বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৩

আপস না রাজপথ


সময়কালটা উনিশ শ’ ঊনসত্তর। আইয়ুব খানপন্থী কনভেনশন মুসলিম লীগ ছাড়া সব দল রাজপথে। সব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ডান-বাম-ইসলামপন্থীসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরাও মিছিলে। ডাক-পিডিএমের ব্যানারে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল আগেই। মওলানা ভাসানী রাজপথের শীর্ষনেতা। বঙ্গবন্ধু কারাগারে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব জাতীয় নেতা আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক। এর অনেক আগেই আইয়ুব-ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন জাতিকে আইয়ুববিরোধী মেরুকরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আমরা রাজপথে স্লোগান দিতামÑ ‘আপস না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’। আজকের প্রবীণেরা অনেকেই সেই দৃশ্য ভোলেননি। সেদিনের ছাত্রনেতারা এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে সক্রিয়। তাদের কেউ সরকারি দলে, কেউ বিরোধী দলে। কেউ ডানপন্থী, কেউ বামপন্থী। বিএনপি-জামায়াত জোটেও কালের অনেক সাক্ষী রয়েছেন। বাম বলয়েও অনেকের বিচরণ লক্ষণীয়। সরকারি দলেও সেদিনের ক’জন তুখোড় ছাত্রনেতা রয়েছেন। রয়েছেন জাতীয় পার্টিতেও। আজ কারো যেন ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা নেই। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার গরজও নেই। জনগণের প্রতি জবাবদিহিতাও নেই। সবাই যেন দলান্ধ, রাজনীতি ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ। পরিস্থিতি সম্পর্কে কেউ নির্বিকার। কেউ বা বিকারগ্রস্ত। ঊনসত্তরে সমাধান এসেছিল রাজপথে। নব্বইয়ের অভ্যুত্থান রাজপথেই হয়েছে। আরো একটি গণবিস্ফোরণ অপেক্ষমাণ, সমঝোতা না রাজপথ সেই স্লোগান উঠতে শুরু করেছে। এরপরই স্লোগান উঠবেÑ আপস না রাজপথ, জনতা বলতে বাধ্য হবে ‘রাজপথ’।

দেশ গভীর সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। মুসলিম বিশ্ব থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। দেশের জননিরাপত্তা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। মানবাধিকার কমিশনের দলান্ধ চেয়ারম্যান ড. মিজান স্বরূপে আভির্ভূত হওয়ার পর ইনসেনটিভ কেয়ারে থাকা মানবাধিকার এখন কিনিক্যালি ডেড। অর্থনীতিবিদেরা অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ ও বিপর্যয়ের আলামত দেখছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু দিন ধরে বক্তব্য দিয়ে সরকারকে সতর্ক করে যাচ্ছে। পুলিশি বাড়াবাড়ি সীমা অতিক্রম করেছে। অঘোষিত কারফিউ কিংবা জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য-বিবৃতি আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারকেও চ্যালেঞ্জ করছে। এর পরও খোদ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। অথচ মৌলিক অধিকার হরণের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। এখনো আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, দাড়ি-টুপি-পাগড়ি টার্গেট করে আক্রমণ করা হচ্ছে। জাতীয় মসজিদে ফিলিস্তিন কিংবা কাশ্মিরের পরিস্থিতি বিরাজমান। বর্ণবাদী ইসরাইলি ও অপর বর্ণবাদী ভারতীয় দৃষ্টান্তও যেন বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দল, ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা করছে এমন মিডিয়া আক্রমণের টার্গেট হচ্ছে। টার্গেট হচ্ছেন মুক্তবুদ্ধির মানুষ ও বিবেকবান বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা। দেশের অরাজনৈতিক আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদেরও সরকার আর সহ্য করতে চাচ্ছে না। সরকার আলেম-ওলামাদের বাধ্য করছে রাজপথে নামতে। গত শুক্রবারের দৃশ্য স্মরণ করলে মনে হবে আলেম-ওলামা এবং তৌহিদি জনতাই সরকারের প্রতিপক্ষ। রাজনৈতিক দলের অফিসে তালা দিয়ে রাখা, রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাধাÑ এখন সরকার রুটিন কাজের অংশ বানিয়ে নিয়েছে। দেশজুড়ে একের পর এক বর্বরোচিত হামলা চলছে। গণহত্যা, গণগ্রেফতার ও গণহারে মামলায় সমগ্র দেশ যেন কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে জনগণ আইন হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। খুন হচ্ছে স্কুলছাত্রও। প্রতিটি খুনের জন্য সরকার অঙ্গুলি তুলছে বিরোধী দলের দিকে। অপর দিকে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে সরকারি আজদাহা। নাশকতা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে, মন্দিরে হামলা করে বিরোধী দলকে অভিযুক্ত করার এক অভিনব কৌশল বাস্তবায়নে সরকার যেন সক্রিয়। শহীদ মিনার ভাঙা ও পতাকা পোড়ানোর মতো অপরাধ করে বিরোধী দল শায়েস্তা করার প্রবণতাও লক্ষণীয়। অথচ ঊনসত্তরের অগ্নিঝরা দিনেও আমরা এমন দৃশ্য দেখিনি। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পুলিশও এতটা পৈশাচিক আচরণ করেনি। তাক করে বন্দুক উঁচিয়ে যুদ্ধংদেহি ভাব নিয়ে ভীতি সঞ্চারের দৃষ্টান্তও নতুন।
এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দল এক দফার কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করলে সঙ্ঘাত যে আরো ছড়িয়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবার আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদেরও সরকার ঠেলে দিচ্ছে সঙ্ঘাতমুখী রাজনীতির স্রোতে। বন্দর নগরীতে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। পুলিশের সাথে সরকারদলীয় ক্যাডারদের যোগসাজশে শ্বেত সন্ত্রাসের যে নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, এর কোনো নজির ব্রিটিশ-পাক আমলেও ছিল না। এখন তার পরিধি আরো বাড়ছে। আলেম-ওলামাদের আরো সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এক সময় দেশ অনিবার্য গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হওয়ার সব আলামত সরকারই সৃষ্টি করে দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পৈশাচিকতার যে তাণ্ডব দেখছি, সরকারি উসকানিতে তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের  অসঙ্গত আচরণ সঙ্কট আরো ঘনীভূত করবে। পরিস্থিতির এমন নাজুক অবস্থায়ও সরকার এক দিকে বিরোধী দলকে আলোচনায় বসার অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিচ্ছে, অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী বলছেন প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা। এক দিকে বলা হচ্ছে, আলোচনায় বসতে চায় সরকার। অন্য দিকে দেশজুড়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠনের আহ্বান কিংবা নির্দেশ দিচ্ছে সরকার। একবারও সরকার ভাবছে না জনমনে শঙ্কা, আতঙ্ক-ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। এর সাথে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ দুর্বিষহ পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। সরকার অস্বীকার করলেও দেশ যে গভীর সঙ্কটে পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকার বাস্তবতা আড়াল করতে চাইলেও তা আর সম্ভব নয়। সরকার দেউলিয়াপনা ঢাকতে ব্যর্থ। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপারগ। ব্লগারদের জন্য তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় ডিঙিয়ে কারা ককটেল ফোটায়! এ নিñিদ্র নিরাপত্তা বলয়ের অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে বায়তুল মোকাররমে তালা ঝুলিয়ে কী লাভ হবে। মুসল্লিরা ক্ষেপে উঠলে কে কাকে রক্ষা করবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশ ও জাতির স্বার্থেই রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরি। আগেই উল্লেখ করেছি, সরকার সমঝোতার দায় বোধ না করলে ঊনসত্তরের মতো স্লোগান উঠবেÑ ‘আপস নয় রাজপথ’, তখন গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য। তাই এখনই সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। বিরোধী দলের অবস্থান এ ক্ষেত্রে এখনো স্বচ্ছ বলাই সঙ্গত। কারণ তারা তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। সরকার বিরোধী দল ও মত দমনে যে অসহিষ্ণু ও পৈশাচিক আচরণ শুরু করেছে তা বন্ধ করে সংযম ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের মাধ্যমে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল আনলেই আলোচনার প্রয়োজন হবে না। সমঝোতার দরজা আপনিতেই খুলে যাবে। আমরা মনে করি, তখন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে থাকলেও পাঁচ বছর ক্ষমতাচর্চার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বিরোধী দল সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে। জনগণও এখন একটি সমঝোতার খোলা দরজা দেখতে চায়। যা এড়ানো বিরোধী দলের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এই অবস্থায় হামলা-মামলা বন্ধ করে, স্ববিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসাই সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। এমন গরজ বোঝার মতো বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী লোকের আকাল এখনো সরকারি দলে হওয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে বিরোধী দলকেও যথেষ্ট দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। তা ছাড়া সরকার যে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে, ছায়ার বিরুদ্ধে লড়ছে, তাও থামানোর দায়িত্ব উভয় পক্ষকেই নিতে হবে। দেশে গণতন্ত্র চর্চার দ্বার অবারিত করে দিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। ক্ষোভ প্রশমনের গণতান্ত্রিক অধিকার পেলে জনগণ শান্ত হবে। আলেম-ওলামারা ‘দেশ বাঁচাও ঈমান বাঁচাও’ যে স্লোগান তুলেছেন, সেটাও সরকারের আচরণে স্বস্তি পেলে বাঁক ঘুরবে। নয়তো সরকার পতনের জন্য এই আলেম-ওলামারাই ক্যাটালিস্টের ভূমিকায় এসে যাবেন। নয়তো আলেম-ওলামারা আরো বিগড়ে যাবেন। গণতন্ত্র সঙ্কটের মুখে পড়ার ফলে যে সঙ্ঘাতমুখর পরিস্থিতি ও নাশকতার ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা-ও উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকবে না। আইনের শাসনের অনুপস্থিতিতে যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, বিচার-আচার ও ট্রাইব্যুনাল নিয়ে যে অসন্তোষ দেশকে অস্থির করে তুলেছে তা-ও নিয়মতান্ত্রিকতার পথে বাঁক ঘোরার সুযোগ পাবে। গণতন্ত্রে ভিন্নমত যেমন গণতন্ত্রেরই সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য, তেমনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট উত্তরণের পথ খোঁজাও গণতন্ত্রের দাবি। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ বিশ্বাসযোগ্য ও আনুষ্ঠানিক হওয়া জরুরি। সরকার সততার সাথে উদ্যোগী হলে বিরোধী দলও আন্তরিকতার সাথে ইতিবাচক সাড়া দিতে বাধ্য। সেই বাধ্যবাদকতায় বিরোধী দলও জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে যে সমঝোতা বা সংলাপের পথে তারা এগোবে।
গেল সপ্তায় লিখেছিলাম, এ যুদ্ধ থামাতেই হবে। এবার বলছি সরকার উদ্যোগী হয়ে সঙ্ঘাতমুখী রাজনীতির এ যুদ্ধের ব্যাপারে সমঝোতার পথে না হাঁটলে একটি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেটা হবে অনিবার্য। সেই পরিবর্তন কতটা বিরোধী দলের পক্ষে যাবে, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে কোনোভাবেই সরকার সুফলভোগী হবে না। জনগণ যদি একবার ‘আপস নয় রাজপথ’ স্লোগান দেয়া শুরু করে, তখন বিরোধী দলকেও দর্শকের কাতারে চলে যেতে হবে। সেটাকে গণ-অভ্যুত্থান বলা হবে, না জননন্দিত কোনো শক্তির অভ্যুদয় ঘটাবে সেটা বলা কঠিন। তাই বল জনগণের কোর্টে চলে যাওয়ার আগেই যা করার করুন।
সরকার জনগণের আস্থার জায়গায় চিড় ধরিয়ে দিয়েছে। বিশ্বাসের জায়গায় আঘাত হেনেছে। প্রতিঘাত এই মাটির ধর্ম। এ জনপদের মানুষের স্বভাব। সরকার অনেক কিছু পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু মাটির ধর্ম ও গণমানুষের স্বভাবের ওপর কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। আলেম-ওলামারা সামাজিক শক্তির অবস্থান থেকে রোখার ঘোষণার পর সবাই কান খাড়া করে দিয়েছে। এই সজাগ কানে তালা লাগানোর সাধ্য বিধাতা ছাড়া আর কারো নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads