শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০১৩

তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে


একটি প্রজন্ম বা জেনারেশন বলতে আমরা বুঝি অভিন্ন সময়ে জন্ম নেয়া সব মানব, যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বেড়ে ওঠে এবং নিজেদের পরবর্তী বংশধর তৈরি করে। এই সময়সীমাটি হচ্ছে গড়পড়তা ৩০ বছরকাল। সৃষ্টির প্রথম মানব হজরত আদম আ: থেকে যদি আমরা ধারাটি গণনা শুরু করি, তাহলে বর্তমানে আমরা হচ্ছি তার কয়েক হাজারতম প্রজন্ম। এই প্রজন্মের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা থাকলেও তা নিয়ে কার্যকর গবেষণা শুরু হয় মূলত বিংশ শতকের শুরু থেকে। প্রজন্ম শব্দটি ইদানীং প্রযুক্তির নবতর উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে; যেমন তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট বা ৩জি ইন্টারনেট, ৫জি মোবাইল নেটওয়ার্ক কিংবা চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটার প্রভৃতি। প্রজন্ম বলতে আমরা তারুণ্যের সময়কালটিকেই বেশি বুঝে থাকি। কারণ নিজেকে ও পৃথিবীকে গড়ার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ অর্জন ও বাস্তবায়ন করার সর্বোৎকৃষ্ট সময়কালটি হচ্ছে তারুণ্যের সময়টি। বাংলাদেশে প্রজন্ম শব্দটি বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়ে আসছে; যেমন তরুণ প্রজন্ম, নতুন প্রজন্ম, আগামী প্রজন্ম, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রভৃতি। বর্তমানে শব্দটির রাজনৈতিক ব্যবহারও যথেচ্ছ করা হচ্ছে। যেমন-প্রজন্ম চত্বর, প্রজন্ম মঞ্চ, দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম প্রভৃতি।

যা হোক, তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক; তাই এ প্রজন্ম নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে গভীরভাবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সংরক্ষণ, উন্নতি, সমৃদ্ধি, সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে তরুণ প্রজন্মকে বিশেষভাবে গড়ে তুলতে হবে। আমরা স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আজ পর্যন্ত লক্ষ করলে দেখতে পাব জাতির এই ভবিষ্যৎ কর্ণধারেরাই সবচেয়ে অবহেলিত হয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, নোংরা রাজনীতি, অপসংস্কৃতি ও অনৈতিকতার কাছে বারবার বলি হতে হচ্ছে এই তরুণদের। দুর্বৃত্তদের ক্ষমতার সিঁড়ি কিংবা ইসলামবিমুখদের নাচের পুতুল হিসেবে এই প্রজন্মকে বারবার ব্যবহৃত হতে আমরা দেখছি। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই পারে তরুণ প্রজন্মকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যপানে অনেক দূর এগিয়ে নিতে। এই দেশের নব্বই ভাগ মানুষের মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে মহান আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও নিঃশর্ত আনুগত্য। সমাজের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ও আনুগত্যের কার্যকারিতা প্রদর্শিত হলেও শিক্ষাব্যবস্থায় আজ পর্যন্ত তা পরিলক্ষিত হয়নি। ক্ষমতার একশ্রেণীর উচ্ছিষ্টভোগী ও ইসলামবিমুখ বুদ্ধিজীবীর প্ররোচনায় রচিত হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০। সেকুলার কিংবা কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামবিমুখ করে জাতির সাথেই প্রতারণা করেছে চিহ্নিত এই গোষ্ঠী।
তরুণ প্রজন্ম আজ বেশির ভাগ মিডিয়ার তথ্য সন্ত্রাসের শিকার। বেশির ভাগ বুর্জোয়া আর সামন্তবাদ গোষ্ঠীর মালিকানায় এবং কমিউনিস্ট ও সেকুলার মতাদর্শের ব্যক্তিদের সম্পাদনায় কিংবা পরিচালনায় চলছে এই তথ্যযুদ্ধ। এদের মূল উপজীব্য হচ্ছে নাস্তিকতাবাদ, ইসলামবিরোধী সব ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ, তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারীর সমানাধিকার এবং প্রগতিশীলতা প্রভৃতি। মহাজোট সরকার এই শ্রেণীর মিডিয়াগুলোকে ব্যাপক হারে লাইসেন্স কিংবা অনুমোদন দিয়ে নিজেদের নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে সহযোগী হবে বলে মনে করছে। এসব বিশেষ চ্যানেলে টকশো আর প্রামাণ্য অনুষ্ঠান দিয়ে এরা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে। মিথ্যা ইতিহাসের মিথ তৈরি করা হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। এই চানক্যবাদী গোষ্ঠীর ইতিহাস চর্চার দৌড় ’৭১ সাল পর্যন্ত। মুসলিম জাতি হিসেবে উপমহাদেশ এবং এ ব-দ্বীপে আমাদের যে গৌরবান্বিত ঐতিহ্য রয়েছে, এসব অন্ধের গোষ্ঠী তা দেখতে পায় না। অথচ একটি জাতিসত্ত্বার ভিত তখনই শক্তিশালী হয়, তার স্বাধীনতা তখনই রক্ষিত হয় যখন সে জাতির গৌরবান্বিত সুপ্রাচীন ঐতিহ্য থাকে এবং বর্তমান প্রজন্ম তা লালন করে। নিজস্ব দলীয় আদর্শ কমিউনিজম ও সেকুলারিজমকে স্বাধীনতা যুদ্ধের তথাকথিত চেতনা হিসেবে আখ্যায়িত করে তরুণদের মধ্যে সেকুলারিজমের বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে। ইসলামি সংগঠনগুলোর নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমকে ঋণাত্মক ভঙ্গিতে উপস্থাপনা করে তরুণদের ইসলামের প্রতি বিতৃষ্ণাভাব সৃষ্টি করা হচ্ছে। এদের টকশো কিংবা উপস্থাপনাগুলোর মূল বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিন্তু এক। তা হলো এ দেশ থেকে ইসলাম নির্মূল। এই গোষ্ঠী মুসলিম নামধারী হলেও এই অপকর্মের জন্য নাস্তিক কিংবা ইসলামবিরোধী বললে তাদের আঁতে ঘা লাগে। এদের সহযোগী রয়েছে বেশ কিছু প্রিন্টেড মিডিয়া যারা অহর্নিশ হলুদ সাংবাদিকতায় নিমগ্ন। তারা শিক্ষা ও ক্যাম্পাস, গণিত অলিম্পিয়াড, টেকনোলজি, রম্য ম্যাগাজিন, ফ্যাশন ডিজাইন, বিনোদন-তারকামেলা প্রভৃতি চটকদার উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তরুণদের মন জয় করছে এবং তার আড়ালে সুকৌশলে ইসলামের বিরুদ্ধে তরুণদের প্রভাবিত করছে। প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে বলার সাহস না থাকলেও এরা সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, পরাজিত শক্তি, উগ্রপন্থী, চরমপন্থী, মধ্যযুগীয় প্রভৃতি প্রতিশব্দ ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্মকে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে।
তরুণ প্রজন্ম আজ ভয়াবহ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের স্যাটেলাইট সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে চলছে। নারী-পুরুষের অবৈধ প্রেম-প্রণয়-পরকীয়া প্রভৃতিই হচ্ছে এসব চ্যানেলের মূল উপজীব্য। এদের আবার বাংলাদেশী সংস্করণ চালু করেছে উপরি উক্ত তথ্য সন্ত্রাসী কিছু মিডিয়া। এরা পাশ্চাত্য আর ভারতীয় নগ্নতা-বেহায়াপনার এ দেশীয় আমদানিকারক। এরাই প্রেসক্রাইব করে বন্ধুত্ব কিংবা সহপাঠীর ছদ্মবেশে তরুণ-তরুণীর অবাধ মেলামেশা ও ব্যভিচার দোষের কিছু নয়। এরাই নারীর সতিত্বের প্রতি অবমাননাকারী সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজক ও বিচারক সেজে যৌনতার পসার সাজিয়ে বসে। ভারতীয় আইডল আর অর্ধ-উলঙ্গ নৃত্য কিংবা সঙ্গীত সন্ধ্যার লাইভ মিডিয়া পার্টনার হয় এসব দেশীয় চ্যানেল। ইন্টারনেট আর মোবাইল পর্নোগ্রাফি উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীদের চরিত্র ধ্বংস করছে। দেশে কিছু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মূল উপজীব্য বিষয় হলো নিজেদের মনগড়া কিছু আচারানুষ্ঠানকে মুসলিম তারুণ্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া এবং তাদের ইসলামি সংস্কৃতি থেকে ভুলিয়ে রাখা। এরা সেসব প্রতারক গোষ্ঠী, যারা ইসলামি সংস্কৃতিকে সাম্প্রদায়িকতা বলে বর্জন করে বিদেশী সংস্কৃতিকে বৈশাখী মেলা, বিভিন্ন সৌধ, শহীদ মিনার, লাশ দাফন অনুষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানে পালন করতে বাধ্য করে।
তরুণ প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে এই দেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই অঞ্চলে সেই সময়ে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু থাকত, তাহলে আজকে বাংলাদেশের ভাগ্যে লেখা থাকত ভারতের সর্বোচ্চ একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে, স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে চিরতরে চাপা দিয়ে রাখতে হতো। ’৪৭-এর সেই সূত্র ধরেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ হিসেবে ’৭১-এর স্বাধীনতা আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের এই যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি স্বৈর ও শোষক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা নির্ধারিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ’৬৬-এর ছয় দফার ভিত্তিতে, যার মূল কথা ন্যায়বিচার, অধিকার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা; সেকুলারিজম বা ইসলামবিমুখতা নয়। এমনকি খ্যাতিমান কোনো মুক্তিযোদ্ধা কখনো বলেননি যে, তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন কিংবা বাংলার জনগণ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। অথচ সেকুলারিজম বা ইসলামবিমুখতা নাকি স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল বলে আজ মিথ ছড়ানো হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের একমাত্র রক্ষাকবচ হতে পারে মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য। মোট কথা মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তিতে এই দেশের উদ্ভব এবং এর ভিত্তিতেই এই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হেফাজতের চূড়ান্ত গ্যারান্টি রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads