‘কোলে তুলে ক্ষমতায় যাওয়া’ নিয়ে রাজনীতিতে বহুল নিন্দিত ও সমালোচিত বক্তব্যটি প্রথম দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে কমপক্ষে পাঁচবার তিনি এ ধরনের বক্তব্য দেন। পরে জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে যোগ দিয়ে বিরোধী দলের দু’জন মহিলা এমপি প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের অশালীন বক্তব্যের সমালোচনা করেন। জবাব দিতে গিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর পুরনো রাজনীতির ইতিহাস টেনে একই আদলে বিষোদ্গার করেন।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালের দাবি নিয়ে বিরোধী দলের চলমান আন্দোলনের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কোলে তুলে ক্ষমতায় যাওয়া’ সংক্রান্ত বক্তব্য দেন। তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘তত্ত্বাবধায়কের প্রতি এত আগ্রহ কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী চ্যাংদোলা করে কোলে তুলে আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে?’ বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কিংবা দলের কোনো সিনিয়র নেতা প্রধানমন্ত্রীর এসব অশালীন বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাননি।
তবে ১৮ ও ১৯ মার্চ বিএনপি দলীয় এমপি রেহেনা আক্তার রানু ও আসিফা আশরাফি পাপিয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণের ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অশালীন বক্তব্যের পাল্টা জবাব দেন। অশালীন বক্তব্যের পাল্টা জবাব নিয়ে জাতির ভাগ্য নির্ধারণের কেন্দ্রস্থল জাতীয় সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার ও বিরোধী দলীয় এমপিদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ‘কোলে ওঠার’ গণ্ডি পেরিয়ে ‘নিষিদ্ধ পল্লী’র আলোচনায় গড়ায়। জাতীয় নেতৃত্বের এমন আলোচনা দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। রাজনীতি ও সচেতন মহলের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছেও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ‘কোলে ওঠা’ প্রসঙ্গে বক্তৃতা করেন। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি এবং ২ ও ৭ মার্চ একই আদলে বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বিষোদ্গার করেন।
মূলত, রাজনৈতিক ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ বছরের শুরুই করেছেন ‘তত্ত্বাবধায়ক খালেদা জিয়াকে কোলে তুলে ক্ষমতায় বসাবে না’ বা ‘বসাবে কি’ এমন প্রসঙ্গ নিয়ে। গত ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি এ ধরনের বক্তৃতার উদ্বোধন করেন। এ নিয়ে পরের দিন বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের একটি ছিল এরকম—বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আপনি এত অস্থির কেন? আবার খাল কেটে কুমির আনার দরকার কি? তত্ত্বাবধায়ক এলেই যে বিরোধীদলীয় নেতাকে চ্যাংদোলা করে ক্ষমতায় বসাবে তার গ্যারান্টি কি?’
৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ছাত্রলীগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় শেখ হাসিনা একই প্রসঙ্গ টেনে কথা বলেন। ৫ ফেব্রুয়ারি পত্রিকার খবরটি ছিল—‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছেন। তত্ত্বাবধায়ক আসলেই যে আপনাকে (খালেদা জিয়া) কোলে করে নিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে, এই আশা করবেন না। ভোট চুরি করে আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে তা আর হবে না।’
২ মার্চ রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের এক যৌথসভায় শেখ হাসিনা একই আদলে বেগম খালেদাকে উদ্দেশ্য করে বিষোদ্গার করেন। পরের দিন একটি জাতীয় দৈনিকের খবরটি ছিল এরকম—‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলেই যে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় বসাবে তার গ্যারান্টি কি? তার স্বাদের প্রিয়জন ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীন-মইনুদ
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণশোভাযাত্রা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য পরের দিন একটি জাতীয় দৈনিকে এভাবে প্রকাশিত হয়—‘বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উনি (খালেদা জিয়া) তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। উনি কি ভেবেছেন, তত্ত্বাবধায়ক এলে উনাকে একেবারে কোলে তুলে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। উনাকে তো কোলে তুলে ক্ষমতায় বসাবে না। উনার বোঝা উচিত, তত্ত্বাবধায়ক এসে উনাকেই জেলে পুরেছিল। দুই ছেলেকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। আর এবার যদি তত্ত্বাবধায়ক আসে, তাহলে তাদের ধরে এনে কারাগারে পুরবে।’
বিরোধী দলের কোনো সিনিয়র নেতা প্রধানমন্ত্রীর এসব অশালীন বক্তব্যের জবাব না দিলেও সুযোগ নেন বিএনপি দলীয় এমপি রেহেনা আক্তার রানু ও সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া। গত ১৮ মার্চ সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে এমপি রেহেনা আক্তার রানু বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, ... ২০০৮ সালের নির্বাচনে উনি (শেখ হাসিনা) মইন ইউ আহমেদের কোলে বসেছেন। শুধু মইন নয়, আরও কোথায় কোথায় বসেছেন এদেশের মানুষ জানে।’
১৯ মার্চ এমপি সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, .. .. .. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে খালেদা জিয়া আন্দোলন করছেন বলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়েছেন। কোলে করে ক্ষমতায় নেয়ার কথা বলেছেন। .. .. .. .. বেগম খালেদা জিয়াকে কোলে তোলার কটাক্ষ করে বক্তব্য দেন। আপনার কি আবারও কোলে ওঠার সাধ জেগেছে? নিজের প্রয়োজনে কোলে ওঠা আর লং ড্রাইভে যাওয়ার বদ অভ্যাস আপনার আছে, বেগম জিয়ার নয়। লং ড্রাইভে গিয়ে স্বৈরশাসকের কোলে চড়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে অবৈধ শাসনকে বৈধতা দেন। যৌবনকালে আর কার কার কোলে চড়েছেন রেন্টুর বই পড়লে সব জানা যাবে। বেয়াইয়ের কোলে চড়ে দোল খাওয়ার সময় বেয়াইন দেখে ফেলে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। ১৯৯৬ সালে গোলাম আযমের কোলে চড়ে তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলন করেছেন। .....”
আর কোলে উঠে ক্ষমতায় আসার এমন বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ১৮ ও ১৯ মার্চ জাতীয় সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সব মহলেই তা সমালোচিত হয়। এবার কোলে ওঠার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিষোদ্গার করলে তা নিয়ে সংসদে বিতর্ক হয়। ১৮ মার্চ এমপি রানুর বক্তব্যের সমালোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি বলেন, ‘বিরোধী দলের এমপিরা জাতীয় সংসদে যেসব শব্দ উচ্চারণ করেছেন, তা নিষিদ্ধ পল্লীতেও মানায় না। আমি তাদের এ ভাষাকে নিষিদ্ধ পল্লীর ভাষার সঙ্গে তুলনা করে সেখানে যারা থাকেন, তাদের ছোট করতে চাই না।’
পরের দিন ১৯ মার্চ এমপি পাপিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বলেন, ‘রোববার নাকি সংসদে নিষিদ্ধ পল্লীর ভাষায় কথা বলা হয়েছে। আমাদের অনুপস্থিতিতে খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলেকে নিয়ে কীভাবে গালাগালি হয়েছে। .. .. .. .. .. যারা নিষিদ্ধ পল্লীর সদস্য, তারাই জানে নিষিদ্ধ পল্লীর ভাষা কী?’
আর এ নিয়ে সংসদে হৈচৈ ও উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময়
পাপিয়ার মাইক বন্ধ করে দিয়ে স্পিকার বলেন, ‘এসব অশ্লীল
কথা, কারও কোলে ওঠার কথা বলে আপনারা বক্তব্য রাখবেন না। আমি তো বলতে পারি না, এগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত। আসলেই তদন্ত হওয়া উচিত। আপনারা যারা সদস্য আছেন তাদের দিয়ে তদন্ত করা যায়
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন