সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০১৩

মহান স্বাধীনতা দিবস



আজ মহান স্বাধীনতাদিবস। ‘স্বাধীনতা’ এক প্রিয় শব্দ, ‘স্বাধীনতা’ এক প্রিয় বিষয়। মানব অস্তিত্বেই স্বাধীনতার আকাঙক্ষা বিরাজমান। তাই তো কবি বলেন : ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়, দাসতব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়।’ আসলে প্রাণীর মত নয়, মানুষের মত বাঁচার তাগিদেই মানুষের স্বাধীনতা প্রয়োজন। কিন্তু যুগে যুগে দাম্ভিক ও অত্যাচারী কিছু মানুষ সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার স্বাভাবিক আকাঙক্ষাকে পদদলিত করতে চেয়েছে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে জালেমদের সাথে মজলুম সাধারণ মানুষের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও লড়াই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের তেমন একটি লড়াইয়ের নাম ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ।’ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের বীর জনতা অত্যাচারী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরচদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সেই থেকে প্রতিবছর ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের মানুষ পালন করে আসছে মহান স্বাধীনতাদিবস। স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন আমরা তাদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা এবং কামনা করি তাদের মাগফিরাত। তাদের আত্মদানের কারণে আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক।
আমরা স্বাধীন ভূখন্ড পেয়েছি, পেয়েছি স্বাধীন পতাকা। এ পতাকার মর্যাদা রক্ষা করা স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। তবে শুধু আবেগঘন বক্তব্যের মাধ্যমে পতাকার মর্যাদা রক্ষা করা যায় না। পতাকার মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজন নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য পালন, কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে যেমন প্রাত্যহিক কর্মের নির্দিষ্ট বিষয়গুলো এসে পড়ে, তেমনি এসে পড়ে জাতীয় লক্ষ্যের বিষয়। এই জনপদে মানুষ জানে কোন লক্ষ্যে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সেই লক্ষ্য কি স্বাধীনতার ৪২ বছরেও আমরা অর্জন করতে পেরেছি? স্বাধীনতাদিবসের এই সময়ে এই প্রশ্নটি সচেতন প্রতিটি নাগরিকের মনেই বেশ বড় হয়ে বাজে। স্বাধীনতার এতগুলো বছরে শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের কথা নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে, এই লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনও হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রচতি বাস্তবায়নের কাঙিক্ষত চিত্র জনগণ লক্ষ্য করেনি। সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ আর নির্মিত হয় না। তাই বর্তমানে দুঃখের সাথে জনগণ বলে থাকে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। যতই দিন যাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনের বেহাল দশা ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যে আদর্শ, নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার চেতনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল, এখন যেন তা বিলীন হতে চলেছে। দেশের চাইতে এখন দল বড় হয়ে উঠেছে, আর দলের চাইতে বড় হয়ে উঠেছে ব্যক্তি-স্বার্থ। রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এমন অবক্ষয় লক্ষ্য করা গেলে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জিত হবে কেমন করে? সরকার তো সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার কথা অহরহ বলে যান। আর দায়িত্বগ্রহণের সময়ও মন্ত্রীবাহাদুররা এই মর্মে শপথগ্রহণ করেন যে, অনুরাগ  ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে তারা দেশ শাসন করবেন না। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছরে এসে আজ আমরা লক্ষ্য করছি, অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়েই দেশ পরিচালনা করছেন আমাদের সরকার। ফলে ঐক্য, সংহতি ও উন্নয়নের রাজনীতির বদলে এখন দেশে চলছে দমন-অবদমন ও ক্ষোভ-বিক্ষোভের রাজনীতি। রাজপথে এক দিকে চলছে মিছিল-†¯­vগান ও ভাংচুরের ঘটনা, অন্যদিকে চলছে পুলিশ-র‌্যাব-এর বেপরোয়া গুলীবর্ষণ। মানুষের প্রাণের যেন আজ কোনো দাম নেই। যে ধরনের সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, তা যেন আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে-এর চাইতে বড় ট্র্যাজেডি আমাদের জন্যে আর কী হতে পারে?
স্বাধীনতার এতগুলো বছরে আমাদের যে কোনো অর্জন নেই তা কিন্তু নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতিতে আমরা এগিয়েছি, তবে সম্পদের সুষম বণ্টন কতটা হয়েছে সে প্রশ্ন থেকেই গেছে। শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, রেল-কেলেঙ্কারি ও পদ্মাসেতুর মত দুর্নীতি একটি স্বাধীন দেশে কেমন করে অবলীলায় ঘটে যায়, সেই প্রশ্নও জনমনে প্রকট হয়ে বাজে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার হার বেড়েছে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত কতজন হয়েছে এবং শিক্ষার লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছে সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। ফলে শিক্ষার হার বাড়লেও সমাজে দুর্নীতি ও অনাচার কমেনি। শিক্ষাঙ্গনে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গোলাগুলীর ঘটনা বেড়েই চলেছে। ছাত্রনেতারা যখন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে তখন সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, আমাদের ছাত্ররাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতি সঠিক পথে চলছে না। প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে টিকে থাকার জন্য যখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য-সংহতি ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চেতনায় কর্মমুখর সংস্কৃতি, তখন আমাদের দেশে চলছে হিংসা-বিদ্বেষ, বিভেদ ও বে­ম-গেমের অপরাজনীতি। অনাকাঙিক্ষত এই অবস্থার জন্য দায়ী ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভ্রষ্ট রাজনীতি। মহান স্বাধীনতাদিবেসে আমরা সুন্দর স্বপ্ন দেখতে চাই। হিংসা-বিদ্বেষ ও সংঘাতের রাজনীতির বদলে দেখতে চাই ঐক্য-সংহতি ও উন্নয়নের রাজনীতি। এমন চাওয়াকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে আজ প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। স্বাধীন লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আজ প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আগামী নির্বাচনটা কোন পদ্ধতিতে, কিভাবে হবে এখনও তা আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। এ ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব আছে, তবে সরকারের দায়িত্বটাই কি প্রধান নয়? বর্তমান সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা সরকারের কাছে স্বাধীন দেশের সরকারের মতই দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করছি। সরকারের কর্মকান্ডে যদি ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতার চাইতে দেশ ও জাতির প্রতি সময়ের কর্তব্য পালনের চেতনা অধিকতর গুরচত্ব পায়, কেবল তাহলেই জনমনে জাগতে পারে নতুন আশাবাদ। বর্তমান সরকার তো তেমন আশাবাদের কথাই শুনিয়েছিল এবং দেখিয়েছিল দিন বদলের স্বপ্নও। সরকারসহ অন্যরাও যদি ওয়াদা ও অঙ্গীকারের বিষয়গুলো বাস্তবায়নে নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিচয় দিতে পারেন তাহলেই পূরণ হতে পারে আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য। লক্ষ্য যাতে পূর্ণ হয় সেটাই আজকের দিনে প্রার্থনা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads