মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০১৩

শাহবাগে অর্জন, শাহবাগ বর্জন


শাহবাগ নিয়ে কোনো লেখার ইচ্ছে ছিল না। ‘বদলে যাও বদলে দাও’ ভিশনের পত্রিকায় গত ১৯.০২.২০১৩ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের মেয়ে সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি ব্লগার রাজীব হায়দারকে আলোর পথযাত্রী হিসেবে চিহ্নিত করে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তা পড়ার পর আমার উপলব্ধি প্রকাশের জন্য এ লেখা।

পত্রিকার  Vision statement টি চমৎকার। চাহিদার সাথে পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। কারো অর্থের চাহিদা থাকলে সে জীবনের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পরিবর্তন আনবে। এ পরিবর্তন জীবনবোধের হবে, হবে মূল্যবোধের। কারো যশ অথবা শান্তির চাহিদা থাকলে সে তার চাহিদা অনুসারে জীবনবোধ ও মূল্যবোধ নির্ধারণ করবে। আমাদেরেকে বুঝতে হবে আমরা কী বদলিয়ে কী হবো অথবা কী বদলিয়ে কী করব। ইমরান এইচ সরকার, আহমেদ রাজীব হায়দার, আরিফুর রহমান (প্রকৃত নাম নিতাই ভট্টাচার্য), শাকিল আহমেদ অরণ্য, এফ এম শাহীন, আসিফ মহিউদ্দিন, মাহবুব রশিদ, ইব্রাহিম খলিল, ওমি রহমান পিয়াল সবাই তাদের চাহিদা অনুসারে বদলেছে। আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-এর প্রতি বিশ্বাস বদলে নাস্তিক হয়েছে। যদিও তাজুল ইসলাম নামে রাজীবের এক বন্ধু somewhere in.blog-এ বলেছেনÑ রাজীব নাস্তিক ছিল না, ছিল ইসলামবিদ্বেষী।
ইমরান-রাজীবদের মতো নাস্তিক বা ইসলামবিদ্বেষীরা Bloggers and Online Activists Network-এর ব্যানারে কাদের মোল্লার বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগে অবস্থান নেয়। প্রথম দিকে এরা নাস্তিক বা ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিতি পায়নি। এদেরকে সামনে রেখে অবস্থান কর্মসূচির ময়দান দখলে রাখে সিপিবি ও অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনগুলো, তা পরিষ্কার ছিল। ধীরে ধীরে এ অবস্থান কর্মসূচির সাথে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল এবং অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একাত্মতা ঘোষণা করে।
ইতোমধ্যে শাহবাগ জাতির অর্জনের একটি জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থাহীনতায় রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। জামায়াত বিএনপির এবং জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দোসর হওয়ায় তাদের ওপরও মানুষের অনাস্থা। তৃতীয় শক্তি হিসেবে সামরিক বাহিনীকে বারবার মনে করা হলেও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ময়দানের পরিবর্তে তাদের পেশাদারিত্বের প্রতি বেশি আগ্রহী। এ রকম একটি শূন্যতা পূরণে একটি ‘সময়ের সঙ্গে কিক’ করা ডাকের জন্য অধীর আগ্রহে ছিল জাতি। দেশের ব্লগাররা ‘আরব বসন্তের’ সফলতায় উজ্জীবিত হয়ে ‘বাংলা বসন্তের’ আহ্বান জানালে হাজার হাজার মানুষ এতে সাড়া দেয়। ইমরান, রাজিব, নিতাই, আসিফ, লাকি, প্রীতিলতারা হয় এর নেতা-নেত্রী। প্রথম দিকে সরকারি দলের নেতা বা মন্ত্রীরা শাহবাগে গিয়ে উপস্থিত জনতার রোষানলে পড়েন। সাজেদা চৌধুরী, মাহবুবুল আলম হানিফ, সাহারা খাতুন, আফসারুল আমিন (চট্টগ্রামে), এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ (চট্টগ্রামে) আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেই সেখানে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ার, চীনের তিয়ানেনমেন স্কয়ার, তুরস্কের তাসকিন স্কয়ার, মিসরের তাহরির স্কয়ারের মতো এ দেশের গণসমাবেশ, গণবিপ্লব করার জন্য একটি স্কয়ার প্রয়োজন। পাকিস্তান আমলে প্রথমে আর্মানিটোলা ময়দান, পরে পল্টন ময়দান ছিল গণসমাবেশ-জনসভা করার উন্মুক্ত জায়গা। আরো বিশাল সমাবেশ করার জন্য ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। আমাদের অদূরদর্শী রাজনীতিবিদেরা সব উন্মুক্ত স্থান বন্ধ করে দেয়। এরশাদ পল্টন ময়দানের কাছে এক ফালি জায়গাকে ‘মুক্তাঙ্গন’ করে বলেছিলেন, এ জায়গাটি লন্ডনের হাইড পার্কের মতো উন্মুক্ত। যে কেউ তার ইচ্ছে মতো বক্তব্য রাখতে পারবে। সে জায়গাটুকু এখন উন্মুক্ত নয়, মাইক্রোবাসের স্ট্যান্ড সেটি। বক্তৃতা দেয়ার জন্য পুলিশের অনুমতি লাগে। সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে মামলায় পড়তে হয়। শাহবাগের অর্জন হচ্ছেÑ দেশে একটি স্কয়ার থাকা প্রয়োজন, তা অনুভব করা গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকাল থেকে আজ অবধি দেশে দু’টি ধারা চলছে। প্রথমটি ধর্মীয় ধারাÑ যারা ইসলামপন্থী ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী; দ্বিতীয়টি হচ্ছেÑ ধর্মহীন, ইসলামবিদ্বেষী ও ধর্মনিরপেতাবাদী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধর্মহীন, ইসলামবিদ্বেষী ও ধর্মনিরপেতাবাদীরা ইসলামপন্থী বা মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের রাজাকার বলে অভিহিত করে আসছে। শাহবাগ থেকে দেশকে রাজাকারমুক্ত করার ঘোষণা এসেছে। দেশকে রাজাকারমুক্ত করার নেপথ্যে আছে ইসলামপন্থী বা মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদেরকে দেশ থেকে নির্বাসনে পাঠানো। মূল টার্গেট হচ্ছে ইসলামকে বিতাড়িত করা। শাহবাগের অর্জন হচ্ছেÑ দেশকে রাজাকারমুক্ত করার নামে স্কুল-কলেজ থেকে জোর করে সমাবেশে নিয়ে কোমল শিশু-কিশোরদেরকে ইসলামবিদ্বেষী করার সুযোগ পেয়েছে।
শাহবাগকে সামনে রেখে কেউ কেউ সীমানাহীন দেশের স্বপ্ন দেখেন। কবীর সুমনদের (যার পূর্বে নাম ছিল সুমন চট্টপাধ্যায়) মতো অনেকেই গান গেয়ে সীমানা না চিনেই চলে এসেছেন শাহবাগে। শাহবাগে যোগদানকারীদের অনেকের পিতা, ভাই বা নিকটাত্মীয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন, আর তাদের মতোই কবীর সুমনের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমীনও একজন রাজাকার ছিলেন। ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পীর মধ্যে তিনিও একজন যারা পাকিস্তানের পে বিবৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। নতুন প্রজন্মের আন্দোলনকারীদের সুযোগ এসেছে তার পিতা, পিতামহ, মাতামহ বা অন্য নিকটাত্মীয়রা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের শরণার্থী শিবিরে কেন যাননি, কেন তারা পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করেছেন, তা জানার। শেখ মুজিব যেমন সীমানাহীন সুবে বাংলার স্বপ্ন দেখতেন, কবীর সুমনের গান আমাদেরকে সীমানাহীন সুবে বাংলার স্বপ্ন দেখার সুযোগ এনে দিয়েছে।
শেখ মুজিবকে বিসর্জন দিয়েছে শাহবাগ। আন্দোলনকারীরা শেখ মুজিবের জায়গায় সচেতনভাবেই জাহানারা ইমামকে স্থাপন করেছে। শেখ মুজিবকে বিসর্জন দেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছেÑ তিনি পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের মা করে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ মার আওতায় সব সহযোগীকে মুক্তি দিয়ে দেশ গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন।
১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন প্রণয়ন করা হয়। শেখ মুজিবের আমলে দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা মিলে এ আইন প্রণয়ন করেন। শাহরিয়ার কবির তার বই ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার : প ও বিপ’র ভূমিকায় লেখেন, ‘এ আইন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের েেত্র আইনশাস্ত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করবে, কারণ এর আগে কোনো দেশ গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য এ ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ মৌলিক আইন প্রণয়ন করতে সম হয়নি।’ স্বয়ংসম্পূর্ণ মৌলিক আইনটিতে ‘মৌলিক’ সংশোধন আনা হয় ২০০৯ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে। একই বিবেচনায় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস বিধিমালা প্রণয়ন ও যখন যেভাবে প্রয়োজন, সেইভাবে সংশোধন আনা হচ্ছে। আবদুল কাদের মোল্লাকে কাদের কসাই সাজিয়ে বিচার করার পরও বিচারকদের বিবেচনায় তাকে ফাঁসি দেয়া সম্ভব না হওয়ায় ‘বিচার চাই না, ফাঁসি চাই’ আন্দোলন শুরু হয়। শাহবাগে ব্লগারদের এ জমায়েতের কাছে আওয়ামী লীগ নতি স্বীকার করে। তাদের ইচ্ছে অনুসারে “স্বয়ংসম্পূর্ণ মৌলিক আইন’টিতে আবারো ‘মৌলিক’ সংশোধন আনা হয়। সুলতানা কামাল বলেন, ‘চাপ প্রয়োগে রায় সমাজের জন্য ভালো নয়” (আমার দেশ, ১৫.০২.২০১৩)। শাহবাগের আন্দোলন থেকে আমাদের অর্জন হচ্ছে রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করে বিচার বদলানো যায়, পছন্দ মতো রায় প্রাপ্তির অনুকূলে আইন বদলানো যায়।
শাহবাগের অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, দেশ ও জাতি কিছু নব্য রাজাকারের সন্ধান পেয়েছে। বঙ্গবীর আবদুুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম সত্য কথা বলার অপরাধে আজ রাজাকার। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমান, পিয়াস করিম, আসিফ নজরুলদেরকেও রাজাকার উপাধি দেয়া হয়। আ স ম আবদুর রব আর মাহমুদুর রহমান মান্না বর্তমান সরকারের সমালোচনা করার কারণে সমাবেশে তাদেরকে সংহতি প্রকাশ করার সুযোগ দেয়া হয়নি।
শাহবাগ হিন্দু মৌলবাদ ও মৌলবাদীদের উত্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ১৯১১ থেকে ২০১২-এ এক শতাব্দীতে ঢাকার মাটিতে হিন্দুদের দ্বারা যা করা সম্ভব হয়নি, তা-ই করা সম্ভব হয়েছে সেখানে। আজান-নামাজের সময় নাচ-গান-বাদ্য এ মাটিতে কখনোই সহ্য করা হতো না। হিন্দুদের কোনো কোনো বাড়াবাড়ি সহিংস রায়টে রূপ নিয়েছে। শাহবাগে অবলীলাক্রমে আজান-নামাজের সময় নাচ-গান-বাদ্য করা সম্ভব হয়েছে। এ আন্দেলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের বেশির ভাগই হচ্ছেন হিন্দু। তারা হচ্ছেন অজয় রায়, ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, ঈশ্বর, বাপ্পাদিত্য বসু, ভাস্কর সাহা, সঞ্জয় রায়, জয়তু বড়–য়া, গৌর বর্মন, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, শুভ আরো অনেকে। এ জাগরণে ভারতীয় হিন্দুরা উল্লসিত। প্রতুল মুখোপাধ্যায় ‘পবিত্র শাহবাগে, তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে এখনও ইচ্ছা জাগে’ গানের কলি লিখে ও গেয়েই ান্ত হননি, শঙ্খ ঘোষ, ড. পবিত্র সরকার, দ্বিজেন বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে আরো বড় কিছু করার আশা করছেন। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন ভারতের বিদ্যুৎ কুমার দেবনাথ, গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সত্যম রায় চৌধুরী, শাওলী মিত্র, শুভা মিত্র, জয় গোস্বামীর মতো শিাবিদ, কবি, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা।
লাকি আক্তার, মুক্তা বাড়ৈ, প্রগতি বর্মন তমা, প্রীতিলতা, সুস্মিতা রায় সুপ্তি, আলিস, নওরোজ, অনিন্দা, তানিয়া, সবিতা সরকার মনি, জয়শ্রী রায়, সুমনা, আঁখি ও আমেনা আক্তার রিমার মতো ১৪ জনকে বারুদকন্যা-অগ্নিকন্যা উপহার দিয়েছে শাহবাগ। গত শতকের ষাট দশকের একমাত্র অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী যিনি ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন’ তিনি এখন আওয়ামী বুর্জোয়া দলে মিশে তার সে খেতাব হারিয়েছেন। শোনা যায় অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী নতুন খেতাবপ্রাপ্ত অগ্নিকন্যা লাকি আক্তারের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা তার মাথায় আঘাত করান।
নতুন প্রজন্ম ‘বাকশাল’ দেখেনি। তখন স্লোগান ছিলÑ ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’। তিনি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সব রাজনৈতিক দল, সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে কায়েম করেন বাকশাল। রীবাহিনী, লালবাহিনী, সেচ্ছাসেবক বাহিনী দিয়ে ভিন্ন মতের মানুষদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা ‘নতুন প্রজন্মের বাকশালী’ হিসেবে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম ও দিগন্ত টিভিসহ তাদের মতের বাইরের সংবাদমাধ্যমের কর্মীদেরকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিদিন আমার দেশ ও নয়া দিগন্ত পোড়ানো, ওইসব গণমাধ্যমের অফিসে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ করাও হচ্ছে। সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, ‘এ দেশ আওয়ামী লীগ স্বাধীন করেছে, আওয়ামী লীগই শুধু এ দেশে থাকবে।’ নতুন প্রজন্ম প্রকাশ্যে স্বাধীনতা হরণের বাকশালী আচরণ দেখতে পেল শাহবাগে। আর জানতে পারল দেশে আর কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না, থাকবে শুধু বাকশাল।
শাহবাগের বিরাট অর্জন হচ্ছেÑ বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের প্রশাসন বিভাগের হাতে বন্দী হয়েছে। বিচার বিভাগের অবস্থা বিশ্লেষণ করে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘বিচার বিভাগ স্বাধীন কিন্তু বিচারকেরা নন।’ (প্রথম আলো, ১২.০৬.২০১২)। আবদুল কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষণার পর সংসদে জাসদের মঈনুদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘এ ইস্যুটি সমঝোতাযোগ্য নয়। অসমঝোতামূলক একটি বিষয় নিয়ে সমঝোতা করা হচ্ছে’ (দৈনিক যুগান্তর, ০৬.০২.২০১৩)। তার ও অন্যদের বক্তব্য অনুসারে ধরা যায়, সরকার এ বিষয় নিয়ে সমঝোতা করেছে, বিচারকগণ নন। কিন্তু রায়টি সরকার দেয়নি, দিয়েছেন বিচারকগণ। আর সরকার বিচারকগণকে দিয়ে এ রায় দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, বিচারকগণ সরকারের কথা শুনে এ রায় দিয়েছেন। বিচারকগণ চোখ খোলা রাখবেন না, কানাও হবেন নাÑ হবেন অন্ধ। সুপ্রিম কোর্টে অন্ধ মূর্তিটিই তার প্রমাণ। নিজের জানা, বিশ্বাস, মতাদর্শ বা অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হওয়ার পরিবর্তে স্যা-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারকগণ আদেশ দেবেন। এ শপথই তারা করেন। তারা মঞ্চের অভিনেতা নন যে, পরিচালক যেভাবে বলবেন সেভাবেই তিনি অভিনয় করবেন, প্রোম্পটার যা বলবেন তা-ই তারা আওড়াবেন। কাদের কসাইয়ের বিচারের নামে আবদুল কাদের মোল্লাকে আসামি করে তদন্তকারী দল ও প্রসিকিউশন মিথ্যার বেসাতি করেও ফাঁসির আদেশ না হওয়ায় ‘বিচার চাই না, ফাঁসি চাই’ ধরনের স্লেøাগান ট্রাইব্যুনালকে অকার্যকর করে তোলে। তাই ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের পদত্যাগ করা উচিত।
৬ মার্চ ২০১৩ থেকে সব গণমাধ্যমে শাহবাগ-শাহবাগ আলোচনা। এর সাথে বুঝে না বুঝে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কারণে সচেতন মানুষ এ ‘শাহবাগ’ ক্রেজে জড়িয়ে পড়ে। শাহবাগকে প্রজন্ম চত্বর, গণজাগরণ চত্বর, প্রাণভোমরা, বাংলাদেশের তাহরির স্কয়ার প্রভৃতি নাম দেয়া হয়েছে। শাহবাগে লাখো মানুষ দেখে ভেবেছেন সতেরো কোটি মানুষ সেখানে জমায়েত হয়েছে। শাহবাগ ক্রেজের বাইরে অনেকে শাহবাগকে ১৭৫৭ সালের পলাশীর আমবাগের (শুদ্ধ করে আম্রকানন বলা হয়) সাথে তুলনা করেছেন। পলাশীর আমবাগে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয়েছিল, ইংরেজদের শাসন আর হিন্দুদের দ্বারা নিপীড়ন ১৯০ বছর মুসলিমদেরকে সহ্য করতে হয়। সূর্যাস্ত আইনের মাধ্যমে মুসলমানদের জমিজিরাত সে দিন হিন্দুদের হাতে চলে গিয়েছিল, আজ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের মাধ্যমে আবারো হিন্দুদের হাতে জমিজিরাতের মালিকানা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
শাহবাগকে কেন্দ্র করে এইচ টি ইমাম, সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. জাফর ইকবাল, ড. আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, গোলাম মুর্তজা, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সৈয়দ শামসুল হকসহ পরিচিত অনেক বুদ্ধিজীবী সমবেত হন। আরবিতে বুদ্ধিজীবীদেরকে বলা হয় ‘আবুল হাকাম’। রাসূলের যুগে ওমর ইবনে হিশামকে (দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব নন) ডাকা হতো ‘আবুল হাকাম’। তিনি এত বুদ্ধি নিয়েও আল্লাহকে চিনতে পারেননি বলে আল্লাহ তার পরিচিতি বদলে দিয়েছিলেন। তাকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘আবু জাহেল’ হিসেবে; আর পৃথিবীর সব মানুষই তাকে এ নামেই জানে।
শাহবাগ ক্রেজে দেশের কিছু রাজনৈতিক নেতার হীনম্মন্যতা প্রকাশিত হয়। ৭৭ জন সংসদ সদস্য এর পূর্বাপর বিবেচনা না করেই তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। আওয়ামী লীগের পুরো নেতৃত্বই শাহবাগ ক্রেজে আত্মসমর্পণ করে। বিএনপির কিছু নেতা ক্রেজে আত্মসমর্পণ করার প্রাক্কালে রাজীবদের আল্লাহ ও রাসূল সা: বিরোধী ব্লগ প্রকাশিত হয়ে পড়লে, তা থেকে তারা বিরত হন। ইসলামপ্রিয় মানুষেরা প্রথম থেকেই শাহবাগ বর্জন করেন।
শাহবাগ ক্রেজ দেশের বিচারব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনেছে, হাতে শিকল পরিয়েছে বিচারকদেরকে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কোনো মামলার বিচার নিষ্পত্তি করার জন্য ৯০ দিন সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু আপিল আদালতের ওপর কোনো সময়সীমা সামরিক সরকারও বেঁধে দিতে পারেনি। হাইকোর্টকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হলেও তাকে ফেরত এনেছে সুপ্রিম কোর্ট। এবার শাহবাগের তরুণ তুর্কিদের কাছে সংসদ এতটাই নতি স্বীকার করে যে, দেশের সুপ্রিম কোর্টকেও হাত-পা বেঁধে বিচার করার নির্দেশ দিয়েছে। দেশের মানুষ দেখতে চায় সুপ্রিম কোর্ট সরকারের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে পারে কি না। মানুষ বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। মানুষ দেখতে চায় বন্দী বিচারকেরা শাহবাগ বর্জন করেছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads