রবিবার, ১০ মার্চ, ২০১৩

বিক্ষোভদ জনতা, বেপরোয়া পুলিশ ।



সাম্প্রতিক হরতাল সময়ে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল অভাবনীয় এক জনবিক্ষোভ। বিুব্ধ জনতার উত্তেজনায় সৃষ্টি হয় এক ধরনের মরিয়া পরিস্থিতি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেপরোয়া পুলিশ বাহিনীও হয়ে ওঠে অনেকটা মারমুখো। শঙ্কিত সরকারি দল ও মহাজোটের নেতাকর্মীরাও পুলিশের ছত্রছায়ায় মাঠে নামে। ফলে হরতাল সময়টা কাটে অনেকটা সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের মাঝে। সংঘর্ষ-সহিংসতা শুধু রাজধানী ঢাকায় একটি-দু’টি মিছিল-সমাবেশে সীমিত থাকেনি, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ ঘটেছে অভূতপূর্বভাবে। এক দিকে বিুব্ধ জনতা, অপর দিকে মারমুখো পুলিশ। কোথাও কোথাও পুলিশের পাশে সরকারি দল ও অঙ্গসংগঠনের সশস্ত্র লোকজন। পুলিশের নির্বিচার গুলি। রাজপথে, এমনকি গ্রামগঞ্জেও পুলিশের গুলিতে বিুব্ধ জনতার লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকে অভাবনীয়ভাবে। তেমনি জনতার বিক্ষোভের তীব্রতাও বাড়ে সমান্তরালভাবে। এ সময় থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, রেলস্টেশন, ট্রেনের বগি, সরকারি দলের এমপির বাড়ি ও একইভাবে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িও আক্রমণের শিকার হয়। একই সাথে বিরোধী দলের সমর্থক বা নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক-বীমা, হাসপাতালসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরকারি দলের লোকদের আক্রমণের শিকার হয়। এ ধরনের হামলা-প্রতিহামলায় দেশের সর্বত্র জনমনে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক আর উদ্বেগ। সব কিছু ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে ৬০ ঘণ্টার হরতাল সময়ে পুলিশের বেপরোয়া তথা নির্বিচার গুলির মুখে পড়ে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির বিষয়টি। এদের মধ্যে রয়েছেন ছয়জন পুলিশ সদস্যও। এই বিুব্ধ নিরস্ত্র মানুষদের পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করার বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন মাত্রার জোরালো বিতর্ক ও সরকারের ব্লেমগেম।
জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে দাবি করেছে, এই কয়দিনের হরতালের সময় তাদের ১৪৫ জন নেতাকর্মী ও সমর্থক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। তবে ৫ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর জাতীয় সংসদে দেয়া এক বিবৃতিতে সংসদকে জানান, গত সাত দিনে সারা দেশে সাত পুলিশ সদস্যসহ ৬৭ জন মারা গেছেন। তিনি এখানে নিহতের যে সংখ্যা উল্লেখ করেছেন, তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যমে অর্থাৎ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিহতের সংখ্যা বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে ওই সাত দিনে পুলিশসহ শতাধিক বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনীর মারধরের শিকার হয়েছেন অসংখ্য। আটকদের সংখ্যাও অভাবনীয়। সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। তবে এক শ্রেণীর গণমাধ্যম এই বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সময়ে যে একপেশে সংবাদ প্রকাশ করে চলে তারই ধারাবাহিকায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরির আশ্রয় নেয়া হয়। গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট তথ্যাভিজ্ঞজনেরা এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, এসব পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যমের অ্যাক্টিভিস্ট জার্নালিস্টরা জার্নালিজমকে অ্যাক্টিভিস্ট জার্নালিজমে রূপ দিয়েছেন। যেদিন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায় প্রকাশিত হয়, সেদিন নয়া দিগন্তের নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর মতে, রাত ১টা পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছিল ৬৬ জন। কিন্তু পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদপত্রগুলো কোনোমতেই সে সংখ্যা ৫০-এর চেয়ে বেশি দেখায়নি। ঘটনার পরদিন শুক্রবার দৈনিক ইনকিলাবে  নিহতের সংখ্যা দেখানো হয় ৩০ জন, ডেইলি স্টার ৩০ জন, ইনডিপেন্ডেন্ট ৩৮ জন, সংবাদ ৩১ জন, প্রথম আলো ৩৭ জন, সমকাল ৩৯ জন, যায়যায়দিন ৪৪ জন, মানবজমিন ৪৬ জন, জনকণ্ঠ ৩৮ জন, ইত্তেফাক ৩৯, কালের কণ্ঠ ৩৯। তবে নিহতের সংখ্যা ৫০-এর চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে : আমার দেশ ৫৬, দিনকাল ৫২, নয়া দিগন্ত ৬৬ ও সংগ্রাম ৭০। আন্তর্জাতিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি এক দিনেই কমপক্ষে ৬৭ জন নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের কিছু দৈনিকে আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন স্থানে নিহতের যে সংখ্যা দেখানো হয়েছে, সেগুলো যোগ করলে নিহতের সংখ্যা ৫০-এর ওপর। অনেক পত্রিকায় হত্যার তীব্রতা কমিয়ে দেখানোর জন্য কৌশলে মোট নিহতের সংখ্যা উল্লেখ না করে আলাদা আলাদা দেখানোর কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। তেমনি সংবাদ পরিবেশনায়ও কৌশলী ভাষার ব্যবহার হয়।
এসব সংবাদপত্রের মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাত দিনে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ৬৭ উল্লেখ করে এ ক্ষেত্রে একই ধরনের লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি এ নিয়ে অন্য দিকে আরেকটি ব্লেমগেমেরও জন্ম দিলেন। তিনি জাতীয় সংসদে এও বলেছেন, এর জন্য দায়ী বিএনপি-জামায়াত। এর দায় বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নিতে হবে। একই সাথে জনগণের সম্পদ ধ্বংসের দায়ও তাদের নিতে হবে। সরকার ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সারা দেশের মানুষ দেখেছে, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায়ের পরবর্তী কয়দিনে দেশজুড়ে সাঈদীভক্তরা বিুব্ধ হয়ে ওঠে। জামায়াত-শিবির এ বিক্ষোভে ঘোষণা দিয়েই যোগ দেয়। দেয় হরতাল কর্মসূচি। এই বিক্ষোভ জামায়াত-শিবিরের লোকদের সাথে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষেরও অংশগ্রহণ ছিল, তা অস্বীকার করা সত্যের অপলাপ মাত্র। রাজনৈতিক কারণে এ বিক্ষোভের পক্ষে যেমনি ছিল জামায়াত-শিবির, তেমনি রাজনৈতিক কারণে এ বিক্ষোভকারীদের দমন-পীড়নে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের দলগুলো এবং তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর অংশগ্রহণও ঘটেছে নেতাকর্মীদের প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে। বিুব্ধ মানুষকে প্রতিহত করার ঘোষণা তো এসেছে প্রকাশ্যেই। আর তাই বিগত কয়েক দিনে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে তার দায় এড়াতে পারে না সরকারি জোটের নেতাকর্মীরাও। এমন খবর অহরহ ছাপা হচ্ছে বিরোধী দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘর ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গড়ে তোলা ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানে হামলা; সেই সাথে দলীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে এরা। সরকারি দলের লোকজন এ ধরনের কর্মকাণ্ড এর বহু আগে থেকেই শুরু করে। এটাও ঠিক, এই কয়দিনের হরতাল সময়ে বিুব্ধ জনতা সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা করেছে কোথাও কোথাও। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে সচেতনভাবে। জনতা যখন কোনো কারণে বিুব্ধ হয়ে ওঠে তখন তাদের তাৎক্ষণিক ক্ষোভের প্রশমন ঘটে কম-বেশি সহিংসতার মধ্য দিয়েই। যেমন সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে জনতা সেই ক্ষোভ ঢালে গাড়ি ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে। আমরা দেখেছি, কয়েক বছর আগে একটি জনসভায় যখন গাজীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি আততায়ীর হাতে নিহত হন, তখন ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চলে যেখানে সেখানে। সেদিন বিুব্ধ জনতা টঙ্গীতে পুরো একটি ট্রেন জ্বালিয়ে দেয়। এই সহিংসতাকে অন্য সন্ত্রাসীদের সহিংসতার সাথে এক পাল্লায় মাপা হয় না এবং যায় না। মাওলানা সাঈদীর রায়ের পর সাঈদীভক্ত বিুব্ধ জনতা যদি কোনো সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে থাকে, তবে তাদের ব্যাপারটিও সেই প্রেক্ষাপট থেকেই বিবেচ্য; যদিও যেকোনো সহিংসতাই কাম্য নয়। সব পক্ষেরই বিবেচনায় রাখতে হবে সহিংসতা সবার জন্য অকল্যাণই বয়ে আনে। এখানে অনেকে হয়তো এই জনবিক্ষোভকে জনতার বিক্ষোভ বলতে আপত্তি করতে পারেন, কিন্তু এ বিক্ষোভে যে বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, তাকে জনতার বিক্ষোভ না বলে অন্য কিছু কি ভাবা যায়? সে যা-ই হোক,  এখানে বলা দরকার, গত কয়েক দিনে যা ঘটেছে তার সব দায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে একতরফাভাবে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের ওপর চাপাতে চাইছেন এবং ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা তার পক্ষ থেকে আরেকটি বড় ধরনের ভুলেরই সূচনা করা হলো। আর সেই ভুলের নাম ব্লেমগেম।
স্বাষ্ট্রমন্ত্রীর উল্লিখিত ৬৭ জনের নিহত হওয়া ও সঙ্ঘাত-সংঘর্ষে বিনষ্ট সম্পদের দায়ে ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এটি তার একটি কথার কথা নয়, বলার জন্যও বলা নয়। এরই মধ্যে সে অনুযায়ী তিনি এ কাজটি শুরু করে দিয়েছেন। সংসদে দেয়া তার উল্লিখিত বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, সর্বসাম্প্রতিক হারতাল ও জনবিক্ষোভের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনায় সারা দেশে বিভিন্ন থানায় প্রচলিত আইনে ২৩৫টি মামলা করা হয়েছে। ১৫৭২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য মতে, গত তিন সপ্তাহে সারা দেশে কমপক্ষে ২০০ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। অজ্ঞাতনামা আসামি দেখিয়ে ছয়টি মামলায় মানিকগঞ্জে সিংগাইরের ৬০টি গ্রামের অধিবাসীদের আসামি করা হয়েছে। এ ধরনের মামলা হয়েছে সারা দেশের অনেক স্থানে। অনেক স্থানে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের নামোল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ লাখ লাখ মানুষ যেখানে আসামি, সে মামলা কার্যত গোটা জনতার বিরুদ্ধেই। এর মাধ্যমে সরকার এ-ও প্রমাণ করল এই কয়দিন যা ঘটেছে, তা কার্যত এক ধরনের জনবিক্ষোভ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি শুধু বিরোধী দলের গুটিকয়েক নেতাকর্মীর সঙ্ঘবদ্ধ সহিংসতা ছিল না মোটেও। এখানে আরেকটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকভাবেই আসে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও সরকার সমর্থক অন্যান্য দলের লোকজন ওই কয়দিন যেভাবে সারা দেশে ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের এটিএম বুথে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে, বিরোধী দলের কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে; বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, দোকানপাটে যারা হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে, সেসব ঘটনায় কি কোনো মামলা দায়ের হয়েছে? যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সরকারদলীয় লোকদের উসকে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো মামলা হয়েছে? না যা কিছু ঘটে সব দোষ ওই কেষ্টা বেটারÑ এ ধরনের ধারণার বশবর্তী হয়ে সব কিছুই চাপানো হচ্ছে বিরোধী দলের ওপর?
এ কথা ঠিক, সর্বসাম্প্রতিক বিক্ষোভের ঘটনার মূলে রয়েছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়ার বিষয়কেন্দ্রিক। সেই সাথে মহানবী সা: ও ইসলামের বিরুদ্ধে নাস্তিক ব্লগারদের কটূক্তি করার বিষয়কেন্দ্রিক। জামায়াতে ইসলামী অভিযোগ করে আসছে, যে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে বিগত ৪০ বছর থানায় একটি জিডি পর্যন্ত হলো না, সরকার আজ রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মাওলানা সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় জড়িয়েছে। সাধারণ মানুষও এমনটি বিশ্বাস করতে শুরু করে। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের মান ও স্বচ্ছতার প্রশ্নেও চলমান নানা বিতর্ক রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না একজন অসাধারণ ওয়ায়েজিন হিসেবে সারা দেশে মাওলানা সাঈদীর জনপ্রিয়তাও অসমান্তরাল। এমনই প্রেক্ষাপটে ট্রাইব্যুনালে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশে সারা দেশে গ্রামগঞ্জের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষোভের বিষয়টি কোনো রাজনৈতিক দলবিশেষের মধ্যে সীমিত থাকেনি। ফলে জনবিক্ষোভ দমনের বিষয়টি অনেকটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও তখন মরিয়া হয়ে ওঠে। নির্বিচারে বিুব্ধ জনতার ওপর সারা দেশে পুলিশ গুলি চালায়।  এতে শতাধিক সাধারণ মানুষ মারা যায়। এখন এসব লোক নিহত হওয়া এবং এ সময়ে বিনষ্ট হওয়া সম্পদের দায় শুধু বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে চাপানো কতটা সঠিক, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া এ সমালোচনাও তো বাজারে ব্যাপক ছিল পুলিশকে জামায়াত-শিবির দেখামাত্র গুলির আদেশও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। বিরোধী দল দমনে পুলিশের পাশাপাশি সরকারি দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের রাজপথে নামার প্রকাশ্য ঘোষণাও এসেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকেই। এখনো সমানতালে চলছে বিরোধী দল প্রতিহত করার হুমকি। এর বাস্তবায়নও দেশবাসী দেখেছে। শুধু জামায়াত-শিবির নয়, বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন আঠারো দলীয় জোটের নেতাকর্মী দমনেও পুলিশের ছত্রছায়া মাঠে ছিল সরকারের সশস্ত্র বাহিনী তা-ও সরকার সমর্থক পত্র-পত্রিকার খবর সূত্রে দেশবাসী দেখেছে। অতএব কথিত ৬৭ জনের নিহতের দায় বিএনপি-জামায়াত নেতাদের ওপর চাপানোর দায় সাধারণ বিবেকবান মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, পাবে না এটুকু নিশ্চিত। প্রকৃতপক্ষে গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ও মার্চের প্রথম দিকে যে শতাধিক লোক নিহত হয়েছেন, গণমাধ্যমের সংবাদ ও টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজ দেখলে এটুকু স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এদের মধ্যে মোটামুটি ৯৫ শতাংশই নিহত হয়েছে পুলিশের গুলিতে। পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলে গুলি চালিয়ে এদের হত্যা করেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, এ সময় পুলিশ ছিল বেপরোয়া ও মারমুখো। অতএব কেউ যদি গলা পানিতে নেমেও বলে এসব হত্যার জন্য জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা দায়ী, তবুও কেউ তা বিশ্বাস করবে না।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা, বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে এক দিনে এত বেশিসংখ্যক মানুষ হত্যা করেনি। আমরা দেশ কাঁপানো একুশে ফেব্রুয়ারির বিক্ষোভ মিছিল, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি সময়ে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলি চলতে দেখেছি। কোথাও নিহতের সংখ্যা এক দিনে পাঁচ ছাড়াতে দেখিনি। কিন্তু এবার এই কয়দিনে পুলিশকে নির্বিচারে জনতার বিক্ষোভ মিছিলে গুলি চালিয়ে শতাধিক নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করতে আমরা দেখলাম। সরকারের পুলিশ গুলি করে এত মানুষ হত্যা করল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি প্রেস রিলিজ পর্যন্ত ইস্যু করলেন না, এতগুলো প্রাণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা তো দূরের কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা। এসব কিছুই না করে স্বজন হারানো মানুষদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের মামলার আসামি করে তাদের দুঃখবোধ আরো শতগুণ বাড়িয়ে তোলা হলো। শুরু হলো তাদেরকে উল্টো সন্ত্রাসী বলে গালাগাল। এমনও ঘটেছে, পুলিশের গুলিতে আহত-নিহতদের স্বজনদের মধ্যে যারা তাদের হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, তাদেরকেও আটক করে মামলায় জড়ানো হয়েছে। সাথে সাথে আসামি করা হয়েছে দুই লাখেরও বেশি মানুষকে। গণহত্যার পর এর মাধ্যমে কার্যত শুরু হলো গণমামলা আর গণগ্রেফতার। আসলে এর মাধ্যমে সরকার কার্যত লাখো কোটি মানুষের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিলো। লাখো কোটি মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য, এটুকু উপলব্ধি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর থাকা উচিত।
আসলে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন তোলাও এখন যেন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কারণ তিনি কখন যে কী বলেন, তার হিসাব-নিকাশ পাওয়া মুশকিল। এই তো কয়দিন আগে তিনি এমন কথা বললেন, যার জন্য যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে গিয়ে তাকে আদালত অবমাননার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হলো। সাংবাদিক সাগর-রুনি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সরকার সমর্থক সাংবাদিকদের চাপে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হলো। তিনি পুলিশের নির্বিচার মানুষ হত্যার বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, এ ক্ষেত্রে পুলিশ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতোই দায়িত্ব পালন করেছে। সাধারণ মানুষও বোঝে, মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর ওপর গুলি চালানো আর নিজ দেশে জনতার ওপর নির্বিচারে পুলিশের গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা কখনো সমার্থক নয়। তার মুখে এমনটি মানায় না। এ ধরনের মন্তব্য তার পক্ষপাতদুষ্টতাকেই আরো স্পষ্ট করে তুলল। তার এই পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যত তাড়াতাড়ি সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে শুরু করবেন, ততই  মঙ্গল। কারণ বাস্তবতা অস্বীকার করার অপর অর্থ জটিলতার তীব্রতা আরো বাড়িয়ে তোলা।
চার দিকে আজ নানা কথাবার্তা হচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল কী বলছে, তা কান পেতে শুনলে সমস্যা উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বলেছেনÑ বাংলাদেশে বাস্তবেই আজ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। নিহত ও আহতদের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপমুখপাত্র প্যাট্রিক ভেনট্রেল গত ৪ মার্চ সাংবাদিকদের সামনে বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলার সময় বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানিতে যুক্তরাষ্ট্র মর্মাহত। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গণহত্যা সম্পর্কে মালয়েশিয়ার সাবেক কিংবদন্তি প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নেতা ড. মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশে বলেনÑ দয়া করে সংলাপে বসুন, নৈরাজ্য বন্ধ করুন। আপনি যখন নৈরাজ্যের পথ ধরবেন, অন্য পক্ষও তখন নৈরাজ্যের পথ অবলম্বন করবে। এতে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। কিন্তু কোনো কিছুই অর্জিত হবে না। গোটা দেশ অস্থিতিশীল হবে ও সমৃদ্ধি ব্যাহত হবে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ‘ত্রুটিপূর্ণ’ উল্লেখ করে বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ট্রাইব্যুনাল পুরনো তর্ক উন্মুক্ত করে দিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এর অনলাইন সংস্করণে ‘আনরেস্ট ইন বাংলাদেশ : অ্যা ন্যাশন ডিভাইডেড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় যে ভয়াবহতা সঙ্গী হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধের বিচার তা নিরসন করবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের ৪২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মতে, ৫ থেকে ৭ মার্চের মধ্যে তিন দিনে ১০০-এরও বেশি লোক নিহত হয়েছে। সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি এক দিনেই নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬৭ জন।
ওআইসির মহাসচিব ড. একমেলুদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের ফলে বাংলাদেশে যে ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সেই সাথে জামায়াত সমর্থক সাধারণ নাগরিক ও পুলিশসহ নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে যে সংঘর্ষ চলছে তা অবিলম্বে বন্ধের উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিও জানান। মিসরের গ্র্যান্ড মুফতি এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শাইখুল আজহার ড. আহমদ তৈয়্যেব বাংলাদেশে চলমান গুম, হত্যা ও সহিংসতা বন্ধ এবং অবিলম্বে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল বাতিল করতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক অন্যান্য মহল থেকে একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশসহ নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ টবি ক্যাডম্যানের প্রশ্নÑ ফাঁসিই যদি একমাত্র গ্রহণযোগ্য শাস্তি ধার্য হয়, তবে বিচারের দরকার কী। কিন্তু সরকার কি এসবে কান দেবে? এ প্রশ্ন থেকেই গেল। কারণ গত ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অনেক ধৈর্য ধরেছি। আমি নির্দেশ দিয়েছি সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করতে। জানি না এ কমিটির কাজ কী হবে। তবে এ কমিটি যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নের ক্রীড়নক হয়ে উঠবে, তেমনটি আঁচ করা যায়। যদি তেমনটি ঘটে তবে দুঃখজনক। এই দুঃখজনক ঘটনা এড়ানোর একটিই পথ, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা-সংলাপ। সরকারি ও বিরোধী উভয় দলকেই এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে। বিরোধী দলও পাল্টা ‘কমিটি ফর পাবলিক সেফটি’ গঠন করতে বলেছে গ্রামে গ্রামে। পরিস্থিতি এতে কোন দিকে গড়ায় আমরা কেউ জানি না।
বলছিলাম সরকারের ব্লেমগেমের কথা। বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দেশে-বিদেশে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, বিদেশী গণমাধ্যমসহ সবাই যখন চলমান সঙ্কট উত্তরণে সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার আহ্বান জানাচ্ছে, তখনো সরকার ব্যস্ত ব্লেমগেমেÑ সরকার বলছে, যা কিছু ঘটছে, সবই ঘটাচ্ছে বিরোধী দল। পুলিশের গুলিতে বিুব্ধ জনতা মরছে, এর জন্য দায়ী বিরোধী দল; শহীদ মিনার ভাঙার সময় জনতার হাতে ধরা পড়ছে যুবলীগ নেতা, এরপরও এর দায় চাপানো হচ্ছে বিরোধী দলের ওপর। হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙছে সরকারি দলের লোকেরা, তার দায়ও বিরোধী দলের ওপর। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্যফ্রন্ট এর জন্য দায়ী করেছে সরকারি দলকে। ওলামা-মাশায়েখদের মধ্যে বিভক্তি ছড়ানোর জন্য ওলামা-মাশায়েখ হত্যার নাটক সাজিয়ে তদন্তের আগেই তাৎক্ষণিকভাবে বলে দেয়া হচ্ছে এটি শিবিরের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এভাবে ব্লেমগেম খেলে সঙ্কট উত্তরণের পথকেই কার্যত বন্ধ করা হয়, সমাধানের পথ বের করা যায় না। অতএব এ ব্যাপারে সাবধান হওয়াই শ্রেয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads