বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১২

দেশের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সরকার ভারতের স্বার্থই দেখছে



বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিকদের আপত্তি ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এবং জনগণকে অন্ধকারে রেখে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ট্রানজিট ও করিডোর দেয়ার ব্যাপারে জোর কদমেই এগিয়ে চলেছে।  গতকাল দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক রিপোর্টেও এ সংক্রান্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্য ত্রিপুরার পালাটানায় ভারত ৪৫ হাজার রূপি ব্যয়ে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে তার জন্য প্রয়োজনীয় ভারি যন্ত্রপাতির এক বিরাট চালান ওভারডাইমেনশনাল কার্গো বা ওডিসির মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর অনুমতি দিয়েছে সরকার। উল্লেখ্য, গত বছর ২০১১ সালেও ভারত একই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৯৩টি ভাগে যন্ত্রপাতি নিয়ে গেছে। ভারতের এসব যন্ত্রপাতি কলকাতা থেকে রায়মঙ্গল-মংলা-চাঁদপুর-আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ-করিমগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরা নেয়ার দীর্ঘ পথে বাংলাদেশের বহু সড়কই দেবে গিয়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল কয়েকটি ব্রিজ ও কালভার্টও। কারণ, যেসব যানবাহনে এই যন্ত্রপাতি নেয়া হয়েছিল ও হচ্ছে সেগুলো ৩০ থেকে ৪০ চাকা বিশিষ্ট। যন্ত্রপাতির ওজনও বহুটন। এজন্যই সে সময় তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবাদের প্রতি মনোযোগ দেয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সুবিধার জন্য গত বছর আশুগঞ্জ বন্দরকে পোর্ট অব কল ঘোষণা করেছে। এর পর থেকেই ভারতীয়রা এই বন্দর দিয়ে ভারি যন্ত্রপাতিসহ নানা ধরনের পণ্য আনা নেয়া করছে। এবার নিয়ে গেছে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির দ্বিতীয় চালান। উল্লেখ্য, পালাটানায় শুধু নয়, ত্রিপুরার মোনারচকেও ভারত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এর সব যন্ত্রপাতিও বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই নিয়ে যাবে দেশটি। ফলে বাংলাদেশের সড়কপথগুলো ভেঙে পড়বে। আপত্তি শুধু এই একটি কারণে ওঠেনি। প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, সরকারের ঘাড়ে পা দিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ করিডোর পাওয়ার জন্যও উঠেপড়ে লেগেছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সূত্রের বরাত দিয়ে এই খবরে জানা গেছে, অরুণাচল ও ত্রিপুরার আগরতলাসহ পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্য থেকে ভারত এই বিদ্যুৎ পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্য কয়েকটি রাজ্যে নিয়ে যেতে চায়। এজন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে দেশটির সঞ্চালন লাইন দরকার। টোপও ভারত মন্দ দেয়নি। বলেছে, করিডোরের বিনিময়ে বাংলাদেশকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়া হবে। অবশ্যই বিনামূল্যে নয়, ওই বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে কিনে নিতে হবে। দামও ভারতই নির্ধারণ করবে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং কার্যক্রম পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য হাইভোল্টেজ পাওয়ার ট্রান্সমিশন করিডোর নামে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। দু'দেশের যৌথ স্টিয়ারিং কমিটি এরই মধ্যে নয়াদিল্লীতে কয়েকটি বৈঠক করেছে। পরবর্তী বৈঠক ঢাকায় আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। ঢাকা বৈঠকের পরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতকে ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ করিডোর দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর এবং ঝুঁকিপূর্ণও। কারণ, এই বিদ্যুৎ নেয়া হবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। এজন্য ব্যবহারও করা হবে বাংলাদেশের সঞ্চালন লাইন তথা জাতীয় গ্রিডকেই। এখানে জাতীয় গ্রিডের বহন ক্ষমতা একটি প্রধান বিবেচ্য। কারণ, ভারত দু-চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নেবে না। খবরে জানা গেছে, শুধু অরুণাচল প্রদেশের একটি কেন্দ্র থেকেই ৪৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নেয়া হবে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অন্য রাজ্যগুলোতেও একের পর এক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করছে ভারত। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নেয়া শুরু হলে স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিমাণ দু'-আড়াই লাখ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। একযোগে বেড়ে চলবে মোট বিদ্যুতের পরিমাণও। এত বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ভার বাংলাদেশের বিদ্যমান জাতীয় গ্রিড বহন করতে পারবে না। তখন সঞ্চালন লাইনের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের ওপর বিশাল ব্যয়ের বোঝা চাপবে। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের পাহারা দেয়াসহ সামগ্রিক রক্ষণাবেক্ষণও বাংলাদেশকেই করতে হবে। দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় ঘটলে তার দায়দায়িত্বও বাংলাদেশের ওপরই বর্তাবে। অথচ চুক্তি হচ্ছে মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের। অন্যদিকে ভারতের লাভ হচ্ছে সবদিক থেকে। অরুণাচল কিংবা ত্রিপুরাসহ যে রাজ্য থেকেই নেয়া হোক না কেন কলকাতা পর্যন্ত দূরত্ব কমে যাবে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। পাহাড়-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে লাইন বসানোর ঝক্কিও ভারতকে পোহাতে হবে না। এত কিছুর পরও ‘বন্ধুরাষ্ট্র' কিন্তু বাংলাদেশকে সামান্য ছাড়ও দিচ্ছে না। ভারত যে পরিমাণ বিদ্যুৎ নিয়ে যাবে তার তুলনায় এক হাজার মেগাওয়াটকে ‘মাত্র' ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তারও দাম আবার ভারতের নির্ধারণ করে দেয়া দরেই দিতে হবে। এখানে বাংলাদেশের জন্য এমনকি দরকষাকষি করার সুযোগও রাখা হচ্ছে না।
সব মিলিয়েই ভারতকে বিদ্যুতের করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। এজন্যই আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করি, আগেও বিরোধিতা করেছি। প্রসঙ্গক্রমে সড়ক ও নৌপথে করিডোর দেয়ার অভিজ্ঞতা স্মরণ করা দরকার। ট্রানজিটের আড়ালে করিডোর দেয়ার আগে ক্ষমতাসীনরা অনেক গালগল্পই শুনিয়েছিলেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলেছিলেন, ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হলে বাংলাদেশে নাকি ‘টাকার পাহাড়' তৈরি হবে এবং কর্মসংস্থানের তথা চাকরির নাকি ‘বন্যা' বইতে শুরু করবে! অন্যদিকে করিডোর দেয়ার পর কিন্তু বাংলাদেশ কোনোভাবেই লাভের মুখ দেখতে পারেনি। ‘টাকার পাহাড়' তৈরি হওয়ার কিংবা কর্মসংস্থানের ‘বন্যা' বয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, এতদিন পর এসে একই ক্ষমতাসীনরা শোনাচ্ছেন, প্রতিবেশির কাছ থেকে ভাড়া চাইতেও তাদের নাকি লজ্জা লাগছে! এই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেও মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের বিনিময়ে বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে ভারতকে বিদ্যুতের করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। সরকারকে অবশ্যই করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারি যন্ত্রপাতি পরিবহন করার সুযোগ দেয়াও বন্ধ করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads