মঙ্গলবার, ২৭ মার্চ, ২০১২

গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে জিয়ার ওপর বই প্রকাশনা অনুষ্ঠান বন্ধ : প্রধান অতিথি ছিলেন খালেদা জিয়া



এবার সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা নির্দেশ দিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ওপর লেখা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। হোটেল রূপসী বাংলায় গতকাল বিকালে এই অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। আগের রাতে গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের উচ্চমহলের নির্দেশে অনুষ্ঠানের ভেন্যুর বরাকণ বাতিল করার কথা আয়োজকদের জানানো হয়।
প্রখ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমানের লেখা ও সম্পাদিত পাঁচটি বইয়ের প্রকাশনা উত্সবে প্রধান অতিথি হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার উপস্থিত থাকার কথা ছিল। গ্রুপ-৯ (জি-৯) নামে একটি গবেষণা সংস্থা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আহূত এক সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকরা এ কথা জানান।
এদিকে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ওপর লেখা বইয়ের প্রকাশনা উত্সব বন্ধ করার প্রতিবাদে গতকাল বিকালেই রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপি। দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশ কে চালাচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। মনে হয় এখন কোনো রাজনৈতিক দল দেশ চালাচ্ছে না। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা গোয়েন্দা সংস্থার ওপর ভর করেছে।
অন্যদিকে সাংবাদিক শফিক রেহমান বলেন, বর্তমান সরকার যেসব অগণতান্ত্রিক কাজ করেছে, তাতে তাদের ১৯৭৫ সালের চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করে বিদায় নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের প্রচারণার জন্য লন্ডনে একজন চৌধুরী আছেন, দিল্লিতে এখন নতুন করে দীপাঞ্জন চৌধুরী যোগ হয়েছেন। দুই চৌধুরীকে দিয়ে অব্যাহত অপপ্রচারের পরও সরকার কেন আমার মাত্র ৫টি বইকে এত ভয় পাচ্ছে?
জানা গেছে, ‘রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান’ ও ‘সংগ্রামী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া’ শীর্ষক দুটি বই বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় এবং ‘পোলোগ্রাউন্ড লুণ্ঠন’ নামে আরও একটি বই লেখেন যায়যায়দিন-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শফিক রেহমান। জি-৯ এর ব্যানারে বই পাঁচটির প্রকাশনা উত্সবের আয়োজন করা হয়। বেগম জিয়া ২৭ মার্চ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সম্মতি দিলে আয়োজকরা সোনারগাঁও হোটেলের বলরুম বুকিং দেয়। সহস্রাধিক অতিথিকে আমন্ত্রণ কার্ড পৌঁছানোর পর গত ১৮ মার্চ হোটেল কর্তৃপক্ষ বুকিং বাতিল করে। প্রধানমন্ত্রী অফিস থেকে একই সময়ে বলরুম চাওয়া হয়েছে জানিয়ে কর্তৃপক্ষ বিরোধীদলীয় নেতার এই অনুষ্ঠানের বুকিং বাতিল করার বিষয়টি আয়োজকদের জানায়।
পরে ২০ মার্চ অ্যাডভান্সড বিল পরিশোধ করে এবার হোটেল রূপসী বাংলা বরাকণ নেয় আয়োজকরা। ২৭ মার্চের পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি ঠিক রেখে হোটেলটির উইন্টার গার্ডেনে অতিথিদের আমন্ত্রণসহ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে রূপসী বাংলা হোটেল থেকে আয়োজকদের কাছে একটি ফোন আসে। কর্তৃপক্ষ পাঁচটি বইয়ের বিষয়বস্তু জানতে চায় এবং মঙ্গলবার (গতকাল) সকাল ১০টার মধ্যে বইগুলোর একটি করে কপি জমা দিতে বলে। রাত ১১টার দিকে রূপসী বাংলা হোটেলের ক্যাটারিং সেলস একজিকিউটিভ মোশাররফ হোসেনের মোবাইল থেকে একটি এসএমএস দিয়ে ভেন্যু বাতিল করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে দেশ চালাচ্ছে সরকার —ফখরুল : প্রকাশনা অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়ার পর জি-৯ এর পক্ষ থেকে গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে প্রতিবাদ জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সাংবাদিক শফিক রেহমান ও জি-৯ এর সভাপতি সাইফুল ইসলাম।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক পথগুলো বন্ধ করবেন না। এর ফল কখনও ভালো হয় না। আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। যারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার দাবি করে, তারা কোন ধরনের কাজ করছে। আমরা এ কোন দেশে বাস করছি? মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়েছে সরকারের এই আচরণ।
তিনি বলেন, সরকারের এই ধরনের কর্মকাণ্ডে মনে হয় তারা গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে বিশ্বাস করে না। জনগণের বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তারা অতীতে সব সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক দল বাতিল করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিল। এখন ভিন্ন মুখোশে একই কাজ করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা আলমগীর বলেন, রূপসী বাংলা হোটেলের পক্ষ থেকে একটি মেসেজে জানানো হয়েছে, গোয়েন্দা বাহিনীর নির্দেশে বুকিং বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু এই গোয়েন্দা বাহিনী কারা—ডিজিএফআই, নাকি এনএসআই তা আমরা জানতে চাই। তাদের এই ধরনের এখতিয়ার কে দিয়েছে? আমার গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার, আমার লেখার অধিকার বন্ধ করবে কেন? ‘সোমবার স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা ও মঙ্গলবারের অনুষ্ঠান বাতিল করার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার চলাফেরায় সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে কি না’—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতে সন্দেহের কিছু নেই। এটা তো এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারা নিয়ন্ত্রণ করছে।
’৭৫-এর চেয়েও ভয়াবহ পরিণতিতে সরকারকে বিদায় নিতে হবে —শফিক রেহমান : সংবাদ সম্মেলনে শফিক রেহমান বলেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো ডিজিএফআই বাংলাদেশ চালাচ্ছে। ‘আমার লেখা কেন বন্ধ করবেন’, সরকারের প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘লন্ডন থেকে এক চৌধুরী সাহেব আপনাদের পক্ষে লেখেন। কলকাতার দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী লেখেন। দুই চৌধুরী লেখেন। অনেক লেখক লেখেন। সাহিত্যিক সাংবাদিকরা লেখেন। শুধু আমার লেখা বন্ধ করবেন কেন?’
শফিক রেহমান বলেন, আপনারা আমাকে কী করবেন? গুলি করবেন? প্রকাশ্যে গুলি করতে পারবেন না। আপনারা অন্ধকার রুমে নিয়ে টর্চার করতে পারবেন।
নিজের লেখা বইয়ের প্রকাশনা উত্সবে বাধা দেয়াকে অবৈধ দাবি করে প্রখ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমান গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের চাকরি ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অবৈধ এ সরকারের সঙ্গে আর চাকরি করবেন না।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার মাসে বাকস্বাধীনতা থাকবে না, মতামত প্রকাশ করা যাবে না, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা যাবে না—এটা হতে পারে না। অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার সংবাদসংবলিত রূপসী বাংলা হোটেল কর্তৃপক্ষের পাঠানো এসএমএসটি সংবাদ সম্মেলনে পড়ে শোনানো হয়। এসএমএসটি হলো—‘Dear Sir, As I had shared with you few minutes earlier over cell phone that we can not organized your event tomorrow. I have been instructed to you from authority of national intelligent department of Bangladesh. Sorry for the inconvenience. Thanks.’
শফিক রেহমান বলেন, ১৯৭২-৭৫ সালে সরকার যে ধরনের কর্মকাণ্ড করেছিল, বর্তমান সরকারও একই আচরণ করছে। এরশাদ ছয় বছর যায়যায়দিন বন্ধ রেখেছিল। তার করুণ পরিণতি হয়েছে। বইয়ের প্রকাশনা উত্সবে বাধা দিয়ে এই সরকার আমার সাংবিধানিক অধিকার হরণ করেছে। তাই এদের পরিণতিও করুণ হবে। তিনি বলেন, এ সরকারের ভবিষ্যত্ জিরো জিরো জিরো...জিরো।
সরকার পুলিশ ও গোয়েন্দানির্ভর হয়ে পড়েছে —ড. মঈন খান : সরকার জনসমর্থন হারিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দানির্ভর হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। গতকাল বিকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক বিক্ষোভ মিছিল-পূর্ব সমাবেশে তিনি বলেন, স্মৃতিসৌধে যেতে খালেদা জিয়াকে বাধা ও বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করতে না দেয়ায় সরকারের সত্যিকারের চরিত্র মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। দেশবিরোধী এই সরকারকে হঠাতে খালেদা জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান বক্তারা।
২৬ মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়ার পথে খালেদা জিয়াকে বাধা ও পরদিন মঙ্গলবার রূপসী বাংলা হোটেলে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করতে না দেয়ার প্রতিবাদে মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি আয়োজন করে ঢাকা মহানগর বিএনপি। মহানগর আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। আরও বক্তৃতা করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, রুহুল কবির রিজভী, সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মহিলা দল সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু প্রমুখ। সমাবেশ পরিচালনা করেন মহানগর সদস্যসচিব আবদুস সালাম।
ড. আবদুল মঈন খান বলেন, স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কোনো রাজনৈতিক শক্তি স্বাধীনতা দিবসে বিরোধী দলের নেতাকে একটি অরাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেয়—এমন নজির নেই। এভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে তারা নিজেদের দুর্বলতাই প্রমাণ করছে। এর মাধ্যমে সরকারের সত্যিকারের চরিত্র মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
মঈন খান বলেন, স্বাধীনতার পক্ষের লোকরা কখনও এ ধরনের কাজ করতে পারে না। ১৯৭২-৭৫ সালে মিডিয়ার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। দিন-দুপুরে মানুষ হত্যা করা হতো। তখন কারও জীবনের নিরাপত্তা ছিল না। সভা-সমাবেশে ছিল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। আজ আবার তারা সে ধরনের শাসন চালু করতে চাইছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে তা সম্ভব নয়।
সাদেক হোসেন খোকা বলেন, সরকার খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে, তাদের জনসমর্থন একেবারেই নেই। তাই টিকে থাকার জন্য এখন তারা পুলিশ, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল নাইটিংগেল মোড়, পুরানা পল্টন মোড় হয়ে প্রেস ক্লাবে গিয়ে শেষ হয়।আমারদেশ,২৮ মার্চ ২০১২

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads