শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০১৩

স্বাধীনতার পক্ষ -বিপক্ষ বিভাজন চক্রান্তের অন্তরালে



ফেব্রুয়ারীর ইতিহাস বড়ই মর্মান্তিক ও বেদনার ইতিহাস। ১৯৫২ সালের এই ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের দাবিতে গুলীতে নিহত হয়েছিলেন ৫ তরুণ মুসলমান। সমস্ত গ্রাম বাংলায় করুণ সুর উঠেছিল- ‘ওরে ভাই বাংগালী, ঢাকার শহর রক্তে ভাসালি।’ এরপরে পাকিস্তানী শাসনামলের ২৪ বছরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশের গুলীতে নিহতের সংখ্যা ছিল দু’ ডজনের কম। পরবর্তীতে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে  ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের এক সমাবেশে পুলিশ গুলী চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করেছিল। তবে অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসনকাল ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। সে দিন এবং পরের দিন এক চক্রান্তের শিকার  ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। সে রক্তের দাগ না মুছতেই মুসলিম বিশ্বের গর্ব ইসলামী আন্দোলনের উজ্জ্বল প্রতীক আলেমে দীন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মিথ্যা মামলায দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশে দ-িত করা হল।
সে রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গোটা দেশের  তৌহিদী জনতা রাস্তায় নেমে পড়ল। আর সেই উত্তাল জনস্রোতের কণ্ঠ নীরব নিস্তব্ধ করে দিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি সরকার দলীয় গু-া ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলীতে নিহত হয়েছে প্রায় ৭০ জন নিরীহ জনতা। জনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে প্রতিদিন নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে গুলীবিদ্ধ করে নিহত করা হচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে আলেমে দীন, কচি শিশু-কিশোরসহ সাধারণ মানুষ। এ সব নিরস্ত্র নিরীহ জনতা নাকি আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত সরকারি পুলিশ বাহিনীর উপরে আক্রমণ চালাচ্ছে; আর পুলিশ নাকি আত্মরক্ষার্থে এদেরকে গুলী করে মারছে। কী অদ্ভুত মিথ্যা প্রোপাগান্ডা। এ প্রোপাগান্ডা যে  নির্জলা মিথ্যা তার সত্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে টিভি পর্দার দিকে তাকালে। অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ পাখি শিকারীদের মতো ঈমানের বলে বলীয়ান প্রতিবাদকারী নিরস্ত্র জনতাকে নিশানা করে গুলী চালাচ্ছে। আর হায়েনার মত ওরা নিহত বনী আদমের লাশগুলো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। হায়রে নির্মমতা, হায়রে বর্বরতাÑ যা সমস্ত দেশের ও কালের অতীতের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের দাবি এ নারকীয় হত্যাকা- নাকি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া গেল, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের উপর দিয়ে অতীত হল প্রায় ৪২ বছর। এ দীর্ঘ সময় দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কোন প্রয়োজনীয়তা কেউ ভাবেনি। কিন্তু হঠাৎ করে আজ কেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ সেøাগানে বাংলার বাতাসকে কলুষিত ও ভারি করে তোলা হচ্ছে  তা জাতিকে বড্ড ভাবিয়ে তুলছে।
জাতির জন্য বড়ই দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরেও স্বাধীনতার পক্ষ -বিপক্ষ বিভাজনটি আজ পর্যন্ত গেল তো না-ই বরং স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে এই বিভাজন যেন আরও দিন দিন জোরদার হচ্ছে। স্বাধীনতার পক্ষের দাবীদারেরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলাম বিরোধী যুদ্ধ বা ইসলাম বিরুদ্ধ প্রয়াস হিসাবে জাতির সামনে তুলে ধরবার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন জোরদার করার চেষ্টা চালান হচ্ছে তাদের জাতিকে দ্বিধা বিভক্তির অপপ্রয়াস। কিন্তু কেন?- জাতির কাছে এ প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ ভেদ রেখা মুছে ফেলার জন্য বঙ্গবন্ধু স্বয়ং ১৯৭৩ সালের ৩০শে নভেম্বর স্বাধীনতার বিপক্ষ অবস্থানকারীদেরদের মধ্য থেকে দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন সকল ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তারই ব্যক্তিগত নির্দেশে সকলকে এক সপ্তাহের মধ্যে তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে তাঁর সাধারণ ক্ষমার উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করে তিনি  বলেন , “ আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা ‘দালাল’ আইনে অভিযুক্ত ও দ-িত হয়েছিলেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে।  দেশের নাগরিক হিসাবে স্বাভাবিক জীবন যাপনে আবার সুযোগ দেয়া হয়েছ। আমি বিশ্বাস করি, অন্যের প্ররোচনায় যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং হিংসার পথ গ্রহণ করেছেন, তারা অনুতপ্ত হলে তাদেরও দেশ গড়ার সুযোগ দেয়া  হবে।”
একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা হয়তোবা গ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমা জগতের  কাছ থেকে।  তিনি দেখেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে ও যে সব দেশে জার্মানরা তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করেছিলÑ ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও স্পেন সহ যেসব রাষ্ট্র বা দেশ তাদের দখলে নিয়েছিল, সে সব দেশের মানুষেরা কী ভূমিকা পালন করেছিল এবং পরবর্তী পর্যায়ে যখন জার্মানীর দখল মুক্ত হয় এই সমস্ত দেশ। সে সব দেশে তারা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে কোন বিভাজনের উদ্ভব ঘটায়নি, তারা সেখানে স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ বলে কোন অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করেনি। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় খেমারুজরা মহাহত্যাযজ্ঞ চালাবার পরেও তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে কম্পুচিয়ায় ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের একটি নতুন রাজনীতি চালু করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন দূর করণের জন্য বাংলাদেশ আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবর রহমান যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন জাতি আশা করেছিল তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা সে পথ অনুসরণ করবেন। কিন্তু শেখ হাসিনার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁকে সে পথ থেকে বিরত রাখতে উদ্বুদ্ধ করল। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ গুলোকে চিহ্নিত করে সেই স্বার্থের পক্ষে এবং বিপক্ষে কারা কাজ করছে তার দিকে নজর না দিয়ে তিনি মেতে উঠলেন স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষে কারা তা খুঁজতে। এতদিন পরে এখন যাদেরকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রূপে চিহ্নিত করে মানবতা বিরোধিতার কাল্পনিক অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিতে ঝুলাতে প্রয়াস চালানো হচ্ছে তাদেরকে সাথে নিয়েই এক সময় তিনি তার গদি পাকাপোক্ত করার আন্দোলন করেছিলেন। সে সময় তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী তোহমত দিয়ে ট্রাইবুন্যালে সোপর্দ করা হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবারে ক্ষমতায় এসে উঠে পড়ে  লেগে গেল পুরাতন কাসুন্দি ঘেঁটে রাজনীতির ময়দানকে ঘোলা করতে। কিন্তু এ অপতৎপরতা এতদিন পরে আবার এখন কেন?
এর উত্তর বিভিন্ন জনে বিভিন্নরূপে দিয়ে থাকেন এবং দিতে পারেন, কিšুÍ একটি কারণ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তা  হলো ভারতের স্বপ্ন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে ভারত নির্ভরশীল করে টিকিয়ে রাখার জন্য খোদাদ্রোহী বাম ও সেকুল্যারপন্থী আওয়ামী লীগকে যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। আর এই চক্রান্ত হিসাবে তারা যুদ্ধাপরাধী ইস্যুকে নতুন করে উস্কিয়ে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি হিসাবে দাঁড় করিয়ে নতুন আর এক মুক্তিযুদ্ধের নামে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার আয়োজনে উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, ভারত সব সময় বাংলাদেশে একটি বিশৃঙ্খল ও অস্থিতিশীল অবস্থা দেখতে চায়। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের ও আই সি সম্মেলনে তাঁর যোগদান ভারতীয়দের অপছন্দনীয় ছিল। তাই সে কারণে মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্রের সকল তথ্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়রা মুজিবকে রক্ষার কোন চেষ্টা করেনি। ভারতীয় সূত্রমতে, জিয়াউর রহমানের হত্যার পেছনেও সক্রিয় ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। ঐ একই উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে দেশময় বিশৃংখলা সৃৃষ্টির উদ্দেশ্যে জামায়াত-শিবিরসহ গোটা তওহীদী জনতার বিরুদ্ধে শাহবাগীদেরকে লেলিয়ে দেয়া ও গোটা দেশময় নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পেছনে রয়েছে ভারতীয়দের চক্রান্ত; যা ঐ দেশের পত্রিকাই ফাঁস করে দিয়েছে।
ভারতীয়  সীমান্ত রক্ষীবাহিনী যখন সীমান্তে আমাদের নিরীহ  গরীব মানুষদেরকে প্রতিদিন হত্যা করে চলছে তখন এ সব অপকর্মের বিরোধিতা না করে বরং স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির অভিযোগে যখন তৌহিদী জনতাকে নিধন যজ্ঞে যারা উস্কানি দিচ্ছে তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে নির্বিঘেœ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে  শাহবাগের উচ্ছৃঙ্খল যুবক যুবতীদেরকে সুড় সুড়ি দিতে বাংলায় হাজির হচ্ছে। তাদের এ আচরণ বলে দিচ্ছে যে তারা বাংলাদেশের মানুষের শত্রু।
দেশের জনতাকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দাঁড় করাবার হীন চক্রান্ত হিসাবে তারা যে কৌশল গ্রহণ করেছে তা হয়তা বা কারও কাছে নতুন মনে হতে পারে কিন্তু তা মোটেই নতুন নয়। যারা বাংলাদেশকে ব্রাহ্মণ্যবাদ নির্ভরশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় তারাই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে এ দেশের রাজনীতি চর্চায় স্বাধীনতার সপক্ষ-বিপক্ষ বলে একটি বিভাজন রেখা তৈরী করার বীজ বপন করেছিল। সেই নির্মূল কমিটির সাথে জড়িত চক্রান্তকারীরা আওয়ামী লীগের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে হাসিনার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আবার অনেক দিন পরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে  স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষে জিগির তুলে নামাবলীর তলে লুকায়িত কৃপাণ বের করে আঘাত হানছে দেশের শান্তিপ্রিয় তৌহিদী জনতার পক্ষে। তারা স্পষ্ট ভাষায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসিকে  প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করে ইসলামী শক্তির উপরে বিজয় ঘোষণা দিচ্ছে। তাদের চক্রান্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অন্তরালে এ দেশ থেকে ইসলামী চেতনা ও শক্তির বিনাশ। চক্রান্তকারীরা হিন্দু জনগোষ্ঠীর চেতনা ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর চেতনার মধ্যে যে একটি বিরাট ভেদ রেখা রয়েছে তা মুছে ফেলার জন্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সাথে রাজনীতির অঙ্গনে আগ্রাসন চালাবার জন্য এবার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে শাহবাগী চক্র। শাহজালাল, খান জাহানের উত্তরসুরী ওলামা পীর মাশায়েখ ও  তৌহিদী জনতাকে এ আগ্রাসন রুখতেই হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads