বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

কবে আসবে সেই নেতৃত্ব?


সোনালী ব্যাংক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরই এর স্থান। সেই ব্যাংক থেকে হলমার্ক নামে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। এত টাকার ঋণ দেয়ার রহস্য কোথায়? পত্রপত্রিকায় এ ব্যাপারে লেখালেখি হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়ার একটি সিস্টেম আছে। যেকোনো লোক বা প্রতিষ্ঠান ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন। ঋণের আবেদনপত্র নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করা হয়। তারা আবেদনপত্রগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। পর্যাপ্ত অতিরিক্ত জামানত না থাকলে সেই আবেদনপত্র বাতিল বলে গণ্য করা হয়। এর পরও  বাস্তব যাচাই বাছাইয়ে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হলে ঋণ দেয়া হয়। হলমার্ককে অতিরিক্ত জামানত নিরাপত্তা ছাড়াই কি ঋণ দেয়া হয়েছে? এসবই তদন্তসাপেক্ষ। এই ঋণ দেয়ার ব্যাপারে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। এ ধরনের ঋণ একমাত্র রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ  ছাড়া দেয়া যায় না। তবু হলমার্কের মতো একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। এত টাকার ঋণ হলমার্কের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয় জেনেও পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এই ঋণ দেয়ার রহস্য কোথায়? ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এমন একটা গর্হিত কাজ কেন করতে যাবে? অনিয়মিত ঋণ দেয়া হলে, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা কেউ রেহাই পাবেন না। তাদের চাকরি যাবে, অন্য ধরনের শাস্তিও হতে পারে। আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা হানিফ বলেছেন, পরিচালনা পর্ষদের কোনো দোষ নেই। তা হলে নিশ্চয়ই কে দোষ করেছেন, তা হানিফ সাহেব জানেন। তবে কেন তিনি তা প্রকাশ করছেন না।
অনেকেই বলেন, হলমার্কের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা ঠুকে দিতে। হলমার্কের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলাও করতে হবে। যার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড, প্রয়োজনবোধে এসব ক্রিমিনালের বিরুদ্ধে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে, তাতে ফাঁসির আদেশের বিধান রাখতে হবে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সবার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিযুক্ত পরিচালকদের রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে। এতে আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশকে যদি অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে সরকারকে কঠোর হতেই হবে।
অতীতে শুধু পাট রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পাট শিল্প ধ্বংস হয়েছে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর। তারপর ধীরে ধীরে গার্মেন্ট শিল্প গড়ে ওঠে। এই শিল্পে লাখ লাখ মেয়ের চাকরির সংস্থান হয়েছেÑ আর এই গার্মেন্ট বিদেশে রফতানি করে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হয়েছে। দেশের প্রায় এক কোটি তরুণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রম দিয়ে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে পাঠাচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ আজ অনেকটা সচ্ছল। কিন্তু এর বেশির ভাগ অর্থ দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় হচ্ছে না। যাচ্ছে দুর্নীতিবাজদের পকেটে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যা দেখেছি, তা মনে হলে শরীর হিম হয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে ফিরলেন। তারপর ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিলেন।
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়ার মাত্র তিন দিন পর (১৪ জানুয়ারি) সমগ্র দেশে শুরু হলো লুটের তাণ্ডব। চোখের সামনে দেখেছি ইসলামপুর রোডে অবাঙালিদের কাপড়ের দোকান, নবাবপুরে হার্ডওয়্যারের দোকান, বায়তুল মোকাররম ও স্টেডিয়ামের বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান লুট হতে। সেদিন এই লুট বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ সরকারের ছিল না। এই লুটের তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুরে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট হয়েছে। এসবই ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রাপ্য। এরপর সেই অবাঙালিদের পরিত্যক্ত দোকানপাট বিলিবণ্টনের জন্য সংসদ সদস্যদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই সব দোকানপাট কমিটির সদস্য আর শেখ ফজলুল হক মনির অনুগত মুজিব বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা হয়।
কোনো নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ওই সব দোকানপাট পাননি। এখানেও সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হতো। তখন দেশের সর্বত্র চলছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অবাধ লুটতরাজ। এই সময় কয়েকটি থানাও লুট হয়। নরসিংদী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ফজলুর রহমানও এ সময় খুন হন। তখন এসব বন্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু রক্ষীবাহিনী নামিয়ে দেন। এ সময় রক্ষীবাহিনীকে দিয়ে প্রশাসন বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মীকে খুন করিয়েছে।
দেশের তখন চরম দুরবস্থা। সংসদ সদস্যরা পুলিশ প্রোটেকশন ছাড়া তাদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে ভয় পেতেন। তখন সংসদ সদস্যদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু আর্মি নামিয়ে দেন। কয়েক দিনের মধ্যে সারা দেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে আসে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে বলেন, ‘আপনি আর্মি নামিয়েছেন কেন? জানেন না, এরা সবাই আমাদের শত্রু। আমাদের কোনো ভালো এরা দেখতে পারে না। শিগগির আর্মি তুলে দেন। নইলে আমরা শেষ হয়ে যাবো।’ বঙ্গবন্ধু আত্মীয় পরিজনের চাপে আর্মি তুলে নিলেন। এ ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের কোনো পরামর্শ তিনি নেননি। আর্মি তুলে নেয়ার পর দেশ আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে এলো। সন্ত্রাস, ছিনতাই, লুটপাট আবার সমানে চলতে লাগল।
এরপর দেশের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর দুঃখজনক মৃত্যুর পর খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতায় এলেন। তিনি মাত্র ৮৭ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর হঠাৎ আর্মির চিফ অব স্টাফ খালেদ মোশাররফ ক্যু করে ক্ষমতায় এলেন। তিনি মোশতাককে অপসারণ করলেন। ঘটনার ছয় দিনের মাথায় সিপাহি জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ক্যান্টনমেন্ট দখল করে খালেদ মোশাররফসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র আর্মি অফিসারকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসানো হয়। জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনী এনে বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) বাতিল করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। জিয়া বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। তিনি সারা দেশে সাধারণ নির্বাচন দিলেন। তিনি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করলেন। কিন্তু আর্মির অনেক অফিসার জিয়ার সিভিল প্রশাসনের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। জিয়া স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দেশে আমি গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি। একে নসাৎ হতে দেবো না। কিন্তু এতে সামরিক বাহিনীর অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তারা মনে করেছেন সিভিলিয়ানরা সবাই দুর্নীতিপরায়ণ। তারা জিয়াকে সামরিক শাসন জারি করার পরামর্শ দেন। জিয়া বলেছেন, দেশে আমি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিয়াকে প্রাণ দিতে হলো। এরপর বিচারপতি সাত্তার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এলেন। মাত্র কয়েক মাস তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। এ সময় জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করলেন। তিনি ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করে চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তার ওষুধনীতি প্রশংসিত হয়েছে। রাস্তাঘাট ও অন্যান্য সংস্কারমূলক কাজ তার আমলে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ নীতিতে সারা দেশের আইনজীবীরা আন্দোলনে নামেন। শেষ পর্যন্ত ছাত্রসমাজ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। তা ছাড়া ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির জন্য জনগণ তাকে বর্জন করে। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেন। দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। খালেদা জিয়ার বিএনপি ক্ষমতায় এলো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধী দল খালেদা জিয়ার সরকারের পতন ঘটাতে লাগাতার হরতাল শুরু করে। এরপর সংসদ বর্জন চলে। দেশে একটা চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া পাঁচ বছর ক্ষমতায় রয়ে গেলেন। বিতর্কিত এক নির্বাচনের পর সংবিধান সংশোধন করে বিধান করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনে খালেদা জিয়া। নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো। তখন থেকেই তিনি তার নিকট-আত্মীয়দের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেন। সবখানে শেখ মুজিবকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নাম পরিবর্তনের জোয়ার শুরু হয়ে যায়। ২০০২ সালের নির্বাচনে আবার খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেন। আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হলো। কিন্তু তিনি তার পরিবারকে রাজনীতিতে নিয়ে এলেন। জিয়াউর রহমান কখনো আত্মীয়-পরিজনকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করেননি। কিন্তু খালেদা জিয়া তার ছেলে তারেক রহমানকে দলের নেতৃত্বে নিয়ে এলেন। শেখ ফজলুল হক মনির মতো প্রশাসনের সর্বত্র তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হলো। দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লেন তারেক রহমান। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ভরাডুবি হলো। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই দাপটের সাথে দেশ শাসন করতে লাগলেন। ১৯৯৬ সালে এই আওয়ামী লীগের আমলে শেয়ারবাজার ধস নামে। এবারো সেই শেয়ারবাজারের পতন লক্ষণীয়। লাখ লাখ যুবক পথে বসে পড়লেন। শেখ মুজিবকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নামই শুধু পরিবর্তন করেননি, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রিত দুই টাকা থেকে আরম্ভ করে ১০০০ টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর তেলেসমাতি দেখেছি। হলমার্ককে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। পেছনে বড় কেউ না থাকলে এত বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া সম্ভব নয়। পরিবারতন্ত্র ও স্তাবকদের মিলিত প্রচেষ্টায় শেখ হাসিনা দেশে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাকশাল না থাকলেও বাকশালের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি শেখ হাসিনার কার্যকলাপে। টিভি সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা আজো হলো না। ইতোমধ্যে আট মাস চলে গেছে। যদিও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা হবে। সরকার সমর্থিত কিছু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির তথ্য সাগর-রুনির কাছে ছিল, সেসব তথ্য নির্মূল করতেই নাকি সাগর-রুনিকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ইলিয়াস আলী গুম হলেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ।
দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলো কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। লাশেরও কোনো হদিস মেলেনি আজো। এমনি গুম, হত্যার ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। আমার মনে হয় দুই দলের চরিত্র প্রায় একই রকম। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? তৃতীয় শক্তির ওপর আমাদের ভরসা নেই।  নিবেদিত নেতৃত্ব  ছাড়া দেশকে বাঁচানো যাবে না। কবে আসবে সেই নেতৃত্ব?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads