বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১২

ছাত্রলীগ-ব্যবসায়ী সংঘর্ষে পুরান ঢাকা রণক্ষেত্রযাযাদি রিপোর্ট জবি ছাত্রলীগ ও ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের একটি মুহূর্ত _যাযাদিসন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে এক দোকান কর্মচারীর মৃত্যুর গুজবে বুধবার দুপুরে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সংঘর্ষে গোটা পুরান ঢাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার শেল ছুড়লে তার ধোঁয়ায় জনতা ব্যাংকের সদরঘাট শাখার পরিচ্ছন্নকর্মী সুনীল ঘোষ (৬৫) শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। এছাড়াও পুলিশের লাঠিচার্জ এবং বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের ছোড়া এলোপাতাড়ি ইট-পাটকেলের আঘাতে অন্তত ৫০ জন আহত হয়। গুরুতর আহত ১২ জন মিটফোর্ড এবং ২০ জন ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এদের মধ্যে কাউসার নামের এক ব্যবসায়ীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে ঘটনার সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ জনসন রোড, লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারি বাজার, কোতোয়ালি থানা মোড়সহ আশপাশের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিলে গোটা এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় এলাকার দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস। থমকে যায় পুরান ঢাকার আদালতপাড়ার সব ধরনের কর্মকা-ও। নিহত সুনীল ঘোষের ছেলে সঞ্জয় ঘোষ জানান, বাবা অফিসের কাগজপত্র ফটোকপি করতে অফিস থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মোড়ে যান। এ সময় পুলিশের ছোড়া একটি টিয়ার শেল তার খুব কাছে বিস্ফোরিত হয়। এর ধোঁয়া তার নাকে ঢুকলে তিনি বুকে হাত চেপে রাস্তায় পড়ে যান। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে দ্রুত সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাল ৫টার দিকে তিনি মারা যান। এ ব্যাপারে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন বলেন, সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এক পর্যায়ে তারা বাধ্য হয়ে টিয়ার শেল ছোড়ে। তবে এতে কেউ মারা গেছেন কিনা তা তিনি জানেন না। ওসি আরো জানান, ছুরিকাঘাতে ইমরান মারা যাননি। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। কেউ কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে ইমরানের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ চশমা বণিক শিল্প সমিতির সদস্য কাজী জানে আলম জানান, দুপুর দেড়টার দিকে ছাত্রলীগ নামধারী ৪/৫ সন্ত্রাসী পাটুয়াটুলীর নূরুল হক টাওয়ারের নূর অপটিকসে ঢুকে কয়েকটি চশমা নেয়। তারা টাকা না দিয়ে চলে যাওয়ার সময় দোকান কর্মচারী ইমরান (২৪) বাধা দিলে সন্ত্রাসীরা তাকে মারধর করে এবং এক পর্যায়ে তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। এ সময় উত্তরা থেকে আসা চশমার ক্রেতা মিঠু এগিয়ে গেলে তাকেও ছুরি মেরে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আহত ইমরান ও মিঠুকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। এর কিছু সময় পর গুজব ছড়িয়ে পড়ে ইমরান মারা গেছেন। এতে মুহূর্তেই পাটুয়াটুলীসহ আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা দোকানপাট বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসেন। বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা বাহাদুর শাহ পরিবহনের ৬টি বাসসহ প্রায় এক ডজন যানবাহন ভাংচুর করেন। এক পর্যায়ে তারা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবন এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অগ্রণী ব্যাংকেও তা-ব চালায়। পরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়ে এগিয়ে গেলে দু'পক্ষের মধ্যে চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও দফায় দফায় সংঘর্ষ। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করে বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দু'পক্ষই বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নিয়ে পুলিশ ও প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ছোড়ে পুলিশ। ঘটনাস্থলের আশপাশের সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। সংঘর্ষের সময় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শত শত শিশু শিক্ষার্থী, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পথচারী আটকা পড়ে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তারা নিরাপদ আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পাটুয়াটুলী চশমা বণিক সমিতির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, গোটা এলাকার ব্যবসায়ীরা ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা প্রতিটি দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলছে। এরপরও বিভিন্ন সময় দোকান থেকে ফাও জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। এতে বাধা দিলেই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর এবং মালিক-কর্মচারীদের মারধর করছে। থানা পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হলেও দীর্ঘদিনেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ কারণে তারা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ইমরানের খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং ছাত্রলীগের নেতা নামধারী সশস্ত্র চাঁদাবাজ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে গোটা পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ রেখে আন্দোলনে নামবে বলে হুমকি দেন চশমা মালিক সমিতির নেতারা। পুরান ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটের নেতারাও তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ চশমা দোকান কর্মচারী ইমরান খুনের সঙ্গে দলের কোনো নেতাকর্মীর জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। নেতাদের ভাষ্য, স্থানীয় সন্ত্রাসীরা তাদের নানা অপকর্মের দায়ভার ছাত্রলীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র সোহেল পারভেজ বলেন, কে কোন চশমার দোকানে গিয়ে কাকে খুন করেছে তা তাদের জানার কথা নয়। কিন্তু ব্যবসায়ী-কর্মচারীরা সে দিক বিবেচনা না করে অতর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। সহপাঠীদের ওপর চড়াও হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধভাবে তাদের প্রতিহত করতে ধাওয়া করে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু এতে কেউ নেতৃত্ব দেয়নি। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের অভিযোগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম শ্রাবণ গ্রুপের কর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে শ্রাবণ বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে তার গ্রুপের কেউ দূরে থাক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রই জড়িত নন। তিনি আরো বলেন, কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্ররা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করেন। এটি হয়তো তাদেরই কাজ। কিন্তু ব্যবসায়ীরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দোষারোপ করছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads