১২ মার্চ ভালো কিছুই হল!
বদিউর রহমান
যুগান্তরের ১০ মার্চ সংখ্যায় লিখেছিলাম ‘১২ মার্চ ভালো কিছুই হবে না’। এখন ১২ মার্চ শেষে তার বিপরীত কথাই যেন লিখতে হচ্ছে। ইংরেজ কবি মিল্টন স্বর্গ হারানো (প্যারাডাইস লস্ট) লেখার পর স্বর্গ ফেরত পাওয়া (প্যারাডাইস রিগেইন্ড্) লিখেছিলেন। হয়তো স্বর্গ হারিয়ে কবি বেকায়দায় পড়ে গিয়ে আবার স্বর্গ ফেরত পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। স্বর্গ থেকে পতনের পর মর্ত্যে এসে তিনি মর্ত্যকেই আবার স্বর্গ ভেবেছেন। আমি মনে করি আল্লাহর সৃষ্টি স্বর্গের বর্ণনা আমরা শুনি, অনেক ভালো ভালো খবর স্বর্গ সম্পর্কে জানতে পারি; কিন্তু ওগুলো বাস্তবে দেখতে পাই না, সম্ভবও হয় না। কিন্তু আমাদের এ মর্ত্য,এ দুনিয়ায় যা কিছু দেখি, পাই, জানি এর সবই কিন্তু বাস্তব। এখানে পাখি গায় আর আমরা তা শুনি এবং দেখিও; এখানে ফুল ফোটে আর আমরা তা প্রত্যক্ষ করি এবং তার ঘ্রাণ-সৌন্দর্য উপভোগ করি। স্বর্গের ‘হুর’ পরে পাব আশায় থাকি, কিন্তু মর্ত্যরে সুন্দরীদের নাচ-গান-চলন-বলন তো স্বচক্ষে দেখছি। অতএব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে সত্য সেটাই অধিক বাস্তব, নগদের বিষয়টি অনেক বেশি চাক্ষুষ। তাই ১২ মার্চ দেখে, ১২ মার্চের সব খবরাখবর জেনেশুনে দেখা গেল ১২ মার্চ ভালো কিছুই যেন হল, নাকি?এবার ১২ মার্চের ভালো (?) কিছু যা যা হল তার খতিয়ানটা একটু নেড়েচেড়ে দেখি না কেন। দেখা যাক তা ভালোর খাতায় টিকে থাকতে সক্ষম হয় কিনা। প্রথমেই দেখা যাক সরকারদলীয় তর্জন আর বিরোধীদলীয় গর্জনের ফল কেমন হল। বিএনপি যেভাবে জনসমাবেশে ঢাকাকে ঢেকে ফেলতে চেয়েছিল তা বোধহয় আর হল না, ঢাকার লোক দিয়েই মূলত সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সরকারের এত এত বাধা পেরিয়ে কত আর পারা যায়! রাস্তাঘাট, স্থলযান আর জলযান সব বন্ধ করে না দিলে, পথে পথে লোকজনকে থামিয়ে না দিলে তবেই তো দেখানো যেত জনসমাবেশের জন্য আরও কয়টা ঢাকার প্রয়োজন হতো। অতএব তর্জনে তর্জন হয়েছে, যা হয়েছে তাতেই খুশি থাকতে হয়েছে। সরকার যে দলের কারও দাবির মুখে সমাবেশই বন্ধ করে দেয়নি তাতেই অন্তত শুকরিয়া আদায় করতে হয়। বন্ধ করে দিলে হয়তো কিছুই করা যেত না, দেশটা তো পুলিশি রাষ্ট্র হয়েই গেল বলা চলে। তর্জনের বড় অর্জন হল কর্মীরা চাঙ্গা হলেন, একটা হরতাল পাওয়া গেল, ৯০ দিনের একটা আলটিমেটাম ঘোষিত হল। সরকারের একঘেয়ে দুঃশাসনের অবসানের লক্ষ্যে বিএনপি-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে না পারলে দেশ বাঁচাবে কে? বেগম জিয়া যে হরহামেশা হাঁক
ছাড়েন জালিম হঠাও, দেশ বাঁচাও এ দেশ বাঁচাতে তো কর্মী প্রয়োজন। অতএব এ সমাবেশের মাধ্যমে তাদের
চাঙ্গা করা গেল।
এবারের এ সমাবেশ উপলক্ষে সরকারের এবং বিরোধী দলের দু’-দুটো হরতাল পাওয়া অবশ্যই ভালো কিছু এটা অস্বীকারের উপায় নেই। বিএনপির সমাবেশকে ‘সাইজ’ করতে সরকার নিজেই ঢাকায় একটি ‘হরতাল’ দিয়ে ফেলেছে, বরং বলা চলে বিরোধী দলের ডাকা হরতাল থেকে কড়া হরতালই দিয়েছে। আর সরকারের এমন অঘোষিত কিন্তু ফলপ্রসূ, সফল হরতালের জনভোগান্তির প্রতিবাদে বিএনপি ২৯ মার্চ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে। সরকার হরতাল করেছে মূলত ঢাকায়, আর বিরোধী দল দিয়েছে সারাদেশে। অনেকদিন পর সরকারি হরতাল আর বিরোধীদলীয় হরতাল আসাই ১২ মার্চের অন্যতম ভালো কিছু নয় কি? তবে হরতালের চেয়েও বড় ভালো কিছু হচ্ছে ৯০ দিনের আলটিমেটাম। সংবিধান সংশোধন করে অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের জন্য বিএনপি সরকারকে ৯০ দিনের (তিন মাসের) সময় বেঁধে দিয়েছে। এর মধ্যে তা না করা হলে ১১ জুন সরকার পতনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে আরেক সমাবেশের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে দলের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের কথা এ আলটিমেটামে মনে পড়তে বাধ্য। জলিলও তখন এপ্রিলের মধ্যে (৩০ তারিখ) বিএনপি সরকারের পতন ঘোষণা করেছিলেন। বিএনপি এবার ভিন্ন সুরে পতনের কর্মসূচি ‘দেবে’ বলেছে। তবুও তো একটা আলটিমেটাম, আওয়ামী লীগ এবার যাবে কোথায়? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা তো ভালো, নচেৎ তোমার সরকারের হবে পতন নির্ঘাতÑ ভাবটা এমনই। এর চেয়ে ভালো কিছু আর কী হতে পারে?
আরেকটা ভালো কিছু হচ্ছে আবার রাজনীতিতে দলীয় গুণ্ডামির প্রকাশ্য আমদানি। এরশাদ আমলে তার সরকারের বিরুদ্ধে ডাকা কোন কোন হরতালের সময় আওয়ামী লীগ আর বিএনপির হরতাল-সমর্থক কর্মী-পিকেটারদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার জন্য আইন-শৃংখলা বাহিনীর সহযোগী হিসেবে অস্ত্রশস্ত্র হাতে মাস্তান বাহিনীকে আমরা দেখেছি। পুলিশ-পাহারায়, পুলিশের ছত্রছায়ায় তারা লাঠিসোঁটা আর পিস্তল হাতে হরতালকারীদের পিটিয়েছে, ধাওয়া করেছে। এবার সমাবেশগামী লোক ঠেঙাতে রামদা আর লাঠি হাতে সরকার-সমর্থকদের ছবিও পত্রিকায় ছাপা হল। কী চমৎকার ভালো কিছু, তাই নয় কি? আরও বড় অর্জন হল তাদেরই কারও ঘোষণা তারা পুলিশকে সহায়তা করছে। এটা একটা নব সংযোজন যে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য দলীয় গুণ্ডারা পুলিশি ক্ষমতা হাতে নিয়ে নেবে আর পুলিশও চুপ থাকবে! এটা সরকারের জন্য উপকারী হবে, বিপদে-আপদে শুধু পুলিশ-র্যাব দিয়ে কি আর সব ‘সাইজ’ করা যায়? আরও সুসংবাদ যে, আগামীতে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে আর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকে, তখন আওয়ামী সমাবেশ ঠেকাতে এই শিক্ষাই বিএনপি কাজে লাগাতে পারবে।
আরেকটা বড় ভালো কিছু কি কারও চোখ এড়িয়ে যেতে পেরেছে? এটা একটা নতুনত্ব, রাজনীতিতে নবসংযোজন, সরকার পরিচালনায় নবকৌশল বলা চলে। সরকার যখনই ভাববে যে বিরোধী দলের কোন সমাবেশে বেশি জনসমাগম হলে সরকারের জনপ্রিয়তা ধরা পড়ে যেতে পারে অথবা তেমন সমাবেশ থেকে নাশকতার আশংকা দেখা দিতে পারে, তখন সরকার নিজেই জনগণের জানমালের হেফাজতের অজুহাতে এবারের ঢাকাকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার মতো ওই সমাবেশস্থলকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। সরকারের দায়িত্ব পালনের এমন নিচিদ্র নিরাপত্তা-বেষ্টনীর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সাময়িক আতংক সৃষ্টি হলেও বড় ক্ষতি তো রোধ করা যাবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকার এবার যদি এমন কঠোর ব্যবস্থা এবং কঠোর নিরাপত্তা-বলয় সৃষ্টি না করত তাহলে ১৮ ডিসেম্বরের মতো অঘটন ঘটানো অস্বাভাবিক ছিল না। সাংবাদিক মশিউল আলমের লেখা ‘ম্যাডাম হুকুম দিলে রাজপথ ছাড়ব না’ (প্রথম আলো, ১৩ মার্চ) একেবারে উড়িয়ে দেয়ার বিষয় ছিল না। সরকার সর্বাÍক কঠোর ব্যবস্থায় না গেলে তেমন আরব-বসন্ত বাস্তবতায় ভ্রান্তি-বিলাস হলেও তার সম্ভাবনা থাকতে পারত এবং ছিলও বলা চলে। বিএনপির গত তিন বছরের সংসদ-বর্জন থেকে শুরু করে সামগ্রিক আন্দোলনের ধারা এবং সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এমনটাই ইঙ্গিত দেয় যে যেভাবেই হোক সরকার পতন হচ্ছে তাদের মূল লক্ষ্য। অতএব সরকারের নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা অবশ্যই ভালো কিছুর অন্যতম প্রধান। তবে জনগণের হয়রানিকে গ্রহণ করেও বলতে হয় দু-একদিনের হয়রানি হলেও লাগাতার বড় হয়রানির চেয়ে তা উত্তম। ভোটের মাধ্যমে ছাড়া সরকার পতনের রেওয়াজ এ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না।
১২ মার্চ আমরা বোধহয় আরও একটা ভালো কিছু দেখলাম। পুলিশ-র্যাব আর দলীয় সমর্থক ছাড়াও বিজিবিকে মাঠে দেখা গেল। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সরকার কি আসলেই বেশ ভয় পেয়েছিল? সমাবেশের আড়ালে-আবডালে কি ভিন্ন কিছুর গন্ধ পেয়েছিল সরকার? নচেৎ এত পুলিশ-র্যাবের পর আবার বিজিবিও কেন? শিক্ষাটা পরে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলেও কাজে লাগানো যাবে। তখন হয়তো আরেক ধাপ এগিয়ে আওয়ামী কোন মহাসমাবেশ ঠেকাতে পুলিশ-র্যাব-বিজিবির পাশে সেনা মোতায়েনও হয়ে যেতে পারে, আর তেমন কিছু হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তখনও ঘোষণা থাকবে একটাই জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে সরকার কোন ত্র“টি করবে না। সিরিয়াস কিছু ভালো পাওনার পরও শফিউল আলম প্রধানের বক্তব্য (সমকাল, ১৩ মার্চ) ‘এই স্বাধীনতার মাসে চিরকুমারী ‘মুখ্যমন্ত্রী’ খালেদা জিয়াকে আমরা আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় দেখতে চাই না’ এবং যুবদল সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবের মাইকে দেয়া স্লোগান ‘খালেদা জিয়ার দিন শেষ/শেখ হাসিনার বাংলাদশ’ কি তাদের অজান্তেই ভেতরের সত্যকে প্রকাশ করে ফেলল নাকি? এমন দুটি বক্তব্য বা স্লোগানকে ভালো কিছুর বাইরে রাখা নিশ্চয়ই অশোভন হতে পারে।
১০ মার্চ যুগান্তরে ‘১২ মার্চ ভালো কিছুই হবে না’ প্রকাশের পর কয়েকজন আমাকে ‘গণক’ বলে ঠাট্টা করেছেন, কেউ কেউ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এখন ‘১২ মার্চ ভালো কিছুই হল!’ পড়ে তারা নিশ্চয়ই খুশি হবেন। আমি ভাবছি ২৯ মার্চ না হয় চিরাচরিত নিয়মে সারাদেশে হরতাল হয়ে যাবে, কিন্তু ১০ জুনের মধ্যে ম্যাডামের দেয়া আলটিমেটাম কি বাস্তবতা পাবে? ম্যাডাম আসলেই যদি তেমন কিছু চান, দয়া করে সংসদে যান। নচেৎ ১১ জুন আরেক সমাবেশে সরকার পতনের ডাক হয়তো দিতে পারবেন, কিন্তু সরকারের পতনের জন্য আরও দুই বছর ভোটের অপেক্ষায়ই যে থাকতে হবে আপনাকে ভেতরের সে কথাটি কিন্তু প্রকাশ করবেন না যেন।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন