বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৩

চলমান রাজনৈতিক সংকট



দেশের চলমান রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সহিংসতা, সংঘাত-সংঘর্ষ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশে­ষক ও সুশীল সমাজসহ দেশপ্রেমিক মহলের তরফ থেকে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে অবিলম্বে সংলাপ শুরচ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাদের মতে দেশকে সরকার যেভাবে বিভক্ত করে ফেলছেন এবং এ বিভক্তির ফলে হিংসা, প্রতিহিংসা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে দেশের অস্তিত্ব এমনকি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বও বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং আত্মম্ভরিতা এবং অহংবোধকে প্রশ্রয় না দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকার এবং বিরোধী দলসমূহের  আলোচনায় বসা দরকার এবং এ আলোচনার উদ্যোগ সরকার পক্ষেরই নেয়া প্রয়োজন। দেশপ্রেমিক, সিনিয়র নাগরিক, সুশীলসমাজ ও রাজনৈতিক বিশে­ষকদের এই অভিমতের সঙ্গে আমরা একমত পোষণ করি।
বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিবসহ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ব্যাপক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন এবং তারা অবিলম্বে উভয়পক্ষের সংলাপের ওপর গুরচত্বারোপ করে এর সুরাহা কামনা করেছেন।
 আমরাও বিশ্বাস করি যে, চলমান সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও সহিংসতার নিরসন না হলে ১৬ কোটি মানুষের এই জনপদটি তার সকল কার্যকারিতা হারাবে এবং তা সভ্য মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই সংলাপ আদৌ সম্ভব কিনা এবং তাতে সরকার পক্ষ সততা ও নিষ্ঠার সাথে সম্মতি দিবেন কিনা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের কারণ বিশে­ষণ করলে দেখা যায় যে, এর পিছনে যত না বিরোধী দলের ভূমিকা রয়েছে তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি ভূমিকা রয়েছে সরকার ও সরকারি দলের। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বিরোধী রাজনীতি নির্মূলের অভিযান শুরচ করে এবং তার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য এই পথে বিরাজমান সকল কাঁটা দূর করার জন্য তারা ব্রতী হন। তারা তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রচতিতে জনকল্যাণমূলক যতগুলো কর্মসূচি গ্রহণের কথা বলেছিলেন তার সবগুলোই ভুলে যান। যেমন খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে আনা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সংকট নিরসন, সন্ত্রাস নির্মূল, দুর্নীতি দমন, পদ্মা সেতু নির্মাণ, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার, পুনর্বাসন, আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠা বেসামরিক ও পুলিশ প্রশাসনকে দলীয় প্রভাব মুক্তকরণ, রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠা এবং ঘরে ঘরে বেকারত্ব নিরসনের লক্ষ্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এ সবগুলো ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন এবং তার পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছেন। তাদের প্রথম শিকার ছিল গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্বের অধিকারী আমাদের সীমান্ত বাহিনী বিডিআর এবং তার নেতৃত্বদানকারী চৌকস সেনা কর্মকর্তারা। একদিনে আমরা আমাদের ৫৭ মেধাবী সামরিক কর্মকর্তাকে হারিয়েছি। সরকারি ও সেনাবাহিনীর তরফ থেকে পরিচালিত তদন্ত রিপোর্টে এই হত্যাকান্ডের পিছনের শক্তিকে চিহ্নিত করার জন্য বৃহত্তর পরিসরে তদন্তের সুপারিশ করা হলেও সরকার তা করেনি। অভিযোগ উঠেছে যে, সরকারের দুঃশাসন ও লুটপাটে সেনাবাহিনী যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সে জন্যই পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে। সরকার জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য সকল প্রকার রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে এ দলটির শীর্ষ, মধ্যসোপান এবং এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে আটক করে রেখেছেন। রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসে একাধিকবার পুলিশ হামলা করেছে এবং তল­vশির নামে জিনিসপত্র তছনছ করেছে এবং মূল্যবান সামগ্রী লুটপাট করে নিয়ে গেছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় মহানগরী এমনকি অনেক জেলা অফিস এখন তালাবদ্ধ। শিবিরের অবস্থাও তাই। জামায়াত-শিবির কর্মীদের কোন প্রকার দলীয় বৈঠক করতেও দেয়া হচ্ছে না। শীর্ষ জামায়াত নেতাদের বিরচদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে বিচার কাজ শুরচ করা হয়েছে। যে আইন ও প্রক্রিয়ায় বিচার চলছে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছে। মাওলানা সাঈদী ও কাদের মোল­vর বিচারের রায়ে সারাদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। জামায়াতের ওপর নির্যাতনের পাশাপাশি দেশের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির ওপরও সরকারি নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছে। পুলিশ এই দলটির নেতা-কর্মীসহ ১৮ দলীয় জোটকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন। সভা-সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকার তারা প্রয়োগ করতে পারেন না এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ৪ বছর ধরে মার খেয়ে খেয়ে তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মাঠে নেমেছেন। সরকারের নির্যাতনে সারাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়ার পর সারাদেশে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। শহর নগর নির্বিশেষে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গ্রাম-গঞ্জে পুরচষের পাশাপাশি হাজার হাজার মা-বোনেরাও  লাঠিসোঁটা ও ঝাড়ু নিয়ে সরকারের বিরচদ্ধে বিক্ষোভে নেমে আসে। সরকার এই বিক্ষোভ দমনের জন্য পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় এবং তারা বৃষ্টির মত গুলী করে তিন দিনেই দেড় শতাধিক লোককে হত্যা করে। বিরোধী দলের তরফ থেকে এই হত্যাকে গণহত্যা আখ্যায়িত করা হয় এবং এর বিরচদ্ধে হরতাল ও বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয়। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ বিক্ষোভে অংশ নেয় কিন্তু সরকার তার অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়ার ফলে দেশ অত্যন্ত দ্রচতগতিতে বৃহত্তর সংঘাতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, এই গণহত্যার জন্য সরকারের তরফ থেকে আজ পর্যন্ত কোন প্রকার দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি এবং দায়ী ব্যক্তিদের সনাক্ত করার লক্ষ্যে কোন প্রকার তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি। তারা শাহবাগ ও দেশের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চ বানিয়ে দলীয় ক্যাডার ও নাস্তিক ব­গারদের দিয়ে বিরোধী দল ঠেকানোর লড়াইয়ে ওয়ার্মিং আপের কাজ শুরচ করেন। অতি সম্প্রতি ১৮ দলীয় জোটের বিক্ষোভসমাবেশে পরিকল্পিতভাবে বোমাবাজি করে বিএনপি ও জোটের দেড় শতাধিক শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিএনপির অফিসের দরজা ভেঙে সেখানে ঢুকে আসবাবপত্র তছনছ এবং আলমারি ভেঙ্গে নগদ অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়। গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে পুলিশের এ ধরনের হানা কল্পনা করা যায় না। এর প্রথম শিকার হয়েছিল জামায়াত-শিবির, এখন হল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বর্তমানে উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর হয়ে উঠছে। আবার সরকারের ক্ষমতালিপ্সা দেশকে অনিশ্চয়তার দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। দীর্ঘ আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে দেশে যে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা সরকার বাতিল করে দিয়ে আরেকটি সংঘাত ও সংঘর্ষের পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এখন যদি দেশকে রক্ষা করতে হয় তাহলে সরকারকে সকল রাজবন্দিকে মুক্তি এবং তাদের বিরচদ্ধে রচজু করা বিচারাধীন ও বিচারের অপেক্ষাধীন সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। যে আইনে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে দেশ-বিদেশে তার ওপর কারোরই আস্থা নেই। এ অবস্থায় আইন সংস্কার ও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দেশী-বিদেশী আইনজ্ঞ এবং বিচারকদের নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা দরকার এবং অভিযুক্তদের সকল প্রকার মৌলিক অধিকার প্রত্যর্পণ করা প্রয়োজন। যাদের বিচার হয়ে গেছে সরকার তাদের শাস্তি মওকুফ করতে পারেন অথবা পুনর্গঠিত আদালতে তাদের পুনর্বিচার হতে পারে বলে আমরা মনে করি। তৃতীয়ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করার নিশ্চয়তা হিসেবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহালে সরকারকে সম্মত হতে হবে। এই ন্যূনতম শর্তগুলো পূরণের ব্যবস্থা হলেই সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে বলে আমরা মনে করি। যারা দেশপ্রেমে বিশ্বাস করেন তারা সকল প্রকার জেদ পরিহার করে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads