॥ মোহাম্মদ আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ ॥
‘The Weak have one weapon : the errors of those who think they are strong.’
উক্তিটি শাশ্বত সত্যের উদ্ভাস বহন করে। যারা নিজেদের শক্তিশালী মনে করে, তাদের ভুলগুলোই দুর্বলের ক্ষমতায় রূপান্তর আনে। আর এই অস্ত্রটি তারা পাবেই, যেহেতু ক্ষমতাধরেরা ভুলের পাহাড় রচনায় ক্লান্তিহীন। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ভুল সিদ্ধান্ত, প্রতিহিংসা আর নিজেরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ও অসতর্ক বেপরোয়া অতিকথনের মধ্য দিয়ে এখন এত ফ্রন্ট খুলেছে যে, এসব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে ফেললেন : আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরা হবে। পুলিশপ্রধান বললেন, একটুখানি ধৈর্য ধরতে। আর দু-এক দিনের মধ্যেই সব জানতে পারবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার মুখ খুললেন, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং মনিটর করবেন। এবার প্রধানমন্ত্রী মুখ খুললেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। তারপরই বললেন, ঘটনার সব আলামত নষ্ট হয়ে গেছে।’ তারপর সাজানো হবে নাটক। মেঘের দায়িত্ব নিলেন প্রধানমন্ত্রী। ঝড়ের দায়িত্ব নেবে কে?
বিরোধীদলীয় নেতা তার চট্টগ্রামের মহাসমাবেশ থেকেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকা মহাসমাবেশের। তারপর শুরু হলো এক অঘোষিত যুদ্ধ। সমাবেশের জন্য জায়গা দেয়া যাবে না, মাইক দেয়া যাবে না, টিভিতে সরাসরি সমপ্রচার করা যাবে না, সমাবেশে জনসাধারণ যাতে যোগদান করতে না পারে, সেজন্য পথে যত বাধা সৃষ্টি করা সম্ভব তার সবই করেছে সরকারি দল। বাস, ট্রেন, নৌকা, মাইক্রোবাস, স্কুটার, লঞ্চ, জাহাজ সবই থামিয়ে রাখা হলো। উদ্দেশ্য- জনসাধারণ যেন ঢাকার মহাসমাবেশে যোগ দিতে না পারে। কিন' বাস্তবে ১২ মার্চ রূপান্তরিত হলো সরকারি নির্দেশে আয়োজিত এক অভূতপূর্ব হরতালে। তার পরপরই আওয়ামী লীগ আয়োজন করল প্রতিসমাবেশ। এ দিকে বহু দিন পরে বিএনপি সংসদমুখী হলো। বেগম জিয়া তার বক্তৃতায় ১৯৭২ সাল থেকে আওয়ামী লীগের অযোগ্য দেশ পরিচালনার দীর্ঘ তালিকা সংসদে তুলে ধরেন। এরপর শেখ হাসিনা আরেক হাত নিলেন বিএনপিকে। বিরোধী দলের মূল প্রস্তাব ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রবর্তন। ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী সে সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। সুতরাং মৌলিক প্রশ্নে দু’দলের পরস্পর বিপরীতমুখী অবস'ান রয়ে গেল আগের মতোই অনিবার্য সঙ্ঘাতের দিকে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন করা না হলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে এক ভয়াবহ সংঘর্ষের নাম। সে ক্ষেত্রে নিকট বা দূরবর্তী এক বা একাধিক পরাশক্তির প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ অপ্রতিহত হয়ে উঠবে। আওয়ামী লীগ হয়তো ভাবছে, এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলরূপে প্রস'ত করবে। আমার যত দূর জানা আছে, তাতে বলা যায়, আওয়ামী লীগের সংসদে বিরোধী দলের প্রধান হতে এরশাদ রাজি হবেন না। তখন কী হবে- যখন এরশাদ বলবেন যে, তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া পুনর্বহাল না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল অংশগ্রহণ করবে না। তখন আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে হবে একা। তারা নিজেরাই এই নতুন বাকশাল মার্কা নির্বাচন করবে না। কেননা, কোনো জাতীয় নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হলে তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ে বিশ্বময়। সে জন্য যেকোনো দেশের নির্বাচন সুষ্ঠু ও সঠিক হলো কি না তা নিয়ে উৎকণ্ঠা সারা পৃথিবীর।
এখানে ব্যক্তিগত দর্প যে দেখাতে যাবে, রাজনীতির কাছে সে ততই অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়বে। জননীতির শিকড় হলো জনসেবা। জনজীবন থেকে দুর্ভোগ দূর করাই এর কাজ। আলোচনাহীন একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এক ধরনের দর্পিত আচরণ, যা গণতন্ত্রকে পরিহাস করে। বিভিন্ন মত তো থাকবেই। তার মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য মত পেতে হলে চাই অবন্ধুর লক্ষ্য, অন্যের মতের প্রতি শুধু সহিষ্ণুতা নয়- শ্রদ্ধাবোধ থাকা, আত্মম্ভরিতা ও অহঙ্কারের পরিবর্তে বিনয় ও আদর্শনিষ্ঠা। ইতিহাসের বিখ্যাত মদিনা সনদ ঘোষণা স্বাক্ষরকালে কেবল শান্তির স্বার্থে রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর উপাধি মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বারবার মুখে ইসলাম শান্তির ধর্ম বলা, কিন' প্রকৃত কাজে তার স্বাক্ষর না রাখা শুধু নিজের সাথে নয়, আল্লাহ তায়ালার সাথেও প্রতারণা করা। কোটি কোটি লোক কি ভোট দিয়েছে তাদের জন্য অশান্তি ও উৎকণ্ঠা বাড়াতে? বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় একটি সামান্যতম ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত দিতে- যেখানে তাদের সিদ্ধান্তের ফলে গণমানুষের একটি হয়রানি দূর হয়েছে, তাদের নিরুত্তর থাকাটাই শোভনীয় হবে।
পুলিশবাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লাগামহীন ব্যবহার করা, হাজার হাজার বিরোধীদলীয় মানুষকে জেলে পুরে ফেলা, নিজেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি হওয়ার সৎসাহস না থাকা ও বিরোধীদলীয় সমর্থকদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা রুজু করা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয়করণ করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মৌখিক সংগ্রামের কথা বলা, আগামী নির্বাচনের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আদায় ও মাস্তান বাহিনীকে সুগঠিত করা- এসবই তো আবার ক্ষমতায় যাওয়ার রণপ্রস'তি? আমরা বুঝি, লোকে বোঝে- বোঝে না শুধু তারা- যারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। ক্ষমতার মসনদ শেষ বিশ্রামের ক্ষুদ্র পরিসরে ঢোকে না। তবু মানুষ পৃথিবীর এই দুই দিনের মোহে এতই মগ্ন যে, আল্লাহ তায়ালার ভয়ও তাদের অন্তর থেকে নির্বাসিত হয়ে যায়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে করুণ ও অসুস' চিত্র, তা দেখে মনে হয়, একদিন এর আমূল পরিবর্তন হবে। এই গণতন্ত্রই যদি জাতির অন্তিম গন্তব্য হয়, তাহলে তা হবে আল্লাহর ক্ষমাহীন অভিশাপ। একে পরিশোধিত করতে হবে, এর গভীর সংস্কার করতে হবে, একে আমাদের জন্য প্রযোজ্য করে নির্মাণ করতে হবে এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে ইনসাফ হবে সর্বোচ্চ প্রেরণা। যেখানে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা থাকবে না কারো কাছে, যেখানে দুর্ভোগের অভিযোগ নিয়ে সরকারি দফতরের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না, যেখানে যেকোনো অজুহাতে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না কোনো নাগরিককে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ ব্যতীত, যেখানে রাষ্ট্রের সেবা কিনতে হয় অনেক দামে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবার তার সিলেট সফরকালে ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হলে টিপাইমুখ বাঁধ দিতে দেয়া হবে না। আর অন্য দিকে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার দিল্লিতে বললেন, টিপাইমুখ বাঁধ দিলে বাংলাদেশের ক্ষতি তো হবেই না, উপকার হবে অনেক। ঠিক এক বছর আগে ঢাকায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারও বলেছিলেন একই কথা। এ দেশে বেশ কৌতুক চলছে। আমাদের মন্ত্রীরা, সচিবরা ও অন্য আধিকারিকরা যখন বিবৃতি দেন, তখন আগে থেকে বলে না দিলে বোঝা যায় না, এরা কার হয়ে কথা বলছেন- ভারতের নাকি আমাদের? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিপক্ষে বিবৃতি দেয়ার অপরাধে দিল্লিতে নিযুক্ত আমাদের(?) হাইকমিশনারকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। শেয়ারবাজারের ট্র্যাজেডি নিয়ে কেউ আর কথা বলছেন না। ত্রিশ লাখ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা বাষ্পের মতো উড়ে গেল। লাখ লাখ মানুষ রাতারাতি হারাল তাদের সর্বস্ব। প্রতারিত হওয়ার অপমান সহ্য করতে না পেরে দু’জন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। কিন' সেই মর্মান্তিক দুঃসংবাদও ধূসর হয়ে গেছে আমাদের স্মৃতি থেকে। অন্য দিকে ঘাতকরা (যারা সংখ্যায় ছয়-সাতজনের বেশি নয়) উল্লাস করছেন, কেননা তারা ক্ষমতার এত কাছাকাছি যে, তাদের স্পর্শ করা এ সরকারের সময়কালে সম্ভব নয়। তবে আশার কথা এই যে, সময় স্তব্ধ হয়ে থাকে না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নায়কেরা শাস্তি পাবেই একদিন। সব কিছুর জন্যই আল্লাহ নির্ধারিত করে রেখেছেন সময়। কিন' সরকার তাদের বিচারের মুখোমুখি করছে না কেন? কেন তাদের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারেন না অর্থমন্ত্রী? তাদের আধা ডজনের কাছে সরকার কেন এত ঋণী? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে একদিন। আসলে আমাদের বিধিলিপিই হয়তো এমন। সমস্ত অন্যায় হতে থাকবে, আর তা নিয়ে কথা বললেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রাষ্ট্র।
সমপ্রতি কলেজের একজন মৌলবাদী সংখ্যালঘু প্রভাষক হজরত মুহাম্মদ সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। ক্রোধের চেয়ে দুঃখ পেলাম বেশি। একজন শ্রেষ্ঠ মহামানবকে নিয়ে কটূক্তি করে তিনি ধিক্কার ছাড়া কী পেলেন? বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলিম ধর্মাবলম্বীর কাছে রাসূল সা:-এর চেয়ে মর্যাদাবান আর কেউ নেই এবং হবেন না। তা ছাড়া বিশ্বের যত ধর্মের অনুসারী আছেন, তাদের সবার কাছে সম্মানের অধিকারী যিনি, তার সম্পর্কে মন্তব্য করার দুঃসাহস কারোই থাকার কথা নয়। আশা করি, তিনি এই ধৃষ্টতার জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন। তিনি অবশ্যই এই প্রাণীকে ক্ষমা করে দেবেন। ক্ষমা করাই তাঁর দীক্ষা।
জাহাজ ডুবে কয়েক শ’ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী সেজন্য সামান্যতম দুঃখিত হওয়ার সৌজন্যও প্রকাশ করেননি। সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা নিহত হওয়ার বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে ও থাকবে। এর মধ্যে হঠাৎ করেই প্রজাতন্ত্রের পদের তালিকায় যুক্ত হলো এক নতুন পদ। সিনিয়র সেক্রেটারি। সামরিক ব্যবস'াপনায় যেমন চিফ অব স্টাফের ওপরে আর কোনো পদ নেই, ঠিক তেমনি অসামরিক ব্যবস'াপনায় সচিবের ঊর্ধ্বে কোনো পদ থাকার কথা নয়। ক্যাবিনেট সচিব সমানদের মধ্যে প্রথম মাত্র। কোনো পরিচিত দেশে সিনিয়র সেক্রেটারি নামে কোনো পদ আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই।
এমনি করে আলোচনা-পর্যালোচনা ছাড়াই হুটহাট করে নেয়া হচ্ছে সব সরকারি সিদ্ধান্ত। কোথায় যেন একটা তাড়া। কলকাতার এক অখ্যাত কবির কবিতার চারটি চরণ খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকে।
‘ব্যরবাদিয়ে গুলিস্তানকে লিয়ে
এক উল্লুহি কাফি থা;
আগ্যর হ্যর শাখ পে এক উল্লু ব্যয়ঠা হো
- তো আঞ্জামে গুলিস্তাঁ ক্যায়া হোগা।’
সেদিনের চালচিত্র নিয়ে এত দিন আগের এক কবিতা আজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এক নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী। তবে এত উল্লু পয়দা হলো কেমন করে, সে প্রশ্ন রইল কবির কাছে।
লেখক : সাবেক সচিব
‘The Weak have one weapon : the errors of those who think they are strong.’
উক্তিটি শাশ্বত সত্যের উদ্ভাস বহন করে। যারা নিজেদের শক্তিশালী মনে করে, তাদের ভুলগুলোই দুর্বলের ক্ষমতায় রূপান্তর আনে। আর এই অস্ত্রটি তারা পাবেই, যেহেতু ক্ষমতাধরেরা ভুলের পাহাড় রচনায় ক্লান্তিহীন। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ভুল সিদ্ধান্ত, প্রতিহিংসা আর নিজেরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ও অসতর্ক বেপরোয়া অতিকথনের মধ্য দিয়ে এখন এত ফ্রন্ট খুলেছে যে, এসব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে ফেললেন : আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরা হবে। পুলিশপ্রধান বললেন, একটুখানি ধৈর্য ধরতে। আর দু-এক দিনের মধ্যেই সব জানতে পারবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার মুখ খুললেন, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং মনিটর করবেন। এবার প্রধানমন্ত্রী মুখ খুললেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। তারপরই বললেন, ঘটনার সব আলামত নষ্ট হয়ে গেছে।’ তারপর সাজানো হবে নাটক। মেঘের দায়িত্ব নিলেন প্রধানমন্ত্রী। ঝড়ের দায়িত্ব নেবে কে?
বিরোধীদলীয় নেতা তার চট্টগ্রামের মহাসমাবেশ থেকেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকা মহাসমাবেশের। তারপর শুরু হলো এক অঘোষিত যুদ্ধ। সমাবেশের জন্য জায়গা দেয়া যাবে না, মাইক দেয়া যাবে না, টিভিতে সরাসরি সমপ্রচার করা যাবে না, সমাবেশে জনসাধারণ যাতে যোগদান করতে না পারে, সেজন্য পথে যত বাধা সৃষ্টি করা সম্ভব তার সবই করেছে সরকারি দল। বাস, ট্রেন, নৌকা, মাইক্রোবাস, স্কুটার, লঞ্চ, জাহাজ সবই থামিয়ে রাখা হলো। উদ্দেশ্য- জনসাধারণ যেন ঢাকার মহাসমাবেশে যোগ দিতে না পারে। কিন' বাস্তবে ১২ মার্চ রূপান্তরিত হলো সরকারি নির্দেশে আয়োজিত এক অভূতপূর্ব হরতালে। তার পরপরই আওয়ামী লীগ আয়োজন করল প্রতিসমাবেশ। এ দিকে বহু দিন পরে বিএনপি সংসদমুখী হলো। বেগম জিয়া তার বক্তৃতায় ১৯৭২ সাল থেকে আওয়ামী লীগের অযোগ্য দেশ পরিচালনার দীর্ঘ তালিকা সংসদে তুলে ধরেন। এরপর শেখ হাসিনা আরেক হাত নিলেন বিএনপিকে। বিরোধী দলের মূল প্রস্তাব ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রবর্তন। ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী সে সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। সুতরাং মৌলিক প্রশ্নে দু’দলের পরস্পর বিপরীতমুখী অবস'ান রয়ে গেল আগের মতোই অনিবার্য সঙ্ঘাতের দিকে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন করা না হলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে এক ভয়াবহ সংঘর্ষের নাম। সে ক্ষেত্রে নিকট বা দূরবর্তী এক বা একাধিক পরাশক্তির প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ অপ্রতিহত হয়ে উঠবে। আওয়ামী লীগ হয়তো ভাবছে, এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলরূপে প্রস'ত করবে। আমার যত দূর জানা আছে, তাতে বলা যায়, আওয়ামী লীগের সংসদে বিরোধী দলের প্রধান হতে এরশাদ রাজি হবেন না। তখন কী হবে- যখন এরশাদ বলবেন যে, তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া পুনর্বহাল না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল অংশগ্রহণ করবে না। তখন আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে হবে একা। তারা নিজেরাই এই নতুন বাকশাল মার্কা নির্বাচন করবে না। কেননা, কোনো জাতীয় নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হলে তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ে বিশ্বময়। সে জন্য যেকোনো দেশের নির্বাচন সুষ্ঠু ও সঠিক হলো কি না তা নিয়ে উৎকণ্ঠা সারা পৃথিবীর।
এখানে ব্যক্তিগত দর্প যে দেখাতে যাবে, রাজনীতির কাছে সে ততই অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়বে। জননীতির শিকড় হলো জনসেবা। জনজীবন থেকে দুর্ভোগ দূর করাই এর কাজ। আলোচনাহীন একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এক ধরনের দর্পিত আচরণ, যা গণতন্ত্রকে পরিহাস করে। বিভিন্ন মত তো থাকবেই। তার মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য মত পেতে হলে চাই অবন্ধুর লক্ষ্য, অন্যের মতের প্রতি শুধু সহিষ্ণুতা নয়- শ্রদ্ধাবোধ থাকা, আত্মম্ভরিতা ও অহঙ্কারের পরিবর্তে বিনয় ও আদর্শনিষ্ঠা। ইতিহাসের বিখ্যাত মদিনা সনদ ঘোষণা স্বাক্ষরকালে কেবল শান্তির স্বার্থে রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর উপাধি মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বারবার মুখে ইসলাম শান্তির ধর্ম বলা, কিন' প্রকৃত কাজে তার স্বাক্ষর না রাখা শুধু নিজের সাথে নয়, আল্লাহ তায়ালার সাথেও প্রতারণা করা। কোটি কোটি লোক কি ভোট দিয়েছে তাদের জন্য অশান্তি ও উৎকণ্ঠা বাড়াতে? বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় একটি সামান্যতম ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত দিতে- যেখানে তাদের সিদ্ধান্তের ফলে গণমানুষের একটি হয়রানি দূর হয়েছে, তাদের নিরুত্তর থাকাটাই শোভনীয় হবে।
পুলিশবাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লাগামহীন ব্যবহার করা, হাজার হাজার বিরোধীদলীয় মানুষকে জেলে পুরে ফেলা, নিজেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি হওয়ার সৎসাহস না থাকা ও বিরোধীদলীয় সমর্থকদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা রুজু করা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয়করণ করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মৌখিক সংগ্রামের কথা বলা, আগামী নির্বাচনের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আদায় ও মাস্তান বাহিনীকে সুগঠিত করা- এসবই তো আবার ক্ষমতায় যাওয়ার রণপ্রস'তি? আমরা বুঝি, লোকে বোঝে- বোঝে না শুধু তারা- যারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। ক্ষমতার মসনদ শেষ বিশ্রামের ক্ষুদ্র পরিসরে ঢোকে না। তবু মানুষ পৃথিবীর এই দুই দিনের মোহে এতই মগ্ন যে, আল্লাহ তায়ালার ভয়ও তাদের অন্তর থেকে নির্বাসিত হয়ে যায়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে করুণ ও অসুস' চিত্র, তা দেখে মনে হয়, একদিন এর আমূল পরিবর্তন হবে। এই গণতন্ত্রই যদি জাতির অন্তিম গন্তব্য হয়, তাহলে তা হবে আল্লাহর ক্ষমাহীন অভিশাপ। একে পরিশোধিত করতে হবে, এর গভীর সংস্কার করতে হবে, একে আমাদের জন্য প্রযোজ্য করে নির্মাণ করতে হবে এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে ইনসাফ হবে সর্বোচ্চ প্রেরণা। যেখানে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা থাকবে না কারো কাছে, যেখানে দুর্ভোগের অভিযোগ নিয়ে সরকারি দফতরের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না, যেখানে যেকোনো অজুহাতে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না কোনো নাগরিককে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ ব্যতীত, যেখানে রাষ্ট্রের সেবা কিনতে হয় অনেক দামে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবার তার সিলেট সফরকালে ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হলে টিপাইমুখ বাঁধ দিতে দেয়া হবে না। আর অন্য দিকে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার দিল্লিতে বললেন, টিপাইমুখ বাঁধ দিলে বাংলাদেশের ক্ষতি তো হবেই না, উপকার হবে অনেক। ঠিক এক বছর আগে ঢাকায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারও বলেছিলেন একই কথা। এ দেশে বেশ কৌতুক চলছে। আমাদের মন্ত্রীরা, সচিবরা ও অন্য আধিকারিকরা যখন বিবৃতি দেন, তখন আগে থেকে বলে না দিলে বোঝা যায় না, এরা কার হয়ে কথা বলছেন- ভারতের নাকি আমাদের? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিপক্ষে বিবৃতি দেয়ার অপরাধে দিল্লিতে নিযুক্ত আমাদের(?) হাইকমিশনারকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। শেয়ারবাজারের ট্র্যাজেডি নিয়ে কেউ আর কথা বলছেন না। ত্রিশ লাখ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা বাষ্পের মতো উড়ে গেল। লাখ লাখ মানুষ রাতারাতি হারাল তাদের সর্বস্ব। প্রতারিত হওয়ার অপমান সহ্য করতে না পেরে দু’জন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। কিন' সেই মর্মান্তিক দুঃসংবাদও ধূসর হয়ে গেছে আমাদের স্মৃতি থেকে। অন্য দিকে ঘাতকরা (যারা সংখ্যায় ছয়-সাতজনের বেশি নয়) উল্লাস করছেন, কেননা তারা ক্ষমতার এত কাছাকাছি যে, তাদের স্পর্শ করা এ সরকারের সময়কালে সম্ভব নয়। তবে আশার কথা এই যে, সময় স্তব্ধ হয়ে থাকে না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নায়কেরা শাস্তি পাবেই একদিন। সব কিছুর জন্যই আল্লাহ নির্ধারিত করে রেখেছেন সময়। কিন' সরকার তাদের বিচারের মুখোমুখি করছে না কেন? কেন তাদের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারেন না অর্থমন্ত্রী? তাদের আধা ডজনের কাছে সরকার কেন এত ঋণী? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে একদিন। আসলে আমাদের বিধিলিপিই হয়তো এমন। সমস্ত অন্যায় হতে থাকবে, আর তা নিয়ে কথা বললেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রাষ্ট্র।
সমপ্রতি কলেজের একজন মৌলবাদী সংখ্যালঘু প্রভাষক হজরত মুহাম্মদ সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। ক্রোধের চেয়ে দুঃখ পেলাম বেশি। একজন শ্রেষ্ঠ মহামানবকে নিয়ে কটূক্তি করে তিনি ধিক্কার ছাড়া কী পেলেন? বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলিম ধর্মাবলম্বীর কাছে রাসূল সা:-এর চেয়ে মর্যাদাবান আর কেউ নেই এবং হবেন না। তা ছাড়া বিশ্বের যত ধর্মের অনুসারী আছেন, তাদের সবার কাছে সম্মানের অধিকারী যিনি, তার সম্পর্কে মন্তব্য করার দুঃসাহস কারোই থাকার কথা নয়। আশা করি, তিনি এই ধৃষ্টতার জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন। তিনি অবশ্যই এই প্রাণীকে ক্ষমা করে দেবেন। ক্ষমা করাই তাঁর দীক্ষা।
জাহাজ ডুবে কয়েক শ’ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী সেজন্য সামান্যতম দুঃখিত হওয়ার সৌজন্যও প্রকাশ করেননি। সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা নিহত হওয়ার বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে ও থাকবে। এর মধ্যে হঠাৎ করেই প্রজাতন্ত্রের পদের তালিকায় যুক্ত হলো এক নতুন পদ। সিনিয়র সেক্রেটারি। সামরিক ব্যবস'াপনায় যেমন চিফ অব স্টাফের ওপরে আর কোনো পদ নেই, ঠিক তেমনি অসামরিক ব্যবস'াপনায় সচিবের ঊর্ধ্বে কোনো পদ থাকার কথা নয়। ক্যাবিনেট সচিব সমানদের মধ্যে প্রথম মাত্র। কোনো পরিচিত দেশে সিনিয়র সেক্রেটারি নামে কোনো পদ আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই।
এমনি করে আলোচনা-পর্যালোচনা ছাড়াই হুটহাট করে নেয়া হচ্ছে সব সরকারি সিদ্ধান্ত। কোথায় যেন একটা তাড়া। কলকাতার এক অখ্যাত কবির কবিতার চারটি চরণ খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকে।
‘ব্যরবাদিয়ে গুলিস্তানকে লিয়ে
এক উল্লুহি কাফি থা;
আগ্যর হ্যর শাখ পে এক উল্লু ব্যয়ঠা হো
- তো আঞ্জামে গুলিস্তাঁ ক্যায়া হোগা।’
সেদিনের চালচিত্র নিয়ে এত দিন আগের এক কবিতা আজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এক নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী। তবে এত উল্লু পয়দা হলো কেমন করে, সে প্রশ্ন রইল কবির কাছে।
লেখক : সাবেক সচিব
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন