বুধবার, ২৮ মার্চ, ২০১২

শোডাউনে লোক কম আসায় মহাজোটে হতাশা : ‘বিএনপি করেছিল শীতকালে আমরা কাঠফাটা রোদে’




দুই মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পলোগ্রাউন্ড ময়দানে দেশের বৃহত্ দুটি রাজনৈতিক জোটের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ও সমমনা দলগুলোর মহাসমাবেশ হয় গত ৯ জানুয়ারি। একই মাঠে সরকারি দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো গতকাল। দুটি সমাবেশের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। সমাবেশে সমাগম আশানুরূপ না হওয়ায় আ.লীগসহ মহাজোটের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশাভাব দেখা গেছে গতকালই।
লোকসমাগম থেকে শুরু করে সমাবেশের আয়োজনের মধ্যে ছিল অনেক পার্থক্য। বিএনপির মহাসমাবেশ পলোগ্রাউন্ডের মাঠ ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী, প্রধান রেল সড়কসহ পলোগ্রাউন্ড সংলগ্ন সড়কগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। গতকাল আওয়ামী লীগের সমাবেশে আশপাশের সড়কগুলোতে লোক সমাগম ঘটলেও সমাবেশস্থল পলোগ্রাউন্ড মাঠ ছিল অনেকটা ফাঁকা। নেতাদের বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে আসে। মহাজোটের শরিক জাসদের এমপি মাইনুদ্দিন খান বাদল তার বক্তব্যে কৌশল অবলম্বন করে বলেন, বিএনপি সমাবেশ করেছিল শীতকালে, আমরা করছি গরমের কাঠফাটা রোদে। পলোগ্রাউন্ড সংলগ্ন রেল সড়কের ওপর তেমন ভিড় ছিল না। অথচ বিএনপির সমাবেশে ৩ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবককে হলুদ ও লাল পতাকা হাতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে। এছাড়া বিএনপির সমাবেশে পলোগ্রাউন্ড মাঠের বাইরে ২০টি পয়েন্টে জায়ান্ট স্ক্রিনের ব্যবস্থা রাখলেও আওয়ামী লীগের সমাবেশে কোনো জায়ান্ট স্ক্রিন ছিল না। বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন রাত থেকেই পলোগ্রাউন্ড এলাকায় অবস্থান নেয় বিএনপি কর্মী সমর্থকরা। কিন্তু গতকালের সমাবেশে তেমনটি দেখা যায়নি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মাঠ থেকে আশপাশের রাস্তাগুলোতে তুলনামূলক লোকসমাগম বেশি ছিল। সমাবেশের সর্বজনীনতা ছাপিয়ে নেতাকেন্দ্রিক শোডাউনের তত্পরতা বেশি দেখা গেছে। নগর ও জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা পৃথকভাবে শোডাউন করে সমাবেশস্থলে এলেও সমর্থকদের মাঠে ধরে রাখতে পারেনি। আশপাশের রাস্তা ও পাহাড়ে আলাদা আলাদাভাবে জটলা করে নিজেদের মধ্যে হিসাবনিকাশে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। বিকাল ৪টার দিকে সমাবেশে যোগ দিতে আসা একদল মানুষ টাইগারপাস মোড় থেকে বাটালীহিলের দিকে চলে যাওয়া সড়কের পাশে জটলা করছিল। সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুস সালামের পক্ষে এসেছে তারা। মিছিল করে সমাবেশস্থলে গিয়ে নেতার সঙ্গে দেখা করে এসেছে। মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চলাকালে সিআরবি এলাকায় নেতাকর্মী বহন করে নিয়ে আসা গাড়ির সারির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একদল মানুষ। এদের মধ্য থেকে সাজেদুর রহমান নামের একজন জানায়, নগরীর পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা তারা। আওয়ামী লীগের দুই নেতা তাদের ট্রাকে করে নিয়ে এসেছে। তাদের পক্ষে আলাদা আলাদাভাবে দুটো মিছিল করে সমাবেশ স্থলে গিয়েছিল। দুপুরে বিরানীর প্যাকেট পেয়েছে। এখন আবার সেই নেতাদের সঙ্গে দেখা করার আশায় আছে তারা।
জনভোগান্তি চরমে : ১৪ দলের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে দিনভর মহাদুর্ভোগে নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে চট্টগ্রামবাসী। প্রশাসনের অতিউত্সাহী ভূমিকা ও দলীয় নেতাকর্মীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ছিল জনভোগান্তির প্রধান অন্তরায়। এদিকে বন্দর, ইপিজেডসহ বিভিন্ন কলকারখানা, হকার মার্কেটসহ অধিকাংশ মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ রেখে সমাবেশে যোগ দেয়ার অলিখিত নির্দেশনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ছিল কার্যত স্থবির। শহরের কোথাও টাউন সার্ভিসের গাড়ি না চলায় সাধারণ মানুষ পড়েন চরম ভোগান্তিতে।
সরেজমিন দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই তত্পর হয়ে ওঠে প্রশাসন। সকাল ৮টার পর থেকেই এয়ারপোর্ট রোড সংলগ্ন বাণিজ্যকেন্দ্র আগ্রাবাদ এলাকা, লালখানবাজার, লাভলেইন বৌদ্ধমন্দির, মুরাদপুর, কাজির দেউরি সার্কিটহাউস এলাকাসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। এসব এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি থাকায় নিরাপত্তার কারণে সড়কগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বলে জানায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। এসময় নগরজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। সকাল ১১টার পর শহরে আর কোনো টাউন সার্ভিস গাড়ি চলেনি। শহর চলে যায় রিকশার দখলে। সুযোগ বুঝে রিকশা চালকরা দ্বিগুণ তিনগুণ ভাড়া হাকিয়ে নেয় যাত্রীদের কাছ থেকে। যানবাহন সঙ্কটের কারণে অনেককে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। ওয়াসার মোড় থেকে রেলস্টেশনের উদ্দেশে বের হন গৃহিণী কেয়া। ২০ টাকার রিকশা ভাড়া ৬০ টাকা দিতে হয়েছে বলে জানান তিনি। নগরীর মুরাদপুর থেকে এনায়েত বাজার কর্মস্থলে আসেন এনজিও কর্মী আব্বাস উদ্দিন। পুলিশের বাধার মুখে ৪ বার যানবাহন পরিবর্তন করতে হয়েছে। ৫ টাকার বাস ভাড়ার স্থলে ৬০ টাকা খরচ হয়েছে তার। একই অভিযোগ করেন বিভিন্ন কাজে শহরে আসা শতাধিক মানুষ।
বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোতেও ছিল অঘোষিত ছুটি। বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে সমাবেশে শিক্ষার্থী নিয়ে আসার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমাবেশে আনা হয়েছে এমপি নুরুল ইসলাম বিএসসির পক্ষে। বেলা ২টায় নগরীর কদমতলী মোড়ে শিক্ষার্থী ভর্তি গাড়িটি দেখা গেছে।
এদিকে ১৪ দলের মহাসমাবেশের দিনে হকার মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ ছিল। দলীয় ক্যাডারদের নির্দেশে এসব দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন দোকানের মালিকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রবর্তক মোড় এলাকার এক টেইলার্স মালিক জানান, সোমবার রাতে স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা এসে বলে গেছে, বুধবার দোকান না খুলে কর্মচারীদের নিয়ে পলোগ্রাউন্ডে যেতে হবে। একই কথা জানায় নিউমার্কেট, জিইসি মোড়, মুরাদপুর, চকবাজার, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বুধবার সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে এলে সরকার সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনসহ বন্দর থানা আওয়ামী লীগের নেতারা শ্রমিকদের সমাবেশে যেতে বাধ্য করেন। এ কারণে বন্দরে পর্যাপ্ত শ্রমিক না থাকায় বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। চট্টগ্রাম ইপিজেড সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ছিল। কারখানা বন্ধ রেখে শ্রমিকদের সমাবেশে পাঠানোর অজ্ঞাত স্থানের নির্দেশনায় অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ছিল বলে সূত্রটি নিশ্চিত করে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads