মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৩

সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার এবং বাস্তবতা


ড. আবদুল লতিফ মাসুম

ক. মানুষ জন্মগতভাবেই কিছু অধিকার ধারণ করে। এ অধিকারগুলোকে মৌলিক অধিকার বলা হয়। প্রাচীনকালে এটি প্রকৃতিগত অধিকার বলে অভিহিত হতো। বিবর্তনের ধারায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল থেকে এটি প্রাণরস সঞ্চার করে। যেমন মদিনার সনদ-৬২২, ম্যাগনাকার্টা-১২১৫, বিল অব রাইটস-১৬৮৯, আমেরিকার মানবাধিকার সংযোজনে প্রথম সংশোধনী-১৭৯১, ফরাসি বিপ্লব ঘোষিত মানিবাধিকারের সনদ-১৭৮৯, বলশেভিক বিপ্লব-১৯১৭, জাতিসঙ্ঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা-১৯৪৮। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানবজাতির পার্লামেন্টে জাতিগুলো প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য কিছু অনিবার্য, অলঙ্ঘনীয় এবং অতি আবশ্যকীয় নীতিমালা ঘোষণা করে। তখন থেকে এটি আর কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়।
পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা লাখ লাখ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার হরণের ফলে সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশে সঙ্গতভাবেই মানবাধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভের পরপরই মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই যে সংবিধান গ্রহণ করে তাতে মানবিক মৌলিক অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু যখন সংবিধানের বিধিবিধান অনুযায়ী অধিকারগুলো থেকে নাগরিক সাধারণ উপকৃত হওয়ার প্রশ্ন আসে তখন দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। দলতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, ব্যক্তিতন্ত্রে সাংবিধানিক রক্ষাকবচগুলো হয়ে ওঠে অকার্যকর, অপ্রায়োগিক ও অবাস্তব। অনুচ্ছেদভিত্তিক চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বর্তমান বাস্তবতার আলোকে সংবিধানকে বোঝার জন্য এ সীমিত প্রয়াস।
সংবিধান পবিত্র দলিল। জনগণের অধিকারের পবিত্র আমানত। শাসনব্যবস্থায় যে ব্যক্তি বা দল আসীন হন না কেন সংবিধানের আলোকেই তাকে দেশ পরিচালনা করতে হয়। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের এসব দেশে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে। এসব দেশে জনসাধারণ সংবিধানে বর্ণিত তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কেও জ্ঞাত নয়। আমরা এই সময় এ দেশে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণের ন্যক্কারজনক পর্যায় অতিক্রম করছি। সে কারণে সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬ অনুচ্ছেদ থেকে ৪৭-এর ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বিস্তৃত মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করে দেখব সংবিধানে কী আছে আর সরকার কী করছে।
অনুচ্ছেদ ২৬-এ বলা আছে, মৌলিক অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য আইন বাতিল। সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘রাষ্ট্র এই ভাগ (মৌলিক অধিকার) এর কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’
অথচ বর্তমান ক্ষমতাসীন দল প্রথম মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করে শাসনতন্ত্রের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৩ জরুরি অবস্থা জারির বিধান অন্তর্ভুক্ত করে। মূল সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে নাগরিকের বিবেকের স্বাধীনতা বাতিলের কোনো বিধান ছিল না।
১৯৭৪ সালে মৌলিক মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগ সরকার কুখ্যাত বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে বিনা ওয়ারেন্টে, বিনা বিচারে যেকোনো নাগরিককে গ্রেফতার করার ক্ষমতা নিয়ে নেয়। পরবর্তীকালে সব দলের নির্বাচনী ঘোষণায় এই কালো আইন বাতিলের অঙ্গীকার থাকলেও কেউই আইন বাতিল করেনি। তার কারণ নাগরিক দলনের হাতিয়ার সবারই প্রয়োজন।
বর্তমান মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেশী-বিদেশী অনেক বিশেষজ্ঞের মতে সংবিধানের ওই মৌলিক ধারার পরিপন্থী।
অনুচ্ছেদ ২৭-এ বলা হয়েছেÑ ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। বাস্তবে কি তাই? বাস্তব হচ্ছে বিপরীত। বিবেকের আহ্বানে সভা সমিতি, সমাবেশ, বিক্ষোভ করার যে মৌলিক প্রাকৃতিক নাগরিক অধিকার ব্যক্তির রয়েছে তা নগ্নভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। একদল পুলিশ প্রহরায়, রাষ্ট্রের সহায়তায় মিছিল সমাবেশ করছে, অপর দল পোস্টার লাগানো, নিরুপদ্রব মানববন্ধনও করতে পারছে না। মসজিদে হামলা করছে পুলিশ। সমাবেশের কোনো অনুমতি পাচ্ছে না বিএনপি-জামায়াত। অপর দিকে সম্পদ বণ্টনে এমনকি ত্রাণ বিতরণেও সমতা নেই। গ্রামগঞ্জেও বিএনপি-জামায়াত সমর্থন করার অপরাধে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে না। আইনের আশ্রয় পাচ্ছে না ক্ষমতাসীন দলের বিরোধীরা। খুন হলেও থানায় মামলা নেয়া হয় না। অপর দিকে মিথ্যা মামালা দিয়ে হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনই এর প্রমাণ। আওয়ামী লীগের সাজাপ্রাপ্ত অনেক খুনি, জঘন্য অপরাধী রাষ্ট্রপতির বিশেষ অনুকম্পায় জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। এক-এগারোর জরুরি শাসনামলে আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রায় সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিরোধী নেত্রীর বিরুদ্ধে ওই সময়ের দায়েরকৃত কোনো মামলা প্রত্যাহার হয়নি। পুলিশের সহায়তায় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ করছে দলীয় ক্যাডাররা। জীবন, সম্মান, সম্পদ রক্ষায় আইনের সমান আশ্রয় পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
অনুচ্ছেদ ২৮-এ বলা হয়েছেÑ ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান। গরিষ্ঠের জোরে লঘিষ্ঠের অধিকার হরণ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এখানে বিস্ময়কর হলেও সত্য গরিষ্ঠ মুসলমানেরা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের কারণে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘিষ্ঠের দ্বারা নয় বরং শাসক এলিটদের দ্বারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে : Minority Islam in a majority Muslims Country. রাষ্ট্র চিন্তকদের কেউ কেউ একে Bosnia Syndrome  বলছেন। বসনিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘিষ্ঠ সার্বরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। এখানে রাজনৈতিক সংখ্যালঘিষ্ঠরা বাকি রাজনৈতিক গরিষ্ঠকে শুধু আদর্শিক বৈপরিত্যের কারণে নিপীড়ন করছে। শাসকদলের জামায়াতে ইসলামী বিরোধী সর্বাত্মক আগ্রাসন ইসলাম বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছে। ধার্মিক মুসলমানেরা তাদের সুন্নতি লেবাস হিসেবে দাড়ি টুপি পরেন। এ কারণে বিক্ষোভ বা সমাবেশ শেষে পুলিশ সাধারণ মুসলমানদের ওপর চড়াও হচ্ছে। পুলিশ একজন মুসলমানের দাড়ি ধরে টানছে এ ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। চ্যানেলে দেখা গেছে একজন সুন্নতি লেবাসধারীকে পেটাচ্ছে পুলিশ। দর্শকেরা বলছেন তিনি নির্দোষ পথচারী। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর গ্রামে যে মহিলা মাথায় গুলি খেল তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল যে তার মুখে দাড়ি ছিল। পুলিশ জামায়াত সন্দেহ করে তার মাথায় গুলি করে হত্যা করে। গত ১৮ মার্চ প্রথম হরতালের দিন একজন নিরীহ পথচারীকে পিকেটার সন্দেহে পুলিশ গুলি করে। কারণ তার দাড়ি ছিল। সে এখন পঙ্গু হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। এভাবে হাজারও উদাহরণ দেয়া যাবে। ইসলাম নামটি এবং এ ভাবধারার সবকিছু শাসকদলের এবং সহযোগী বামদের কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে। যেমন ইসলামী ব্যাংক, ফারইস্ট ইসলামী বীমা, ট্রাস্ট ব্যাংক এমনকি বিসমিল্লাহ বা ইবনে সিনা নামধারী সব প্রতিষ্ঠানে তারা হামলা চালিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক তো জামায়াত নয়। মুসলমান ও ইসলামি ঐতিহ্য ও ভাবধারার সব প্রতিষ্ঠান তারা নিষিদ্ধ করতে বলছে। তারা দীর্ঘ তালিকা ঘোষণা করেছে। সরকারও একই মনোভাব প্রদর্শন করছে।
আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয়ের জন্য সংগ্রাম করছে। সরকার নৃতাত্ত্বিক কারণে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। সংবিধানে বলা আছে জন্মস্থানের কারণে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। অথচ সবাই জানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা বেশির ভাগ পুলিশ কোন জেলার?
অনুচ্ছেদ ২৯-এ বলা হয়েছেÑ ‘সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা থাকিবে।’ অথচ সবাই জানে ক্ষমতাসীন দলের লোক না হলে চাকরি পাওয়া দুষ্কর। সরকারি কর্মকমিশন বা পিএসসি থেকে পিয়ন দারোয়ানের চাকরি পর্যন্ত এ দলীয় অনাচার সম্প্রসারিত। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা প্রকাশ্য দিবালোকে গণমাধ্যমের সামনে বলেছেন তার দল ছাড়া অন্যদের চাকরি দিলে খবর আছে। গোপালগঞ্জের ভাগ্যবান মানুষদের কথা তো একটু আগেই উল্লেখ করেছি।
অনুচ্ছেদ ৩১-এ বলা হয়েছেÑ ‘আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম ও সম্পত্তিহানি ঘটে।’
সংবিধানের ভাষা দেখলেন। এখন প্রায়োগিক পর্যায় দেখুন। ব্যক্তির জীবন রক্ষার বদলে জীবন নেয়ার জন্য সরকারের পুলিশ বাহিনী কয়েক সপ্তাহ ধরে যে নির্মম গণহত্যা দেশের সর্বত্র ঘটিয়েছে তা সব নাগরিকের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। তাই গণরোষ সৃষ্টি হয়েছে। আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : ক্রসফায়ার করে বিগত চার বছরে তারা দৃষ্কৃতকারী নিধনের নামে ভিন্নমতের মানুষকে হত্যা করেছে। গত কয়েক সপ্তাহের হত্যাকাণ্ডে  প্রায় দুই শ’ লোক নিহত হয়েছে। তারা বলছে, এসব লোক সাধারণ মানুষ নয়। অসাধারণ কেউ অর্থাৎ জামায়াত-শিবিরের লোক। ভাবখানা এই যে, জামায়াত-শিবিরের লোক হলে হত্যা করা জায়েজ হয়ে যায়। তারা যেন মানুষ না। এ দেশের নাগরিক নয়। আমার ধারণা বিশ্বজিৎ যদি হিন্দু না হতো তাহলে সরকার এবং তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এবং বিদ্বেষী চ্যানেলগুলো টুঁ শব্দও করত না। এটি অসম্ভব বিপজ্জনক অমানবিক প্রবণতা। আইনের চোখে সবাই সমান। আইনের আশ্রয় থেকে বিদ্বেষী বিবেচনায় কাউকে বঞ্চিত করা যায় না।
অনুচ্ছেদ ৩২-এ বলা হয়েছেÑ ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’
জীবন রক্ষায় সারা পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রাণদণ্ড যখন উন্নত বিশ্বে বিলুপ্তপ্রায় তখন ফাঁসি জিকির হচ্ছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। হত্যা করা, জবাই করার স্লেøাগান উচ্চারিত হচ্ছে মুহুর্মুহু। নবপ্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্মকে হিংসা বিদ্বেষে আচ্ছন্ন করা হচ্ছে সারাক্ষণ। এখন সরকার তো বটেই কোনো কোনো জ্ঞানপাপী এর মধ্যে অহিংসতার অপূর্ববাণী উদগীরণ করতে দেখছেন। এর অর্থ এই নয়, লাখ লাখ মানুষ হত্যাকারীদের আমরা বিচার চাইব না। যথার্থ হত্যাকারীদের ন্যায়ানুগ বিচারই সাধারণের দাবি।
ব্যক্তিস্বাধীনতায় আর একটি নগ্ন হস্তক্ষেপ হচ্ছে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসের প্রতি সরকারের প্রতিহিংসামূলক আচরণ। যে ব্যক্তি বিন্দু বিন্দু ঘাম, মেধা ও মনন দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেন তাকে তার প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সম্মানধারী এই ব্যক্তির প্রতি অসম্মানের ঘটনা অনেক দিন ধরে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে জনমনে জাগরুক থাকবে।
ব্যক্তিস্বাধীনতার এ ধরনের অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে বাদ যাননি নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদও। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে যতই সরকার আতিশয্য দেখাক না কেন হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ উপন্যাসে পিতার মৃদু সমালোচনাও সহ্য করেনি ক্ষমতাসীন সরকার। অবশেষে হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক ওই সব বিষয় সংশোধন করেই ছাপতে হয়েছে দেয়াল।
অনুচ্ছেদ ৩৩-এ গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে মূল সংবিধানে যথার্থ রক্ষাকবচ ছিল। বর্তমান সংবিধানে ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’ এর মারপ্যাঁচে সেই রক্ষাকবচ নাকচ করা হয়েছে। গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের শর্ত থাকলেও এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তির হদিসই মিলছে না। ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাক্ষীও গুম হওয়া থেকে রেহাই পচ্ছেন না। সাভারের একদল যুবককে গ্রেফতারের অনেক দিন পর আদালতে সোপর্দ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরপরাধ ছাত্রকে ডাকাত বানানো হয়। ঝালকাঠির লিমনকে পঙ্গু করে দিয়েছে র‌্যাব। চোখ তুলে ফেলছে পুলিশ। ধরে নিয়ে গিয়ে সর্বশেষ হরতালে ফার্মগেটে পায়ে গুলি করেছে পুলিশ। পা কেটে ফেলতে হয়েছে এ রকম দু’জনের। সাধারণ নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার এভাবেই লঙ্ঘিত হচ্ছে বারবার। গ্রেফতারের পর পর্দানশীন সম্মানিত নারীদের অপমান অপদস্ত করা হয়েছে। গর্ভবতী ডাক্তার মহিলাকে আটতলায় হেঁটে উঠতে বাধ্য করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা সরকারি ব্যবসায়-বাণিজ্যে নদী-নালা, খাল-বিল, সরকারি জমিজমা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, লাইসেন্স পারমিট, টেন্ডার ইত্যাদি ১০০ ভাগই তাদের ভোগদখলে রাখছে। আর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো অনেক জায়গায় ব্যক্তিগত সহায় সম্পত্তি, ব্যবসায় বাণিজ্য, মৎস্য চাষ কেন্দ্র জোর করে দখল করেছে, লুটপাট করেছে।
এসব বিবরণের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এ সরকারের হাতে মানুষের জীবন, সম্মান ও সম্পদ কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। সরকারের উঁচু মহলের লোকেরা প্রকাশ্যে শুধু নির্মূলের স্লেøাগান দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা হয়েছে : ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ অথচ যন্ত্রণা নিষ্ঠুরতা লাঞ্ছনাই সরকারের অঘোষিত নীতিতে পরিণত হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে আইনকানুন, রীতি-রেওয়াজ, ভদ্রতা-সভ্যতা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না।
অনুচ্ছেদ ৩৬-এ চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কার্যক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিরোধী নেতৃবৃন্দকে বিদেশ যেতে বাধা দেয়া হচ্ছে, এমনকি তাদেরকে বিমান থেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরেও তাদের চলাফেরায় নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।
অনুচ্ছেদ ৩৭-এ সমাবেশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ভাষা এরূপ : ‘জনশৃঙ্খলা বা জনগণের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ অথচ বিগত চার বছরে বিরোধী জোটকে সহজে স্বাভাবিকভাবে সভাস্থল দেয়া হয়নি। বরং সমাবেশগুলো ব্যর্থ করার জন্য সরকার অঘোষিত হরতাল করেছে। যানবাহন বন্ধ করে দিয়েছে, জায়গায় জায়গায় গ্রেফতার করেছে, সরকারি পেটোয়া বাহিনী বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মারধর করেছে।
অনুচ্ছেদ ৩৮-এ ‘সংগঠনের স্বাধীনতা’ শিরোনামে সংবিধানে বলা হয়েছেÑ ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ এখানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার ক্ষেত্রে বাধা নিষেধের কথা বলা হয়নি। সরকারি লোকেরা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণের দাবি জানিয়ে আসছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান যেভাবে কৌশলগতভাবে কোর্টের মাধ্যমে তারা বাতিল করেছে এ ক্ষেত্রে আবারো তারা এ অপকৌশল নিয়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক দায়েরকৃত রিট পিটিশনকে সম্বল করে সরকার কার্যব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। ইতঃপূর্বে সরকার নির্বাচন কমিশনের ওপর সওয়ার হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন জামায়াতে ইসলামী বেআইনি হলে বিএনপি অধিকতর শক্তিশালী হবে এবং আওয়ামী লীগের ভরাডুবি নিশ্চিতকরণে সহায়ক হবে। তা ছাড়া বেআইনি করলে চিহ্নিতকরণ অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির প্রবণতাই সশস্ত্র হওয়া, নাশকতামূলক কাজ করা। সুতরাং জামায়াত বেআইনি করলে সরকারের জন্য তা বুমেরাং হয়ে উঠবে।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টত বলা হয়েছেÑ ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
ক. প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং
খ. সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বিবেকের স্বাধীনতা। বিবেকের স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক স্বাধীনতাগুলোর মৌলিক ভিত্তি বলে গণ্য করা হয়। বিবেকের স্বাধীনতার ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত। বলার স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, ইচ্ছামতো গমনাগমনের স্বাধীনতা ইত্যাদি হচ্ছে বিবেকের স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। এমনকি নিজের খুশিমতো কাপড়-চোপড় পরা, নিজ ইচ্ছামতো শখের কাজটি করতে পারা, মনের মতো সঙ্গীত শোনা অর্থাৎ ব্যক্তির নিজস্ব বা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো  স্বাধীন মতো করতে পারা বিবেকের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। সহজভাবে, স্বাভাবিকভাবে, নিজের কাজটি নিজে করায় কোনো বাধা থাকার কথা নয়। যখন সমাজতান্ত্রিক বা স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত সমাজে নিজের খেয়াল খুশিমতো চলা যায় না তখনই মুক্ত সমাজের সাথে এর পার্থক্য বোঝা যায়। মুক্ত সমাজ মানেই গণতান্ত্রিক সমাজ। সুতরাং বাক বিবেকের স্বাধীনতার সাথে গণতন্ত্রের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বলা যায় ÔFree speech requires democracy and democracy requires free speechÕ (Stansley C. Brulaker, 1195:506) স্বৈরাচার বা ব্যক্তিতন্ত্র বাক বিবেকের স্বাধীনতাকে অবদমন করে। তার কারণ এটা তাদের স্থায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। ব্যক্তিতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের প্রবণতাই হচ্ছে ক্ষমতার মসনদকে চিরস্থায়ী করা আর না হলেও দীর্ঘায়িত করা। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ব্যক্তিতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র স্থায়িত্বকে হ্রাস করে।
ঝ. নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থায় বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। রাষ্ট্রের বা সরকারের ইচ্ছাই ব্যক্তির ইচ্ছা। ব্যক্তি কী বই পড়বে অথবা কী সঙ্গীত শুনবে কী কথা বলবে তা নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্র। এমনকি ধর্মের ব্যাপারেও তাদের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ। মার্কসীয় দর্শন মনে করে ধর্ম হচ্ছে আফিম, যা সাধারণ মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সুতরাং প্রগতিশীল হতে হলে, বামপন্থী হতে হলে আগে অবশ্যই তাকে ধর্ম বর্জন করতে হবে। মার্কসবাদী ছাড়াও যারা স্বৈরতান্ত্রিক তারা তাদের ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের সুবিধা মতো। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোনো কোনো স্বৈরতন্ত্র তার পদবি যাই হোক রাজা, বাদশাহ, আমির, সুলতান, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তারা কখনো কখনো ধর্মকে ক্ষমতার বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে যেখানে লোকজন ধার্মিক সেখানে রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ধর্মের লেবাস ধারণ করে। ক্ষমতায় আরোহণের পর ধর্মকেও রাষ্ট্রীয়করণ করে নেয়। এসব সমাজে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিজ বিবেক মোতাবেক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। লেখার জন্য, বলার জন্য, কারাদণ্ড-শ্রমশিবিরে প্রেরণ অথবা মৃত্যুদণ্ড ওই সব সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। বাক ব্যক্তিস্বাধীনতা যখনই ত্বরান্বিত হয়েছে তখন স্বৈরতন্ত্রের পতনও অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ৯০-এর দশকে যাকে হান্টিংটন গণতন্ত্রের থার্ড ওয়েভ বলে অভিহিত করেছেন।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও কোনো কোনো দেশে এর অপভ্রংশ এখনো লক্ষ করা যায়। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নাগরিকের মত প্রকাশের সুযোগে গণতন্ত্রবিরোধী বামরা এর সদ্ব্যবহার করে। সমাজকে বিপথগামী করে। যেমন করেছিল হিটলার। জাতীয় মুক্তির অতি উচ্চাকাক্সা জাগিয়ে ইহুদি বিদ্বেষ তুঙ্গে তুলে হিটলার জার্মান জনগণকে ভাবাবেগে তাড়িত করে জার্মান জাতির সর্বনাশ সাধনে সক্ষম হয়। একবার হিটলারতন্ত্র, নাৎসিবাদ বা ফ্যাসিবাদ কায়েম হলে মুক্তির পথ অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অপর দিকে মুক্ত বিশ্বে যেখানে মানুষ সতত স্বাধীন সেখানে ব্যক্তি তার মেধা, মনন, আচরণ ও বিশ্বাস দ্বারা একটি মর্যাদাকর অবস্থান তৈরি করে। ব্যক্তি যখন সমষ্টি হয়ে দাঁড়ায় তখন গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করে। বলা হয় ব্যক্তির বিবেক পুণ্যময় সমাজ তৈরি করে, পুণ্যময় সমাজ গণতন্ত্রকে পরিপূর্ণতা দান করে। যখন গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা পায় রাষ্ট্রে তা প্রতিফলিত হয়। এভাবে অতীতে ÔVirtue and religious salvation-laid the foundation for liberal democracy and aligned it with freedom of speechÕ (পূর্বোক্ত : ৫০৬)।
ঞ. এ ধরনের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিবেকের স্বাধীনতা সৃজনশীলতার পরিবেশ পায়। ব্যক্তির উৎকর্ষতার সাথে সামাজিক উৎকর্ষতা সাধিত হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণ পায়। এমনকি কবিতা কাব্য থেকে আবিষ্কার অর্জনে উৎসাহিত হয় মানুষ। অন্যথায় মানুষ হয়ে ওঠে প্রাণহীন বস্তুর মতো: স্টেরিও টাইপ। বাক ব্যক্তিস্বাধীনতা মানুষকে সত্যান্বেষণে সাহায্য করে, আর তা গণতন্ত্রেরই অনুষঙ্গ। বাক বিবেকের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন ‘ÔAbsolute power corrupts absolutely’’ তখন বিবেক তার লাগাম টেনে ধরে। গণতন্ত্র স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। গণতন্ত্র বাক বিবেকের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত। গণতান্ত্রিক সমাজেও বাকস্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত, নিয়ন্ত্রিত, এমনকি নির্বাসিত হতে পারে। কর্তৃত্বের ওপর নির্ভর করে যেমন জাতির ভবিষ্যৎ (তেমনি বাক বিবেক ব্যক্তিস্বাধীনতা) নেতৃত্ব যদি হয় স্বৈরতান্ত্রিক, আবার তা যদি হয় বিকারগ্রস্ত তাহলে সে জাতির বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ, সমাবেশের স্বাধীনতা পরিত্যাজ্য, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পরিত্যক্ত হতে বাধ্য।
বাংলাদেশের এ সময় বাক বিবেক ব্যক্তিস্বাধীনতার সার্বিক অবস্থা যদি উপরিউক্ত তত্ত্বকথার আলোকে বিচার করি তাহলে এক ভয়ঙ্কর চিত্র প্রতিভাত হবে। বিবেকের তাড়নায় যদি কেউ মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন তাহলে প্রশ্ন আসে : তিনি কার খপ্পরে অথবা নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে মধ্যস্থতার খায়েশ কেন। কেউ যখন বলে বাজিকরদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে তখন তাকে কটাক্ষ করা হয়। একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যখন বিমানবন্দর নির্মাণের নামে সাধারণ জনগণের উচ্ছেদের প্রতিবাদ করেন তখন দালাল বদনাম শুনতে হয়। একজন আসিফ নজরুল যখন সত্যের সাক্ষ্য দেন তখন হুমকি দেয়া হয়, একজন পিয়াস করিম যখন নিয়মতান্ত্রিকতা যৌক্তিকতার কথা বলেন কটুবাক্য শুনতে হয়। তারা শুধুই তোষামোদ খোসামোদের ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বেশির ভাগ চ্যানেলের ভাষ্য আর ক্ষমতাসীনদের ভাষ্যে বিন্দুবিসর্গ পার্থক্য থাকছে না। ঘোষক প্রতিবেদক সগৌরবে তাদেরই একজন হওয়ার মহিমা প্রচার করছেন।
সভা সমাবেশের অবস্থা তো এতই নাজুক যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশুদ্ধ বয়ানে : সর্বশক্তি দিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমেছেন। সংবাদপত্রের অবস্থা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তথ্যমন্ত্রীর হুমকিকে অগ্রাহ্য করে যে একজন সাহসী সম্পাদক হিমালয় উচ্চতায় শিরদাঁড়া করে আছেন তাকে মামলার পর মামলা দিয়ে, হামলার পর হামলা করে অবরুদ্ধ রেখেছেন নিজ কার্যালয়ে। মানসিক নিপীড়ন, সামাজিক, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে তাকে অবনত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি চির উন্নত শির। অন্য আরো দু-একজন সম্পাদক যারা বিবেককে নিসর্জন দেননি তাদের ডজন ডজন মামলায় আসামি করা হয়েছে। হুমকি দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বিবেকের স্বাধীনতা আজ বিপর্যস্ত। বিবেকের স্বাধীনতা বিসর্জিত। যেকোনো ধরনের সামান্যতম বিরোধিতাও তারা সহ্য করে না। সমাজ নিরীক্ষায় দেখা যায় এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক বা ব্যক্তিতান্ত্রিক অবস্থায় তিনভাবে বাক ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাহত হতে পারে।
প্রথমত : স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্তৃত্ব থেকে, যিনি লু দ্য ফোরটিনথের মতো মনে করেন তিনিই রাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনিই রাষ্ট্র, তিনি দলীয় প্রধান, জনগণের একক ভাগ্যনিয়ন্তা। তার কাছে কালেকটিভ উইজডোমের কোনো মূল্য নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে প্রায় সবাই যখন একমত ছিলেন ব্যবস্থাটি অব্যাহত রাখতে, তিনি যখন বললেন তা হবে না। তখন সব উল্টে গেল। সব সুর পাল্টে গেল।
দ্বিতীয়ত : একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশেষত দলীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলই সরকার পরিচালনা করে। এই রাজনৈতিক দল যদি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারক না হয় তাহলে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিপীড়নের শিকার হয়, অন্যান্য দল সভা সমাবেশের অধিকার হারায়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল তার জন্মের পর থেকেই অসহিষ্ণুতা, পেশিশক্তি ব্যবহারের জন্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আক্রান্ত বলে বদনাম কুড়িয়েছে।
তৃতীয়ত : গণতন্ত্র তথা বাকস্বাধীনতার প্রতিবন্ধক হতে পারে আকস্মিকভাবে আবির্ভূত কোনো গোষ্ঠী বা জনশ্রেণী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে হঠাৎ করে ইস্যু ভিত্তিতে বা কোনো দাবি স্বার্থ সেন্টিমেন্ট-নির্ভর এ ধরনের গোষ্ঠীকে বলা হয় ‘এনোমিক গ্রুপ’। এদের বৈশিষ্ট্য হলো প্রচণ্ডতা এবং ঐকান্তিকতা। বাংলাদেশে তথাকথিত নতুন প্রজন্ম বা শাহবাগ প্রজন্ম একটি নেতিবাচক দাবি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ফাঁসি, নির্মূল, জবাইÑ এসব দাবি কোনো নিয়মতান্ত্রিক দাবি হতে পারে না। তারা প্রচলিত বিচারব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। সমাজ হিংসা বিদ্বেষ হানাহানি অরাজকতা অস্থিরতার উৎসে পরিণত হয়েছে; যার ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যেই অসংখ্য লোক প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি বড় ধরনের সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। ব্যক্তি বিবেক দিয়ে যারাই বা যেসব প্রতিষ্ঠান এর বিরোধিতা করছে সবাই প্রচণ্ড হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
বস্তুত এটাই একটি অপ্রিয় সত্য কথা যে, এই আওয়ামী শাসনামলে স্বাভাবিক অবস্থা ছিল না কখনোই। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ শাসনকালে যেহেতু তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না তাদের দাঁত বের করতে সময় লেগেছিল। এবারে Winners gets all তত্ত্ব অনুযায়ী তারা সবকিছু দলীয় দখলে নিয়ে নেয়। রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোÑ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আমলা বিভাগকে তারা দলীয় স্বার্থসিদ্ধির বাহনে পরিণত করে। সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করে দেয়। বিডিআরকে তারা শুধু নামেই পরিবর্তন করেনি বরং নখদন্তবিহীন কাগুজে বাঘে পরিণত করেছে। রাষ্ট্র বা সরকার যদি এভাবে বাক ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে, সঙ্কুচিত করে অথবা অস্বীকার করে, তাহলে জ্যা জ্যাক রুশো মনে করেন রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম, আন্দোলন এমনকি বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। সেই ন্যায়সঙ্গত গণবিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads