে তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেড়ে নিলো ৩০ জনের প্রাণ। মিডিয়ার ‘তাণ্ডব’ শব্দের গোমর ফাঁস করে দিলো শক্তিশালী টর্নেডো। টর্নেডোয় নিহত মানুষের প্রতি সারা দেশের মানুষের মতো আমরাও শোকাভিভূত। আমরা প্রার্থনা করি এ ধরনের নির্মম টর্নেডো আর যেন বাংলাদেশে কখনো কোনো জনপদের ওপর দিয়ে বয়ে না যায়। শব্দটি এবার উপহাস করল বাংলাদেশের টোটাল মিডিয়ার কপটতাকে। ইট-পাটকেল নিক্ষেপকারী, গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া এবং ভাঙচুরকারী রাজনৈতিক কর্মীদের কর্মকাণ্ডকে বর্তমান সরকারের আমলে মিডিয়া ‘তাণ্ডব’ বলে চিহ্নিত করে। অথচ এর আগে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে গাড়ি পুড়িয়ে ডজন মানুষ হত্যার ঘটনাও ছিল। সে ঘটনা মিডিয়া ‘তাণ্ডব’ বলে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত করেনি। তখন সেটি রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে প্রকাশ করেছে। এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টর্নেডো মিডিয়াকে শিক্ষা দিয়ে গেল ‘তাণ্ডব’ কাকে বলে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পুলিশ পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্যতম এলাকা। সেখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানোদের মধ্যে একটি শিশু হোটেল শ্রমিকও রয়েছে। শিশুটি বিুব্ধ মানুষের মিছিল দেখার জন্য রাস্তায় বেরিয়েছিল। পুলিশের নির্বিচার গুলি তার ছোট্ট শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। দেশের প্রধান একটি দৈনিক সাতকানিয়া হত্যাকাণ্ডের ফলোআপ স্টোরি করেছে ‘২০ হাজার গাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা’ শিরোনামে। পুলিশের গুলিতে নিহত মানুষ, তাদের আত্মীয়স্বজন এবং আহত হওয়া শত শত মানুষকে বাদ দিয়ে গাছের স্টোরিটি পাঠককে অবাক করেছে। গাছেরও প্রাণ আছে। তারাও কষ্ট পায় প্রমাণ করেছেন আমাদের বিজ্ঞানী জগদিশ চন্দ্র বসু। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার গাছ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু গাছ কখনো মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে মানুষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে এ প্রথম আমরা দেখলাম। কিন্তু সে স্টোরিটির বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হলো।
শিরোনামে বলা হয়েছে ২০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এর সাথে যে ছবিটি দেয়া হয়েছে তা সন্দেহ সৃষ্টি করবে। দুইটি গাছ মাটি থেকে ফুটখানেক ওপরে করাত দিয়ে কাটা। এর এক পাশে বড় একটি গাছ সমূলে দণ্ডায়মান। অন্য পাশে দু’টি গাছ সমূলে দণ্ডায়মান। শিরোনামে ২০ হাজার গাছ নিধনের খবর জানার পর পাঠক ছবিতে পাঁচটি গাছের মাছখানে দু’টি কাটা গাছ দেখছে। তার মনে এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক ২০ হাজার গাছের মধ্যে এমন একটি ছবিও পাওয়া গেল না যেখানে অন্তত ডজনখানেক গাছ কাটা হয়েছে তা দেখা যাচ্ছে।
একই পত্রিকা সাতক্ষীরায় ১৩ জন মানুষ প্রাণ হারানোর পর ফলোআপ স্টোরি করে এক আহত আওয়ামী লীগ নেতার করুণগাথা নিয়ে। বগুড়ার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে অফিস আদালত ভাঙচুর। এ জেলায়ও এক ডজনের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। একই পত্রিকা পুলিশের নির্বিচারে মানুষ হত্যার পর থেকে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপসনালয়ে হামলা ও আগুন দেয়ার খবর নিয়মিত ছবিসহ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে একই ছবি ও ঘটনা একাধিকবার প্রথম পাতায় প্রকাশ করেছে। কিন্তু এসব খবর তৈরিতে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক ভাব যতটা প্রকাশ পেয়েছে তার ধারেকাছেও ছিল না নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের আর্তি। ছিল না অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আহ্বান। অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই মন্তব্য করে বসেছে জামায়াত-শিবির এসব কাজ করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করা হচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অনেক অভিযোগ খোদ এ দলটির বিরুদ্ধে এসেছে। সংখ্যালঘু নিয়ে যে খেলা তাতে মিডিয়ার বড় অংশটিকে সরকারের পক্ষের খেলোয়াড় হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ পাঠক-দর্শক-শ্রোতার চোখ আরো স্পষ্ট করে চোখ খুলে দিয়েছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দল ঢাকায় কোনো কর্মসূচি পালন করলে মিডিয়ার প্রধান খবর হয় রাজধানীর মানুষের দুর্ভোগ। কর্মসূচিতে যত মানুষই হোক না কেন যানজট থেকে সৃষ্ট দুর্ভোগকে বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে মিডিয়া। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মানুষের উপস্থিতির কারণে সেই যানজট সৃষ্টি হতো। অন্য দিকে মাওলানা মাসউদ যে ‘মহাসমাবেশ’ করেছেন সেখানে মানুষের বিপুল উপস্থিতির কারণে নয়; পুলিশ ঢাকা শহরের বড় একটি অংশকে ফ্রিজ করে দেয় সেটিকে নির্বিঘেœœ সম্পন্ন করার জন্য। প্রথম আলো প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে বলেছে মাসউদের ‘মহাসমাবেশে’ দুই হাজার মানুষ হয়েছে। মানবজমিন এ সংখ্যাকে কোনোরকমে এক হাজারের বেশি হবে না বলে জানিয়েছে। ঢাকা শহরের বিশাল একটি এলাকাকে পুলিশিবলয় তৈরি করে যানচলাচলে যে সমস্যা সৃষ্টি করা হলো তা নিয়ে ওই সব মিডিয়াকে সংবাদ করতে দেখা গেল না। মাসউদের ‘মহাসমাবেশকে’ টিভি চ্যানেল লাইভ কাভার করেছে। যদিও তাদের ক্যামেরার চোখ ওপরের দিকে ওঠাতে পারেনি। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে সৃষ্ট যানজটকে জনভোগান্তি হিসেবে যেসব মিডিয়া বাড়িয়ে দেখায় তারা মাসউদের জনসমর্থনহীন ‘মহাসমাবেশ’ থেকে পুলিশের সৃষ্ট জনভোগান্তির কোনো সংবাদই করল না। একই অবস্থা দেখা গেছে শাহবাগ নিয়েও। দু’টি বড় হাসপাতালের রোগীদের দেড় মাস ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে শাহবাগের কারণে। দিনের পর দিন শ’কয়েক ব্লগারের জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছে রাজাধানীর প্রাণকেন্ত্রের ট্রাফিক ব্যবস্থা।
এখন পাঠক জনমিতি পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। শাহবাগ প্রকৃতপক্ষে পাঠকের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী একটি উপাদান হিসেবে কাজ করছে। শাহবাগ কপট ও ভণ্ডদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। বেশির ভাগ মিডিয়া যাদের বিরুদ্ধে হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনতে চাচ্ছে পাঠক সেসব মিডিয়ার দিকেই ঝুঁকছে। টেলিভিশনের টিআরপি (পাঠক দর্শক জরিপ) ফলাফলে এ ইঙ্গিত পাওয়া যচ্ছে। কাগজ খারাপ দাম বেশি যেসব পত্রিকার সেগুলোর পাঠক হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। দাম কম চমৎকার কাগজ ও বেশি পৃষ্ঠা দিয়েও অনেক পত্রিকার সার্কুলেশন পড়ে যাচ্ছে দ্রুত। পাঠকেরা একটা জিনিস জানিয়ে দিলো তারা সত্যিটা জানতে চায়। সে ক্ষেত্রে তারা পচা কাগজের পত্রিকা অনেক বেশি দাম দিয়েও কিনতে প্রস্তুত।
ঘটনার সঠিক বর্ণনা তুলে ধরা সংবাদমাধ্যমের কাজ। পরিস্থিতি বর্ণনার পর সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরবে তারা। এ কাজটি করার সময় কোনো পক্ষের অংশ হবে না তারা। শাহবাগের কথিত আন্দোলনকে ঘিরে মিডিয়ার বড় অংশ স¤পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। খবর প্রকাশের ধারেকাছে না গিয়ে বেশির ভাগ মিডিয়া একটি অযাচিত আবেগ দেখিয়েছে। কয়েক শ’ অ্যাক্টিভিস্টের সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক দাবিকে জাতির আকাক্সা বলে ঢালাও সংবাদ প্রচার করে। শাহবাগ ও মিডিয়ার একাকার হয়ে যাওয়ার দুটো দিক ছিল অত্যন্ত লজ্জার। একটি হচ্ছে, উগ্র কাভারেজ প্রদান। এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রচারণা পৃথিবীতে কখনো দেখা যায়নি। অনেকে হয়তো হিটলারের প্রপাগান্ডা ওয়ারের কথা বলবেন। এক মাসব্যাপী দৈনিক পত্রিকা শাহবাগ নিয়ে ব্যানার হেডিং করেছে। প্রথম পাতার ওপরের অংশে টানা শাহবাগের ছবি ছাপিয়েছে। একটি পত্রিকা প্রথম পাতার পুরোটি পোস্টার ছাপায়। মোমবাতি প্রজ্ব¡লনের ছবি ছিল সেটি। অর্ধপাতা ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হওয়ার ঘটনা বিরল। সেখানে প্রতিদিন আমরা ছাপিয়ে গেলাম।
এখন একজন সিটিং রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর কাভারেজ পাঠকের চোখ খুলে দিলো। ফাঁসি দাও, খতম করো, উৎখাত করোÑ এ স্লেøাগানে আন্দোলনকারীদের এক মাসেরও বেশি সময় উগ্র কাভারেজ দেয়ার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর কিভাবে দিলো পাঠকেরা সেটি ভালো করে লক্ষ করেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর প্রথম পাতায় আড়াই কলাম জায়গা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান সুশীল পত্রিকা যারা বলেছিল, ‘শাহবাগ বাংলাদেশের প্রাণভোমরা’ তারা দিলো তিন কলাম জায়গা। পত্রিকার আট কলাম জমিনের মধ্যে সিটিং রাষ্ট্রপতি মরে গিয়ে যদি তিন কলাম পান তাহলে সাবেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর নাই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এর মাধ্যমে এ সম্ভাবনাও দেখা গেল আসল ইস্যু বাদ দিয়ে মিডিয়া যেকোনো সময় একটা অপ্রয়োজনীয় অপ্রাসঙ্গিক ইস্যুকে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে। মিডিয়া নিয়ে দেশের মানুষ এখন রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত।
শাহবাগের ঘটনাটি দুটো পক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতাকে তলানিতে নিয়ে গেছে। এখন মানুষ এসব মিডিয়াকে চিহ্নিত করেছে ষড়যন্ত্রের অংগ্রহণকারী মিথ্যুক হিসেবে। বৃহত্তর জনগণের মধ্যে এ ধারণার জন্ম নিয়েছে সরকার ব্যর্থতা ঢাকতে সস্তা আবেগ উসকে দিয়ে শাহবাগ সৃষ্টি করেছে। জনগণের দাবি দাওয়ার পরিবর্তে কিছু সাম্প্রদায়িক দাবি সেখান থেকে উচ্চারিত হওয়ায় এ ধারণা জনগণের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে। মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল এ যড়যন্ত্র জনগণের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া। উল্টো এরা এ ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়ে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধুলায় মিশিয়ে দিলো।
অন্য বিষয়টি আরো বিস্ময়কর। সংবাদমাধ্যমের অর্থনীতি ব্যতিক্রম। দৈনিক পত্রিকার কপি বিক্রি করে এর খরচ ওঠে না। পত্রিকার দাম এবং এর উৎপাদন খরচের মধ্যে বড় ফারাক থাকে। সরকার পত্রিকায় ব্যবহৃত কাগজের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করে। আবার সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেকটা সহযোগিতা করে। বর্তমান সরকারের আমলে আমার দেশ, নয়া দিগন্তসহ ভিন্নমতের পত্রিকা এ সুবিধা পায় না। এসব পত্রিকাকে বিজ্ঞাপন না দিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ওপরও চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর বাইরেও পত্রিকাকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যথেষ্ট পরিমাণ বিজ্ঞাপন আয় প্রয়োজন হয়। মিডিয়া লাভজনক ব্যবসায় হয়ে ওঠা কঠিন। দেশের দুই ডজনের মতো টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অতীব সত্য। শুধু উগ্র কাভারেজ দিয়ে নয়, অবিশ্বাস্যভাবে কয়েকটি মিডিয়াকে শাহবাগ জমায়েতে আর্থিক সহযোগিতা দিতেও দেখা গেছে। পাঠকেরা এখন সন্দেহের মধ্যে পড়েছে মিডিয়ার অর্থের উৎস নিয়ে।
কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল শাহবাগকে দিনের পর দিন সরাসরি সম্প্রচার করেছে। লাইভ অনুষ্ঠানের স্পন্সর কারা তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। পাঠকের ওপর জোর করে তারা শাহবাগীদের চাপিয়ে দিয়েছে। কথিত প্রজন্ম কী করছে তা দেখতে পাঠকদের বাধ্য করা হয়। খবর প্রচারে এমন রঙ চড়ানো হয় যা ছিল উদ্ভট ও অবিশ্বাস্য। মানবজমিন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মাত্র কয়েক শ’ মানুষের সমাগমকে লাখ মানুষের সমাবেশ বলে চালিয়ে দেয় মিডিয়া। টেলিভিশন অবশ্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শান্তশিষ্ট সৎ নির্মোহ চরিত্রকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। খুনিদের মাফ করে দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার পরও তাদের কাভারেজ উগ্র পত্রিকাগুলোর চেয়ে ভালো বলতে হবে। তবে ২৪ ঘণ্টা লাইভ প্রচার করে কয়েক শ’ মানুষকে লাখো মানুষ বলে জালিয়াতি করা এসব টিভিকে একজন সিটিং রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর কয় ঘণ্টা প্রচার করা উচিত ছিল সেই প্রশ্নটি পাঠক করতে পারে।

মিডিয়ার বড় অংশটি এখানে থেমে থাকেনি। শাহবাগের ফ্যাসিবাদী আচরণের সহযোগী হয়ে সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও ভিন্নমতের সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েছে। আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, দিগন্ত টেলিভিশন কথিত আন্দোলনকারীদের মনঃপূত সংবাদ কাভারেজ দেয়নি। টোটাল সংবাদমাধ্যমের একটি ুদ্র অংশ এরা। শাহবাগ থেকে নির্দেশ দেয়া হয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চড়াও হওয়ার জন্য। এরপর নয়া দিগন্ত অফিসে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। দৈনিকটির গাড়ি পুড়িয়ে দেয়, আগুন দেয় প্রেসে। আমার দেশ ও নয়া দিগন্তের কপিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পত্রিকা দু’টি বিক্রি করতে গিয়ে হকাররা মারধরের শিকার হন। দিগন্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয় দেশের অনেক জায়গায়। দুর্ভাগ্য এ সময় মিডিয়ার বড় পক্ষটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ছিল একেবারে চুপ। পাঠক, হকার ও সংযোগদাতারাই দুর্বৃত্তদের রুখে দিয়েছে। সাংবাদিক কমিউনিটির বড় অংশটি বরং শাহবাগীদের অপরিণামদর্শী জঘন্য কার্যক্রমের পক্ষে অবস্থান নেয়।
সরকার ও মিডিয়ার সহযোগিতা নিয়ে শাহবাগে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয় আমার দেশ প্রথম তা খোলাসা করে প্রকাশ করে দেয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে চরমভাবাপন্ন ব্লগারদের ব্যবহার করা হয় শাহবাগ আয়োজনে। আয়োজকদের মধ্যে ছিল খুনি ও নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য এবং রাজাকার পরিবারের সদস্যও। পত্রিকাটি তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। সরকার এবং মিডিয়ার বড় অংশ এ অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার বদলে তাদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা নেয়। এমনকি মিডিয়া জোরেশোরে প্রচার করতে থাকে যে, শাহবাগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে। অপপ্রচারটা কী সে তথ্যপ্রমাণ অবশ্য হাজির করতে পারেনি তারা।
বাপ্পাদিত্য বসু লাশের ওপর নৃত্য করছেন এমন ছবি প্রকাশ করে আমার দেশ। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হাজির করে নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়ার। তার আগেই কয়েকজন ব্লগারের ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের প্রমাণ প্রকাশ হয়। অভিযুক্তরা কেউ নিজেদের নির্দোষ দাবি করেনি। তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে আদালতে যায়নি। কিন্তু শাহবাগ মঞ্চকে ব্যবহার করে সরাসরি সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে খতম করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। এক দিন-দু’দিন নয়; কয়েক সপ্তাহ ধরে এরা এ অপরাধটি করেছে। মঞ্চটিকে সব সময় ঘিরে রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য। এরা কেউ অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারও মঞ্চের অপরাধী নেতাদের সাথে সুর মিলিয়েছে। শাহবাগের ব্লগাররা মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়ার পরিবর্তে অপরাধীদেরই আশ্বাস দেন যে, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার জন্য সরকার আইনি প্রক্রিয়া খুঁজে দেখছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো যখন দেখা গেল মিডিয়াও সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিলো সরাসরি। আরো অবাক হওয়ার মতো ঘটনা ঘটালেন কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক। তারা অপরাধীদের অপরাধ বিষয়ে কোনো সংবাদ করলেন না। বরং তারা মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। তারা এ সাহসী সংবাদিককে ব্যক্তিগতভাবেও আক্রমণ করল।
আন্দোলনকারীদের ব্যানারে সংগঠিত হওয়া অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করছে যে গুটিকয় মিডিয়া তাদের বিরুদ্ধে এখন হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনার চেষ্টা আমরা দেখলাম। একটি শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক এ ধরনের একটি অভিযোগ নিয়ে দিনের প্রধান সংবাদ করে বসে। যে সংবাদটিকে হলুদ সংবাদ বলছে সেটি স্ক্যান করে বসিয়ে দেয় তারা। তাদের অভিযোগ যুদ্ধারপাধের বিচার বিঘিœœত করার জন্য এসব মিডিয়া হলুদ সাংবাদিকতা করছে। সরকার সাধারণত ঢালাওভাবে সব আন্দোলন সংগ্রামকারীদের যুদ্ধাপরধের বিচার বিঘিœœত করার জন্য অভিযুক্ত করে আসছে। এ কৌশলটি তিন বছর ধরে দেশের মানুষ দেখছে। যে সংবাদটি প্রকাশের জন্য হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনা হয় সেটি ভুলবশত ঘটেছে বলে একটি সংশোধনীও মাস কয়েক আগে অভিযুক্ত পত্রিকাটি প্রকাশ করে। এরপরও সেই খবরটি নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনা কতটা সঙ্গত। যারা ‘উৎখাত করো’ স্লেøাগানের আন্দোলনকারীদের মাসাধিককাল ব্যানার হেডিং করল, অর্ধেক পৃষ্ঠাজুড়ে ছবি ছাপিয়ে উগ্র কাভারেজ দিলো তাদের নিজেদের নৈতিক অবস্থান এর মাধ্যমে আরো ধসে গেল।
হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ উত্থাপনকারী ইংরেজি পত্রিকাটি নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যা নিয়ে এমন বানোয়াট প্রতিবেদন প্রকাশ করল যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পথটিও খোলা রাখল না। আমার দেশ ত্বকী হত্যা নিয়ে পত্রিকাটির স্টোরিগুলো ছাপিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার ন্যক্কারজনক অপচেষ্টা প্রমাণ করে দিয়েছে। যে তথ্যপ্রমাণ আমার দেশ উপস্থাপন করেছে তার বিরুদ্ধে ইংরেজি পত্রিকাটি কোনো যুক্তিপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads