সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৩

বিজেপি লংমার্চ ও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রশ্ন



বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে নতুন খেলা এখন জমজমাট হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। গত কয়েক মাসের সরকার বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর সরকারি দল ও পুলিশ বাহিনীর নৃশংস আচরণ ও মারণাস্ত্র প্রয়োগ এবং গণহত্যা ও সরকারের গণবিরোধী কর্মকান্ড থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে সরকার সংখ্যালঘুদের নিয়ে এই নতুন খেলা শুরচ করেছেন। এই খেলায় এখন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কথিত হামলার প্রতিবাদে এবং শাহবাগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সংহতি জানানোর লক্ষ্যে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে। গতকাল সোমবার পিটিআই, দ্যা হিন্দু ও টাইমস অফ ইন্ডিয়াসহ প্রতিবেশী দেশটির বেশ কিছু পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত রিপোর্টের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী বিজেপির ত্রিপুরা ইউনিটের প্রেসিডেন্ট সুধীন্দ্র দাশগুপ্ত বলেছেন, এই লংমার্চে সাতশ’র বেশি নেতা-কর্মী অংশ নেবে। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে বিক্ষোভকারী তরচণদের গণজাগরণ মঞ্চের সাথে তারা সংহতিও প্রকাশ করবে। এনটিভির অনলাইন প্রতিবেদনে বলা হয় আগরতলা প্রেসক্লাব থেকে দুপুর বারোটায় এ লংমার্চ শুরচ হবে এবং আখাউড়া চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। সুধীন্দ্র আরো বলেছেন যে, ‘সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনায় আমরা চুপ হয়ে বসে থাকতে পারি না।’ বিজেপি ভারতের অন্যতম বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দল। দেশটির সকল রাজ্যে এর কার্যক্রম রয়েছে এবং দলটি ধর্মভিত্তিক একটি দল। এই দলটির অনুপ্রেরণায় ও প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছিল এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংঘটিত মুসলিম ও খ্রীস্টান বিরোধী দাঙ্গার সাথে কোন না কোনভাবেই এই দলটির সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে এই দলের অনুসারীদের সংখ্যা ও প্রভাব এত বেশি যে রাজনৈতিক বিশে­ষকদের মতে ভারতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে এই দলটি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল এবং এই দলেরই অন্যতম শীর্ষনেতা নরেন্দ্র মোদী ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী  হবার সম্ভাবনাও অত্যন্ত উজ্জ্বল। অতি সম্প্রতি আসাম রাজ্যে মুসলিম বিরোধী যে ভয়াবহ দাঙ্গায় ৫ লক্ষাধিক মুসলমান হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং তাদের পরিবার-পরিজন, ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ হারিয়েছিলেন তার সাথে বিজেপির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ছিল বলে জানা যায়। এই বিজেপি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে লংমার্চের ঘোষণা দিয়েছে এবং তারাই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাজনৈতিকভাবে অভিযুক্ত বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের বিচার নয় একমাত্র ফাঁসি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক তরচণদের মঞ্চের প্রতি সংহতি প্রকাশের লক্ষ্যে লংমার্চের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের একটি দায়ীত্বশীল দলের এ ধরনের একটি ঘোষণাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করি। পাশাপাশি এই হস্তক্ষেপকে উৎসাহিত করার জন্য মহাজোট সরকারের প্রতি ধিক্কার জানাই।
সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ সারা দুনিয়ায় একটি অনন্য সহনশীল দেশ। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান মিলে শতশত বছর ধরে বসবাস করছি। আমরা যার যার ধর্ম ও কৃষ্টি-কালচার পালন ও অনুশীলন করছি। বিশেষ করে আমরা যারা মুসলমান তারা কখনো হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা বা তাদের সম্পত্তি দখলের চিন্তা করিনি। প্রায় সাতশ বছর ধরে মুসলমানরা এদেশ শাসন করেছে। তারা যদি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করতেন তাহলে এদেশে অন্য কোন ধর্মের মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। পরাধীন আমলে ইংরেজ শাসকরা তাদের শাসন শোষণের সুবিধার্থে ‘ডিভাইড এন্ড রচল’ নীতির অনুসরণ করে এবং তারই অংশ হিসেবে এখানে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়। সাম্প্রদায়িকতা রাজনীতির টোপে পরিণত হয় এবং এই টোপটি অমুসলিম বিশেষ করে হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি গিলে নেয়। তাদের কারণেই অবিভক্ত ভারত বিভক্ত হয় এবং ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে হিন্দুস্থান তথা বর্তমান ভারতীয় ইউনিয়ন ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল পশ্চিমাঞ্চল থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম বিরোধী কয়েক লাখ দাঙ্গা হয়েছে এবং এখনো এই দেশটিতে এমন কোন দিন নেই যে দিন কোন না কোন স্থানে দাঙ্গা হচ্ছে না। পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিগত ৪১ বছরে এই অঞ্চলে দাঙ্গা যে হয়নি তা বলা যাবে না। তবে তা ভারতের তুলনায় হাজার ভাগের একভাগেরও কম। তবে পাকিস্তান আমল হোক কিংবা বাংলাদেশ আমল, এই অঞ্চলের সংখ্যালঘু বিরোধী দাঙ্গার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সাথে এই দেশের ধর্মপ্রাণ আলেম-ওলামা এবং ঈমানদার সাধারণ মুসলমানদের সম্পৃক্তি অত্যন্ত কম। জামায়াতের সম্পৃক্তি তো শূন্যের কোঠায়। হিন্দুদের উপর অত্যাচার ও তাদের সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত তার মধ্যে আওয়ামী লীগের অবস্থান শীর্ষে। হিন্দু সম্পত্তি দখল, তাদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত এবং এমনকি অবাঙ্গালী বিহারীদের বাড়িঘর, দোকানপাট, শিল্প-কারখানা, প্রভৃতি জবরদখলের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই দলটির জুড়ি নেই। অর্পিত সম্পত্তির শতকরা ৭৫ ভাগ এবং বিহারীদের সম্পত্তির শতকরা ৯৫ ভাগ দখল করে এই দলের বহু নেতা-কর্মী এখন দেশের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
এখন সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রতিক হামলা প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতার এক পর্যায়ে গত মাসের শেষের দিকে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল­v ও বিশ্বনন্দিত মুফাসসিরে কুরআন এবং জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরচদ্ধে আন্তর্জাতিক আপরাধ ট্রাইব্যুনালের ন্যায়ভ্রষ্ট যথাক্রমে যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদন্ডের রায়ের প্রেক্ষাপটে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশ কমিশনার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়েই আন্দোলনরত জামায়াত নেতা-কর্মীদের দেখামাত্র গুলীর নির্দেশ দেন এবং পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে দেন। তাদের বেপরোয়া গুলীবর্ষণ ও নির্যাতনে এক সপ্তাহের মধ্যে ১৭০ জন লোক প্রাণ হারান। দেশ নৈরাজ্যের দিকে চলে যায়। গুলী করে গণহত্যা চালিয়েও সরকার আন্দোলনকারীদের দমাতে ব্যর্থ হয়ে কোন কোন স্থানে সেনাবাহিনীও নামিয়েছেন যদিও এ সত্যটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে অস্বীকার করেছেন। তবে আইএসপিআর তার তথ্য বিবরণীতে এর সত্যতা তুলে ধরেছেন। নৈরাজ্যের এই সুযোগে সরকারি ব্যর্থতা ঢাকা দেয়ার জন্যে সরকার দলীয় লোকেরা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সংস্থার এজেন্টরা আন্দোলনকারীদের উপর দায় চাপানোর জন্যে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা চালিয়েছে এবং কোন কোন স্থানে তারা চাঁদা আদায় ও সম্পত্তি দখলের জন্যে তাদের বাড়ি ছাড়া করেছে বলে সন্দেহাতীত তথ্য প্রমাণ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশের প্রচার মাধ্যমের একটি অংশ তাদের শুধু মাথা নয় সম্পূর্ণ দেহও বিক্রি করে দিয়েছে বলে মনে হয়। তারা আওয়ামী লীগের কুকীর্তিগুলোকে দেখতে পান না। বরং সেগুলোকে জামায়াত-শিবিরের অপকর্ম হিসেবে চালিয়ে দিতে উৎসাহ বোধ করে। কেউ কেউ মনে করেন এ জন্যে তারা সরকারের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের উপঢৌকনও পাচ্ছেন। নিচে আমি কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
 দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় গত ১২ মার্চ মঙ্গলবার ‘সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজের হাত থেকে রক্ষা পেতে টাঙ্গাইলের ১৩ হিন্দু পরিবারের থানায় আশ্রয়’ শীর্ষক একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। এই সংবাদটিতে বলা হয়েছে যে গোপালপুর পৌরসভার চন্দ্রবাড়ি গ্রামের এই হিন্দু পরিবারগুলো সরকারি দলের চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। গ্রামে টিকতে না পেরে ১০ মার্চ তারা দল বেঁধে থানায় হাজির হয়ে জান-মালের নিরাপত্তা চেয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগে তারা ফারচক, মনির, লতিফ ও শরীফ নামক চার ব্যক্তির বিরচদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় এবং সর্বশেষ চাঁদা না দেয়ায় বাড়ি ঘরে হামলা চালিয়ে কয়েক দফা ভাংচুর ও লুটপাটের অভিযোগ করেছেন। তারা তাদের মারধরও করেছে বলে বলা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী ৯ মার্চ এই সন্ত্রাসীরা তাদের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে এবং ১০ ঘণ্টার মধ্যে তা পরিশোধে ব্যর্থ হলে সবাইকে গ্রামছাড়া এবং বউ ঝিদের উঠিয়ে নেয়ার হুমকি দেয়। সন্ত্রাসীদের সকলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। এই বিষয়ে পৌর কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগ নেতা কিতাবআলী বলেছেন যে, ‘ওরা আমাগো দলেরই ছাওয়াল-পাওয়াল। তবে ওরা বেশি বাইড়া গেছে।’ দেশে আইন -শৃঙ্খলার অবনতির সুযোগে ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীরা সর্বত্রই এই সুযোগটি নিচ্ছে। তারা প্রতিপক্ষকে জব্দ করা, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, তাদের সম্পত্তি দখল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের মেয়েদের ওপর অত্যাচারের লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। টাঙ্গাইলের ঘটনায় হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অপরাধীদের গ্রেফতার করার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে। আদালত এ ব্যাপারে সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। এই সময়টি এর মধ্যে পারও হয়ে গেছে। কিন্তু অপরাধীরা ধরা পড়েছে কিনা এ ধরনের তথ্য আমার নজরে পড়েনি। আবার মিডিয়াতেও ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে এই অপকর্মের নিন্দা করা হয়নি। আরো কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। জয়পুরহাটের আমদই ইউনিয়নের একটি ঘটনাকেও সরকার পুঁজি করে জামায়াত শিবির কর্তৃক সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি দৃষ্টান্ত বানিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এটি্ সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোন ঘটনাই ছিল না। বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং জামায়াতের সাথে এর কোন সংশি­ষ্টতাই নেই। এখানে যা ঘটেছে তা হচ্ছে আন্দোলন চলাকালে ঐ ইউনিয়নেরই সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আন্দোলন প্রতিহত করতে গিয়ে মাওলানা সাঈদীর ভক্তদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। তাদের কয়েকজনকে বাড়িতে নিয়ে লাঞ্ছিত করেছে। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে গ্রামের হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে ঐ আওয়ামী লীগ নেতা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ওপর হামলা চালায়। এটা সাম্প্রদায়িক কোন ঘটনা নয়। একইভাবে পাঁচবিবি উপজেলার কুসুম্বা ইউনিনের কিছু আওয়ামী লীগ নেতা আন্দোলন চলাকালে একটি মসজিদের ইমামকে লাঞ্ছিত করে। দুর্ভাগ্যবশত লাঞ্ছনাকারীদের মধ্যে আওয়ামীলীগপন্থী কয়েকজন হিন্দুও ছিলেন। মসজিদের আশপাশের মুসল­xরা তাদের ইমাম সাহেবের লাঞ্ছনাকে মেনে নিতে পারেননি। তারা লাঠিসোটা নিয়ে এর প্রতিশোধ নিতে গিয়েছেন। এখানে পক্ষ অবলম্বন করায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও জনরোষের শিকার হয়েছিলেন। জয়পুরহাট সদরের বোম্বা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগপন্থী কিছু হিন্দু পরিবারের সদস্য মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায় শোনার পর এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করে উল­vস প্রকাশ করেছিলেন। এতে সাঈদী ভক্তরা বিক্ষুব্ধ হন। তারা উল­vসকারীদের ওপর হামলা করেন। এই ভক্তরা সাধারণ মানুষ, মুসলমান। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে যে, এদের সাথে জামায়াতের কোন সম্পর্ক নেই। এ ঘটনাকেও সরকার জামায়াতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করে দলটির বিরচদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।
দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলা সদরে হিন্দুদের বাড়ি ঘরে আগুন দেয়ার একটি ঘটনা অতি উৎসাহী কিছু গণমাধ্যম প্রচার করেছে। কিন্তু দেখা গেছে যে, এ ধরনের ঘটনা সেখানে ঘটেনি। তবে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে আমি যে তথ্য পেয়েছি তা চমকপ্রদ। ফুলবাড়ি উপজেলা সদরের কিছু হিন্দু পরিবারকে ঘটনার দিন নিজ ইচ্ছায় বাড়িঘরের মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা যায়। বিনা কারণে তারা বাড়িঘর খালি করায় আশপাশের মুসলিম পরিবারগুলোর মনে সন্দেহ জাগে। তারা তাদের কাছ থেকে এর কারণ জানতে চান। অনেক পীড়াপীড়ি করে যে তথ্যাটি তারা পান সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা তাদের বলেছেন যে, তাদের বাড়িতে আগুন দেয়া হবে এবং তারা যেন মালামাল সরিয়ে নেন। আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা ছিল এদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জামায়াত-শিবির ও বিএনপিকে ফাঁসানো। কিন্তু ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যাবার পর তাদের পরিকল্পনাটি আর বাস্তবায়িত হতে পারেনি। নবাবগঞ্জ উপজেলার ভাদুরিয়ায় মন্দির ভাঙ্গার একটি ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাটিও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ঘটিয়েছে বলে স্থানীয় হিন্দুরা অভিযোগ করেছে। স্থানীয় মিডিয়া ও প্রশাসনকে তারা বলেছে যে, এই ঘটনা জামায়াত-শিবির করেনি।
ঘোড়াঘাট উপজেলার বুলাকিপুর ইউনিয়নের বলগাড়ি বাজারে একটি হিন্দু পরিবারের খড়ের গাদায় আগুন দেয়া হয়েছিল। এই আগুনদাতারাও জামায়াত-শিবির কিংবা বিএনপির সাথে সংশি­ষ্ট ছিল না বলে গাদার মালিক এবং স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। একইভাবে দিনাজপুর সদর থানার ফাজিলপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে একটি হিন্দু পরিবারের খড়ের গাদায় আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে যে এই আগুনের পিছনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলই দায়ী ছিল। স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে অবহিত রয়েছেন। অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নোয়াখালী এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিককালে সংখ্যালঘু ও তাদের সম্পত্তির ওপর যে কয়টি হামলার ঘটনা সরকার ফলাও করে প্রচার করছেন এবং তার জন্য জামায়াত-শিবির, বিএনপি কিংবা অন্যান্য ইসলামী দলের আলেম-ওলামাদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা্ করছেন এই ঘটনাগুলোর সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বয়ং আওয়ামী লীগ দলীয় সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যেখানে এই দলটির নেতা-কর্মীরা ধরা পড়ছে সেখানে অপরাধীদের বলা হচ্ছে ‘পাগল’ আবার যেখানে ধরা পড়ছে না সেখানে তাদের বলা হচ্ছে জামায়াত-শিবির, শহীদ মিনার ভাঙ্গা ও পতাকা পোড়ানোর ঘটনাটিও বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বগুড়ায় শহীদ মিনার ভাঙতে গিয়ে আওয়ামী যুবলীগের একজন নেতা হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। এলাকার লোক তাকে পুলিশেও সোপর্দ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের তরফ থেকে তাকে পাগল অভিহিত করে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। কথা হচ্ছে কোন ব্যক্তিকে পাগল ঘোষণার দায়িত্ব তো কোন দলকে দেয়া যায় না। দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত কোন ব্যক্তি পাগল কিনা তা নিশ্চিত হবার জন্যে আদালতের তরফ থেকে তাকে সিভিল সার্জনের নিকট পাঠানো হয়। সিভিল সার্জন চিকিৎসকদের বোর্ড করে তাকে তার সামনে হাজির করান এবং চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার মানসিক ভারসাম্যহীনতার রিপোর্ট দেন। পুলিশ এই আইন অনুসরণ না করেই অপরাধীকে মুক্তি দিয়ে আরেকটি অপরাধ করেছেন বলে আমি মনে করি। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন এখন সর্বস্তরে রয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, সৈনিক লীগ পভৃতি। কিন্তু পাগল লীগ বলেও তাদের একটি অঙ্গসংগঠন আছে এটা অনেকের জানা ছিল না। এখানে আরেকটি মজার ব্যাপার আছে। এই ঘটনাগুলো ঘটার পর প্রায় তিন সপ্তাহেরও বেশি পার হয়ে গেছে। সরকার এখনো বে­ইম গেম খেলছেন। কোন ঘটনার জন্যই কোনও প্রকার তদন্ত কমিটি গঠন করেননি। কিন্তু কেন? থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে বলে? কিন্তু এই খেলাটি খেলে সরকার কি করতে চাচ্ছেন তা অনেকের কাছেই এখন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পূর্বে তারা বিহারীদের ওপর নির্যাতন করে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণ ও বাঙ্গালী নিধনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এর ফলে প্রায় ৭৫ লাখ হিন্দুসহ ৮৬ লাখ লোক ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের গল্প প্রচারের মাধ্যমে প্যানিক সৃষ্টি করে সরকার কি হিন্দুদের ভারতে পাঠায়ে দিয়ে আরেকটি একাত্তর সৃষ্টি করে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে জামায়াত-বিএনপিসহ এদেশের ইসলামী জনতাকে নির্মূল করে ক্ষমতায় টিকে থাকার রাস্তাকে প্রশস্ত করতে চান? যদি এটাই তাদের পরিকল্পনা হয়ে থাকে তাহলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আর সংখ্যালঘুদের আমি বলবো যে আপনারা আমাদের সহযোগী, ভাই ও প্রতিবেশী; শত্রচ নন। এদেশ আমাদের আপনাদের। কাজেই কারচর প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হয়ে হিংসা বিদ্বেষ পরিহার করে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করি। আওয়ামী লীগের অত্যাচারের ভয়ে তাদের বশংবদ না হয়ে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে এখন আপনাদের বুক ফুলিয়ে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads