মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

গৌরবময় নভেম্বর বিপ্লব ১৯৭৫



ড. আবদুল লতিফ মাসুম
বিপ্লব মানে ব্যাপক পরিবর্তন। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামগ্রিক কাঠামোগত এবং ক্ষমতার আমূল রদবদলকে আমরা বিপ্লব বলে অভিহিত করতে পারি। শব্দটির সরল অর্থ হলো সম্পূর্ণ ঘুরে যাওয়া। একটি চাকা যেমন ঘোরে। বিপ্লব শব্দটির মার্ক্সীয় ব্যাখ্যা অবশ্য অন্যরকম। তবে বিপ্লবের ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন মানবেন্দ্র নাথ রায়। অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করাই বিপ্লবের একমাত্র লক্ষ্য নয়। সামাজিক সৃজনশীলতা এবং রাজনৈতিক মুক্তিও রায়ের মতে বিপ্লব। পশ্চিমা জগতে বিপ্লবের বুর্জোয়া ব্যাখ্যাও রয়েছে। সেখানে বিপ্লব মানে জনগণের ক্ষমতার নবতর বিন্যাস। গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানও বিপ্লব। বিপ্লব সভ্যতার অগ্রগতির ধারক। এভাবে মার্ির্কন স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬), ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯), রুশ বিপ্লব (১৯০৫/১৯১৭) এবং ইরানের ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯)—এসব বিপ্লবের মাধ্যমে অসম্ভব সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়। ব্রিটেনে যে বিপ্লব গৌরব বয়ে এনেছিল, আমাদের এই বাংলাদেশেও এমন একটি বিপ্লব আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সেটি ছিল ১৯৭৫ সালের সংঘটিত সিপাহী-জনগণের ঐক্যবব্ধ বিপ্লব।
একটি অভাবনীয় ঘটনা
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বিপ্লব ছিল সমসাময়িক পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। এটি ছিল অভাবনীয়, অভূতপূর্ব এবং নিপাতনে সিদ্ধ। ÔEntirely a new story, a story never known or told beforeÕ (এমাজউদ্দীন আহমদ : ১৯৯৮:৮০) উপমহাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ১৮৫৭ সালে। ইংরেজরা এটিকে অভিহিত করেছিল সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে। আসলে তা ছিল আমাদের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। ওই যুদ্ধ, ওই বিপ্লব ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার জন্য। আর ১৯৭৫-এর বিপ্লব ছিল অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। সৈনিকরা ৭ নভেম্বর-’৭৫ নির্দেশের পদসোপানকে অগ্রাহ্য করে, শৃঙ্খলার ব্যারিকেড ভঙ্গ করে, জীবন বাজি রেখে বিপ্লবকে যেভাবে সফল করেছিল স্বাভাবিক সময়ে, স্বাভাবিক নিয়মে তা কল্পনাও করা যায় না। একটি পেশাগত সেনাবাহিনীর জন্য এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে-এর টার্ম অনুযায়ী প্রথাগত বা গতানুগতিক অভ্যুত্থান নয়। এটি কোনো প্রতিবিপ্লব নয়। এটি ছিল সংক্ষিপ্ত অথচ লক্ষ্যে সফল। বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যাবলী : সংগঠন, আন্দোলন, আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নেতৃত্ব এবং ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ অনুযায়ী নিঃসন্দেহে এটি বিপ্লবের পরিপূরক। এটি শুধু ক্ষমতার কাঠামোকেই পরিবর্তন করেনি বরং রাজনৈতিক সমাজে লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয়। সত্যিকার অর্থেই এটি ছিল একটি বিপ্লব (এমাজউদ্দীন আহমদ, পূর্বোক্ত)। বিপ্লবের প্রতি সাধারণ মানুষের সতত স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন প্রকাশিত হয় : ‘মিছিলের স্রোত আর উল্লাস’-এর মাধ্যমে (সম্পাদকীয় মন্ত্মব্য,দৈনিক ইত্তেফাক,৮ নভেম্বন ১৯৭৫) যে বিপ্লবকে প্রত্যক্ষ করেছে ব্যক্তিগতভাবে এ অনুভব যে কোনো সাধারণ নাগরিকের হতে বাধ্য। গোটা ঢাকা শহর চষে বেড়ানোর পর আমার ব্যক্তিগত মন্তব্য : আমি মানুষকে কোনো ঈদেও এত খুশি হতে দেখিনি। দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির জন্য প্রতিটি সৈনিকের, প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের আনুগত্য উজ্জ্বল ৭ নভেম্বর আমাদের রাজনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে একটি অনিবার্য মাইলফলক।
৭ নভেম্বর ’৭৫ : ইতিহাসের উত্সমূল
শহীদ জিয়াউর রহমান তাঁর একটি মৌলিক নিবন্ধ : ‘একটি জাতির জন্ম’-এ বাংলাদেশ জাতিসত্তার উত্সমূল সন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন। সেখানে তিনি আমাদের ভৌগোলিকতা, ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমন্বিত করেছেন। ওই নিবন্ধের মূল বক্তব্য এ রকম : আমাদের কোন পরিচয়কে অস্বীকার করতে পারি? ভৌগোলিকতা, ভাষা, ধর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুই পৃথক পৃথকভাবে এবং সমন্বিতভাবে আমাদের জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করেছে। লিফসুজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অসমাপ্ত বিপ্লব বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের ক্ষমতাসীনরা ভাষা ব্যতিরেকে আমাদের ধর্ম, আমাদের নৃতত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন। অধিকতর ভারতনির্ভরতা সমাজের অন্তরালে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ফের চাঙ্গা করেছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস-অনুভূতি নিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট সৃৃৃষ্টি হয়। আবহমান লালিত জীবনবোধ ও চেতনা অনুধাবনে শাসককুল ব্যর্থ হয়। মুসলিম পরিচয়বাহী ইসলাম নামধারী সবকিছু এমনকি প্রচারমাধ্যমে কোরআন তেলাওয়াত, মুসলিম সম্বোধন নিষিদ্ধ হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেশের সত্যিকার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকে ৭ নভেম্বর ’৭৫ পর্যন্ত যদি রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে জনচিত্তের ওই ধারাটি বোঝা কষ্টকর হবে না। বিশেষ করে ৩ নভেম্বর ’৭৫ প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী এবং ভারতপন্থী মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলরা ক্ষমতা দখল করলে সেনা অভ্যন্তরে ক্ষোভ এবং জনসাধারণ্যে চিত্তচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ৭ নভেম্বর ’৭৫ সৈনিক-জনতার ঐক্য সূচিত হয়।
মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনী
৭ নভেম্বরের ইতিহাসের উত্সমূল বা আদর্শিক ভিত্তি নির্ণয়ের পর ফিরে তাকাতে হয় বাস্তব ঘটনাবলীর দিকে। প্রকৃত ঘটনা অনুধাবনের জন্য ’৭৫-এর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলোতে। ইতিহাসের গহীন গভীরে যেমন আদর্শিক চেতনা অন্তর্নিহিত, তেমনি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের চেতনা নিহিত। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মিয়ানমার বা ইন্দোনেশিয়ার মতো একটি স্বাধীনতা সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়। সেনাবাহিনীর রাজনীতিকীকরণ এতটা মাত্রায় ঘটে যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১১টি সেক্টরের ১৬ জন সেক্টর কমান্ডারের কেউই স্বাভাবিক চাকরিকাল শেষ করতে পারেননি। সৈনিক থেকে অফিসার সবাই রাজনীতির প্রতি গভীর সংশ্লিষ্টতা অনুভব করেন। বেসামরিক সরকার তাদের রক্তে অর্জিত স্বদেশকে যখন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দুর্ভিক্ষ এবং স্বেচ্ছাচারের দিকে ঠেলে দেয়, খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা বিচলিত, ক্ষুব্ধ এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ ধরনের একটি প্রেক্ষাপটেই নভেম্বর বিপ্লব ঘটে।
৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব ছিল ৩ নভেম্বর ’৭৫-এর পাল্টা অভ্যুত্থানের সরাসরি প্রতিক্রিয়া। ১৫ আগস্ট সেনা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে সিনিয়র বনাম জুনিয়রের যে সংঘাত শুরু হয়, সিপাহী-জনতার গণবিপ্লবের মাধ্যমে তার অবসান ঘটে।
জিয়াকেন্দ্রিক ঘটনা পরম্পরা
৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলী গোটা জাতিকে উদ্বেগাকুল করে তোলে। সৈনিকরা যখন লক্ষ্য করে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির পুনরাবির্ভাব হচ্ছে, ভারতীয় বেতার ও কর্তৃত্ব সক্রিয় হয়ে উঠেছে তখন আবারও তারা গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হওয়ার ভয়ে উত্কণ্ঠিত হয়ে ওঠে। তারা আরও লক্ষ্য করে সিনিয়র-জুনিয়রের দ্বন্দ্ব তাদের জীবনকে শঙ্কাকুল করে তুলেছে, ভাইয়ে-ভাইয়ে সংঘর্ষ অত্যাসন্ন। তখন তারা তাদের কর্তব্য নির্ধারণের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। অফিসারদের ওপর আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। জিয়ার বন্দিত্ব সাধারণ সৈনিকদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। স্বাধীনতা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা এবং ন্যায়ানুগ ভূমিকার জন্য সব কোর, সব সেক্টর এবং সব সেনা ছাউনিতে জিয়ার ইমেজ ছিল অনেক উঁচুতে। সাধারণ সৈনিকরা তাঁকে কেন্দ্র করেই সব কার্যক্রমের চিন্তা করে। আমাকে ব্যক্তিগত সাক্ষাত্কারে এরকম সৈনিকরা নেতৃত্বের সঙ্কটের কথা জানায়। সৈনিকরা যখন এ ধরনের দিকশূন্যতায় ভুগছিল তখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সেনাবাহিনী উইং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা (বিসৈস) সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাপ্রধান ছিলেন কর্নেল (অব.) তাহের। বিসৈসের উপপ্রধান ছিলেন হাসানুল হক ইনু। কর্নেল তাহের অসুস্থ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। তাঁকে লোকাল ট্রেনে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে ঢাকা আনা হয়। বিসৈসের জওয়ানরা ঢাকায় কর্নেল তাহেরের সঙ্গে অসংখ্যবার বৈঠক করে। এসব সভায় জিয়ার সমর্থক অসংখ্য সৈনিকও অংশগ্রহণ করে। বৈঠক শেষে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গৃহীত হয়। প্রথমত, একটি ভবিষ্যত্ রাজনৈতিক কর্মসূচি গৃহীত হয়। দ্বিতীয়ত, বিপ্লবের দিনক্ষণ ধার্য করা হয় (পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের জন্য দেখুন আবদুল লতিফ মাসুম, আচ্ছাদিত ইতিহাস, পূর্বোক্ত)। রাজনৈতিক পরিকল্পনার মধ্যে ছিল জাতীয় কমান্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা, প্রাতিষ্ঠানিক সেনাবাহিনীর পরিবর্তে গণসেনাবাহিনী গঠন এবং অবশেষে একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠন। বিপ্লবের পূর্বে এবং পরে ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মীবাহিনীতে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সাবেক সৈনিক সংস্থাপ্রধান সুবেদার (অব.) শামসুল আলম সিদ্দিকী, বীর প্রতীক আমাকে জানান, বিসৈস তাদের মূল লক্ষ্যকে উহ্য রেখে জিয়াকে মুক্ত করার লক্ষ্যেই সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, এমন হাবভাব দেখান। জিয়াকে শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করতে না পারলে জিয়াকেও শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত তাদের ছিল।
তাহের কর্তৃক জিয়া হত্যার ষড়যন্ত্র
পরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার সারোয়ারের (অব.) নেতৃত্বে একদল বিসৈসের সৈনিক জিয়ার বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয়। জিয়াভক্ত সাধারণ সৈনিকরা তাকে মুক্ত করে কাঁধে তুলে আনন্দনৃত্য করতে করতে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। ফলে কর্নেল তাহেরের নির্দেশ মোতাবেক জিয়াকে শহরে অন্তরীণ করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। জিয়াকে নিয়ে আসতে না পারার জন্য কর্নেল তাহের বিসৈসের সৈনিকদের ভর্ত্সনা করেন। তারা আবার চেষ্টা নেয়। জিয়াকে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট থেকে কর্নেল তাহেরের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা চালায়। ব্যর্থ হয়ে কর্নেল তাহেরই সেখানে যান। কর্নেল তাহের এবং বিসৈস যখন বুঝতে পারে পরিস্থিতির ওপর জিয়ার সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের তথাকথিত বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে, তখন তারা বন্দুক ঘুুরিয়ে ধরে। ৭ নভেম্বর ’৭৫ রাত ৪টার দিকে জিয়াকে রেডিও ভাষণের নামে আর একবার গ্রেফতারের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। তাহেরপন্থীরা জিয়ার বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হতেই স্লোগান উত্থিত হয় : ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই অফিসারের রক্ত চাই, সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই সুবেদারের উপর অফিসার নাই, বেঈমান জিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হবে একসাথে।’ বিসৈস আপত্তিকর লিফলেটও বিতরণ করে। ৮ নভেম্বর সকালে বিশেষ বিসৈসের লোকেরা অরাজকতা সৃষ্টি করে। ১২ জন অফিসারকে হত্যা করে। এরা অফিসারদের র্যাংক কেড়ে নেয়, বিতাড়ন করে, লুটপাট চালায়। এসব কাজে বিসৈস বাইরের গণবাহিনীর লোকদের সেনানিবাসে নিয়ে আসে। তারা জিয়াপন্থী অফিসারদের হত্যার নির্দেশ দেয়। এসব দেখে বিসৈস একাংশ জিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। তাঁরা ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সারাদেশে সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এর আগেই কর্নেল তাহেরসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীকালে কর্নেল তাহের এবং তাঁর অনুগামীদের মুক্ত করার জন্য বিসৈস ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এভাবে শেষ হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঝঞ্ঝাবহুল অধ্যায়ের। প্রতিষ্ঠিত হয় জিয়াউর রহমানের সফল কর্তৃত্ব। অরাজক, বিশৃঙ্খল এবং রাজনীতিপ্রবণ সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন ছিল এ সময়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জিয়াউর রহমান অব্যাহতভাবে ব্যারাকে থেকে, অফিসারদের মনোবল ফিরিয়ে ্এনে এবং সৈনিকদের আস্থায় নিয়ে, সেনানিবাসে সম্পূর্ণ শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তাই মার্কাস ফ্রান্ডা যথার্থভাবেই মন্তব্য করেন : “It was Zia himself who saved the army from an impending doom” (Marcus Franda, Bangladesh : The First Decade, South Asian Publisher, New Dilhi, 1982 p. 258).
উপসংহার
বিপ্লব যদি হয় সর্বাত্মক পরিবর্তন তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ নভেম্বর ’৭৫ একটি বিপ্লবী ঘটনা। এ সময় দেশজ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়। বাংলাদেশ একটি পক্ষকূট থেকে অন্য সমীকরণে প্রবেশ করে। জাতীয় নীতিনির্ধারণ, পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ এবং উন্নয়ন কীেশল প্রণয়ন—প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। জাতি সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অধীনতা এবং শোষণ থেকে মুক্তি পায়। প্রশাসনে আস্থা এবং বিশ্বাস পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, অর্থনৈতিক নৈরাজ্য এবং সামাজিক অনাচার থেকে মানুষের সতত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে ৭ নভেম্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে। ৭ নভেম্বরের ফলশ্রুতিতে জিয়াউর রহমান তাঁর সব সৃজনশীলতা দিয়ে বাংলাদেশকে একটি উদ্যমী, উদ্যোগী এবং উন্নয়নকামী দেশে পরিণত করেছেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে শুধু জাতিসত্তার সঙ্কট থেকেই মুক্ত করেননি বরং জাতিকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রদান করেছেন। ৭ নভেম্বরের মাধ্যমে তিনি প্রজ্বলিত করেছেন দেশপ্রেমের ফল্গুধারা। তাই তিনিই বলতে পারেন ‘জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’। ৭ নভেম্বরে সৃষ্ট জাতীয় ঐক্যকে তিনি ধারণ করে সুদৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেন। আর এ সবকিছুই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। তাই উবহরং ডত্রমযঃ-এর বক্তব্যকে সারাংশ করে বলা যায় ‘Zia’s talent to quickly transform himself into an astute politician is clearly reflected by his discreet engineering of events that took him to the top of the political hierarchy’ (Denis Wright, The Rise of Zia From Soldier to politician in Habib Zafarullah (ed) The Zia Episode in Bangladesh Politics, UPL Dhaka 1996, p. 9).

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads