একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে মেজর জিয়ার বিদ্রোহ ঘোষণার বীরত্বপূর্ণ ঘটনা এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহর চোখে। তিনি বলেন, এই বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়েই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে শুরু হয় বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ সংগ্রাম, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধ। মেজর জিয়া সেদিন ‘বিদ্রোহ ঘোষণা’ করেই দায়িত্ব শেষ করেননি, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাটিও দেন। তিনি বাঙালি সৈনিকদের একত্রিত করেন এবং একটি সামরিক পরিকল্পনাও দেন। এই পরিকল্পনাতেই আমরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সেদিন আমরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্নেল জানজুয়াসহ পাকিস্তানি অফিসারদের হত্যা করি এবং বেলুচ রেজিমেন্টকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্ত্রশস্ত্র দেয়া ঠেকিয়ে দিই। সেদিন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শে বেলুচ রেজিমেন্টকে অস্ত্র সরবরাহ ঠেকিয়ে দিতে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম। নইলে আমাদের বিপদ আরও বেড়ে যেতো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহর কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনও তরতাজা হয়ে আছে। দৈনিক আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ওইসব ঐতিহাসিক ঘটনাই তুলে ধরেন।
ক্যাপ্টেন আহসান উল্লাহ বলেন, সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানিরা যে ক্ষমতা দেবে না তা নির্বাচনের পর থেকেই বুঝতে পারছিলাম। একাত্তরের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর আমরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হয়ে যাই, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তেই হবে। আমরা বাঙালি সৈনিকদের কাছে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি ‘গ্রিন সিগন্যাল’। তাছাড়া পাকিস্তানিদের গতিবিধি এবং তাদের আচরণও আমাদের সন্দিগ্ধ করে তোলে। পাকিস্তানিরা আমাদের কৌশলে কীভাবে নিরস্ত্র করবে, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছিল। একইসঙ্গে তারা বাঙালি সৈনিকদের অন্য কাজে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিচ্ছিল। ষোলশহর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নে বাঙালি অফিসার এবং সৈনিকদেরই প্রাধান্য ছিল। এই ব্যাটালিয়নের পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়া ২৪ মার্চ হঠাত্ করেই আন্তঃকোম্পানি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিক্সসহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হলো। ২৪ মার্চ বিকালে আমরা মাঠে খেলাধুলা করছি। এ সময় দেখি, ২৪ বেলুচ রেজিমেন্টের সাঁজোয়া গাড়িসহ পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম রিয়াজ উদ্দিন বাজারের দিকে যাচ্ছে। ষোলশহর সিডিএ মার্কেটে ছিল আমাদের ব্যাটালিয়ন। এ সময় ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি। কর্নেল জানজুয়া তাকে অর্ডার দিয়েছে বেলুচ রেজিমেন্টের কাছে যেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেয়া হয়। এর আগে অবশ্য অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাকিস্তানের খারিয়ায় বদলি করার আদেশ করানো হয়। আমাকেও সেখানে বদলি করা হয়। যা-ই হোক, আমরা দেখলাম ক্যাপ্টেন অলি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অস্ত্র বেলুচ রেজিমেন্টের কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছেন। তখন আমার সঙ্গের বাঙালি সৈনিকরা আমাকে বলল, ওস্তাদ আপনি গোয়েন্দা ইউনিটের লোক। এ তথ্যটি সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়া স্যারকে জানান। সৈনিকদের কথায় আমি মেজর জিয়ার বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বাসায় যাওয়ার পথে হঠাত্ মাথায় বুদ্ধি এলো, আগে রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারকে বলে যদি রেললাইনে একটি ব্যারিকেড করানো যায়, সেটা তো কাজে লাগবে। তাই রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে যাই। তার কানে কানে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অস্ত্রগুলো আটকানোর ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিই। তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন। আমার কথায় পুরোপুরি একমত হলেন। তত্ক্ষণাত্ তিনি একটি রেলওয়ে কার পাঠিয়ে ট্রেনের অনেকগুলো বগি দিয়ে রেলগেট আটকে দিলেন। এরপর আমি গেলাম মেজর জিয়ার বাসায়। কিন্তু বাসায় স্যারকে পেলাম না। তখন শহরে জ্বালাও-পোড়াও চলছে, ব্যারিকেড চলছে। শুনলাম জিয়া স্যার লে. মাহফুজকে নিয়ে কালো পতাকা লাগিয়ে শহরে বের হয়েছেন। বাসায় ছিলেন ম্যাডাম খালেদা জিয়া। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কেন এসেছেন? আমি বললাম, ব্যাটালিয়নের অস্ত্র কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে ক্যাপ্টেন অলি সাহেব বেলুচ রেজিমেন্টকে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তখন ম্যাডাম খালেদা জিয়া আমাকে বললেন, আপনি গিয়ে বলুন মেজর সাহেব না আসা পর্যন্ত যেন অস্ত্র না দেয়া হয়। আমি ম্যাডাম খালেদা জিয়ার এ পরামর্শ নিয়ে দ্রুত ব্যাটালিয়নে যাই এবং সৈনিকদের বলি, জিয়া সাহেব না আসা পর্যন্ত অস্ত্র যেন না যায় সে সম্পর্কে ম্যাডাম জিয়া পরামর্শ দিয়েছেন। একথা শুনে বাঙালি সৈনিকরা নারায়ে তাকবির আল্লাহ আকবর ধ্বনি দিয়ে বেলুচ রেজিমেন্টের গাড়ি থেকে ভারী অস্ত্রগুলো পুনরায় নামিয়ে ফেলে। অলি সাহেবকে দেখলাম যেন দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছেন। এক ঘণ্টা পর কমান্ডিং অফিসারের একটি অর্ডার এল আমি যেন জিয়া সাহেবকে জানিয়ে দিই ২৫ মার্চ সকালে মাঠে হকি খেলার রেফারি করবেন জিয়া সাহেব। আবার আমি জিয়া সাহেবের বাসায় যাই। কিন্তু তখনও তিনি বাসায় ফেরেননি। ম্যাডামকে অর্ডার সম্পর্কে জানিয়ে আসি। আমরা যে অস্ত্র বেলুচ রেজিমেন্টকে দিইনি সে কথাও তাকে জানাই। ২৫ মার্চ সকালে মেজর জিয়া হকি খেলার রেফারি করলেন। ষোলশহর সিডিএ মার্কেটের পূর্ব মাঠে খেলা চলছে। কর্নেল জানজুয়াও খেলা দেখতে এসেছেন। আসলে আমাদের খেলায় ব্যস্ত রেখে পাকিস্তানিরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিল। যাই হোক, খেলা শেষ হওয়ার পর কর্নেল জানজুয়া বললেন, সবাইকে রেলওয়ে গেটে গিয়ে রেলওয়ে কার সরাতে হবে। আমরা সবাই গেলাম। পাঞ্জাবি সৈন্যও ছিল। কিন্তু দেখা গেল কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশ ঠিকমত পালন করা হচ্ছে না। পাঞ্জাবিরা রেলওয়ে কারের যেদিকে ধাক্কা দিচ্ছে, বাঙালিরা তার উল্টো দিকে ধাক্কা দিচ্ছে। এ অবস্থায় রেলওয়ে কার একটুও হেলল না। কর্নেল জানজুয়া রাগ হলেন। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। তিনি ব্যারাকে চলে যান। ডাকেন পানিওর প্লাটুনের (গোলাবারুদ যাদের হাতে থাকে) হাবিলদার ইউনূসকে। তাকে বলা হয়, মাইন দিয়ে ট্রেন উড়িয়ে দিতে। কিন্তু বাঙালি পানিওর হাবিলদার ইউনূস বললেন—স্যার মাইন দিয়ে উড়ালে আমাদের বাসাবাড়ি ক্ষতি হবে। সব গিয়ে পড়বে আমাদের বিল্ডিংয়ে। আমরা বসবাস করতে পারব না। কর্নেল জানজুয়া তখন ডাকল ইএমই আরমোরার একজন পাঞ্জাবি সৈনিককে। তাকে বলা হলো, রেঞ্জ দিয়ে ট্রেনের বগির জোড়া ভেঙে দিতে। নির্দেশ মতে, ইএমই’র পাঞ্জাবি সৈনিকরা ট্রেনের বগির জোড়া খুলে দিল এবং এক কোম্পানি সৈন্য ট্রেন সারিয়ে রেলগেটের ব্যারিকেড সরালো।
ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহ বলেন, পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়ার বড় ভয় ছিল মেজর জিয়াকে নিয়ে। মেজর জিয়াই বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের নিয়ে একটা কিছু করে ফেলতে পারেন সেটা তার বিশ্বাস ছিল। সে জন্য জানজুয়া ব্যারিকেড সরানোর নাম করে মেজর জিয়াকে হত্যার এক পরিকল্পনা নেন। ষোলশহর রেলগেট থেকে ট্রেনের বগিগুলো সরানোর পর কর্নেল জানজুয়া পুরো ব্যাটালিয়নকে দু’ভাগ করলেন। ক্যাপ্টেন অলি ও ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে এবি আলফা ও ব্যাভো কোম্পানি সঙ্গে দিয়ে বললেন, তারা যেন ষোলশহর রেলগেট থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত যাবতীয় ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে।
অন্যদিকে মেজর জিয়াউর রহমান ও ক্যাপ্টেন সাদেকুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয় চার্লি ও ডেল্টা অর্থাত্ সি এবং ডি কোম্পানি নিয়ে তিনি যেন ষোলশহর থেকে বন্দর পর্যন্ত সব ব্যারিকেড সরিয়ে বন্দরে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার আনসারির কাছে রিপোর্ট করেন। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় কর্নেল জানজুয়া নিজে এসে মেজর জিয়াকে গাড়িতে তুলে দেন। পরিকল্পনা ছিল ব্যারিকেড সরিয়ে তারা বন্দরে যাবে। সেখানে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর পরপর মেজর জিয়াসহ সবাইকে হত্যা করা হবে। ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রসহ চারটি জাহাজ এসেছিল। এগুলো হলো—সোয়াত, এমভি শামস, শফিনা-ই-আরব এবং আওরঙ্গজেব। ব্যারিকেডের কারণে অস্ত্র খালাস করা যাচ্ছিল না। যাই হোক, মেজর জিয়া চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানি নিয়ে বন্দরের পথে বের হলেন। রাস্তা পরিষ্কার করে ঠিক সময়ে বন্দরে পৌঁছা যায়নি। শুধু চার্লি কোম্পানি বন্দরে পৌঁছে গিয়েছিল। ওই সময় ব্যাটালিয়নে আমার টেলিফোন ডিউটি ছিল। হঠাত্ দু’জন রিক্রুট সৈনিক গুলিতে আহত হয়ে কাতরাতে কাতরাতে এলো। তাদের কাছে শুনলাম, পাকিস্তানিরা বাঙালি সৈনিকদের হত্যা শুরু করেছে। ক্যান্টনমেন্টে বহু বাঙালিকে তারা মেরেছে ঘুমন্ত অবস্থায়। একদিকে রাগে কাঁপছিলাম, অন্যদিকে অজানা শঙ্কায় অসহায় হওয়ায় মতো অবস্থা। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তখন অ্যাডজুটেম্লট ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। আল্লাহর মর্জি টেলিফোন করে তাকে পেলাম। স্যারকে ঘটনা বলতেই তিনি একটি এম৩৮ ছোট জিপ নিয়ে সিডিএ মার্কেটে সৈনিকদের ব্যারাকে এসে হাজির হলেন। সব ঘটনা শুনে বুঝতে পারলেন মেজর জিয়াকে এই সংবাদ দেয়া প্রয়োজন। না হলে তারা মেজর জিয়াকেও গ্রেফতার করে মেরে ফেলবে। তিনি দ্রুত চলে গেলেন। আমাদের বললেন, সাবধানে থাকতে, তিনি আসছেন। এরই মধ্যে এসব ঘটনা কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন অলিও জেনে গেছেন। তার সঙ্গে কাজ করছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। তিনি ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে বার্তা দিয়ে পাঠালেন মেজর জিয়ার কাছে। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান আগ্রাবাদের কাছে গিয়ে মেজর জিয়াকে পাকিস্তানিদের বাঙালি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানাতেই মেজর জিয়া বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিলেন ওই আগ্রাবাদের রাস্তায়। তিনি তার সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাবু করে গাড়ি ফেরালেন এবং ষোলশহর সিডিএ মার্কেটে ব্যাটালিয়নের দিকে রওয়ানা হলেন। ওই সময় আমার সঙ্গে ডিউটিতে ছিল কোয়ার্টার গার্ডের ছয় সিপাহী, দু’জন গার্ড কমান্ডার, একজন বিউগলার, হাবিলদার ইউনুস ও ব্যাটালিয়নের সুইপার। গুলি খাওয়া রিক্রুটদের আমরা ফাস্ট এইড দিলাম। এ সময় বিমান বাহিনীর চারজন অফিসার এলেন। তাদের একজন আমাদের ব্যাটালিয়নের পাঞ্জাবি অফিসার লে. আজম। এরা চারজন কোয়ার্টার গার্ডে এসে গার্ড কমান্ডার আলী হোসেনকে বললেন—বাইরের অবস্থা ভালো নয়। আমাদের একজনের কাছে রাইফেল আছে। অন্যদের হাতেও অস্ত্র দরকার। কোয়ার্টার গার্ডের চাবি দাও, তাদের অস্ত্র দিতে হবে। তখন আলী হোসেন বলল—আপনি ডিউটি অফিসারও নন, জেসিও নন। আপনাকে চাবি দিতে পারব না। ওই চারজনের মধ্যে যার কাছে অস্ত্র আছে সে আলী হোসেনকে গুলি করতে রাইফেল উঠাল। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সিপাহিরা তার রাইফেল কেড়ে নিল। আমি গিয়ে বললাম—সবাইকে ধরে কোয়ার্টার গার্ডের খাঁচায় ঢুকিয়ে ফেল। ফলে বাঙালি গার্ড ও সিপাহীরা তাদের ধরে খাঁচায় ঢুকিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পরই এলেন মেজর জিয়া ও মেজর মীর শওকত। মেজর জিয়া কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি চারজনকে দেখে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন—মেহমানরা কারা? আমরা ঘটনা খুলে বললাম। তিনি আমাকে বললেন— আহসান আমাকে ‘এক তিন গার্ড’ দাও। অর্থাত্ একজন কমান্ডার ও তিনজন সিপাহি অস্ত্রসহ। আমি মেজর জিয়াকে এক তিন গার্ড দিলাম। মেজর জিয়া কমান্ডিং অফিসারের গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন কর্নেল জানজুয়ার বাসায়। এর আগে তিনি গার্ডদের ব্রিফ করলেন। বাসায় পৌঁছে তিনি কলিংবেল চাপলেন। বাসার ভেতর থেকে কর্নেল জানজুয়া বললেন—‘তুম কোন হ্যাঁ?’ জিয়া বললেন—মে জিয়া হোঁ। তুম কিসলিয়ে আয়া হে? জিয়া বললেন—‘স্যার বাহার হালত আচ্ছা নেহি হ্যায়, আপকা পাছ সাজেশন লেনে কি লিয়ে আয়া হ্যায়।’ অর্থাত্ বাইরের অবস্থা ভালো নয়। আপনার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে এসেছি। এ অবস্থায় দরজা খুলতেই মেজর জিয়া কর্নেল জানজুয়ার কলার গলাসুদ্ধ ধরে ফেলেন। সঙ্গে গার্ডরাও তার চারদিকে অস্ত্র ধরে তাকে বাসা থেকে টেনে বের করে গাড়িতে তোলেন। তার পরনে ছিল পায়জামা। মেজর জিয়া জানজুয়াকে বলেন, তুমি আমাকে বন্দরে পাঠিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলে? এখন লক্ষ্মী সোনার মতো গাড়িতে উঠো। কর্নেল জানজোয়াকে নিয়ে তিনি কোয়ার্টার গার্ডে এলেন এবং খাঁচায় ভরলেন। কোয়ার্টার গার্ডের রেজিস্ট্রার টেবিলের ওপর বসলেন জানজুয়া। ওই খাঁচায় পাঞ্জাবি লে. আজমসহ আটককৃত আরও চারজন। জিয়াউর রহমান সবগুলো কোম্পানিকে একত্রিত করার নির্দেশ দিলেন। মেজর জিয়াকে নিয়ে যে দুটি কোম্পানি বন্দরের দিকে গিয়েছিল তার মধ্যে চার্লি কোম্পানি বন্দরে ঢুকে যাওয়ায় তারা আর ফিরতে পারেনি। পরে শুনেছি তাদের হত্যা করা হয়েছে। হাশেম নামের একজন সৈনিক সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে পড়ে বেঁচে যায়। যাই হোক, বাঙালিরা ব্যাটালিয়নে একত্রিত হলো। ব্যাটালিয়নের পাকিস্তানি অফিসার, সৈনিক ও অন্যদের গ্রেফতার করা হলো। এ সময় কোয়ার্টার গার্ডের খাঁচার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন মেজর জিয়া। খাঁচার ভেতর থেকে কর্নেল জানজুয়া পাঞ্জাবি লে. আজমকে চিন্তিত দেখে বলছিলেন— ‘আজম তুম কিয়া সুস্তা হ্যায়, আউর পাঁচ মিনিট হ্যাঁয়, পাঁচ মিনিট কা বাদ এইট বেঙ্গল কা কুই নিশানা নেহি মিলে গা।’ অর্থাত্ আজম তুমি কি চিন্তা করছ? পাঁচ মিনিট পর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। মেজর জিয়া কর্ণেল জানজুয়ার দম্ভোক্তি শুনেই উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন—ওদের বের করে কমান্ডিং অফিসারের কক্ষে ঢোকাও। সঙ্গে সঙ্গে সব বন্দিকে সিও’র অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। মেজর জিয়া আদেশ দিলেন ফায়ার করো। সিও’র রানার আবদুল মতিন ফায়ার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও ফায়ার করা শুরু করল। এ সময় বন্দিদের মধ্য থেকে একজন এয়ারফোর্সের অফিসার চিত্কার করে বললেন—‘আমি বাঙালি, আমাকে মারবেন না।’ তাকে বের করে বাকিদের ওপর চালানো হলো ফায়ার। ওখানে ২০ থেকে ২৫ জন পাকিস্তানি ছিল।
রাত তখন প্রায় ২টা। ২৫ মার্চ গিয়ে ২৬ মার্চের সূচনা। মেজর জিয়া সব বাঙালি অফিসার, গার্ড, জেসিও, সিপাহিদের একত্রিত করলেন। ষোলশহর ব্যাটালিয়নে কয়েকশ’ বাঙালি সৈনিক আমরা সমবেত হলাম। মেজর জিয়া বললেন—‘উই রিভোল্ট’। আমরা বিদ্রোহ করলাম। আজ থেকে আমরা আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে নেই। আমরা বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করে আমাদের এই মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে আমরা সবাই জীবন দেব। সবাই এক বাক্যে আমরা আমাদের একই শপথের কথা জানালাম। এরপর মেজর জিয়া একটি সামরিক পরিকল্পনা বা যুদ্ধ কৌশল আমাদের দিলেন। তিনি বলেন, আত্মরক্ষার জন্য ইউনিফর্ম আমরা পরিত্যাগ করে সিভিল ড্রেস পরব। যে কোনো সময় হামলা হতে পারে, তাই এখানে থাকা আমাদের আর ঠিক হবে না। এই জায়গা দ্রুত ছেড়ে দিতে হবে। ২৬ মার্চের সূচনায় তার ঐতিহাসিক বিদ্রোহ ঘোষণা সম্পন্ন করে ভাষণ দেয়ার পর ব্যাটালিয়নে অস্ত্র নিয়ে সবাই ষোলশহর ত্যাগ করলাম। সারারাত আমরা রেললাইন ধরে কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হলাম। যাওয়ার পথে মেজর জিয়ার বাসা পাশেই ছিল। কেউ একজন মেজর জিয়াকে বললেন— স্যার পাশেই আপনার বাসা। ম্যাডামের সঙ্গে একটু সাক্ষাত্ করে গেলে ভালো হয়। মেজর জিয়া বললেন—তোমরা কি তোমাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে পারবে? আমরা এখন দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নেমেছি। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ফিরে তাকানোর আর সুযোগ নেই। সামনে এগিয়ে যাও।
রেললাইন ধরে সারারাত হেঁটে ২৬ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে আমরা কালুরঘাট ব্রিজ পার হলাম। কক্সবাজার রোডে ব্রিজের কাছে ইপিআরের একটি কোম্পানি নিয়ে মেজর রফিক সাহেব আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। সবাইকে নিয়ে একটি পাহাড়ের ভেতর আমরা পুরো দিন কাটালাম। পাহাড়ের পাশের গ্রাম থেকে লোকজন আমাদের জন্য খাবার সরবরাহ করলেন। সন্ধ্যার পর কালুরঘাট ব্রিজের কাছে একটি স্কুলে এসে অবস্থান নেয়ার পর মেজর জিয়া সবাইকে বললেন আর্মি পোশাক ছেড়ে সিভিল পোশাক পরতে। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে কাপড় আনা হলো। এক বাড়ি থেকে মেজর জিয়ার জন্যও ফতুয়া এবং লুঙ্গি আনা হলো। লোকজন খুশি হয়ে আমাদের জন্য পোশাক দিলেন। এরপর কর্ণফুলী নদী পার হয়ে আমরা ডিফেন্স নিলাম। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গেলেন। মেজর জিয়াকে পেয়ে বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা বেশ উত্ফুল্ল হলেন। মেজর জিয়া বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দেন। পরবর্তীকালে তার এই ঘোষণাটি কিছুক্ষণ পর পর বেতার থেকে নিউজ বুলেটিন আকারে পড়ে শোনান ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া ও লে. শমসের মবিন চৌধুরী। মেজর জিয়ার এই ঘোষণা সেদিন দিকনির্দেশনাহীন জাতির মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল এবং তারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
২৭ মার্চ আমরা কালুরঘাট ব্রিজের হিন্দুপাড়ায় রাতযাপন করি। ২৮ মার্চ খবর আসে পাকবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মেজর জিয়ার নির্দেশে আমরা কুমিরায় গিয়ে ডিফেন্স নিই। দেখতে পাই পাকিস্তানিরা বাঙালি সাধারণ মানুষকে সামনে ঢাল হিসেবে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অ্যামবুশ অবস্থা থেকেই আমরা চিত্কার করে বাঙালিদের শুয়ে পড়তে বলি। বাঙালিরা মাটিতে শুয়ে পড়লে আমরা ফায়ার শুরু করি। পাকিস্তানিদের সঙ্গে কুমিরার এই যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছিল। অবশ্য বেশিক্ষণ আমরা এই প্রতিরোধ ব্যুহ টিকিয়ে রাখতে পারিনি। পাকিস্তানিরা ফায়ার করতে করতে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ঢুকে আমাদের ঘিরে ফেলার অবস্থা করে। আমরা খাল দিয়ে বেরিয়ে যাই। এরপর আমরা অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহ বলেন, বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেশ কিছুদিন পর আমি ভারতে যাই। কলকাতার থিয়েটার রোডে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি আমাকে আবার মেঘালয়ে তুরা পাহাড়ে মেজর জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সে পাঠিয়ে দেন। মেজর জিয়া আমাকে তার অফিসের কাজে দায়িত্ব দেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ‘জেড ফোর্স’। একাত্তরের রণাঙ্গনে ‘জেড ফোর্সের’ যুদ্ধগুলো ছিল স্মরণীয়। মেজর জিয়াকে দেখেছি প্রতিটি যুদ্ধে নিজে অংশ নিয়েছেন, তদারকি করেছেন।
একবার সিলেটের কানাইঘাট এলাকায় যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমরা। দু’দিন কেউই কিছু খাইনি। বড় বিল পার হয়ে টিলার মাঝখানে বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাত্ জিয়া সাহেব আমাকে ডেকে বললেন আহসান উল্লাহ দেখ তো কোথাও থেকে এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কি-না। আমি চায়ের জন্য প্রথম বেঙ্গলে খোঁজ নিলাম, পেলাম না। জেড ফোর্স ডিফেন্স প্লাটুনে গেলাম। প্লাটুন কমান্ডার সুলতান সাহেব বললেন কিছু চা পাতা ছিল, সেটা দিয়ে আমরা চা করে খেয়েছি। পরিত্যক্ত পাতা দিয়ে যদি কিছু চা করা যায় চেষ্টা করুন।
আমি তা-ই করলাম। পরিত্যক্ত পাতা গরম করে একটি মগে করে জিয়া সাহেবের জন্য আনলাম। আসার পথে একটি বেগুন ক্ষেত পেলাম। সেখান থেকে বেগুন পেড়ে আমি কাঁচা খেলাম এবং জিয়া সাহেবের জন্য দুটি নিয়ে এলাম। জিয়া সাহেবকে বললাম, স্যার আমি কাঁচা বেগুন খেয়েছি, আপনি কি খেতে পারবেন? তিনি আমার হাত থেকে দুটি বেগুন নিয়ে খেলেন। এরপর চা খেলেন। অবশ্য সেটা চা ছিল না, চায়ের নামে গরম পানি।
abdal62@gmail.com। সুত্র আমারদেশ ২৯ মার্চ ২০১২শুক্রবার শুক্রবার ৩০ মার্চ ২০১২৩০ মার্চ ২০১২
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহর কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনও তরতাজা হয়ে আছে। দৈনিক আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ওইসব ঐতিহাসিক ঘটনাই তুলে ধরেন।
ক্যাপ্টেন আহসান উল্লাহ বলেন, সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানিরা যে ক্ষমতা দেবে না তা নির্বাচনের পর থেকেই বুঝতে পারছিলাম। একাত্তরের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর আমরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হয়ে যাই, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তেই হবে। আমরা বাঙালি সৈনিকদের কাছে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি ‘গ্রিন সিগন্যাল’। তাছাড়া পাকিস্তানিদের গতিবিধি এবং তাদের আচরণও আমাদের সন্দিগ্ধ করে তোলে। পাকিস্তানিরা আমাদের কৌশলে কীভাবে নিরস্ত্র করবে, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছিল। একইসঙ্গে তারা বাঙালি সৈনিকদের অন্য কাজে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিচ্ছিল। ষোলশহর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নে বাঙালি অফিসার এবং সৈনিকদেরই প্রাধান্য ছিল। এই ব্যাটালিয়নের পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়া ২৪ মার্চ হঠাত্ করেই আন্তঃকোম্পানি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিক্সসহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হলো। ২৪ মার্চ বিকালে আমরা মাঠে খেলাধুলা করছি। এ সময় দেখি, ২৪ বেলুচ রেজিমেন্টের সাঁজোয়া গাড়িসহ পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম রিয়াজ উদ্দিন বাজারের দিকে যাচ্ছে। ষোলশহর সিডিএ মার্কেটে ছিল আমাদের ব্যাটালিয়ন। এ সময় ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি। কর্নেল জানজুয়া তাকে অর্ডার দিয়েছে বেলুচ রেজিমেন্টের কাছে যেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেয়া হয়। এর আগে অবশ্য অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাকিস্তানের খারিয়ায় বদলি করার আদেশ করানো হয়। আমাকেও সেখানে বদলি করা হয়। যা-ই হোক, আমরা দেখলাম ক্যাপ্টেন অলি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অস্ত্র বেলুচ রেজিমেন্টের কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছেন। তখন আমার সঙ্গের বাঙালি সৈনিকরা আমাকে বলল, ওস্তাদ আপনি গোয়েন্দা ইউনিটের লোক। এ তথ্যটি সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়া স্যারকে জানান। সৈনিকদের কথায় আমি মেজর জিয়ার বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বাসায় যাওয়ার পথে হঠাত্ মাথায় বুদ্ধি এলো, আগে রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারকে বলে যদি রেললাইনে একটি ব্যারিকেড করানো যায়, সেটা তো কাজে লাগবে। তাই রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে যাই। তার কানে কানে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অস্ত্রগুলো আটকানোর ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিই। তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন। আমার কথায় পুরোপুরি একমত হলেন। তত্ক্ষণাত্ তিনি একটি রেলওয়ে কার পাঠিয়ে ট্রেনের অনেকগুলো বগি দিয়ে রেলগেট আটকে দিলেন। এরপর আমি গেলাম মেজর জিয়ার বাসায়। কিন্তু বাসায় স্যারকে পেলাম না। তখন শহরে জ্বালাও-পোড়াও চলছে, ব্যারিকেড চলছে। শুনলাম জিয়া স্যার লে. মাহফুজকে নিয়ে কালো পতাকা লাগিয়ে শহরে বের হয়েছেন। বাসায় ছিলেন ম্যাডাম খালেদা জিয়া। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কেন এসেছেন? আমি বললাম, ব্যাটালিয়নের অস্ত্র কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে ক্যাপ্টেন অলি সাহেব বেলুচ রেজিমেন্টকে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তখন ম্যাডাম খালেদা জিয়া আমাকে বললেন, আপনি গিয়ে বলুন মেজর সাহেব না আসা পর্যন্ত যেন অস্ত্র না দেয়া হয়। আমি ম্যাডাম খালেদা জিয়ার এ পরামর্শ নিয়ে দ্রুত ব্যাটালিয়নে যাই এবং সৈনিকদের বলি, জিয়া সাহেব না আসা পর্যন্ত অস্ত্র যেন না যায় সে সম্পর্কে ম্যাডাম জিয়া পরামর্শ দিয়েছেন। একথা শুনে বাঙালি সৈনিকরা নারায়ে তাকবির আল্লাহ আকবর ধ্বনি দিয়ে বেলুচ রেজিমেন্টের গাড়ি থেকে ভারী অস্ত্রগুলো পুনরায় নামিয়ে ফেলে। অলি সাহেবকে দেখলাম যেন দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছেন। এক ঘণ্টা পর কমান্ডিং অফিসারের একটি অর্ডার এল আমি যেন জিয়া সাহেবকে জানিয়ে দিই ২৫ মার্চ সকালে মাঠে হকি খেলার রেফারি করবেন জিয়া সাহেব। আবার আমি জিয়া সাহেবের বাসায় যাই। কিন্তু তখনও তিনি বাসায় ফেরেননি। ম্যাডামকে অর্ডার সম্পর্কে জানিয়ে আসি। আমরা যে অস্ত্র বেলুচ রেজিমেন্টকে দিইনি সে কথাও তাকে জানাই। ২৫ মার্চ সকালে মেজর জিয়া হকি খেলার রেফারি করলেন। ষোলশহর সিডিএ মার্কেটের পূর্ব মাঠে খেলা চলছে। কর্নেল জানজুয়াও খেলা দেখতে এসেছেন। আসলে আমাদের খেলায় ব্যস্ত রেখে পাকিস্তানিরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিল। যাই হোক, খেলা শেষ হওয়ার পর কর্নেল জানজুয়া বললেন, সবাইকে রেলওয়ে গেটে গিয়ে রেলওয়ে কার সরাতে হবে। আমরা সবাই গেলাম। পাঞ্জাবি সৈন্যও ছিল। কিন্তু দেখা গেল কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশ ঠিকমত পালন করা হচ্ছে না। পাঞ্জাবিরা রেলওয়ে কারের যেদিকে ধাক্কা দিচ্ছে, বাঙালিরা তার উল্টো দিকে ধাক্কা দিচ্ছে। এ অবস্থায় রেলওয়ে কার একটুও হেলল না। কর্নেল জানজুয়া রাগ হলেন। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। তিনি ব্যারাকে চলে যান। ডাকেন পানিওর প্লাটুনের (গোলাবারুদ যাদের হাতে থাকে) হাবিলদার ইউনূসকে। তাকে বলা হয়, মাইন দিয়ে ট্রেন উড়িয়ে দিতে। কিন্তু বাঙালি পানিওর হাবিলদার ইউনূস বললেন—স্যার মাইন দিয়ে উড়ালে আমাদের বাসাবাড়ি ক্ষতি হবে। সব গিয়ে পড়বে আমাদের বিল্ডিংয়ে। আমরা বসবাস করতে পারব না। কর্নেল জানজুয়া তখন ডাকল ইএমই আরমোরার একজন পাঞ্জাবি সৈনিককে। তাকে বলা হলো, রেঞ্জ দিয়ে ট্রেনের বগির জোড়া ভেঙে দিতে। নির্দেশ মতে, ইএমই’র পাঞ্জাবি সৈনিকরা ট্রেনের বগির জোড়া খুলে দিল এবং এক কোম্পানি সৈন্য ট্রেন সারিয়ে রেলগেটের ব্যারিকেড সরালো।
ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহ বলেন, পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়ার বড় ভয় ছিল মেজর জিয়াকে নিয়ে। মেজর জিয়াই বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের নিয়ে একটা কিছু করে ফেলতে পারেন সেটা তার বিশ্বাস ছিল। সে জন্য জানজুয়া ব্যারিকেড সরানোর নাম করে মেজর জিয়াকে হত্যার এক পরিকল্পনা নেন। ষোলশহর রেলগেট থেকে ট্রেনের বগিগুলো সরানোর পর কর্নেল জানজুয়া পুরো ব্যাটালিয়নকে দু’ভাগ করলেন। ক্যাপ্টেন অলি ও ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে এবি আলফা ও ব্যাভো কোম্পানি সঙ্গে দিয়ে বললেন, তারা যেন ষোলশহর রেলগেট থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত যাবতীয় ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে।
অন্যদিকে মেজর জিয়াউর রহমান ও ক্যাপ্টেন সাদেকুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয় চার্লি ও ডেল্টা অর্থাত্ সি এবং ডি কোম্পানি নিয়ে তিনি যেন ষোলশহর থেকে বন্দর পর্যন্ত সব ব্যারিকেড সরিয়ে বন্দরে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার আনসারির কাছে রিপোর্ট করেন। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় কর্নেল জানজুয়া নিজে এসে মেজর জিয়াকে গাড়িতে তুলে দেন। পরিকল্পনা ছিল ব্যারিকেড সরিয়ে তারা বন্দরে যাবে। সেখানে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর পরপর মেজর জিয়াসহ সবাইকে হত্যা করা হবে। ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রসহ চারটি জাহাজ এসেছিল। এগুলো হলো—সোয়াত, এমভি শামস, শফিনা-ই-আরব এবং আওরঙ্গজেব। ব্যারিকেডের কারণে অস্ত্র খালাস করা যাচ্ছিল না। যাই হোক, মেজর জিয়া চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানি নিয়ে বন্দরের পথে বের হলেন। রাস্তা পরিষ্কার করে ঠিক সময়ে বন্দরে পৌঁছা যায়নি। শুধু চার্লি কোম্পানি বন্দরে পৌঁছে গিয়েছিল। ওই সময় ব্যাটালিয়নে আমার টেলিফোন ডিউটি ছিল। হঠাত্ দু’জন রিক্রুট সৈনিক গুলিতে আহত হয়ে কাতরাতে কাতরাতে এলো। তাদের কাছে শুনলাম, পাকিস্তানিরা বাঙালি সৈনিকদের হত্যা শুরু করেছে। ক্যান্টনমেন্টে বহু বাঙালিকে তারা মেরেছে ঘুমন্ত অবস্থায়। একদিকে রাগে কাঁপছিলাম, অন্যদিকে অজানা শঙ্কায় অসহায় হওয়ায় মতো অবস্থা। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তখন অ্যাডজুটেম্লট ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। আল্লাহর মর্জি টেলিফোন করে তাকে পেলাম। স্যারকে ঘটনা বলতেই তিনি একটি এম৩৮ ছোট জিপ নিয়ে সিডিএ মার্কেটে সৈনিকদের ব্যারাকে এসে হাজির হলেন। সব ঘটনা শুনে বুঝতে পারলেন মেজর জিয়াকে এই সংবাদ দেয়া প্রয়োজন। না হলে তারা মেজর জিয়াকেও গ্রেফতার করে মেরে ফেলবে। তিনি দ্রুত চলে গেলেন। আমাদের বললেন, সাবধানে থাকতে, তিনি আসছেন। এরই মধ্যে এসব ঘটনা কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন অলিও জেনে গেছেন। তার সঙ্গে কাজ করছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। তিনি ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে বার্তা দিয়ে পাঠালেন মেজর জিয়ার কাছে। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান আগ্রাবাদের কাছে গিয়ে মেজর জিয়াকে পাকিস্তানিদের বাঙালি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানাতেই মেজর জিয়া বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিলেন ওই আগ্রাবাদের রাস্তায়। তিনি তার সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাবু করে গাড়ি ফেরালেন এবং ষোলশহর সিডিএ মার্কেটে ব্যাটালিয়নের দিকে রওয়ানা হলেন। ওই সময় আমার সঙ্গে ডিউটিতে ছিল কোয়ার্টার গার্ডের ছয় সিপাহী, দু’জন গার্ড কমান্ডার, একজন বিউগলার, হাবিলদার ইউনুস ও ব্যাটালিয়নের সুইপার। গুলি খাওয়া রিক্রুটদের আমরা ফাস্ট এইড দিলাম। এ সময় বিমান বাহিনীর চারজন অফিসার এলেন। তাদের একজন আমাদের ব্যাটালিয়নের পাঞ্জাবি অফিসার লে. আজম। এরা চারজন কোয়ার্টার গার্ডে এসে গার্ড কমান্ডার আলী হোসেনকে বললেন—বাইরের অবস্থা ভালো নয়। আমাদের একজনের কাছে রাইফেল আছে। অন্যদের হাতেও অস্ত্র দরকার। কোয়ার্টার গার্ডের চাবি দাও, তাদের অস্ত্র দিতে হবে। তখন আলী হোসেন বলল—আপনি ডিউটি অফিসারও নন, জেসিও নন। আপনাকে চাবি দিতে পারব না। ওই চারজনের মধ্যে যার কাছে অস্ত্র আছে সে আলী হোসেনকে গুলি করতে রাইফেল উঠাল। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সিপাহিরা তার রাইফেল কেড়ে নিল। আমি গিয়ে বললাম—সবাইকে ধরে কোয়ার্টার গার্ডের খাঁচায় ঢুকিয়ে ফেল। ফলে বাঙালি গার্ড ও সিপাহীরা তাদের ধরে খাঁচায় ঢুকিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পরই এলেন মেজর জিয়া ও মেজর মীর শওকত। মেজর জিয়া কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি চারজনকে দেখে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন—মেহমানরা কারা? আমরা ঘটনা খুলে বললাম। তিনি আমাকে বললেন— আহসান আমাকে ‘এক তিন গার্ড’ দাও। অর্থাত্ একজন কমান্ডার ও তিনজন সিপাহি অস্ত্রসহ। আমি মেজর জিয়াকে এক তিন গার্ড দিলাম। মেজর জিয়া কমান্ডিং অফিসারের গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন কর্নেল জানজুয়ার বাসায়। এর আগে তিনি গার্ডদের ব্রিফ করলেন। বাসায় পৌঁছে তিনি কলিংবেল চাপলেন। বাসার ভেতর থেকে কর্নেল জানজুয়া বললেন—‘তুম কোন হ্যাঁ?’ জিয়া বললেন—মে জিয়া হোঁ। তুম কিসলিয়ে আয়া হে? জিয়া বললেন—‘স্যার বাহার হালত আচ্ছা নেহি হ্যায়, আপকা পাছ সাজেশন লেনে কি লিয়ে আয়া হ্যায়।’ অর্থাত্ বাইরের অবস্থা ভালো নয়। আপনার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে এসেছি। এ অবস্থায় দরজা খুলতেই মেজর জিয়া কর্নেল জানজুয়ার কলার গলাসুদ্ধ ধরে ফেলেন। সঙ্গে গার্ডরাও তার চারদিকে অস্ত্র ধরে তাকে বাসা থেকে টেনে বের করে গাড়িতে তোলেন। তার পরনে ছিল পায়জামা। মেজর জিয়া জানজুয়াকে বলেন, তুমি আমাকে বন্দরে পাঠিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলে? এখন লক্ষ্মী সোনার মতো গাড়িতে উঠো। কর্নেল জানজোয়াকে নিয়ে তিনি কোয়ার্টার গার্ডে এলেন এবং খাঁচায় ভরলেন। কোয়ার্টার গার্ডের রেজিস্ট্রার টেবিলের ওপর বসলেন জানজুয়া। ওই খাঁচায় পাঞ্জাবি লে. আজমসহ আটককৃত আরও চারজন। জিয়াউর রহমান সবগুলো কোম্পানিকে একত্রিত করার নির্দেশ দিলেন। মেজর জিয়াকে নিয়ে যে দুটি কোম্পানি বন্দরের দিকে গিয়েছিল তার মধ্যে চার্লি কোম্পানি বন্দরে ঢুকে যাওয়ায় তারা আর ফিরতে পারেনি। পরে শুনেছি তাদের হত্যা করা হয়েছে। হাশেম নামের একজন সৈনিক সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে পড়ে বেঁচে যায়। যাই হোক, বাঙালিরা ব্যাটালিয়নে একত্রিত হলো। ব্যাটালিয়নের পাকিস্তানি অফিসার, সৈনিক ও অন্যদের গ্রেফতার করা হলো। এ সময় কোয়ার্টার গার্ডের খাঁচার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন মেজর জিয়া। খাঁচার ভেতর থেকে কর্নেল জানজুয়া পাঞ্জাবি লে. আজমকে চিন্তিত দেখে বলছিলেন— ‘আজম তুম কিয়া সুস্তা হ্যায়, আউর পাঁচ মিনিট হ্যাঁয়, পাঁচ মিনিট কা বাদ এইট বেঙ্গল কা কুই নিশানা নেহি মিলে গা।’ অর্থাত্ আজম তুমি কি চিন্তা করছ? পাঁচ মিনিট পর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। মেজর জিয়া কর্ণেল জানজুয়ার দম্ভোক্তি শুনেই উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন—ওদের বের করে কমান্ডিং অফিসারের কক্ষে ঢোকাও। সঙ্গে সঙ্গে সব বন্দিকে সিও’র অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। মেজর জিয়া আদেশ দিলেন ফায়ার করো। সিও’র রানার আবদুল মতিন ফায়ার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও ফায়ার করা শুরু করল। এ সময় বন্দিদের মধ্য থেকে একজন এয়ারফোর্সের অফিসার চিত্কার করে বললেন—‘আমি বাঙালি, আমাকে মারবেন না।’ তাকে বের করে বাকিদের ওপর চালানো হলো ফায়ার। ওখানে ২০ থেকে ২৫ জন পাকিস্তানি ছিল।
রাত তখন প্রায় ২টা। ২৫ মার্চ গিয়ে ২৬ মার্চের সূচনা। মেজর জিয়া সব বাঙালি অফিসার, গার্ড, জেসিও, সিপাহিদের একত্রিত করলেন। ষোলশহর ব্যাটালিয়নে কয়েকশ’ বাঙালি সৈনিক আমরা সমবেত হলাম। মেজর জিয়া বললেন—‘উই রিভোল্ট’। আমরা বিদ্রোহ করলাম। আজ থেকে আমরা আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে নেই। আমরা বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করে আমাদের এই মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে আমরা সবাই জীবন দেব। সবাই এক বাক্যে আমরা আমাদের একই শপথের কথা জানালাম। এরপর মেজর জিয়া একটি সামরিক পরিকল্পনা বা যুদ্ধ কৌশল আমাদের দিলেন। তিনি বলেন, আত্মরক্ষার জন্য ইউনিফর্ম আমরা পরিত্যাগ করে সিভিল ড্রেস পরব। যে কোনো সময় হামলা হতে পারে, তাই এখানে থাকা আমাদের আর ঠিক হবে না। এই জায়গা দ্রুত ছেড়ে দিতে হবে। ২৬ মার্চের সূচনায় তার ঐতিহাসিক বিদ্রোহ ঘোষণা সম্পন্ন করে ভাষণ দেয়ার পর ব্যাটালিয়নে অস্ত্র নিয়ে সবাই ষোলশহর ত্যাগ করলাম। সারারাত আমরা রেললাইন ধরে কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হলাম। যাওয়ার পথে মেজর জিয়ার বাসা পাশেই ছিল। কেউ একজন মেজর জিয়াকে বললেন— স্যার পাশেই আপনার বাসা। ম্যাডামের সঙ্গে একটু সাক্ষাত্ করে গেলে ভালো হয়। মেজর জিয়া বললেন—তোমরা কি তোমাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে পারবে? আমরা এখন দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নেমেছি। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ফিরে তাকানোর আর সুযোগ নেই। সামনে এগিয়ে যাও।
রেললাইন ধরে সারারাত হেঁটে ২৬ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে আমরা কালুরঘাট ব্রিজ পার হলাম। কক্সবাজার রোডে ব্রিজের কাছে ইপিআরের একটি কোম্পানি নিয়ে মেজর রফিক সাহেব আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। সবাইকে নিয়ে একটি পাহাড়ের ভেতর আমরা পুরো দিন কাটালাম। পাহাড়ের পাশের গ্রাম থেকে লোকজন আমাদের জন্য খাবার সরবরাহ করলেন। সন্ধ্যার পর কালুরঘাট ব্রিজের কাছে একটি স্কুলে এসে অবস্থান নেয়ার পর মেজর জিয়া সবাইকে বললেন আর্মি পোশাক ছেড়ে সিভিল পোশাক পরতে। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে কাপড় আনা হলো। এক বাড়ি থেকে মেজর জিয়ার জন্যও ফতুয়া এবং লুঙ্গি আনা হলো। লোকজন খুশি হয়ে আমাদের জন্য পোশাক দিলেন। এরপর কর্ণফুলী নদী পার হয়ে আমরা ডিফেন্স নিলাম। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গেলেন। মেজর জিয়াকে পেয়ে বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা বেশ উত্ফুল্ল হলেন। মেজর জিয়া বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দেন। পরবর্তীকালে তার এই ঘোষণাটি কিছুক্ষণ পর পর বেতার থেকে নিউজ বুলেটিন আকারে পড়ে শোনান ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া ও লে. শমসের মবিন চৌধুরী। মেজর জিয়ার এই ঘোষণা সেদিন দিকনির্দেশনাহীন জাতির মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল এবং তারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
২৭ মার্চ আমরা কালুরঘাট ব্রিজের হিন্দুপাড়ায় রাতযাপন করি। ২৮ মার্চ খবর আসে পাকবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মেজর জিয়ার নির্দেশে আমরা কুমিরায় গিয়ে ডিফেন্স নিই। দেখতে পাই পাকিস্তানিরা বাঙালি সাধারণ মানুষকে সামনে ঢাল হিসেবে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অ্যামবুশ অবস্থা থেকেই আমরা চিত্কার করে বাঙালিদের শুয়ে পড়তে বলি। বাঙালিরা মাটিতে শুয়ে পড়লে আমরা ফায়ার শুরু করি। পাকিস্তানিদের সঙ্গে কুমিরার এই যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছিল। অবশ্য বেশিক্ষণ আমরা এই প্রতিরোধ ব্যুহ টিকিয়ে রাখতে পারিনি। পাকিস্তানিরা ফায়ার করতে করতে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ঢুকে আমাদের ঘিরে ফেলার অবস্থা করে। আমরা খাল দিয়ে বেরিয়ে যাই। এরপর আমরা অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহ বলেন, বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেশ কিছুদিন পর আমি ভারতে যাই। কলকাতার থিয়েটার রোডে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি আমাকে আবার মেঘালয়ে তুরা পাহাড়ে মেজর জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সে পাঠিয়ে দেন। মেজর জিয়া আমাকে তার অফিসের কাজে দায়িত্ব দেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ‘জেড ফোর্স’। একাত্তরের রণাঙ্গনে ‘জেড ফোর্সের’ যুদ্ধগুলো ছিল স্মরণীয়। মেজর জিয়াকে দেখেছি প্রতিটি যুদ্ধে নিজে অংশ নিয়েছেন, তদারকি করেছেন।
একবার সিলেটের কানাইঘাট এলাকায় যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমরা। দু’দিন কেউই কিছু খাইনি। বড় বিল পার হয়ে টিলার মাঝখানে বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাত্ জিয়া সাহেব আমাকে ডেকে বললেন আহসান উল্লাহ দেখ তো কোথাও থেকে এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কি-না। আমি চায়ের জন্য প্রথম বেঙ্গলে খোঁজ নিলাম, পেলাম না। জেড ফোর্স ডিফেন্স প্লাটুনে গেলাম। প্লাটুন কমান্ডার সুলতান সাহেব বললেন কিছু চা পাতা ছিল, সেটা দিয়ে আমরা চা করে খেয়েছি। পরিত্যক্ত পাতা দিয়ে যদি কিছু চা করা যায় চেষ্টা করুন।
আমি তা-ই করলাম। পরিত্যক্ত পাতা গরম করে একটি মগে করে জিয়া সাহেবের জন্য আনলাম। আসার পথে একটি বেগুন ক্ষেত পেলাম। সেখান থেকে বেগুন পেড়ে আমি কাঁচা খেলাম এবং জিয়া সাহেবের জন্য দুটি নিয়ে এলাম। জিয়া সাহেবকে বললাম, স্যার আমি কাঁচা বেগুন খেয়েছি, আপনি কি খেতে পারবেন? তিনি আমার হাত থেকে দুটি বেগুন নিয়ে খেলেন। এরপর চা খেলেন। অবশ্য সেটা চা ছিল না, চায়ের নামে গরম পানি।
abdal62@gmail.com। সুত্র আমারদেশ ২৯ মার্চ ২০১২শুক্রবার শুক্রবার ৩০ মার্চ ২০১২৩০ মার্চ ২০১২
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন