ড. মা হ্ বু ব উ ল্লা হ্
আজকের বাংলাদেশের শ্বাসরুদ্ধকর দুঃসহ পরিস্থিতিতে টমাস পেইনের একটি কথা আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে। টমাস পেইন তার The Crisis গ্রন্থের একটি নিবন্ধে বলেছিলেন, “These are the times that try men’s souls : The summer soldier and the sunshine patriot will, in this crisis, shrink from the service of his country; but he that stands it now, deserves the love and thanks of man and woman. Tyranny, like hell, is not easily conquered; yet we have this consolation with us, that the harder the conflict, the more glorious the triumph. What we obtain too cheap, we esteem too lightly.”
টমাস পেইনের এই উদ্ধৃতিটি ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়—‘এখনকার সময়টি হচ্ছে এমন এক সময় যখন মানুষের আত্মার পরীক্ষা : এই সঙ্কটে গ্রীষ্মের সৈনিকরা এবং রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের দেশপ্রেমিকরা তাদের দেশের সেবা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। কিন্তু যে মানুষটি এখন এর মোকাবিলা করছে, সে নারী ও পুরুষের ভালোবাসা ও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। নরকের মতোই অত্যাচারকে সহজে জয় করা যায় না। তবুও আমাদের এই সান্ত্বনা যে, সংঘাত যতই কঠিনতর হোক বিজয় ততোধিক গৌরবময়। যা কিছু আমরা সহজে অর্জন করি তার মর্যাদা আমরা অতি সামান্যই দিই।’ পেইন গ্রীষ্মের সৈনিক এবং রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের দেশপ্রেমিকদের সম্পর্কে বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মতো দেশে শীতের সময় যখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে আসে, তখন প্রকৃতিকে খুব বৈরী মনে হয়। কিন্তু গ্রীষ্ম কিংবা রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনগুলোকে আরামদায়ক মনে হয়। যে সৈনিক শুধু গ্রীষ্মের সময় যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত কিন্তু শীতের প্রচণ্ডতা উপেক্ষা করে লড়াই চালিয়ে যেতে কুণ্ঠা বোধ করে, সেই সৈনিক যথার্থ লড়াকু সৈনিক নয়। তেমনি দেশের সুদিনে দেশপ্রেমিক হওয়া যত সহজ, শত্রুকবলিত দেশে দেশপ্রেমিক হওয়া তত সহজ নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি, ঘোর দুঃসময়ে যারা দেশের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, প্রবল প্রতিকূলতাকে জয় করতে দৃঢ়চিত্ত হয়—তারাই সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। নরকাগ্নিকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মতো অত্যাচার ও নিপীড়নের মুখোমুখি দাঁড়ানোও দুঃসাহসিক কাজ। যে রাজ্য অত্যাচারী রাজার শাসনাধীন, যে দেশ ফ্যাসিবাদী শাসকের হাতে নিষ্পেষিত হয়; সে দেশকে একমাত্র নরকের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। মহত্ কিছু অর্জন করতে হলে সুকঠিন প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করতে হয়। যা কিছু আমরা সহজে অর্জন করি, আমাদের কাছে তার মূল্য ততই কম। দেশে দেশে এমন এক সময় আসে, যখন অত্যাচারীর অত্যাচার ও নিপীড়ন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এমন নজির পৃথিবীতে আমরা অনেক দেখেছি। হিটলার, মুসোলিনি কিংবা ফ্রাঙ্কো ও সালাজারের শাসন তাদের দেশবাসীকে চরম শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলেছিল। চিলিতে পিনোশের শাসনও ছিল অসহনীয় অত্যাচার ও নিপীড়নের ভারে জর্জরিত। রাত যত গভীর হয়, ঊষার আলো ততই নিকটবর্তী হয়। সুতরাং দুঃসময়ে ধৈর্যহারা হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাতের অন্ধকারের মতোই দিনের আলো নিশ্চিত এক সত্য। তবে একথাও সত্য যে, মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে রাতের কালো এবং দিনের আলো অদ্ভুত এক পরম্পরায় চলে এসেছে। তাই মানবজাতিকে বারবার লড়াই করতে হয়, নির্যাতন-নিপীড়ন সইতে হয়; শুধু শিশুর মুখে এক টুকরো হাসির জন্য। এমন দিন কি কখনও আসবে যে দিন পৃথিবীর সব কিছু অমলিন হাসিতে পৃথিবীটাকে আলোকিত করে তুলবে? তেমন অনন্ত ও নিরবচ্ছিন্ন শান্তি হয়তো পৃথিবীতে কখনও আসবে না। এর জন্য আমি সংশয়বাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারি। কিন্তু এটাই বোধ হয় প্রাকৃতিক নিয়ম। তা না হলে মানবপ্রগতি স্তব্ধ হয়ে যেত।
টমাস পেইনের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছিলাম। তার জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ডের থেটফোর্ডে ১৭৩৭ সালে। তার বাবা জাহাজের মাস্তুল বাঁধার রজ্জু পাকানোর কাজ করতেন। স্কুলে সামান্যই লেখাপড়া করতে পেরেছিলেন তিনি। জীবন ধারণের জন্য বেশকিছু চাকরিও করেছেন। সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের চাকরি করাকালীন আবগারি শুল্ক আদায়কারীদের বেতন বৃদ্ধির জন্য বিক্ষোভ করতে গিয়ে তিনি চাকরি হারান। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের অনুরোধে ১৭৭৪ সালে তিনি আমেরিকায় হিজরত করেন। ১৭৭৬ সাল থেকে তিনি অসবত্রপধহ ঈত্রংরং সিরিজের ১৩টি প্রচারপত্র রচনা করতে শুরু করেন। তার সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনাটি হলো ঈড়সসড়হ ঝবহংব. ঈড়সসড়হ ঝবহংব রচনা করে পেইন একজন প্রকৃত বিপ্লবী চিন্তাবিদের মর্যাদা অর্জন করেন। তাকে আমেরিকান বিপ্লবের সবচেয়ে সাহসী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বলা হয়। ১৭৮৭ সালে পেইন ইউরোপে প্রত্যাবর্তন করে বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ইংল্যান্ডে তার লেখা বইগুলো প্রকাশ্যে ফাঁসি কার্যকরকারীদের দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। পেইন ফ্রান্সে পালিয়ে যান। সেখানে ফরাসি সংবিধানের খসড়া রচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং রাজার মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেন। সেখানে এক বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন এবং অল্পের জন্য মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে যান। ১৮০২ সালে তিনি আমেরিকায় ফিরে আসেন এবং নিউইয়র্ক রাজ্যে বসবাস শুরু করেন। তার জীবনের শেষ দিনগুলো ছিল দারিদ্র্য ও ব্যাধিতে জর্জরিত। চরমপন্থার জন্য তিনি নিন্দিতও হয়েছিলেন। টমাস পেইন ১৮০৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি বুদ্ধিবৃত্তি এবং রাজনৈতিক লড়াই ও সংগ্রামে অবদানের জন্য প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি শুধু অনলবর্ষী কলমে লিখে যাননি, তিনি ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সৈনিক হিসেবেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি রাইফেল ও কলম দিয়ে সমানতালে যুদ্ধ করেছেন। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
বাংলাদেশে এখন বড় দুঃসময়। সাংবাদিক নির্মল সেন ’৭২-৭৫ পর্বে স্বভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়ে তার বিখ্যাত কলামটি লিখেছিলেন। তা আজও নানাভাবে উচ্চারিত হয়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ অনেকের ভাগ্যেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি জোটেনি। ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল গণতন্ত্র ও সুষম অর্থনৈতিক বণ্টনের স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। একটি সভ্য দেশে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার অনেক কিছুই থাকতে পারে। তবে ন্যূনতম চাহিদাটি হলো জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা। রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রে সবার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে, এমনটি ভাবা অলীক কল্পনা হবে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা হলো, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের নিখাদ আন্তরিকতা। রাষ্ট্রের আচার-আচরণে বেশিরভাগ মানুষ যদি ভাবতে শুরু করে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোথাও শৈথিল্য আছে, তাহলে বুঝতে হবে আমরা বড় রকমের বিপদের মধ্যে আছি। পেটে ভাত না জুটলেও যদি মন খুলে বলতে পারি আমি অভুক্ত, তাহলেও ক্ষুধার কষ্ট কিছু ভোলা যায়। স্বাধীন দেশে ৪১ বছর পর এই কষ্ট ভুলে থাকার মতো একটি পরিবেশ চাই। এ কেমন স্বাধীন দেশ! যে দেশের স্বাধীনতা দিবসে জনপ্রিয় বিরোধীদলীয় নেতাকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বাধার সম্মুখীন হতে হয়? তার যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে নামগোত্রহীন বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার আনন্দ ভোগ করার স্বাধীনতা কতটুকু আছে সে প্রশ্ন তোলা অবান্তর হবে না। একইভাবে ‘গণতন্ত্রে’র এই দেশে পুস্তক প্রকাশনার মতো নির্দোষ অনুষ্ঠানও বাতিল হয়ে যায়। অজুহাত নিরাপত্তার, অজুহাত গোয়েন্দা তথ্যের। দুর্ভেধ্য নিরাপত্তা ব্যূহ এবং সর্বাধিক সাবধানতাও অনেক সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। তাই যদি হতো তাহলে জন এফ কেনেডি, আব্রাহাম লিঙ্কনসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪ জন প্রেসিডেন্ট নিহত হতেন না। প্রয়াত জননেতা আতাউর রহমান খান তার ওজারতির দুই বছর গ্রন্থে বিভ্রান্তিকর গোয়েন্দা তথ্য সম্পর্কে হাস্যরসাত্মক ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তাই গোয়েন্দা তথ্যকে রাজনৈতিক আচরণাদির সঙ্গে মিলিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এগুলোকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার যৌক্তিকতা নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সবচাইতে মূল্যবান সম্পদটি হলো পারস্পরিক আস্থা। এই আস্থা দলের সঙ্গে দলের, এক মতের সঙ্গে অন্য মতের, এক ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির। আস্থার ঘাটতি যখন ঘটে তখন ছায়াকেও শত্রু মনে হয়। বাংলাদেশের সঙ্কটের একটি প্রধান উত্স হলো আস্থাহীনতা। সবাই যখন নির্বিবাদে মত প্রকাশ করতে পারবে, নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারবে এবং প্রত্যেকে অপরের মতটিকে শ্রদ্ধা করবে—কেবল তখনই এই আস্থার সঙ্কট কেটে যাবে। মত প্রকাশের টুঁটি চেপে ধরা কখনোই মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে না। অবসান ঘটাতে হবে নিপীড়ন, নির্যাতন ও ভীতি উদ্রেককারী শাসনপদ্ধতির।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com
টমাস পেইনের এই উদ্ধৃতিটি ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়—‘এখনকার সময়টি হচ্ছে এমন এক সময় যখন মানুষের আত্মার পরীক্ষা : এই সঙ্কটে গ্রীষ্মের সৈনিকরা এবং রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের দেশপ্রেমিকরা তাদের দেশের সেবা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। কিন্তু যে মানুষটি এখন এর মোকাবিলা করছে, সে নারী ও পুরুষের ভালোবাসা ও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। নরকের মতোই অত্যাচারকে সহজে জয় করা যায় না। তবুও আমাদের এই সান্ত্বনা যে, সংঘাত যতই কঠিনতর হোক বিজয় ততোধিক গৌরবময়। যা কিছু আমরা সহজে অর্জন করি তার মর্যাদা আমরা অতি সামান্যই দিই।’ পেইন গ্রীষ্মের সৈনিক এবং রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের দেশপ্রেমিকদের সম্পর্কে বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মতো দেশে শীতের সময় যখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে আসে, তখন প্রকৃতিকে খুব বৈরী মনে হয়। কিন্তু গ্রীষ্ম কিংবা রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনগুলোকে আরামদায়ক মনে হয়। যে সৈনিক শুধু গ্রীষ্মের সময় যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত কিন্তু শীতের প্রচণ্ডতা উপেক্ষা করে লড়াই চালিয়ে যেতে কুণ্ঠা বোধ করে, সেই সৈনিক যথার্থ লড়াকু সৈনিক নয়। তেমনি দেশের সুদিনে দেশপ্রেমিক হওয়া যত সহজ, শত্রুকবলিত দেশে দেশপ্রেমিক হওয়া তত সহজ নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি, ঘোর দুঃসময়ে যারা দেশের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, প্রবল প্রতিকূলতাকে জয় করতে দৃঢ়চিত্ত হয়—তারাই সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। নরকাগ্নিকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মতো অত্যাচার ও নিপীড়নের মুখোমুখি দাঁড়ানোও দুঃসাহসিক কাজ। যে রাজ্য অত্যাচারী রাজার শাসনাধীন, যে দেশ ফ্যাসিবাদী শাসকের হাতে নিষ্পেষিত হয়; সে দেশকে একমাত্র নরকের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। মহত্ কিছু অর্জন করতে হলে সুকঠিন প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করতে হয়। যা কিছু আমরা সহজে অর্জন করি, আমাদের কাছে তার মূল্য ততই কম। দেশে দেশে এমন এক সময় আসে, যখন অত্যাচারীর অত্যাচার ও নিপীড়ন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এমন নজির পৃথিবীতে আমরা অনেক দেখেছি। হিটলার, মুসোলিনি কিংবা ফ্রাঙ্কো ও সালাজারের শাসন তাদের দেশবাসীকে চরম শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলেছিল। চিলিতে পিনোশের শাসনও ছিল অসহনীয় অত্যাচার ও নিপীড়নের ভারে জর্জরিত। রাত যত গভীর হয়, ঊষার আলো ততই নিকটবর্তী হয়। সুতরাং দুঃসময়ে ধৈর্যহারা হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাতের অন্ধকারের মতোই দিনের আলো নিশ্চিত এক সত্য। তবে একথাও সত্য যে, মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে রাতের কালো এবং দিনের আলো অদ্ভুত এক পরম্পরায় চলে এসেছে। তাই মানবজাতিকে বারবার লড়াই করতে হয়, নির্যাতন-নিপীড়ন সইতে হয়; শুধু শিশুর মুখে এক টুকরো হাসির জন্য। এমন দিন কি কখনও আসবে যে দিন পৃথিবীর সব কিছু অমলিন হাসিতে পৃথিবীটাকে আলোকিত করে তুলবে? তেমন অনন্ত ও নিরবচ্ছিন্ন শান্তি হয়তো পৃথিবীতে কখনও আসবে না। এর জন্য আমি সংশয়বাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারি। কিন্তু এটাই বোধ হয় প্রাকৃতিক নিয়ম। তা না হলে মানবপ্রগতি স্তব্ধ হয়ে যেত।
টমাস পেইনের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছিলাম। তার জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ডের থেটফোর্ডে ১৭৩৭ সালে। তার বাবা জাহাজের মাস্তুল বাঁধার রজ্জু পাকানোর কাজ করতেন। স্কুলে সামান্যই লেখাপড়া করতে পেরেছিলেন তিনি। জীবন ধারণের জন্য বেশকিছু চাকরিও করেছেন। সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের চাকরি করাকালীন আবগারি শুল্ক আদায়কারীদের বেতন বৃদ্ধির জন্য বিক্ষোভ করতে গিয়ে তিনি চাকরি হারান। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের অনুরোধে ১৭৭৪ সালে তিনি আমেরিকায় হিজরত করেন। ১৭৭৬ সাল থেকে তিনি অসবত্রপধহ ঈত্রংরং সিরিজের ১৩টি প্রচারপত্র রচনা করতে শুরু করেন। তার সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনাটি হলো ঈড়সসড়হ ঝবহংব. ঈড়সসড়হ ঝবহংব রচনা করে পেইন একজন প্রকৃত বিপ্লবী চিন্তাবিদের মর্যাদা অর্জন করেন। তাকে আমেরিকান বিপ্লবের সবচেয়ে সাহসী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বলা হয়। ১৭৮৭ সালে পেইন ইউরোপে প্রত্যাবর্তন করে বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ইংল্যান্ডে তার লেখা বইগুলো প্রকাশ্যে ফাঁসি কার্যকরকারীদের দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। পেইন ফ্রান্সে পালিয়ে যান। সেখানে ফরাসি সংবিধানের খসড়া রচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং রাজার মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেন। সেখানে এক বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন এবং অল্পের জন্য মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে যান। ১৮০২ সালে তিনি আমেরিকায় ফিরে আসেন এবং নিউইয়র্ক রাজ্যে বসবাস শুরু করেন। তার জীবনের শেষ দিনগুলো ছিল দারিদ্র্য ও ব্যাধিতে জর্জরিত। চরমপন্থার জন্য তিনি নিন্দিতও হয়েছিলেন। টমাস পেইন ১৮০৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি বুদ্ধিবৃত্তি এবং রাজনৈতিক লড়াই ও সংগ্রামে অবদানের জন্য প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি শুধু অনলবর্ষী কলমে লিখে যাননি, তিনি ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সৈনিক হিসেবেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি রাইফেল ও কলম দিয়ে সমানতালে যুদ্ধ করেছেন। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
বাংলাদেশে এখন বড় দুঃসময়। সাংবাদিক নির্মল সেন ’৭২-৭৫ পর্বে স্বভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়ে তার বিখ্যাত কলামটি লিখেছিলেন। তা আজও নানাভাবে উচ্চারিত হয়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ অনেকের ভাগ্যেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি জোটেনি। ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল গণতন্ত্র ও সুষম অর্থনৈতিক বণ্টনের স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। একটি সভ্য দেশে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার অনেক কিছুই থাকতে পারে। তবে ন্যূনতম চাহিদাটি হলো জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা। রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রে সবার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে, এমনটি ভাবা অলীক কল্পনা হবে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা হলো, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের নিখাদ আন্তরিকতা। রাষ্ট্রের আচার-আচরণে বেশিরভাগ মানুষ যদি ভাবতে শুরু করে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোথাও শৈথিল্য আছে, তাহলে বুঝতে হবে আমরা বড় রকমের বিপদের মধ্যে আছি। পেটে ভাত না জুটলেও যদি মন খুলে বলতে পারি আমি অভুক্ত, তাহলেও ক্ষুধার কষ্ট কিছু ভোলা যায়। স্বাধীন দেশে ৪১ বছর পর এই কষ্ট ভুলে থাকার মতো একটি পরিবেশ চাই। এ কেমন স্বাধীন দেশ! যে দেশের স্বাধীনতা দিবসে জনপ্রিয় বিরোধীদলীয় নেতাকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বাধার সম্মুখীন হতে হয়? তার যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে নামগোত্রহীন বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার আনন্দ ভোগ করার স্বাধীনতা কতটুকু আছে সে প্রশ্ন তোলা অবান্তর হবে না। একইভাবে ‘গণতন্ত্রে’র এই দেশে পুস্তক প্রকাশনার মতো নির্দোষ অনুষ্ঠানও বাতিল হয়ে যায়। অজুহাত নিরাপত্তার, অজুহাত গোয়েন্দা তথ্যের। দুর্ভেধ্য নিরাপত্তা ব্যূহ এবং সর্বাধিক সাবধানতাও অনেক সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। তাই যদি হতো তাহলে জন এফ কেনেডি, আব্রাহাম লিঙ্কনসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪ জন প্রেসিডেন্ট নিহত হতেন না। প্রয়াত জননেতা আতাউর রহমান খান তার ওজারতির দুই বছর গ্রন্থে বিভ্রান্তিকর গোয়েন্দা তথ্য সম্পর্কে হাস্যরসাত্মক ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তাই গোয়েন্দা তথ্যকে রাজনৈতিক আচরণাদির সঙ্গে মিলিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এগুলোকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার যৌক্তিকতা নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সবচাইতে মূল্যবান সম্পদটি হলো পারস্পরিক আস্থা। এই আস্থা দলের সঙ্গে দলের, এক মতের সঙ্গে অন্য মতের, এক ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির। আস্থার ঘাটতি যখন ঘটে তখন ছায়াকেও শত্রু মনে হয়। বাংলাদেশের সঙ্কটের একটি প্রধান উত্স হলো আস্থাহীনতা। সবাই যখন নির্বিবাদে মত প্রকাশ করতে পারবে, নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারবে এবং প্রত্যেকে অপরের মতটিকে শ্রদ্ধা করবে—কেবল তখনই এই আস্থার সঙ্কট কেটে যাবে। মত প্রকাশের টুঁটি চেপে ধরা কখনোই মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে না। অবসান ঘটাতে হবে নিপীড়ন, নির্যাতন ও ভীতি উদ্রেককারী শাসনপদ্ধতির।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন