শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১২

কী ঘটতে যাচ্ছে রাজনীতিতে



মাসুমুর রহমান খলিলী
বাংলাদেশে রাজনীতির গন্তব্য নিয়ে সংশয় যেন বেড়েই চলেছে। সরকারের মেয়াদ পুরোপুরি শেষ হতে আরো বছরখানেক সময় সামনে আছে। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এমন সব মেরুকরণের ঘটনাপরম্পরার আভাস এখন পাওয়া যাচ্ছে, যাতে ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতা অর্জনের লড়াইয়ে রক্তক্ষয়ী উত্তেজনার শঙ্কা বেড়েই চলেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে কি না, হলে সে নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেবে কি না আর বিরোধী দল অংশ না নিলে নির্বাচন আদৌ করা সম্ভব কি না, হলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে কি নাÑ এ ধরনের নানা প্রশ্ন নিয়ে সরগরম আলোচনা চলছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিরোধীদলীয় নেতার ভারত ও চীন সফরের নানামুখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মেরুকরণ।
রাজনৈতিক ময়দানে এখন সরকার ও বিরোধী দলÑ এ দু’টি প্রধান পক্ষ। সরকারপক্ষে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির ভূমিকা ও স্বার্থ একই সমান্তরালে এখন আর বইতে দেখা যাচ্ছে না। মহাজোটের আরেক শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির মুখেও ভিন্ন সুর বেজে ওঠে মাঝে মধ্যে। অন্য দিকে বিরোধী পক্ষের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের স্বার্থ ও কর্মসূচি সব সময় একই সমান্তরালে বইছে এমনটিও নয়। দুই প্রবীণ নেতা ড. কামাল হোসেন ও ডা: বি চৌধুরীর ঐক্যের ডাকে অনেকে ভিন্ন রকম তাৎপর্য দেখছেন। সুশীলসমাজের কিছু তৎপরতাও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে। যাতে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন কেউ কেউ।
রাজনীতির এসব পক্ষ-প্রতিপক্ষ আগামী এক বছরে কী অর্জন করতে চাচ্ছে তা নিয়ে নানা জল্পনা রয়েছে। সরকারপক্ষের সামনে তিনটি বিকল্পের কথা দলের হাইকমান্ড সূত্র থেকে জানা যায়। এসব বিকল্পের একটি না হলে দ্বিতীয়টি আর সেটিও না হলে তৃতীয় বিকল্প রূপায়ণের চেষ্টা হতে পারে।
তিন বিকল্পের প্রথমটি হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়বেন না। তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারে বিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। বিরোধী দল সরকারে যোগ দিলে দুই পক্ষের সম্মতি ছাড়া মৌলিক কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো হবে। এ ব্যবস্থায় প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসে বড় রকমের কোনো হেরফের হবে না। ১৮ দল ঐক্যবদ্ধভাবে যাতে নির্বাচন করতে না পারে, তার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হবে গোপনে। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের সম্মত হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্তদের ট্রাইব্যুনালে শাস্তি দেয়া হবে। অভিযুক্তদের মধ্যে তিন থেকে চারজনের ব্যাপারে শাস্তি নিশ্চিত করা হবেÑ যার মধ্যে কয়েকজনকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হতে পারে। মে-জুনের মধ্যে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। বিএনপির কিছু নেতার সাথে সমঝোতা করে তাদের নির্বাচনে আনার চেষ্টা করা হবে। জামায়াতকেও নির্বাচনে আনার প্রচেষ্টা চালানো হবে। এ ক্ষেত্রে দরকষাকষির হাতিয়ার হতে পারে নেতাদের শাস্তি লঘু বা মওকুফ করার প্রস্তাব। এরশাদের নেতৃত্বে একটি ফ্রন্ট গঠন করে তাদের নির্বাচনে আনা হবে। পরিস্থিতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে মনে করলে দুই মাসের জন্য ক্ষমতা ছেড়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সম্মত হবেন শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে এ কথা বলার সুযোগ থাকবে যে বিরোধী দলের দাবি সরকার মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিকল্পে বিরোধী দলের আন্দোলন জোরালো আকার নেয়ার ঝুঁকি থাকায় রাখা হয়েছে তৃতীয় বিকল্প।
এই তৃতীয় বিকল্পটি সামনে আনা হবে প্রথম দুই বিকল্প ব্যর্থ হলে। এ বিকল্প অনুসারে বিরোধী দলের আন্দোলন চলাকালে কিছু নাশকতার ঘটনা ঘটানো হবে। এর দায় বিরোধী পক্ষের ওপর চাপিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হবে। এ ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট করে অথবা সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠিয়ে সরকারের মেয়াদকে নির্বাচন ছাড়াই দুই বছর বাড়িয়ে নেয়া হবে। আদালতের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব না হলে সংবিধানে সংশোধনী এনে এ ব্যবস্থা করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। জরুরি অবস্থাকালে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে দেয়া হবে না।
সংবিধানের নবম ক ভাগে জরুরি বিধানাবলি জারির কথা বলা হয়েছে। ১৪১(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে এমন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে, যাহাতে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা উহার যে কোন অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহা হইলে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিতে পারিবেন।’ এ জন্য অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর প্রয়োজন হবে। সংবিধানের ৭৫(৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের যুদ্ধে লিপ্ত থাকিবারকালে সংসদের আইন দ্বারা অনুরূপ মেয়াদ এককালে এক বৎসর বর্ধিত করা যাইবে, তবে যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে বর্ধিত মেয়াদ কোনক্রমে ৬ মাসের অধিক হইবে না।’
অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সৃষ্টি হলে জরুরি অবস্থা জারির কথা সরাসরি সংবিধানে রয়েছে। কিন্তু সংসদের মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখ আছে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার বিষয়টি নিয়ে। জরুরি অবস্থা জারির শর্তটি সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যাবে কি না, সেটিই রেফারেন্স হিসেবে পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে। প্রয়োজনবোধে সংবিধান সংশোধন করে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কথা বিবেচনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি এক বছরের পরিবর্তে দুই বছর করার বিষয়টিও সামনে রাখা হয়েছে।
সরকারপক্ষের তিন বিকল্পকে সামনে রেখে নানা তৎপরতা ইতোমধ্যে শুরু করা হয়েছে। মামলা, গ্রেফতার, দণ্ড দান, দণ্ড মওকুফÑ এসব বিষয়কে রাজনৈতিক সমঝোতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কৌশল নেয়া হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা ও তার পরিবারের সদস্য এবং যুদ্ধাপরাধ ও অন্যান্য মামলায় জামায়াত নেতাদের শাস্তিদানের বিষয়কে চাপ সৃষ্টির জন্য কৌশল হিসেবে নেয়া হয়েছে। এ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর শীর্ষ পদে পরিবর্তন আনার বিষয়টিও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিরোধী দল বিএনপির সামনে প্রধানত দু’টি বিকল্প রয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর শর্তে গ্রহণযোগ্য যেকোনো অবয়বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ ধরনের নির্বাচনে জনমতের কারণে বিএনপি ও সহযোগী দলগুলোর জয় হবে বলে বিএনপি নেতৃত্ব মনে করে। এ ধরনের একটি নির্বাচনে কূটনৈতিক অংশীদারদের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, চীন ও ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ও তা আরো জোরদার গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন নেতৃবৃন্দ। বিরোধী দলের নেতার সৌদি আরব, চীন ও ভারত সফরের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। কূটনৈতিক অংশীদারদের স্বার্থের মধ্যে কোনো সাংঘর্ষিক ইস্যু থাকলে সেসব ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী অবস্থান নেয়ার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে ১৮ দলের সহযোগী কোনো দলের বিদায়কে স্বাগত জানানোর প্রয়োজন হলে সেটিও করা উচিত বলে হাইকমান্ডের একটি বড় অংশ মনে করেন।
বিরোধী দলের সামনে দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা; কোনোভাবেই সম্ভব না হলে সরকারের পতন ঘটানোর জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন করা। এ ক্ষেত্রে ১৮ দলকে সংহত করার পাশাপাশি আরো কিছু দলকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হবে। এ ধরনের আন্দোলনে তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাচন আয়োজনের মতো পরিস্থিতি যেমন না থাকার ঝুঁকি রয়েছে তেমনিভাবে তৃতীয় কোনো একটি পক্ষ ক্ষমতায় চলে আসার সম্ভাবনাও থাকতে পারে। এ সম্ভাবনা সত্ত্বে¡ও দল বাঁচানোর জন্য অনাকাক্সিত বিকল্প হিসেবে এটাকে গ্রহণ করে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আয়োজনের জন্য আন্দোলন চালানো যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এক-এগারোর পর দুই প্রধান দলকে সাইডলাইনে সরিয়ে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টির যে প্রচেষ্টা ছিল, সে ধরনের একটি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে একটি পক্ষ কাজ করছে। এ পক্ষটি সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই প্রান্তিক অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। তারা চায় যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্তদের যেন চূড়ান্ত শাস্তি দেয়া হয়, যাতে বিুব্ধ জামায়াত ও শিবির সর্বোচ্চপর্যায়ের আন্দোলন করে এবং দেশে সহিংস পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তারা বেগম জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলার নিষ্পত্তি ও শাস্তি প্রদানেও নানাভাবে উৎসাহিত করছে, যাতে দুই দল পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংসভাবে মুখোমুখি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সৃষ্ট জটিলতার নিষ্পত্তি না করে অচলাবস্থা বাড়াতে চায় এ পক্ষ।
বাংলাদেশের রাজনীতির এ তিন পক্ষের মধ্যে কোন পক্ষ জয়ী হবে, সেটি স্পষ্ট হতে শুরু করবে মাস দুয়েকের মধ্যে। শক্তি পরীক্ষায় মাঠে থাকবে মূলত প্রথম দুই পক্ষ। তাদের লড়াই যত জোরদার হবে, অচলাবস্থা যত বাড়বে, এক পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে অপর পক্ষ ক্ষমতায় স্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন যত জোরদারভাবে দেখবেÑ তৃতীয় পক্ষের উঠে আসার সম্ভাবনা ততই উজ্জ্বল হবে। এই উত্থানে তৃতীয় পক্ষের কোনো ত্যাগ বা শক্তিক্ষয় নেই। আছে শুধু অন্যের ভুলভ্রান্তি থেকে সুবিধা আদায়ের নিজস্ব কৌশলের জয়।
mrkmmb@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads