সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১২

খালেদা জিয়াকে স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা




বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা দিয়েছে সরকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে তিনি সোয়া ৫টার দিকে বাসা থেকে বের হতে চাইলে পুলিশ তার গাড়ি আটকে দেয়। বাসার গেটে ব্যারিকেড এবং রাস্তায় তিনটি স্পটে ট্রাক ও পুলিশের রেকার রেখে বাধা দেয়া হয়। পুলিশের সঙ্গে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতাহাতির পর অনেকটা জোর করেই তিনি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান। পথে পথে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের জটলার বাধা পেরিয়ে প্রটোকল ছাড়াই ৬টা ৪৫ মিনিটে খালেদা জিয়া শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এদিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনে বাধার জের ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘর্ষে শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। স্মৃতিসৌধ এলাকায় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়ে টাঙানো বিএনপির সব ব্যানার ও ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলা হয়। স্মৃতিসৌধ এলাকায় জাতীয় পার্টির দু’গ্রুপের সংঘর্ষেও কমপক্ষে ১৫ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও সংঘর্ষে আরও অর্ধশতাধিক আহতের খবর রয়েছে।
সূর্যোদয়ের পরই প্রটোকল অনুযায়ী চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা; কিন্তু দেখা যায় ভোর ৪টা থেকে কয়েকশ’ পুলিশ খালেদা জিয়ার বাসভবন ঘেরাও করে রেখেছে। ৫টা ৫৫ মিনিটে সূর্যোদয় হয় বলে তিনি গুলশানের বাসভবন থেকে বের হতে সোয়া ৫টার দিকে গাড়িতে ওঠেন। বাসভবনের গেটেই পুলিশ তার গাড়ি আটকে দেয়। গেটের নিরাপত্তা ব্যারিকেড ফেলে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যান কয়েকজন মহিলা পুলিশ। বাড়ির গেটে শতাধিক পুলিশ অবস্থান নেয়। বিরোধীদলীয় নেতাকে পুলিশ এভাবে কেন বাধা দিচ্ছে—জিজ্ঞাসা করা হলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। পুলিশের পক্ষ থেকে শুধু বলা হয়, বিরোধীদলীয় নেতার নিরাপত্তার জন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু হঠাত্ কেন এ ধরনের নিরাপত্তার কথা এলো, সে সম্পর্কে তারা কিছুই বলতে পারেনি। শুধু নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে তাকে বের না হওয়ার অনুরোধ জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। এমনকি নিরাপত্তার জন্য সরকারের দেয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের আটকে দেয়া হলে খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়েই বাসা থেকে বের হন ৫টা ৫৫ মিনিটে।
এ অবস্থায় অনেকটা জোর করে গাড়ি বের হয়। বাসভবন থেকে বের হতেই সামনের রাস্তায় একটি বালুভর্তি ট্রাক ও পুলিশের রেকার রেখে রাস্তা আটকে দেয়া হয়। রং সাইড দিয়ে গাড়িবহর এগিয়ে গেলে গুলশান মোড় ও কাকলীর রাস্তাও ট্রাক এবং রেকার দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। রং সাইড দিয়েই খালেদা জিয়ার গাড়িবহর মেইন রোডে উঠে মহাখালী পৌঁছলে সেখানে স্থানীয় শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা বাস-ট্রাক রেখে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এভাবে বাধার পথ পেরিয়ে ৬টা ৪৫ মিনিটে খালেদা জিয়া স্মৃতিসৌধে পৌঁছেন এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
স্বাধীনতা দিবসে বিরোধীদলীয় নেতাকে এভাবে বাধা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো বাধা দিইনি। উনি সম্মানিত ব্যক্তি, ওনাকে কেন বাধা দেব! ওনারা ক্লেইম (অভিযোগ) দিতে পারেন, এটা সঠিক নয়।’ গভীর রাতে শতাধিক পুলিশের বেষ্টনী দেয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিশেষ দিন বলে আমরা ওনার অতিরিক্ত নিরাপত্তা দিয়েছি। উনি যেহেতু বের হবেন, সেহেতু আগে থেকেই আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত রেখেছি।’
বাধা দিয়ে স্বাধীনতার চেতনা হত্যা করছে সরকার —ফখরুল : স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচিতে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে বাধা দেয়াকে সরকারের ফ্যাসিবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী আচরণ বলে অভিযোগ করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া গতকাল সকালে গুলশানের বাসভবন থেকে সাভার স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে রওনা হলে পুলিশ বাসা থেকে বেরুতেই বাধা দেয়। এরপর পথে বেশ কয়েক জায়গায় পুলিশ ও সরকারি দলের সশস্ত্র কর্মীরা বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সকাল ৫টার কিছু পরে গুলশানের বাসা থেকে বের হওয়ার পথ পুলিশ অবরুদ্ধ করে রাখে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের মতো এই দিনটিকেও বর্তমান সরকার দলীয়করণের বাইরে রাখতে পারেনি। জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে বিরোধীদলীয় নেতাকে পথে পথে বাধা দিয়েছে। সকালে তার গুলশানের বাসার চারদিক পুলিশ ঘেরাও করে রাখে। রাস্তায় ট্রাক আড়াআড়ি করে রেখে নেত্রীর গাড়িবহর যেতে বাধা দেয়। শুধু তা-ই নয়, বিরোধীদলীয় নেতার প্রটোকলের গাড়িও কিছু সময় আটকে রাখা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
মির্জা আলমগীর বলেন, জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়ার পথে পথে বিরোধীদলীয় নেতার গাড়িবহরকে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বাধা পেরিয়ে সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে মির্জা আলমগীর বলেন, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট সরকার এভাবে বিরোধী দলকে দাবিয়ে রাখছে। আমরা বিরোধীদলীয় নেতাকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা দেয়ার কঠোর নিন্দা জানাই। এক প্রশ্নের জবাবে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, বিএনপি সবসময় বলে আসছে, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুষ্ঠু বিচার আমরা চাই। তবে সে বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া।
সরকারের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, দেশের মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। জনগণের কোনো সমস্যার তারা সমাধান দিতে পারেনি। দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অস্থিরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জনগণের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। দেশের অর্থনীতিকে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেশকে পরনির্ভরশীল করে ফেলেছে।
বাধার কারণ কী : বিরোধীদলীয় নেতাকে স্মৃতিসৌধে যেতে কেন বাধা দেয়া হলো, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায়নি। পুলিশ শুধু নিরাপত্তাজনিত কারণের কথা বলেছে। কিন্তু হঠাত্ কেন নিরাপত্তাজনিত কারণ সৃষ্টি হলো, সে সম্পর্কেও পুলিশ কিছু বলেনি। এ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতেই সরকার পরিকল্পিতভাবে পুলিশ দিয়ে এ কাজটি করিয়েছে। সরকার চেয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি দল সুশৃঙ্খলভাবে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজধানীতে ফেরার পর বিরোধীদলীয় নেতার গাড়ি ছাড়া হবে। এরপর অসংখ্য সংগঠনের মাঝে বিরোধীদলীয় নেতা গেলে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে। এতে বিরোধী দলকে দোষারোপ করা যাবে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে খালেদা জিয়ার শ্রদ্ধা : পথে পথে বাধা পার হয়ে সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে একাত্তরে আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। তিনি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে তাদের শ্রদ্ধা জানান। এ সময় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, সেলিমা রহমান, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, রুহুল কবির রিজভী, মহানগর সদস্য-সচিব আবদুস সালামসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
শহীদ জিয়ার মাজারে শ্রদ্ধা : মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে গতকাল সাড়ে ৭টায় খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে দলের প্রতিষ্ঠাতার রুহের মাগফিরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ এবং বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন।
এ সময় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, সেলিমা রহমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শাহজাহান ওমর বীর উত্তম, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
পরে মহানগর বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, ওলামা দল, মত্স্যজীবী দল, জাসাস, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এ্যাব), জিয়া ব্রিগেড, জিয়া সেনাসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জিয়ার মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।আমারদেশ ২৭ মার্চ ২০১২

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads