॥ সিরাজুর রহমান ॥
মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয়, শেখ হাসিনা কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী। উপমাটা সবচেয়ে ভালো হয় ব্রিটিশ আমলের, বিশেষ করে গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শেষার্ধ থেকে সাতচলিস্নশ পর্যনৱ সময়ের শ্বেতাঙ্গ লাট সাহেবদের সাথে। যেকোনো মূল্যে ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখতে হবে; কোনো প্রতিবাদ বা সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না, পুসৱক প্রকাশ কিংবা মতামত ব্যক্ত করাও অবৈধ হবে। প্রয়োজনবোধে পুলিশ, ভাড়াটে গুণ্ডা বাহিনী এবং সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বাহিনীকেও লেলিয়ে দেয়া হবে সমালোচক ও রাজনৈতিক বিরোধী নেতাদের বিরম্নদ্ধে।
শেখ হাসিনা বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের ৰতি করবে না বলে ভারত আশ্বাস দিয়েছে, ৰতি যদি হয়ই তখন দেখা যাবে। বাংলাদেশের মানুষ বিগত ৫০ বছর ধরে দেখছে অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ তৈরি করে ভারত বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার সব চেষ্টা করেছে। তারা দেখছে শুকনো মওসুমে পদ্মা শুকিয়ে যাচ্ছে, নদীর তলায় পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা এলে নদীর পাড় ভেঙে হাজার হাজার একর জমি তলিয়ে যায় প্রতি বছর। বন্যা দূর থেকে আরো দূরে ছড়িয়ে পড়ছে, নদীমোহনা শুকিয়ে যাচ্ছে বলে বন্যার পানি নেমে যেতে বেশি দেরি হচ্ছে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল মরম্নভূমি হওয়ার অবস'ায় আছে এখন।
হাসিনার বাবা ফারাক্কা বাঁধ চালু করার অনুমতি দিয়েছিলেন পরীৰামূলকভাবে, মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য। সে দুই সপ্তাহ আর শেষ হলো না। হাসিনা নিজে পানিবণ্টন চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তিকে কানাকড়ি মূল্য দেয়নি অন্যপৰ, এক বছরও চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ । গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিসৱা নদীও শুকিয়ে মারছে ভারত। প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় মুরব্বিরা বলেছিলেন মনমোহন সিং গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় তিসৱার পানিবণ্টন চুক্তি করবেন। সে চুক্তি না করেই তিনি দেশে ফিরে গেলেন। তারপর থেকে প্রায়ই বলা হচ্ছে- সে চুক্তি এই আসে, এই হবে। এ দিকে বাংলাদেশের কত বড় ৰতি হচ্ছে, সে হিসাব কে রাখে?
কী প্রতিকার করেছেন বা করতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রী? তিন বছর ধরে ভারত হাইকোর্ট দেখাচ্ছে টিপাইমুখের ব্যাপারে। এ দিকে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনার ওপর যারা নির্ভরশীল তারা বিভীষিকা দেখছেন চোখের সামনে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ৫২ নদীর মধ্যে সংযোগ খাল তৈরি করে মধ্য ভারতের ঊষর মরম্নতে ফসল ফলাবে ভারত আর বাংলাদেশের পূর্বাংশও পশ্চিমাংশের মতো মরম্নভূমি হয়ে যাবে, পদ্মার ইলিশের মতো মেঘনার ইলিশও বিদায় নেবে। দুই তিন বছরের মধ্যেই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের ভয়ভীতি সত্য প্রমাণিত হলে কী করবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী? বিগত নির্বাচনে ‘বসৱা বসৱা টাকা আর পরামর্শ’ তিনি পেয়েছিলেন ভারতের কাছ থেকে। টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি শেষ হওয়া পর্যনৱ হাসিনা আর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না, অনৱত বাংলাদেশের মানুষ তাকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য ভোট দেবে না। কিন' ধরে নেয়া যায়, দেশের বাইরে তার স'ানাভাব বা অর্থাভাব হবে না।
টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে আরো একবার প্রমাণিত হলো দেশের মানুষের, এমনকি বরেণ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমল দেন না। অন্য দিকে তার অসীম বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বিদেশীদের ওপর। স্বাধীনতা দিবসে তিনি বিদেশীদের সম্মাননা দেন, এবারেও দিয়েছেন অনেককে। সেটা ভালো কথা। গুণীজনকে শ্রদ্ধা জানানো, যারা উপকার করেছেন তাদের কৃতজ্ঞতা জানানো মহৎ গুণ। কিন' কৃতজ্ঞতা, দয়া-দাৰিণ্য সব কিছুরই সূচনা হওয়া উচিত তৃণমূল সৱরে। ইংরেজিতে বলে, ‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’ অর্থাৎ দাৰিণ্য শুরম্ন হবে ঘর থেকে। এর ব্যতিক্রম হলে বাংলা প্রবাদ অনুযায়ী ‘গাঁয়ের যোগী ভিখ পায় না’।
ঘরের মানুষের কৃতজ্ঞতা কোথায়?
বহু বিদেশী নানাভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছেন, সাহায্যও করেছেন কেউ কেউ। সেটা সম্ভব হয়েছে এ কারণে, আমরা যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপৰে বিশ্বজনমত গঠনের জন্য সংগ্রাম করেছি তাদের প্রচেষ্টা অভাবনীয় রকম সফল হয়েছিল বলেই। বাংলাদেশের অজস্র মানুষ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাদের সম্মানিত করার আগে বিদেশীদের সম্মান প্রদর্শনের আকুলতাকে বিদেশীরাও কপটতা বলে চিনতে পারে। সাইমন ড্রিং স্বাধীনতা দিবসে ঢাকাতেই বলেছেন, ‘বাঙালিরাও (বাংলাদেশীরা) সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য।’
শেখ হাসিনার সব কাজই পরিচালিত হয় দলীয় বিবেচনা দিয়ে। দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অনেক বাংলাদেশীকেও তিনি পুরস্কৃত করেছেন। দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দেয়া হয়েছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নয়- শেখ হাসিনার ক্যাডারের কলেবর বাড়ানোর প্রয়োজনে। এমন এমন ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে, যারা মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন স্বাধীনতার পরে। যেসব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন অথবা অপরিসীম সাফল্য অর্জন করেছেন, শেখ হাসিনার বিবেচনায় তারা পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য নন।
বিদেশীদের মধ্যে ভারতীয়রা অবশ্য মনে করেন, যেহেতু তারা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহায্য করেছেন সেহেতু সব সম্মান, এমনকি নতুন স্বাধীন গোটা দেশটাই তাদের প্রাপ্য। অন্যদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যা করছেন সেটা অশোভন, বিব্রতকর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কে দিয়েছিলেন বহু বিদেশী সেটা জানেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মেজর জিয়াউর রহমানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা ফরাসি রেডিও ও টেলিভিশনের কল্যাণে অনেকেই শুনেছেন। মেজর জিয়া পরবর্তীকালে জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা, সমাজে শানিৱ ও সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং বাংলাদেশের মানুষকে উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত করার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রচেষ্টা গোটা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। শহীদ জিয়া, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী তিনবারের প্রধানমন্ত্রী জিয়ার বিধবা পত্নী খালেদা এবং তাদের দুই ছেলের বিরম্নদ্ধে শেখ হাসিনার অবিরাম বিষোদ্গার ও নির্যাতন স্বভাবতই তাদের ব্যথিত করে। শেখ হাসিনার সরকারের দেয়া সম্মাননা নিতে তাদের অনেকেই বিব্রত বোধ করেন।
ফ্যাসিবাদের নগ্ন চেহারা
এবারে যারা সম্মাননা নিতে এসেছেন কী দেখেছেন তারা? তারা দেখেছেন স্বাধীনতাকে দলীয়করণ, আত্মীয়করণ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা শহীদ স্মৃতিসৱম্ভে শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন কিন' হাসিনার চেয়েও বেশি দিন যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং যার স্বামী স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই খালেদা জিয়াকে স্মৃতিসৱম্ভে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে। পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে বের হতে বাধা দিয়েছে, তার অনুসারীদের স্মৃতিসৱম্ভে যেতে পদে পদে বাধা দেয়া হয়েছে। বিদেশীরা স্বদেশে বসেও শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী নির্যাতন-নিপীড়নের খবর পান। স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশে এসে তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ দেখলেন তারা, তারা দেখলেন শাসকদলের গুণ্ডারা বিরোধী দলের সমর্থকদের মারধর করে তাদের শহীদ স্মৃতিসৱম্ভে যেতে বাধা দিয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। পত্রিকা সম্পাদক ও জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উপস'াপক শফিক রেহমান পাঁচটি পুসৱক প্রকাশ করেছেন। বইগুলোর মোড়ক উন্মোচনের কথা ছিল বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার। প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মারক রচনাও ছিল। প্রথমে সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠানের স'ান ধার্য করা হয়েছিল। কিন' হোটেল কর্তৃপৰ পরে সে বুকিং বাতিল করে। বিকল্প স'ান নির্ধারণ করা হয় রূপসী বাংলা হোটেলে। অনুষ্ঠানের দিন সে হোটেলও বুকিং বাতিল করে। জানা গেছে, একটি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ (অবশ্যই দলীয়কৃত) উভয় হোটেল কর্তৃপৰকে হুমকি দিয়ে বুকিং বাতিল করতে বাধ্য করে।
শেখ হাসিনার ‘কৃতজ্ঞতা’ নিতে যারা বাংলাদেশে এসেছিলেন তাদের নাকের ডগায় ঘটেছে এই কলঙ্কময় ঘটনাগুলো। তারা স্বচৰে দেখে গেলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা অবদান রেখেছিলেন সে দেশ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে কতখানি এগিয়ে গেছে। মনে করার কোনো কারণ নেই, যারা আসেননি কিংবা আসতে চাননি বর্তমান সরকারের নির্যাতননিপীড়ন সম্বন্ধে তারাও অবগত নন।
বাংলাদেশের মানুষ পাকিসৱানিদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র, রৰীবাহিনী ও বাকশালী নির্যাতন, এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র- সবই দেখেছেন, বহু অত্যাচারনির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন' শেষ পর্যনৱ সে সব এরা অতিক্রম করেছেন। আমাদের কবির মহাবাণী এরা অনৱরে পোষণ করে : ‘ওদের বাঁধন যত শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে, বাঁধন টুটবে।’ হিটলারমুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসন ইতিহাস দেখেছে এবং সে ফ্যাসিবাদের পতনও ইতিহাসের অজানা নয়।
লন্ডন, ২৭.০৩.১২
serajurrahman@btinternet.com
মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয়, শেখ হাসিনা কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী। উপমাটা সবচেয়ে ভালো হয় ব্রিটিশ আমলের, বিশেষ করে গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শেষার্ধ থেকে সাতচলিস্নশ পর্যনৱ সময়ের শ্বেতাঙ্গ লাট সাহেবদের সাথে। যেকোনো মূল্যে ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখতে হবে; কোনো প্রতিবাদ বা সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না, পুসৱক প্রকাশ কিংবা মতামত ব্যক্ত করাও অবৈধ হবে। প্রয়োজনবোধে পুলিশ, ভাড়াটে গুণ্ডা বাহিনী এবং সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বাহিনীকেও লেলিয়ে দেয়া হবে সমালোচক ও রাজনৈতিক বিরোধী নেতাদের বিরম্নদ্ধে।
শেখ হাসিনা বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের ৰতি করবে না বলে ভারত আশ্বাস দিয়েছে, ৰতি যদি হয়ই তখন দেখা যাবে। বাংলাদেশের মানুষ বিগত ৫০ বছর ধরে দেখছে অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ তৈরি করে ভারত বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার সব চেষ্টা করেছে। তারা দেখছে শুকনো মওসুমে পদ্মা শুকিয়ে যাচ্ছে, নদীর তলায় পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা এলে নদীর পাড় ভেঙে হাজার হাজার একর জমি তলিয়ে যায় প্রতি বছর। বন্যা দূর থেকে আরো দূরে ছড়িয়ে পড়ছে, নদীমোহনা শুকিয়ে যাচ্ছে বলে বন্যার পানি নেমে যেতে বেশি দেরি হচ্ছে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল মরম্নভূমি হওয়ার অবস'ায় আছে এখন।
হাসিনার বাবা ফারাক্কা বাঁধ চালু করার অনুমতি দিয়েছিলেন পরীৰামূলকভাবে, মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য। সে দুই সপ্তাহ আর শেষ হলো না। হাসিনা নিজে পানিবণ্টন চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তিকে কানাকড়ি মূল্য দেয়নি অন্যপৰ, এক বছরও চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ । গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিসৱা নদীও শুকিয়ে মারছে ভারত। প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় মুরব্বিরা বলেছিলেন মনমোহন সিং গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় তিসৱার পানিবণ্টন চুক্তি করবেন। সে চুক্তি না করেই তিনি দেশে ফিরে গেলেন। তারপর থেকে প্রায়ই বলা হচ্ছে- সে চুক্তি এই আসে, এই হবে। এ দিকে বাংলাদেশের কত বড় ৰতি হচ্ছে, সে হিসাব কে রাখে?
কী প্রতিকার করেছেন বা করতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রী? তিন বছর ধরে ভারত হাইকোর্ট দেখাচ্ছে টিপাইমুখের ব্যাপারে। এ দিকে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনার ওপর যারা নির্ভরশীল তারা বিভীষিকা দেখছেন চোখের সামনে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ৫২ নদীর মধ্যে সংযোগ খাল তৈরি করে মধ্য ভারতের ঊষর মরম্নতে ফসল ফলাবে ভারত আর বাংলাদেশের পূর্বাংশও পশ্চিমাংশের মতো মরম্নভূমি হয়ে যাবে, পদ্মার ইলিশের মতো মেঘনার ইলিশও বিদায় নেবে। দুই তিন বছরের মধ্যেই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের ভয়ভীতি সত্য প্রমাণিত হলে কী করবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী? বিগত নির্বাচনে ‘বসৱা বসৱা টাকা আর পরামর্শ’ তিনি পেয়েছিলেন ভারতের কাছ থেকে। টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি শেষ হওয়া পর্যনৱ হাসিনা আর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না, অনৱত বাংলাদেশের মানুষ তাকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য ভোট দেবে না। কিন' ধরে নেয়া যায়, দেশের বাইরে তার স'ানাভাব বা অর্থাভাব হবে না।
টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে আরো একবার প্রমাণিত হলো দেশের মানুষের, এমনকি বরেণ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমল দেন না। অন্য দিকে তার অসীম বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বিদেশীদের ওপর। স্বাধীনতা দিবসে তিনি বিদেশীদের সম্মাননা দেন, এবারেও দিয়েছেন অনেককে। সেটা ভালো কথা। গুণীজনকে শ্রদ্ধা জানানো, যারা উপকার করেছেন তাদের কৃতজ্ঞতা জানানো মহৎ গুণ। কিন' কৃতজ্ঞতা, দয়া-দাৰিণ্য সব কিছুরই সূচনা হওয়া উচিত তৃণমূল সৱরে। ইংরেজিতে বলে, ‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’ অর্থাৎ দাৰিণ্য শুরম্ন হবে ঘর থেকে। এর ব্যতিক্রম হলে বাংলা প্রবাদ অনুযায়ী ‘গাঁয়ের যোগী ভিখ পায় না’।
ঘরের মানুষের কৃতজ্ঞতা কোথায়?
বহু বিদেশী নানাভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছেন, সাহায্যও করেছেন কেউ কেউ। সেটা সম্ভব হয়েছে এ কারণে, আমরা যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপৰে বিশ্বজনমত গঠনের জন্য সংগ্রাম করেছি তাদের প্রচেষ্টা অভাবনীয় রকম সফল হয়েছিল বলেই। বাংলাদেশের অজস্র মানুষ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাদের সম্মানিত করার আগে বিদেশীদের সম্মান প্রদর্শনের আকুলতাকে বিদেশীরাও কপটতা বলে চিনতে পারে। সাইমন ড্রিং স্বাধীনতা দিবসে ঢাকাতেই বলেছেন, ‘বাঙালিরাও (বাংলাদেশীরা) সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য।’
শেখ হাসিনার সব কাজই পরিচালিত হয় দলীয় বিবেচনা দিয়ে। দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অনেক বাংলাদেশীকেও তিনি পুরস্কৃত করেছেন। দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দেয়া হয়েছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নয়- শেখ হাসিনার ক্যাডারের কলেবর বাড়ানোর প্রয়োজনে। এমন এমন ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে, যারা মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন স্বাধীনতার পরে। যেসব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন অথবা অপরিসীম সাফল্য অর্জন করেছেন, শেখ হাসিনার বিবেচনায় তারা পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য নন।
বিদেশীদের মধ্যে ভারতীয়রা অবশ্য মনে করেন, যেহেতু তারা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহায্য করেছেন সেহেতু সব সম্মান, এমনকি নতুন স্বাধীন গোটা দেশটাই তাদের প্রাপ্য। অন্যদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যা করছেন সেটা অশোভন, বিব্রতকর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কে দিয়েছিলেন বহু বিদেশী সেটা জানেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মেজর জিয়াউর রহমানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা ফরাসি রেডিও ও টেলিভিশনের কল্যাণে অনেকেই শুনেছেন। মেজর জিয়া পরবর্তীকালে জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা, সমাজে শানিৱ ও সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং বাংলাদেশের মানুষকে উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত করার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রচেষ্টা গোটা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। শহীদ জিয়া, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী তিনবারের প্রধানমন্ত্রী জিয়ার বিধবা পত্নী খালেদা এবং তাদের দুই ছেলের বিরম্নদ্ধে শেখ হাসিনার অবিরাম বিষোদ্গার ও নির্যাতন স্বভাবতই তাদের ব্যথিত করে। শেখ হাসিনার সরকারের দেয়া সম্মাননা নিতে তাদের অনেকেই বিব্রত বোধ করেন।
ফ্যাসিবাদের নগ্ন চেহারা
এবারে যারা সম্মাননা নিতে এসেছেন কী দেখেছেন তারা? তারা দেখেছেন স্বাধীনতাকে দলীয়করণ, আত্মীয়করণ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা শহীদ স্মৃতিসৱম্ভে শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন কিন' হাসিনার চেয়েও বেশি দিন যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং যার স্বামী স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই খালেদা জিয়াকে স্মৃতিসৱম্ভে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে। পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে বের হতে বাধা দিয়েছে, তার অনুসারীদের স্মৃতিসৱম্ভে যেতে পদে পদে বাধা দেয়া হয়েছে। বিদেশীরা স্বদেশে বসেও শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী নির্যাতন-নিপীড়নের খবর পান। স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশে এসে তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ দেখলেন তারা, তারা দেখলেন শাসকদলের গুণ্ডারা বিরোধী দলের সমর্থকদের মারধর করে তাদের শহীদ স্মৃতিসৱম্ভে যেতে বাধা দিয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। পত্রিকা সম্পাদক ও জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উপস'াপক শফিক রেহমান পাঁচটি পুসৱক প্রকাশ করেছেন। বইগুলোর মোড়ক উন্মোচনের কথা ছিল বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার। প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মারক রচনাও ছিল। প্রথমে সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠানের স'ান ধার্য করা হয়েছিল। কিন' হোটেল কর্তৃপৰ পরে সে বুকিং বাতিল করে। বিকল্প স'ান নির্ধারণ করা হয় রূপসী বাংলা হোটেলে। অনুষ্ঠানের দিন সে হোটেলও বুকিং বাতিল করে। জানা গেছে, একটি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ (অবশ্যই দলীয়কৃত) উভয় হোটেল কর্তৃপৰকে হুমকি দিয়ে বুকিং বাতিল করতে বাধ্য করে।
শেখ হাসিনার ‘কৃতজ্ঞতা’ নিতে যারা বাংলাদেশে এসেছিলেন তাদের নাকের ডগায় ঘটেছে এই কলঙ্কময় ঘটনাগুলো। তারা স্বচৰে দেখে গেলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা অবদান রেখেছিলেন সে দেশ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে কতখানি এগিয়ে গেছে। মনে করার কোনো কারণ নেই, যারা আসেননি কিংবা আসতে চাননি বর্তমান সরকারের নির্যাতননিপীড়ন সম্বন্ধে তারাও অবগত নন।
বাংলাদেশের মানুষ পাকিসৱানিদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র, রৰীবাহিনী ও বাকশালী নির্যাতন, এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র- সবই দেখেছেন, বহু অত্যাচারনির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন' শেষ পর্যনৱ সে সব এরা অতিক্রম করেছেন। আমাদের কবির মহাবাণী এরা অনৱরে পোষণ করে : ‘ওদের বাঁধন যত শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে, বাঁধন টুটবে।’ হিটলারমুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসন ইতিহাস দেখেছে এবং সে ফ্যাসিবাদের পতনও ইতিহাসের অজানা নয়।
লন্ডন, ২৭.০৩.১২
serajurrahman@btinternet.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন