শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০১৩

সোনার ডিম দেয়া হাঁস জবাই করবেন না


১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মরহুম আবদুল মতিন চৌধুরী। স্বল্পভাষী, ভদ্র, বিনয়ী ও সৎ ব্যক্তি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল দেশজোড়া। এ কথা কেউ কোনো দিন বলতে পারবেন না যে, তিনি কাউকে ধমকের স্বরে কখনো কোনো কথা বলেছেন। এহেন ব্যক্তি মতিন চৌধুরী ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীনে গঠিত আওয়ামী লীগ শাসনামলে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হন। এমনকি পুলিশের লাঠিপেটার শিকারও হন তিনি। ’৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম। তাকে দিয়ে কাজ হচ্ছে না বলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিমকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। জনাব নাসিমের পিতা মরহুম মনসুর আলী স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে যুক্ত মোহাম্মদ নাসিম দোর্দণ্ড প্রতাপে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেন। তার আমলে বিএনপি নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা পুলিশের পিটুনিতে অন্য অনেকের মতো রক্তাক্ত হয়েছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হন লুৎফুজ্জামান বাবর। এ সময়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম পুলিশ কর্তৃক নিগৃহীত হন। পরবর্তী সময়ে আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং লুৎফুজ্জামান বাবর প্রতিমন্ত্রী হয়েও পুরো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে জনাব চৌধুরীকে পুলিশ বিভিন্ন সময়ে হেনস্তা করেছে। অন্য দিকে জনাব বাবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দীর্ঘকাল জেলের ঘানি টানছেন। যে পুলিশকে তিনি কঠোরভাবে নির্দেশ দিতেন সেই একই পুলিশ তার প্রতি এখন শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্রমাগত নির্যাতন করে চলেছে।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। পাঁচ বছর পর পর স্বাভাবিক অবস্থায় এ দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদল হয়। পাঁচ বছর যারা ক্ষমতায় থেকে ধরাকে সরাজ্ঞান করতেন, তারা বিরোধী দলে এসে পুলিশকে দেখেন ভিন্ন চরিত্রে। ক্ষমতায় থাকাকালে যে পুলিশ সরকার, সরকারি দল এবং বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কুর্নিশ, পদলেহন ও তোয়াজ করে দিবানিশি কাটাত, সেই একই পুলিশ চোখ উল্টাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর থেকে কোনো সরকার পরপর দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেনি। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না বলে ইতোমধ্যে দেশী-বিদেশী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবাদমাধ্যমগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বর্তমান সরকারের আমলে প্রথমে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পরবর্তীকালে তার স্থলে যিনি নিয়োগ পেয়েছেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম যাকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন তার ভূমিকার জন্য, তিনি সেই মহিউদ্দীন খান আলমগীর। এককালের আমলা এবং ১৯৯৬ সালে অন্যদের সাথে আমলাদের নিয়ে গঠিত জনতার মঞ্চের অন্যতম রূপকার মহিউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণের পর বিরোধী দল দমনে পুলিশকে যেভাবে নির্দেশ-নির্দেশনা দিচ্ছেন ও হুকুম করছেন, তা অতীতের সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রেকর্ডই ভঙ্গ করেছে। এমনকি তার দলের প্রভাবশালী নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফসহ আরো অনেকে জনাব মহিউদ্দীনের কর্মকাণ্ড সমর্থন করছেন না বলে প্রকাশ্যে জানিয়েছেন। বর্তমান সরকার শেষ সরকার নয়। এ দেশ থাকবে চিরদিন। সরকার বদল হবে পাঁচ বছর পর পর। আজকের সরকার আগামীতে যাবে বিরোধী দলে আর বর্তমানে যারা বিরোধী দলে আছেন তারা আসবেন ক্ষমতায়। নতুন সরকারে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে কেউ একজন আসবেন। তখন কী হবে? বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে অতীতের ইতিহাসের কি পুনরাবৃত্তি ঘটবে না? কথায় বলে History repeats itself.. আমাদের দুর্ভাগ্য, ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিই না।
কয়েক দিন আগে নিউ ইয়র্কভিত্তিক একটি সংবাদপত্রে চাঞ্চল্যকর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পুলিশের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের পুলিশকে বাদ দেয়া হতে পারে। মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা ও নীতিনৈতিকতা জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্ব মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের নজরে এসেছে’ বলে এই সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘জাতিসঙ্ঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসের সাথে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই পুলিশের জন্য মানবাধিকারসম্মত আচরণবিধির নিরিখে বাংলাদেশের পুলিশের আচরণ, তাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেছেন। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশের আচরণ ভয়াবহ।’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘রাজপথ ও মাঠে একমাত্র পুলিশকেই তৎপর দেখা যাচ্ছে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে আরেক গোষ্ঠীর ওপর চড়াও হতে, যা বিশ্ব মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের বেশ কিছু সদস্য কাজ করছেন জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে। কিন্তু যেভাবে পুলিশ বাংলাদেশের জনগণের ওপর অমানবিক আচরণ করছে, তাতে তারা জাতিসঙ্ঘের বিবেচনায় মানবাধিকারের যথার্থ স্ট্যান্ডার্ড এবং জাতিসঙ্ঘ চার্টার ধারক হওয়ার যোগ্য কি না, তা আবার বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।’ ‘এই বিবেচনায় বাংলাদেশের পুলিশের যোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হলে তাদের মিশন থেকে বাদ দেয়া হতে পারে’ বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশ পালাক্রমে কাজ করছে দীর্ঘ দিন ধরে। বিভিন্ন সময়ে জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা শান্তি মিশনে কর্মরত বাংলাদেশীদের কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তারা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে কাজ করতে খুবই আগ্রহী। সীমিত আয়ের সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা মনে করেন যে, শান্তি মিশনে কাজ করাটা তাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা মিশনে কাজ করে যে অর্থ আয় ও সঞ্চয় করেন, তা তাদের পরিবারের জন্য একটা বিরাট অর্জন। সারা জীবনে চাকরি করে তারা খুব সামান্যই সঞ্চয় করতে পারেন; কিন্তু এক-দুই বছরের জন্য মিশনে কাজ করে তারা মোটামুটি এ পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন, যা ভবিষ্যতে তাদের জন্য খুবই উপকারে আসবে। বর্তমানে জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সাত হাজার ৮৪০ সদস্য কাজ করছেন। এদের মধ্যে পুলিশের সংখ্যা এক হাজার ৭৭০ জন। দেখা যায়, পালাক্রমে কাজ করার ফলে সেনা ও পুলিশ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সদস্য কোনো না কোনো সময়ে শান্তি মিশনে কাজ করেছেন। বাকি যারা আছেন তারাও জানেন, পর্যায়ক্রমে তারাও শান্তি মিশনে কাজ করার সুযোগ পাবেন।
জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে কাজ করার এই যে ‘সোনার ডিম’, তা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পুরো বাহিনীর জন্য হতাশা ডেকে আনবে। শান্তি মিশনে বাংলাদেশীদের ভূমিকা এবং উত্তরোত্তর সংখ্যাবৃদ্ধি অনেকের কাছেই চুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশের দেশ ভারতের বিশাল সেনা ও পুলিশ বাহিনী থাকা সত্ত্বেও জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব তাদের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশের পুলিশ যদি শান্তি মিশন থেকে বাদ পড়ে তাহলে ভারত লাভবান হবে; কারণ শূন্যস্থান পূরণ করার সম্ভাবনা সে দেশটির।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। এক-এগারোর প্রাক্কালে বাংলাদেশে তৎকালীন জাতিসঙ্ঘ মিশনের প্রধান রেনেটা ডেসালিয়ন এ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অনেক ছোটাছুটি করেছিলেন। শোনা যায়, তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধানকে জানিয়েছিলেন যে, তাদের মনমতো পদক্ষেপ যদি গ্রহণ না করা হয়, তাহলে জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করা হবে। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নেয়।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নজর রাখছে। বিভিন্ন সময়ে তারা বক্তব্য ও বিবৃতি দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত তারা তাদের মনোভাব বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এমন একটা সময় আসবে যখন সম্ভবত তারা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। বাংলাদেশ বিশ্বমণ্ডলে এমন কোনো শক্তিশালী দেশ নয় যে, আমরা বিশ্বমতকে উপেক্ষা করতে পারি। আমাদের অনেক কিছুই ভেবেচিন্তে করতে হয় এবং করা উচিত।
যা হোক, এক মাস ধরে দেশে বিরোধী দমনের নামে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, অত্যাচার নির্যাতন করে বিরোধীদের দমন করা যায় না। জনগণ পুলিশকে বন্ধু এবং বিপদে-আপদে সাহায্যকারী হিসেবে দেখতে চায়। সম্ভবত সাধারণ পুলিশ তাই-ই চায়; কিন্তু তা হচ্ছে না কেন? পুলিশকে কেন জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে? দেশের বর্তমান সমস্যা রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিক উপায়েই তার সমাধান করতে হবে, দমন-নিপীড়ন করে নয়। এতে হিতে বিপরীত হবে। অতীতেও দেখা গেছে, নিপীড়ন-অত্যাচার যখন বৃদ্ধি পায় তখন প্রতিরোধও বৃদ্ধি পায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থকের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও পথে নেমেছে। তারা বিশেষ কোনো দলের সমর্থক না হলেও অত্যাচারিতের পক্ষাবলম্বন করেছে। ‘হিউম্যান সাইকোলোজি’ এটাই। গ্রামগঞ্জে হাজার হাজার মানুষ যারা কোনো রাজনীতি করে না, তারাও পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছে লাঠিচার্জ, গুলি আর টিয়ার শেল উপেক্ষা করে।
সেনাবাহিনীর মতো পুলিশও একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। তারা কাজ করে চেইন অব কমান্ড মান্য করে। কমান্ডার যে নির্দেশ দেন তারা তাই-ই মেনে নেন। কমান্ডার যদি পক্ষপাতদুষ্ট হন তাহলেই ঘটে বিপত্তি। দুঃখজনক হলেও এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, ভালো পোস্টিং, প্রমোশন এবং সর্বোপরি দলীয় আনুগত্যের কারণে পুলিশ বাহিনীর কমান্ডে যারা আছেন তাদের একটা অংশ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছেন। দেশে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে পুলিশের ভূমিকা এটাই প্রমাণ করে। এতে সাময়িক কেউ কেউ হয়তো লাভবান হবেন, কিন্তু সামগ্রিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুলিশের ভাবমূর্তি, যা কারো কাম্য নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads