বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

সব ডিম আর একই ঝুঁড়িতে রাখতে চায় না ভারত



সৈয়দ আবদাল আহমদ
বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ভারতে সপ্তাহব্যাপী তার বহুল আলোচিত সফর শেষ করে কাল শনিবার দেশে ফিরছেন। খালেদা জিয়ার এ সফর শুধু সংবাদ মাধ্যমে নয়, দু’দেশের রাজনৈতিক মহলেও চাঞ্চল্য এবং ঔত্সুক্যের সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের এক বছর আগে খালেদা জিয়ার এ ভারত সফর খুবই তাত্পর্যপূর্ণ বলে দু’দেশের কূটনীতিকরাও মন্তব্য করেছেন।
খালেদা জিয়ার এ সফরটি ছিল ভারত সরকারের আমন্ত্রণে। গুরুত্বপূর্ণ এ সফরে তিনি নয়াদিল্লিতে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন এবং বিরোধীদলীয় নেতা সুষমা স্বরাজ প্রমুখের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তার সম্মানে মধ্যাহ্ন ভোজ দেন। হায়দরাবাদ ভবনেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর তার সম্মানে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হয়, যা সাধারণত রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। জয়পুর ও আজমির সফর করে আজ তিনি নয়াদিল্লিতে ফিরবেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গেও তার সাক্ষাত্ হওয়ার কথা রয়েছে। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি অনিশ্চিত। সফরটির তাত্পর্য কতটা—অনায়াসেই বোঝা যাচ্ছে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে খালেদা জিয়া ও মনমোহন সিংয়ের দুটি মন্তব্যের কারণে এ সফর ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহনের সঙ্গে বৈঠককালে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে তিনি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবেন না।’ অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, ‘কোনো একটি বিশেষ দল বা ব্যক্তির সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, এমন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়বে ভারত।’ অর্থাত্ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। অন্যভাবে বললে সম্পর্কের নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি হচ্ছে। ‘আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল’—এ প্রচারণার বিপরীতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের প্রচারণা হচ্ছে, ‘তিনি ভারতবিরোধী’। অন্যদিকে ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের জনমনে একটি ধারণা বিদ্যমান আছে যে, তাদের সম্পর্ক একটি বিশেষ দলের সঙ্গেই। এমন ধারনা এ সফরের ফলে অনেকটা কেটে যাচ্ছে। কারণ ভারতের কংগ্রেস এবং বাংলাদেশের বিএনপি উভয়ের রাজনৈতিক কৌশলের যে পরিবর্তন হয়েছে, সেটাই প্রকাশ পেয়েছে সফরটিতে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকবর উদ্দিন সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং দেন। আকবর উদ্দিন বলেন, খালেদা জিয়ার সফর দু’পক্ষের সম্পর্কে নতুন সময়ের সূচনা করেছে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়া নিজেই বলেছেন, ‘এটা নতুন এক সূচনা। গাড়ির পেছনের আয়নায় তাকানোর কোনো প্রয়োজন নেই।’ এ প্রসঙ্গে আকবর উদ্দিন বলেন, ‘খালেদা জিয়ার কথাতেই এ সফরের নির্যাস রয়েছে।’ সাংবাদিকরা ভারতের ব্যাপারে বিএনপির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে আকবর উদ্দিন বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মতো ভারত সরকারও সামনের দিকে তাকাতে চাইছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোনো সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে বাধা থাকতে পারে না। বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ। খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গণতান্ত্রিক সে ব্যবস্থার প্রতিই আমরা আস্থা জ্ঞাপন করেছি।’
নয়াদিল্লিতে খালেদা জিয়া যেমন অতীতের সন্দেহ-অবিশ্বাস পেছনে ফেলে সামনে তাকানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, তেমনি ভারতের নীতিনির্ধারকরাও বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে বাঁধা থাকতে পারে না। খালেদা জিয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে একই কথা বলেছিলেন। অর্থাত্ বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী কার্যকলাপের প্রশ্রয় দেয়া হবে না। বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের কাছ থেকেই যখন ভারতের প্রধান উদ্বেগের বিষয়টি দূর হয়েছে, তখন ভারতেরও উচিত সীমান্তে বিএসএফের হত্যা বন্ধ, তিস্তাচুক্তিসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান করা; সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তিসহ এদেশের জনগণের উদ্বেগ নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের ২০ মাস পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কিন্তু ওই সফরটি হতাশ করেছিল বাংলাদেশকে। প্রত্যাশিত তিস্তাচুক্তি তখন হয়নি। এ ধরনের হতাশ যেন আর বাংলাদেশকে হতে না হয়।
ভারতের প্রতি খালেদা জিয়ার বার্তা
খালেদা জিয়ার ভারত সফর আকস্মিক ছিল না। বরং তিনি এবং তার দল এজন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন কয়েক মাস ধরেই। লন্ডনের গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিস’-এর সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে তার ও বিএনপির মনোভাব আগেই তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমস্যাগুলোর উত্পত্তির প্রেক্ষাপট, ইতিহাস ও কারণ উল্লেখ করেছেন। সমস্যাগুলোর সমাধানে করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। বলেছেন, ‘প্রথমেই আমাদের উভয় নেতৃত্বকে একসঙ্গে বসতে হবে এবং যাবতীয় সমস্যাকে তুলে ধরতে হবে। খোলামেলা মুক্ত আলোচনা আর সমঝোতার মাধ্যমেই গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্বে আলোড়ন তুলে এমন ঘটনার মধ্যে রয়েছে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত এলাকায় নিরস্ত্র মানুষদের গুলি করে হত্যা করা এবং সীমান্ত সমস্যার মীমাংসা যা দীর্ঘকাল ধরে অমীমাংসিত রয়ে আছে। একই সঙ্গে সীমান্তের উভয় দিকেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকেও আমাদের আমলে নিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো পক্ষই পরস্পরের স্বার্থের বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না। এসব জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করাই শীর্ষ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। যেসব সমস্যা গুরুতর ও উত্তপ্ত, সেসব জিইয়ে না রাখাই হলো পররাষ্ট্রনীতির গতিশীলতা যাচাইয়ের শর্ত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব ইস্যু এখন সমস্যা, সেসবের নিরসন হলে দুইদিকের জনমতই অনুকূল হয়ে উঠবে। এজন্য প্রয়োজন নিখাদ রাজনৈতিক সদিচ্ছা। প্রয়োজন স্বচ্ছতা এবং পারস্পরিক মঙ্গল ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে টেকসই সম্পর্ক তৈরিকেই উভয়ের স্বার্থ বলে গণ্য করা।’ ভারত সফরে যাওয়ার আগে লেখা এই নিবন্ধে তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের জনগণের প্রতি আমার বার্তা হলো বন্ধুত্বের ও বোঝাপড়ার। নিকট প্রতিবেশী হওয়ার পাশাপাশি বসবাসই আমাদের নিয়তি এবং তা করতে হবে শান্তি ও সৌহার্দ্যের মাধ্যমে। পরস্পরের কোনো অমঙ্গল আমাদের চাওয়া হতে পারে না, নিজেদের মধ্যে শত্রুতাও আমরা বহন করতে পারব না। আমাদের অবশ্যই সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে শিখতে হবে, বাড়াতে হবে জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ। মতভিন্নতা দূর করার কাজ করে যেতে হবে এবং উভয় দেশের জনগণের মধ্যে জাগাতে হবে আরও বৃহত্তর আস্থা ও বিশ্বাস। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের মর্মমূলে থাকা উচিত পরস্পরের মঙ্গলের জন্য বিরতিহীন এবং খোলামেলা সংলাপ ও আলোচনা। একই সঙ্গে, উভয় রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাও যেন পরিব্যাপ্ত করে রাখে আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক।’
ভারতের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস যে কারণে
ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অবশ্যই একটা কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘন কালো দিনগুলোতে ভারত আমাদের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ভারত যেভাবে চাইবে আমাদের সেভাবেই চলতে হবে। আমরা শুধু দিয়েই যাব, বিনিময়ে কিছুই পাব না! স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়েই আসছে। ভারতের কাছ থেকে এমন সব আচরণ পাওয়া গেছে, যার কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতকে নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। তাদের কূটকৌশলে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধেও তাদের সহযোগিতা একেবারে নিঃস্বার্থ ছিল না। এর পেছনেও তাদের রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থচিন্তা কাজ করেছে।
স্বাধীনতার সে ঊষালগ্নেই ভারতের আচরণ আমাদের অবাক করে দেয়। শেখ মুজিবের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেও যাওয়ার সময় তারা বাংলাদেশের অনেক মূল্যবান সম্পদ নিয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবের ভারত সফর শেষে স্বাক্ষরিত যুক্ত বিবৃতির সূত্র ধরে ১৯৭৫ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল তার সঙ্গে প্রতারণা করেই। বলা হয়েছিল, ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলক এ বাঁধ চালু করা হয়েছে। কিন্তু সেই ৪১ দিন আর শেষ হয়নি। ফারাক্কা বাঁধ চালুর কারণে গত তিন যুগে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ প্রায় শুষ্ক করে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলা হয়েছে। ফারাক্কা এখন বাংলাদেশের জীবন-মরণ সমস্যা। সত্তরের দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারত তথাকথিত ‘শান্তি বাহিনী’ গঠন করে ওই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাস উসকে দিয়েছিল। ভারতীয় মাটিতে শেল্টার নিয়ে তথাকথিত শান্তিবাহিনী একের পর এক হামলা চালিয়ে এদেশের বিপুলসংখ্যক বাঙালি, পাহাড়ি বেসামরিক নাগরিক ও সেনাবাহিনীর সদস্যকে হত্যা করেছে। সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড তো এখন বাংলাদেশের জন্য এক বড় উদ্বেগের বিষয়। গুলি করে, পিটিয়ে, তীর ও পাথর ছুড়ে অথবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সপ্তাহে গড়ে দু’জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করছে বিএসএফ। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিএসএফ প্রধানের ‘আর গুলি হবে না, হত্যা হবে না’ প্রতিশ্রুতির পরও এই সীমান্তহত্যা থামেনি। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত অধিকার-এর রিপোর্টে দেখা যায়, গত ১০ মাসে সীমান্তে ১৭৪ জন নিরীহ বাংলাদেশীকে খুন, জখম এবং আহত করা হয়েছে। ফারাক্কা ও তিস্তার গজলডোবা বাঁধের পর ভারত সিলেট সীমান্তের ওপারে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের তোড়জোড় চালাচ্ছে। এটি নির্মিত হলে মেঘনা বেসিনের জন্যও নেমে আসবে করুণ পরিণতি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে প্রতীক্ষিত চুক্তিও হয়নি। ভারত তার দেশে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের কারণে অভিন্ন নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার হবে। বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বেরুবাড়ী ভারতকে দিলেও তিনবিঘা করিডোরের বিষয়টা এখনও পুরোপুরি সমাধান করেনি; তেমনি পুরোপুরি সমাধান হয়নি অন্যান্য ছিটমহল সমস্যাও। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিও বিশাল। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করে বাংলাদেশী পণ্যের ভারতে প্রবেশেরও আশাব্যঞ্জক কোনো সমাধান হয়নি। অথচ ট্রানজিট এবং চট্টগ্রাম ও খুলনা বন্দর ব্যবহারে বাংলাদেশের কাছ থেকে সম্মতি আদায় পাকাপাকি করে ফেলেছে ভারত। বাংলাদেশের জনগণ এসব কারণেই ভারতকে আস্থায় নিতে পারে না। সন্দেহ ও অবিশ্বাস এ কারণেই। ভারত যদি সেসব বিষয় উপলব্ধি করে বাংলাদেশকে আস্থায় নিয়ে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধান করে সম্পর্কের উন্নতি করতে চায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ অবশ্যই খুশি হবে এবং ভারতকে বন্ধু হিসেবে আস্থায় নিতে ভুল করবে না।
ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন!
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠু ভিত্তিতে পরিচালিত হয়নি। বাংলাদেশের অনেকেই এজন্য ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করেন। তাদের মতে, ভারত বাংলাদেশে তার স্বার্থের সবগুলো ডিম এতদিন একই ঝুড়িতে রেখে এসেছে। একটিমাত্র দল অর্থাত্ শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক নির্ণয় করেছে। আর এটা করতে গিয়েই একটা খুঁত সৃষ্টি করেছে। তবে দেরি হলেও ৪০ বছর পর ভারত তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা উপলব্ধি করছে তাদের ওই দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়। বিরাজমান সমস্যার প্রকৃত সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হলে শুধু বাংলাদেশকে দোষ দিলে চলবে না, তাদের নীতি ও অবস্থানেরও পরিবর্তন দরকার। ভারত তার কৌশল যে পরিবর্তন করছে, তা প্রথম আঁচ পাওয়া যায় কয়েক মাস আগে ঢাকায় সফরে আসা প্রণব মুখার্জীর মন্তব্যে। ভারতের অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি। ঢাকা সফরকালে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছিলেন। খালেদা জিয়াকে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারত একক কোনো দলের সঙ্গে নয়, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চায়।’ সাক্ষাত্ শেষে সাংবাদিকদেরও তিনি একই কথা জানান। ভারতের মনোভাবে যে কিছুটা পরিবর্তন আসছে, তখনই আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এবার সেটা স্পষ্ট হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের ঘোষণায়। সফররত বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, ‘ভারত বিশেষ কোনো দল বা ব্যক্তির সঙ্গে নয়, প্রতিবেশী বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এমন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই সম্পর্কে আগ্রহী।’ তিনি এও বলেন, ‘ভারত তার নিজের স্বার্থেই স্থিতিশীল, উদার ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চায়।’
ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবেই বর্ণনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ড. মনমোহন সিংয়ের এই ঘোষণা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আরও ইতিবাচক গতি দেবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, ভারতের মনোভাব যদি সত্যি বদলায় তাহলে তো ভালো সংবাদ। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরীর মন্তব্য হচ্ছে, খালেদা জিয়ার ভারত সফর দু’দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার মজবুতি ঘটাবে। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ভারত সম্পর্কে বলা হয় যে তাদের সম্পর্ক আওয়ামী লীগের সঙ্গে উষ্ণ, বিএনপির সঙ্গে ঠাণ্ডা। এটা উভয় দেশের জন্যই ভালো নয়। তবে এবার ভারত প্রকাশ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের যে ঘোষণা দিয়েছে, তাকে ইতিবাচকই বলতে হবে। নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভারত দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করেছে। এতকাল তারা একটি দলের সঙ্গেই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করত। এবার জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব দলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলছে। এটা দু’দেশের সম্পর্কে নতুন মোড় সৃষ্টি করবে। একই কথা বলেন অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সফরকে ভারতের তরফে যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে ভারত কেবল আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দেয়া থেকে সরে এসেছে। ভারত শুধু এখন একটি বিশেষ দলের সঙ্গে সম্পর্ক চায় না, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী।
শুধু বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাই নয়, ভারতীয় পত্র-পত্রিকাও ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেছে ভারতের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিকে। আনন্দবাজার পত্রিকার মন্তব্য হচ্ছে—বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির আবেগ-তাড়িত নয়। খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির যে বিরোধই থাক না কেন, নিরপেক্ষ বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে দুই দলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে চায় তারা। টাইমস অব ইন্ডিয়ার বিশ্লেষণ হচ্ছে—নয়াদিল্লির জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির প্রচেষ্টারই অংশ খালেদা জিয়ার সঙ্গে এই আলোচনা। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও জোরদার হতে চলেছে, দিনে দিনে এখন বোঝাপড়াও মজবুত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের কোনো একটি রাজনৈতিক পক্ষের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে চাইবে না ভারত। তারা এটাও বোঝে যে, ঢাকার ক্ষমতায় কে থাকবে তা তারা ঠিক করে দিতে পারে না। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, সম্পর্ক উন্নতির এই অগ্রগতি বজায় রাখতে চায় নয়াদিল্লি।
ভারতবিরোধিতা প্রসঙ্গ
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এই সমস্যাগুলোর কারণে বাংলাদেশ কষ্ট ভোগ করছে। এর মধ্যে রয়েছে—ফারাক্কা সমস্যা, ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড, ছিটমহল বিরোধ, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ, তিস্তা চুক্তি, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, বাণিজ্য বৈষম্য, ট্রানজিট ইস্যু প্রভৃতি। এসব সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ তুলে ধরার ক্ষেত্রে বরাবরই সোচ্চার থেকেছে বিএনপি এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। রাজনীতিতে আসার পর থেকেই জনসভাগুলোতে এবং বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের স্বার্থকে তুলে ধরেছেন। এমনকি জাতিসংঘেও তিনি ফারাক্কা ইস্যুটি তুলে গঙ্গাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করেছেন।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কারণে আওয়ামী লীগ বরাবরই এসব বিষয়ে চুপ থেকেছে। আবার বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মনের কথা বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার বক্তব্যে উঠে আসাকেও তারা ভালো চোখে দেখেনি। তাই আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতারা বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যকে ভারতবিরোধী প্রচারণা হিসেবে অভিহিত করে। একই সঙ্গে তারা ‘খালেদা জিয়া ভারতবিরোধী’—এই প্রচারণাও চালিয়েছে। তাদের প্রচারণায় ভারতীয় পত্র-পত্রিকা এবং সে দেশের নীতিনির্ধারক মহলেও একটি ধারণার সৃষ্টি হয় যে, খালেদা জিয়া ভারতবিরোধী। যদিও খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং বন্ধুত্বকে তিনি এবং তার দল বিএনপি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এবার ভারত সফরে গিয়েও তিনি বিষয়গুলো খোলাসা করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় যেসব বিষয়, তা তিনি তুলে ধরে গ্রহণযোগ্য সমাধানের আশ্বাস চান ভারতের কাছে। একইভাবে ভারতের পক্ষ থেকেও তাদের উদ্বেগের বিষয় নিরাপত্তা ইস্যুটি তুলে ধরা হয়। খালেদা জিয়া বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন সীমান্তের উভয় দিকেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকে উভয় রাষ্ট্র আমলে নিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে কোনো পক্ষই পরস্পরের স্বার্থের বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী কোনো কার্যকলাপকে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না। খালেদা জিয়ার এই ঘোষণায় ভারতীয় মহলে উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। সে দেশের কূটনীতিকরাও এ বক্তব্য ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জী বিবিসিকে বলেন, খালেদা জিয়ার এই প্রতিশ্রুতি ইতিবাচক। আমরা আশা করি, তিনি তার জনগণের কাছেও এটা বলবেন। ভারতের মিডিয়ার মন্তব্য হচ্ছে—খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপির ভারতবিরোধী একটি ইমেজ রয়েছে। কিন্তু এবার তার ভারত সফরে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাতে তার সেই ইমেজ ভেঙে বৃহত্ প্রতিবেশীর আস্থাভাজনই হয়েছেন।
ভালো চোখে দেখেনি আওয়ামী লীগ
খালেদা জিয়ার সফরটি বাংলাদেশ ও ভারতে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, এই সফর গুরুত্বহীন। তিনি খালেদা জিয়ার আলোচিত বক্তব্যটি নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও করেন। তার এ বক্তব্যকে অনেকেই বলেছেন বিদ্বেষপূর্ণ। তার এ বক্তব্যের পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, খালেদা জিয়ার ভারত সফরকে আওয়ামী লীগ ভালো চোখে দেখেনি। বিশেষ করে ‘আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল ক্ষমতায় আসছে’ এমন মন্তব্য ভারতীয় মিডিয়া গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছে। ভারতের আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া, টেলিগ্রাফসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সরাসরি এ মন্তব্য করা হয়। একই সঙ্গে ভারতীয় মিডিয়ায় মন্তব্য ছিল—বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার নানা কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে আওয়ামী লীগ অনেকটা বিমর্ষ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
abdal62@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads