রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৩

সরকার রক্ষা কমিশন


বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সবচেয়ে সঙ্কটকাল যাচ্ছে। উদ্বেগ জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অন্য দিকে যে দেশে রক্তের নদী বইছে সে দেশের মানকাধিকার সংগঠন ও সরকার নিষ্ঠুর নীরবতা পালন করছে। দেড় শতাধিক মানুষ হত্যার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরকম দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। সরকার এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্যও দেয়নি। কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পরিবর্তে চলছে সরকারের সমান্তরালে। এতগুলো মানুষ হত্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রশ্নও তোলেনি। যখন পাখির মতো মানুষ খুনকে বিরোধী দলের নেতা গণহত্যা আখ্যা দিলেন কেবল তখনই কমিশন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান দৃশ্যপটে হাজির হলেন। গণহত্যা বন্ধ বা হাজার হাজার আহত মানুষের মানবাধিকার নিয়ে নয়; বরং তিনি হাজির হলেন এটি গণহত্যা হতে পারে না; সেই যুক্তি নিয়ে।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম দেড় শ’ নাগরিক হত্যা গণহত্যা নয়। কিন্তু তার দায়িত্ব কী? মানুষের জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসা, না খুন ও গণহত্যার সংজ্ঞা নিয়ে কূটতর্ক করা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটের হোমপেজে মিজানুর রহমানের বাণী দেয়া আছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সমগ্র দেশের জনসাধারণ এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত নাগরিকের মানবাধিকারের উন্নয়ন এবং রক্ষার স্বপ্ন দেখে।’ প্রায় তিন বছর ধরে আমরা যদি বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যকলাপ খতিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাবো ড. মিজান কেবল সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মহলের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর ছিলেন।
দেড় শতাধিক মানুষ খুনের ব্যাপরে মুখ না খুলে সাম্প্রদায়িক ইস্যু উসকে দিচ্ছে সরকার। বলদর্পী সরকারের নিপীড়ন থেকে মানুষকে বাঁচানোর পরিবর্তে তিনি ঠিক যেন খুনি চরিত্রকে জায়েজ করার চেষ্টায় নেমেছেন। ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা হিন্দু বা অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করেছে এমন একটি নজির নেই। ভারতীয় ম্যাগাজিন আউটলুক সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে এ বিষয়টি স্বীকার করেছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এক মুখপাত্র আউটলুককে জানিয়েছেন, ‘২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর চট্টগ্রামের কাছে বাঁশখালীতে একটি মন্দিরের প্রবীণ এক পুরোহিতকে প্রহার করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা জোর দিয়েই বলেছেন, এ মৃত্যুর সাথে ধর্মীয় কোনো ব্যাপার জড়িত নেই।’
আউটলুক আরো জানায়, ভারতীয় কোনো কূটনীতিক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো নেতা মনে করতে পারলেন না সম্প্রতিক বছরগুলোতে কেবল ধর্মীয় কারণে কোনো হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। আউটলুকের প্রতিবেদনটি রচনা করেছেন ভারতের প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী (প্রণব মুখার্জির সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর) ও আউটলুকের সাংবাদিক এস এস এন এম আবদি। অন্য দিকে মানবাধিকার নেতা মিজানুর রহমান বাঁশখালী সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘দাউ দাউ করে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর জ্বলছিল তখন জামায়াত-শিবির ও যুদ্ধাপরাধের বিরোধী শক্তি উল্লাস করে বলেছে- তোরা মালাউন, যত দিন তোরা নৌকায় ভোট দিবি তত দিন তোদের এই শাস্তি।’ তার এ বক্তব্য সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক আওয়ামী লীগের বক্তব্যের কার্বনকপি। তিনি ঠিক সরকারি লাইনে গিয়ে হিন্দু কার্ডটি খেললেন। বাণীতে তিনি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক সমঝোতা এবং জাতিসঙ্ঘ প্যারিস নীতিমালা অনুযায়ী গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সত্যিকার অর্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট।’ তার কার্যকলাপ প্রকৃতপক্ষে এর বিপরীতে অর্থাৎ শুধু সরকারের স্বার্থসংশ্লিøষ্ট।
এস এস এন এম আবদি আউটলুকে লিখেছেন,‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সর্বোত্তম দিকটি হলো দলটি স্রেফ ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কোনো হিন্দুকে হত্যা করে না। সততার সাথে বলতে হয়, ভারতে নিয়মিতভাবে মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণতকারী দানবীয় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর বিপরীতে জামায়াতের ভূমিকা অতি নগণ্য।… অবশ্য ভারত ও পশ্চিমা মিডিয়া এসব বিষয়ে রিপোর্ট ছাপছে না।’ আবদি বাঁশখালীর ঘটনাটি ধর্মীয় কোনো ইস্যু নয় বলে ভারতীয় হাইকমিশন সূত্রে নিশ্চিত করেছেন। অন্য দিকে মিজানুর রহমান দায়িত্বহীন সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে সরকারকে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার সুযোগ করে দিতে চাইলেন।
সরকারি বাহিনী পরিচালিত এ হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় শিকার সাতক্ষীরা, বগুড়া, গাইবান্ধা ও মানিকগঞ্জের মানুষ। খুনের শিকার একজন হিন্দুকে একজন মুসলমান থেকে আলাদা করা যায় না। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে ড. মিজানের কাছে ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে মানবাধিকার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা। একজন হিন্দুকে হত্যা করা যেমন অপরাধ একজন অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করাও একই অপরাধ। এমনকি একজন নিকৃষ্ট অপরাধীকে অবৈধভাবে খুন করা চরম নিন্দনীয়। মিজানুর রহমান মানবাধিকার রক্ষায় বাঁশখালীতে ছুটে গেছেন। মন্দির পোড়ানো এবং পুরোহিত হত্যার নিন্দা করেছেন। তাদের সমবেদনা জানালেন। এ ধরনের সহমর্মিতা প্রকাশ প্রশংসার যোগ্য। একই ধরনের সহমর্মিতা ও সহযোগিতা পাওয়ার দাবিদার ছিল খুন হওয়া দেড় শতাধিক মানুষের পরিবার, পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হাজার হাজার মানুষ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ড. মিজান পুলিশের নির্দয় গুলির শিকার এসব মানুষের মানবাধিকারের কথা না বলে তাদের চিহ্নিত করলেন জামায়াত-শিবির হিসেবে। এ কাজটি জামায়াতের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগও এমন নগ্নভাবে করেনি।
বাঁশখালীতে সংঘটিত ঘটনার অনেক আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সুখরঞ্জনকে নিয়ে একটি কথাও বলেননি ড. মিজান। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার খোঁজ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনের মতে, এটি একটি জঘন্য মানবাধিকারবিরোধী কাজ। সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী হিসেবে নয় অন্ততপক্ষে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সুখরঞ্জনের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। তার স্ত্রী সন্তানেরা মানবাধিকার নেতা মিজানুর রহমানের কাছে সে দাবি করতে পারেন। ড. মিজান কি কখনো সুখরঞ্জনের পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন?
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপগুলো বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মানবাধিাকার ট্রাইব্যুনালের ত্রুটি নিয়ে যখন প্রায় বিবৃতি দিচ্ছে,  তখন সুখরঞ্জনের ব্যাপারে নীরব থেকেই ড. মিজান ক্ষান্ত হননি বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালের পক্ষে জোর গলায় সাফাই গাইছেন। সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে বাঁশখালী সফরের পর দেয়া লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি আদালত। এ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংুব্ধ ব্যক্তি আপিলের মাধ্যমে আইনি প্রতিকার পেতে পারে।’ অথচ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ বলে মন্তব্য করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কারো কারো বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে যাদের বিচার চলছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তেও চলছে নানা ধরনের অসাধুতা। এখন বুঝতে আর কারো বাকি থাকার কথা নয়, তিনি বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার নয়, সরকার রক্ষার আন্দোলনে রয়েছেন।
ইসরাইল গণহত্যা বলতে হিটলারের ইহুদি নিধনকে বোঝাতে চায়। বিশ্ববাসীকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তারা ফায়দা লুটতে চায়। অন্য দিকে নির্বিচারে ফিলিস্তিনি হত্যাকে কেউ যেন কখনো গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে সে প্রচারণা চালায়। সে জন্য গণহত্যাকে সংখ্যার বিচারে বেঁধে রাখতে বদ্ধপরিকর তারা। মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব নির্মম নির্যাতনের শিকার মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে তাদের রক্ষা করা। গণহত্যাকে একই ধরনের বর্ণবাদী ধারণার মধ্যে আটকে দেয়ার চেষ্টা করলেন ড. মিজান। তার এ প্রচেষ্টা মানবাধিকারের শতভাগ বিপরীত।
বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যা-খুন-গুম বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনকে ভাবায়নি। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। তাকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতির প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও সরকার সেটা রক্ষা করেনি। দৈনিক সমকাল লিখেছিল, ১০ শর্ত মানলেই ‘মুক্তি’। এসব শর্ত মূলত সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি ও ইলয়াস আলী পরিবারকে দেয়া হয়েছে। কয়েক দিন ধরে দেন দরবার চলেছে। তিনি তখন ইলিয়াস আলীর পক্ষে দাঁড়াননি।
দলটির ঢাকা মহানগরীর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে সরকারি বাহিনী গুম করেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জোর দাবি করা হয়। কিছু দিন আগে একই ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা হাজী রফিকুল ইসলামকে গুম করে হত্যা করা হয়েছে। কুষ্টিয়া কুমারখালীর আদাবাড়িয়া গ্রামের আলফাজ মিয়ার পেঁয়াজ ক্ষেতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় লাশটি উদ্ধার হয়। র‌্যাব তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। হাতকড়াটিও র‌্যাবের। পাবনার গয়েশপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় বিএনপি নেতা ইব্রাহীম আলীর লাশও কুষ্টিয়ার কোনো এক ক্ষেতে পাওয়া যায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ওয়ালী ও মোকদ্দাসকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে যাত্রীদের মাঝে থেকে তুলে নেয়া হয়। উচ্চ আদালত তাদের খোঁজ দিতে সরকারকে নির্দেশ দিলেও তার কোনো কার্যকারিতা পাওয়া যায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের শত শত নেতাকর্মী গুম হয়েছে গত চার বছরে। গুম-খুন বন্ধে মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি এই সময়ে। তিনি জোর গলায় সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে কখনো বলে ওঠেননি ‘খামোশ’।
বাংলাদেশ পুলিশের নিষ্ঠুরতা কয়েক বছর ধরে আলোচিত। বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ এটি। বিএনপির শান্তিপূর্ণ মিছিল গুলি-গ্রেনেড ছুড়ে বারবার ভণ্ডুল করে দিচ্ছে পুলিশ। অন্যায়ভাবে নেতাদের মারধর করে তাদের ধরে নিয়ে গেছে। অস্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনকানুন রয়েছে। একটি শান্তিকামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সেগুলোতে স্বাক্ষর করেছে। পুলিশ এসব আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমঝোতা মেনে চলতে বাধ্য। গণতান্ত্রিক সরকারের শৃঙ্খলা বাহিনী নয়; পুলিশ ভাড়াটে বাহিনীর মতো অস্ত্রের ব্যবহার করছে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর। সরাসরি জনগণের বুকে গুলি চালাচ্ছে বলে তিন সপ্তাহে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের ‘হিউম্যান রাইটস স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড প্র্যাকটিস ফর দ্য পুলিশ’ গাইডে বর্ণিত ধাপ বাংলাদেশের পুলিশ মানছে না। জনগণের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, জবাবদিহিতাবিহীন আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োগ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসঙ্ঘ থেকে বাংলাদেশের পুলিশকে সরিয়ে দেয়ার কথা উঠেছে। মিজানুর রহমান পুলিশ বাহিনীকে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের কথা স্মরণ করিয়ে দেননি। অথচ মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটে দেয়া বাণীতে ড. মিজান, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক বহুরাষ্ট্রীয় সমঝোতাগুলো রক্ষায় সচেষ্ট থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। কিছু পুলিশ কর্মকর্তার কর্মকাণ্ড জঘন্য সন্ত্রাসীকেও হার মানিয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ বিরোধীদলীয় চিপ হুইপকে সংসদ ভবনের পাশের রাস্তায় নির্মমভাবে পিটিয়েছে। একজন জনপ্রতিনিধির ওপর পুলিশের দানবীয় আচরণ সেদিন সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে। জয়নুল আবদিন কয়েক মাস ধরে চিকিৎসা নিয়েছেন। শৃঙ্খলাভঙের অভিযোগে জয়নুল আবদিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। হারুনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেয়া হয়নি। গরিব দর্জি বিশ্বজিৎ হত্যারকাণ্ডটিও ঘটেছে হারুনের সামনে। এ হত্যার দায়ও তিনি এড়াতে পারেন না। শাস্তির বদলে এ কর্মকর্তাকে পিপিএম পুরস্কার দেয়া হয়েছে। মিজানুর রহমান কিছুই বলেননি। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাস যখন শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যা করেছেন, উপসনালয়ে গিয়ে মুসল্লিদের গুলি করেছেন। মিজানুর রহমান কিছু বলেননি। হারুন, বিপ্লব, মেহেদী, প্রদীপদের সাথে আরো অসংখ্য পুলিশ কর্তা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা করেছেন। তিনি এসব অত্যাচারী পুলিশের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করেননি।
সাতক্ষীরায় পুলিশ এবং ক্ষমতাসীনদের যৌথ হামালায় এক ডজনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এদের একজন বৃদ্ধ আবদুস সালাম মোড়ল। গুলিবিদ্ধ মোড়লকে যখন হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা তার পথরোধ করে দাঁড়ায়। মুমূর্ষু মোড়লকে রড দিয়ে বেধড়ক পিটাতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে দুর্বৃত্তরা তাকে পিটিয়েছে। বৃদ্ধ মোড়ল মৃত্যুর আগে পানি চাইলে পিশাচরা তার মুখে প্রসাব করে দেয়। গত চার বছরে ক্ষমতাসীনদের নারকীয়তার শিকার হয়েছেন এ ধরনের আরো অনেক নিরীহ মোড়ল। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান তাদের মানবাধিকার রক্ষায় কী করেছেন? সীমান্তে বাংলাদেশীদের মানবাধিকার নিয়েও ড. মিজান ছিলেন রহস্যজনকভাবে চুপ। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ১৫ বছরের বাংলাদেশী বালিকা ফালানীকে গুলি করে হত্যা করে। কিশোরী ফালানীর রক্তাক্ত দেহ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে যায়। আধা ঘণ্টা ধরে সে পানি পানি বলে চিৎকার করেছে। নিষ্ঠুর বিএসএফ নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী ফালানীকে এক ফোঁটা পানি দেয়ার উদারতা দেখাতে পারেনি। সীমান্তে প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করছে বিএসএফ। সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষায় কী প্রচেষ্টা নিয়েছে মানবাধিকার কমিশন?
ছাত্রলীগ-যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগসহ সরকারের লেজুড় বিভিন্ন সংগঠনের জঙ্গিপনা নিয়ে তিনি ছিলেন শীতনিদ্রায়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে গরিব দর্জি বিশ্বজিৎকে। ঘটনাটি দুপুরের প্রখর আলোয় ঘটেছে। টিভি ফুটেজে দেখা গেছে হত্যাকারীরা নিজেদের মধ্যে সক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা করেছে। স্পষ্ট করে বোঝা গেছে খুনিরা মানুষ হত্যায় ব্যক্তিগত পারদর্শিতা দেখাতে চেয়েছে। খুনিরা এ ধরনের প্রতিযোগিতা করেছে দলে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার জন্য। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু রাব্বিকে গুলি করে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। রামদা, কিরিচ ধারালো অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে সবসময় দেখা গেছে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনটিকে। মিজানুর রহমান জঙ্গি ছাত্রলীগের হাত থেকে দেশের নাগরিকদের রক্ষায় কখনো সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন দেখা যায়নি।
গত চার বছরে আইনশৃঙ্খলা সংস্থার হাতে খুন হয়েছে ৪৫৯ জন। সরকারি বাহিনীর বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে গিয়ে খুন-গুম হওয়া সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় মানবাধিকার কমিশন কী করেছে তা দৃশ্যমান হয়নি। একই সময়ে ১৬ হাজার ৫৮৯ জন খুন এবং ১৩ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করার কথা। কার্যত এর বিরুদ্ধে কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিষয়টি স্পষ্ট মানবাধিকারের রক্ষায় ড. মিজানুর রহমানের কোনো ভূমিকা নেই। তার সফলতা শুধু একটি জায়গায় দেখা যায়, সেটা সরকারকে রক্ষায়। বন্দুকের নল যে সরকার বেশি চর্চা করে তাকে রক্ষা করার মধ্যে নাগরিক সমাজের কোনো লাভ নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads