শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০১৩

বাংলাদেশকে ভারতের ইচ্ছাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছে সরকার



মেয়াদের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে যাওয়ায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতা এবং পারফরমেন্সের নানাদিক নিয়ে আলোচনা জমে উঠতে শুরচ করেছে। প্রসঙ্গক্রমে ভারত এসেছে বিশেষ গুরচত্বের সঙ্গে। কারণ, বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বলতে শুধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককেই বোঝায়। কিন্তু পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, সবে ধন নীলমণি এই দেশটির সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক সকল বিষয়ে বাংলাদেশ কেবল পিছিয়েই পড়েছে। প্রমাণিত হয়েছে, অতীতের মতো বিগত সোয়া চার বছরেও ভারত শুধু নিয়েছেই। এখনো সে নেয়ার ও ইচ্ছাপূরণ করার তথা নিজেরটা কড়ায়-গন্ডায় আদায়ের ব্যাপারেই ব্যস্ত রয়েছে দেশটি। শেখ হাসিনার সরকারও বাণিজ্য থেকে ট্রানজিটের আড়ালে করিডোর পর্যন্ত একের পর এক প্রতিটি বিষয়ে কেবল উজাড় করে দিয়ে চলেছে। সরকার একই সঙ্গে বাংলাদেশকে ভারতের ইচ্ছাধীন রাষ্ট্রেও পরিণত করে ফেলেছে। এ প্রসঙ্গে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা কাঠামোগত চুক্তির উলে­খ করা যেতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ‘ঐতিহাসিক’ সফরের সময় স্বাক্ষরিত এ চুক্তির পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে আসলে সর্বাত্মকভাবেই ভারতের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। এই চুক্তি ১৯৭২ সালের ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তির চাইতেও ভয়াবহ। আগের চুক্তিতে তবু ২৫ বছরের মেয়াদ ছিল, যার পর চুক্তি বহাল রাখা না রাখার অধিকার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কাঠামোগত চুক্তিতে কোনো মেয়াদের উলে­খ রাখা হয়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশ কখনো এই চুক্তি বাতিল বা অকার্যকর করার সুযোগ পাবে না। সে অধিকারই চুক্তিতে দেয়া হয়নি। চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সকল দিক থেকেই বাংলাদেশকে গোলামির জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলেছে ভারত। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়েও বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে এমনকি সামরিকভাবেও জড়িয়ে পড়তে হবে। যার ফলে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যুদ্ধ বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসতে পারে।
কাঠামোগত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও ভারতকে অনুসরণ করতে হবে। এমন কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখতে ও বাণিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে লেনদেন করতে পারবে না, যার সঙ্গে ভারতের শত্রচতা রয়েছে। বিষয়টি গুরচত্ব অর্জন করেছে বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে ঐতিহাসিক দু-একটি তথ্য স্মরণ করা দরকার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের কোনো সমরাস্ত্র পেতে পারেনি। সমর্থন দেয়ার সুযোগ নিয়ে যুদ্ধের পরপর ভারতের সেনারা পাকিস্তানীদের সমুদয় সমরাস্ত্র লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর হিসাবে এসব সমরাস্ত্রের দাম ছিল প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। সশস্ত্র বাহিনীর হাতে কোনো অস্ত্রই ছিল না। অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল গণচীন। বস্ত্তত গণচীনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। গাজীপুরস্থ সমরাস্ত্র কারখানায় অস্ত্র তৈরির মাধ্যমে তো বটেই, রফতানির পথেও গণচীনই বাংলাদেশকে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিয়ে চলেছে। ট্যাংক থেকে যুদ্ধ বিমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি সমরাস্ত্র এসেছে গণচীন থেকে। অর্থাৎ গণচীনের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
এমন বিশে­ষণের ভিত্তিতে বলা যায়, ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট বা কাঠামোগত চুক্তির ফলে চীনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত সুসম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হবে। চীন ও ভারতের দ্বন্দ্বমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই, নিজের সমরাস্ত্রের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে চীনের সতর্কতাও একটি বড় কারণ হয়ে উঠবে। চীনের সন্দেহ থাকবে, আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে ভারত চীনের সামরিক প্রযুক্তি চালান করে নিয়ে যাবে- যা চীনের মতো পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে, চীন এমনকি সামরিক সহযোগিতা বন্ধও করতে পারে। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে- যার অর্থ, বাংলাদেশ আসলে ভারতের অধীনস্থ হয়ে পড়বে।
সীমান্ত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। মনমোহন সিং-এর সফরকালে অমীমাংসিত ও অপদখলীয় ভূমি উদ্ধারের ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে বলে যে কল্পকাহিনী সরকার শুনিয়েছে  বাস্তবে দেখা গেছে তার উল্টো রকম। যেমন বাংলাদেশকে মাত্র ৩৫৭ একর জমি দিয়ে আসাম পেয়ে গেছে ১২৩৯ একর জমি। এজন্য শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরচণ গগৈ। উলফাসহ আসামের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরচদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা ও সমর্থনের জন্যও তরচণ গগৈ ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন শেখ হাসিনাকে। বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের আরেক রাজ্য মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী ড. মুকুল সাংমা জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে ৪১ একর জমি দেয়ার বিনিময়ে মেঘালয় পেয়েছে ২৪০ একর। তিনিও শেখ হাসিনাকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন! ওদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশীদের হাজার হাজার একর জমির মালিকানা নিষ্পত্তি না করেই বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতীয়দের এই কর্মকান্ডকে বন্ধুসুলভ বলার উপায় নেই। কারণ, সীমান্ত ঘেঁষে এভাবে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। বড়কথা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশীদের এমন কয়েক হাজার বিঘা জমি রয়েছে যেগুলোর মালিকানার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। একই অবস্থা ছিটমহলগুলোর ক্ষেত্রেও। এভাবেই সীমান্ত সমস্যার ‘সমাধান’ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার! উলে­খ্য,  বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের ব্যাপারে মন্ত্রীদের পাশাপাশি জাতীয় সংসদকেও কিছুই জানানো হয়নি। এমনকি মনমোহন সিং আসার ঠিক আগেরদিন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকেও কোনো চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকের খসড়া উপস্থাপন করা হয়নি। অর্থাৎ মন্ত্রীদের পর্যন্ত এসব বিষয়ে আস্থায় নেয়া এবং জানতে দেয়া হয়নি। অথচ, সংবিধানের নির্দেশনা হলো, জাতীয় স্বার্থ সংশি­­ষ্ট যে কোনো বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে চুক্তির খসড়া সংসদে পেশ করতে হবে, পাস করিয়ে নিতে হবে। ভৌগোলিক নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত থাকলে বিষয়টি সম্পর্কে জনমত যাচাই ও গণভোট আয়োজন করারও নির্দেশনা রয়েছে। অন্যদিকে মহাজোট সরকার সংসদে যেমন যায়নি তেমনি ধারে-কাছে ঘেঁষতে দেয়নি সংশি­­ষ্ট মন্ত্রীদেরকেও। সব মিলিয়েই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, বিরোধী দলের প্রচারণা অসত্য নয়- আসলেও ভারতের স্বার্থ হাসিল করে দেয়ার শর্তেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়েছিল।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যসহ এসব বিষয়ে যাওয়ার আগে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য জানিয়ে রাখা দরকার। সে তথ্যটি হলো, শেখ হাসিনার সরকার ভারতের স্বার্থ উদ্ধারে যতো আন্তরিকতার সঙ্গেই ভূমিকা পালন করচক না কেন, ভারত কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই আনুগত্যের বিনিময়ে ‘বন্ধুরাষ্ট্রসুলভ’ ব্যবহার করেনি। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের কোনো দাবি বা আবদারই পূরণ করেনি। প্রাসঙ্গিক অসংখ্য উদাহরণের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ভারতীয়দের কৌশলের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দাবি বা আবদার জানানোর প্রস্ত্ততি নেয়া মাত্র ভারতীয়রা এমনভাবেই আগে আক্রমণের কৌশল নিয়েছেন যাতে শেখ হাসিনার সরকার কোনো দাবি বা আবদার জানানোর চিন্তাও না করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ সফরে আসার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর একটি মন্তব্যের উলে­খ করা যায়। সেবার অর্থাৎ ২০১১ সালের ২৯ জুন নয়াদিলি­তে সিনিয়র সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকে মনমোহন সিং বলেছিলেন, বাংলাদেশে ‘যে কোনো সময়’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটতে পারে। কিভাবে বা কারা এই পটপরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করবে বা করছে সে প্রশ্নের উত্তরে না গিয়ে পরের নিঃশ্বাসেই মনমোহন সিং বলেছিলেন, বাংলাদেশের অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং তারা তীব্র ভারতবিরোধী। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকেও টেনে এনেছিলেন মনমোহন সিং। বোঝাতে চেয়েছিলেন যেন আইএসআই-এর সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী ‘পটপরিবর্তন’ তথা শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে!
অন্যদিকে অমন অনুমান আসলে মোটেও সত্য ছিল না। কারণ, জামায়াতের প্রতি সত্যিই ২৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন থাকলে যতো ‘ডিজিটালই’ হোক না কেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অন্তত ক্ষমতায় আসতে পারতো না। তাছাড়া জামায়াতের সঙ্গে দেশের প্রধান দল বিএনপিও ছিল। এই বাস্তবতা সত্ত্বেও মনমোহন সিং যেহেতু বাংলাদেশে আসার ঠিক প্রাক্কালে বলেছিলেন সেহেতু তার কথাটা নিয়ে পর্যালোচনাও যথেষ্টই হয়েছিল। মূলকথার বিশে­ষণে দেখা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি ‘ধমক’ দিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, কথা না শুনলে কিংবা কোনো বিষয়ে ঘাড় বাঁকাতে চাইলে শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। এখানেই ছিল প্রকৃত হিসাব-নিকাশের ব্যাপার। কারণ, লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের অজুহাতে ১/১১ ঘটানো থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো এবং শেখ হাসিনার সরকারকে দিয়ে একের পর এক নিজের দাবি ও ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেয়া পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে ভারতই প্রধান ভূমিকা পালন করে এসেছে। এ প্রচারণাও রয়েছে যে, ভারতের ইচ্ছা ও পছন্দের বাইরে অন্য কোনো দল বা নেতার পক্ষে বাংলাদেশের ক্ষমতায় যাওয়া সহজে সম্ভব নয়। অর্থাৎ ‘পটপরিবর্তন’ যদি ঘটেও যায় তাহলে তার পেছনেও ভারতেরই প্রধান নির্ধারকের ভূমিকা থাকবে। সে কারণে মনমোহন সিং-এর কথার অর্থ দাঁড়িয়েছিল, কোনো কারণে শেখ হাসিনার সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে ভারত সম্ভবত অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য চিন্তাভাবনা করছে। ভারতকে সবকিছু দিয়ে দেয়ার জন্য শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যও গোপন করেননি মনমোহন সিং। সব মিলিয়েই তিনি ভয় দেখিয়েছিলেন বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
এই ভয় দেখানোর কারণও জানা গিয়েছিল ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন খবরে। যেমন ভারতের বিরচদ্ধে শেখ হাসিনার ক্ষোভ ও অভিমান সম্পর্কে জানাতে গিয়ে ৫ জুলাই কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছিল, নিজের জনপ্রিয়তা বিসর্জন দিয়ে এবং জাতির স্বার্থবিরোধী অবস্থানে গিয়ে সর্বতোভাবে সেবা করা সত্ত্বেও ভারতের নেতারা নাকি বিনিময়ে শেখ হাসিনাকে ‘কিছুই’ দেননি। আনন্দবাজার প্রসঙ্গক্রমে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার দিলি­ সফরকালে স্বাক্ষরিত যুক্ত ঘোষণার উলে­খ করেছিল। সেই থেকেই শেখ হাসিনা নাকি ‘ঘাড় বাঁকিয়ে’ রেখেছেন। মনমোহন সিং-এর সরকার অবশ্য বিকল্প পথেও পা বাড়িয়েছিল। উদাহরণ দেয়ার জন্য ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির একটি পদক্ষেপের কথা উলে­খ করা যায়। বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর উপলক্ষে ২০১০ সালের ৭ আগস্ট ঘণ্টা ছয়েকের ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। সেবার রীতিমতো জানান দিয়ে অনেক বেশি গুরচত্বের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তিন সিনিয়র নেতার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলেন তিনি। জেনারেল মইন উ’দের সময় শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করার কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ‘র‌্যাটস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা চার নেতার মধ্যে অসুস্থ আবদুর রাজ্জাক ছাড়া আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ ও সুরঞ্জিত  সেনগুপ্তর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের মাধ্যমে প্রণব মুখার্জি আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ধমক’ দিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা যদি কোনো কারণে ‘অবাধ্য’ হওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে ভারত তার ‘সেকেন্ড লাইন’কে কাজে লাগাবে। তেমন অবস্থায় নেতৃত্বে চলে আসবেন ‘র‌্যাটস’ নামে পরিচিত চার নেতা। ক্ষমতায় এলে সত্যি সত্যি শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করবেন তারা। সে সময় বিশেষ ইঙ্গিতসহকারে বলা হয়েছিল, প্রায় মাইনাস হয়ে যাওয়া নেত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে ভারতের সুনির্দিষ্ট ধারণা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে প্রণব মুখার্জির ‘ধমকে’ কাজও হয়েছিল। এজন্যই এত বড় একটি ‘ধমক’ খাওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে টু শব্দটি শোনা যায়নি। এর পরপর বরং ভারতীয়দের বাংলাদেশ সফরের ধুম পড়ে গিয়েছিল। একের পর এক ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এবং কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। কিছুদিনের মধ্যে ঢাকায় এসে ‘ফিনিশিং টাচ’ দিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন।
এভাবে ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করার পরই ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফরে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সে সময় মানুষের মুখে মুখে বেশি আলোচিত হয়েছিল তিস্তা চুক্তি। কারণ, মনমোহন সিং আসার প্রাক্কালে, ৩/৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্তও জনগণকে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে লম্বা অনেক কথা শুনিয়েছিলেন মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা। বলেছিলেন, এবার তিস্তা চুক্তি ‘হবেই’! দৃশ্যতও সবই ঠিকঠাক মতোই চলছিল। কিন্তু শেষ ধাক্কাটা মেরেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের ‘বাঙালী’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি- যাকে বাংলাদেশের বিশিষ্টজনেরা ‘দিদিমনি’ বলে ডেকে থাকেন। এই ‘দিদিমনি’ পরিকল্পিত চুক্তির বিরোধিতাই শুধু করেননি, একই সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে আসতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেছিলেন। কারণও জানিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, বাংলাদেশকে কতটা পানি দেয়া হবে সে বিষয়ে তার সঙ্গে নাকি ‘প্রতারণা’ করেছেন মনমোহন সিং। কথা নাকি ছিল বাংলাদেশকে ২৫ হাজার কিউসেক দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তির খসড়ায় ৩৩ হাজার কিউসেক দেয়ার কথা উলে­খ করা হয়েছিল। এতেই বেঁকে বসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। প্রণব মুখার্জি থেকে সোনিয়া গান্ধী পর্যন্ত সবাই চেষ্টা করে দেখেছেন। কিন্তু মমতাকে রাজি করাতে পারেননি। কারণ, তিস্তা তার কাছে তাদের রাজ্যের উত্তর বঙ্গের কৃষির জন্য ‘লাইফ লাইন’। মমতা ব্যানার্জি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি শেখ হাসিনা নন। এজন্যই তার রাজ্যের স্বার্থের প্রশ্নে এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাড় দেননি মমতা। প্রসঙ্গক্রমে গুরচত্বপূর্ণ হিসেবে আবারও সামনে এসেছিল ভারতীয়দের বাংলাদেশ নীতি। কারণ, বাংলাদেশের বিরচদ্ধে ভারত পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। বাংলাদেশের ওপারে তিস্তার ৪৫ কিলোমিটার উজানে ভারত এমন এক গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে যার ফলে কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ খুব একটা পানি পেতো না। ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর মাত্র ৪৫ কিলোমিটারের পানি ভাগাভাগি নিয়েই এত কিছু ঘটেছে। মমতা ব্যানার্জি ঘাড় না বাঁকালেও এবং সত্যি সত্যি কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ লাভবান হতে পারতো না। এর কারণ শুধু মোট পানির পরিমাণ নয়, ভারতীয়দের চাণক্য কৌশলও।
এই কৌশলের কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থে যা কিছু করছে ও করেছে সেগুলোর কোনোটিতেই বাংলাদেশের এক ক্ষতি ছাড়া লাভ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, লোক দেখানোর ব্যাপারে চাণক্য কৌশল নিয়ে অগ্রসরমান ভারতীয়রা এখনো অতুলনীয়। প্রসঙ্গক্রমে দু-একটি ‘ঐতিহাসিক’ তথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে নিশ্চয়ই নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার পড়ে না। এদেশের কোনো কোনো বিশিষ্টজনের পরম শ্রদ্ধেয় ‘দাদা’ তিনি। সে ‘দাদা’ই ২০০৭ সালে সিডরের ধ্বংসযজ্ঞের পর পাঁচ লাখ টন চাল রফতানি করা নিয়ে বাংলাদেশকে রীতিমতো ‘খেল’ দেখিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার অঙ্গীকারের ওপর বিশ্বাস করে উদ্দিন সাহেবদের অসাংবিধানিক সরকার অন্য কোনো দেশ থেকে চাল আমদানির চেষ্টা করেনি। এরপর বাংলাদেশ যখন খাদ্য সংকটের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক তখনই হঠাৎ কূটনীতির প্যাঁচ কষে প্রণব মুখার্জি জানিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে এত কম দামে এত বেশি পরিমাণ চাল রফতানি করা সম্ভব নয়। ফলে মহাবিপদে পড়ে গিয়েছিল উদ্দিন সাহেবদের সরকার। বাধ্য হয়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে সরকারকে চাল আনতে হয়েছিল। প্রণব মুখার্জিরা তাই বলে কথা মতো পাঁচ লাখ টন দেননি। দিয়েছিলেন মাত্রই এক লাখ টন। এতেই অবশ্য ভারতের নামে ধন্য ধন্য রব পড়ে গিয়েছিল!
দ্বিতীয় তথ্যটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সংক্রান্ত। সময়ে সময়ে আশ্বাস কম দেননি ভারতীয় নেতারা কিন্তু প্রতি বছর ঘাটতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বৃহৎ এ প্রতিবেশি দেশটি থেকে আমদানি লাফিয়ে বাড়লেও নানা ধরনের শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের রফতানি বাড়তে পারছে না। এ ব্যাপারে ভারতের নীতি ও কার্যক্রমকে ব্যবসায়ীসহ তথ্যাভিজ্ঞরা প্রতারণাপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ, প্রকাশ্যে আমদানি বাড়ানোর এবং ঘাটতি কমিয়ে আনার ঘোষণা দিলেও ভারত সুকৌশলে এমন কিছু শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্ক বাধার সৃষ্টি করে চলেছে যার ফলে রফতানির সম্পূর্ণ প্রস্ত্ততি নেয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ভারত থেকে নানা ধরনের অসংখ্য পণ্য আসছে বাংলাদেশে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো জানিয়েছে, ভারত থেকে যেখানে ২০৮৬ ধরনের পণ্য আসছে বাংলাদেশে সেখানে মাত্র ১৬৮ ধরনের বেশি পণ্য রফতানি করতে পারছে না। নিজেদের শিল্প সংরক্ষণের অজুহাত দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশের ৭৫০ ধরনের পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। ভারত সেই সাথে এমন ৪৫০টি পণ্যের জন্য ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যেগুলোর ৯৮ শতাংশই বাংলাদেশ উৎপাদন করে না। বৈধ বাণিজ্যের পাশাপাশি চোরাচালানের পথেও বিপুল পরিমাণ পণ্য ঢুকে পড়ায় ঘাটতি শুধু বেড়েই চলেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরের পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, ভারতের সঙ্গে শুধু বৈধ বাণিজ্যেই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এভাবে বাংলাদেশকে বিপুল ঘাটতির মধ্যে থাকতে হচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকেই। প্রসঙ্গক্রমে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর ঢাকা সফরের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৯৯ সালে ঢাকা-কোলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকায় এসে তিনি ২৫ ক্যাটাগরির বাংলাদেশী পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে ঘোষণার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সফরকালেও ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ার কথা শোনানো হয়েছিল। কিন্তু তারও বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের শত শত কোটি টাকার তৈরি পোশাকের বিল আটকে রেখেছে ভারতীয়রা।
এভাবেই দেশের সার্বভৌমত্বসহ বিভিন্ন প্রশ্নে দেশপ্রেমিক অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়িয়ে দেয়ার নামে দেশকে উল্টো ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ও পানি আগ্রাসন বন্ধ করার মতো বিভিন্ন প্রশ্নে দরকষাকষির যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকার কিন্তু এসব বিষয়ে উলে­খ করার মতো কোনো চেষ্টাই করেনি, করছেও না। সরকার ব্যস্ত রয়েছে একটি মাত্র কাজে- সেটা ভারতের ইচ্ছা পূরণ। এটাও আবার এমনভাবেই করা হচ্ছে যেন সবই আগে থেকে সরকারের এজেন্ডায় ছিল! বলার অপেক্ষা রাখে না, লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের আড়াল নিয়ে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল মইন উ’দের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় এসেছে বলেই আওয়ামী লীগ সরকার সর্বান্তকরণে ভারতের স্বার্থে পদক্ষেপ নিতে উঠে-পড়ে লেগে আছে। আপত্তি উঠতো না যদি বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয়দের নীতি-কৌশল ও মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবার কোনো সম্ভাবনা দেখা যেতো। কিন্তু তেমন কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। ভারতের মতো সম্প্রসারণবাদী দেশের দিক থেকে এমনটাই অবশ্য স্বাভাবিক। অন্যদিকে আফসোসের বিষয় হলো, ভারতের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলই যেখানে বাংলাদেশকে শোষণ করার ও ইচ্ছাধীন রাখার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকে, আওয়ামী লীগ সরকার সেখানে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপস তো করছেই, লজ্জার মাথা খেয়ে নিজেদের মাথাও নত করে বসেছে। এজন্যই ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। বিপন্ন হয়ে পড়ছে এমনকি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads