মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

বীর উত্তম জিয়া এবং সাতই নভেম্বর



কাজী সাইদ
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে জিয়াউর রহমান পাঞ্জাবের খেমকারান সেক্টরে ৩০০ থেকে ৫০০ সৈন্যের এক কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে শত্রুদের বিরুদ্ধে অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিজে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় খেতাব হিলাল-ই-জুরাত পদক। তার কোম্পানি দুইটি সিতারা-ই-জুরাত মেডেল এবং ৯টি তমঘা-ই-জুরাত মেডেল অর্জন করেছিল যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দিলে তৎকালীন আওয়ামী নেতৃত্ব ঘটনার আকস্মিকতায় দিগি¦দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেরা আত্মগোপনের নিরাপদ গন্তব্য বেছে নিতে শুরু করে। সশস্ত্রবাহিনীগুলোর বাঙালি জওয়ান ও অফিসারেরা প্রতিরোধযুদ্ধে নিজেদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতির সেদিন বীরপ্রসবিনী চট্টলার কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ক্ষীণতরঙ্গে ভেসে আসা বজ্রঘোষণায় ভবিষ্যৎ পথ চলার নির্দেশনার সন্ধান খুঁজে পায়। স্বাধীনতার প্রথম তূর্যবাদকের কণ্ঠে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় বেতারে ভেসে আসে একটি গলার গমগমে আওয়াজ : আমি মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেসের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে আমি ঘোষণা করছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় : (I Major Zia declare as the provisional Cheif of Bangladesh Liberation Forces the emergance of Independent and sovereign Bangladesh…) ৩০ মার্চ কালুরঘাট ট্রান্সমিশন স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনুরোধে মেজর জিয়া আবার ঘোষণা করলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ইতঃপূর্বে আমি যে ঘোষণা ও নির্দেশ দিয়েছিলাম, তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এবং তার পক্ষ থেকে এই স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করছি।’
জিয়াউর রহমানের প্রথম ঘোষণাটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এই আলোর দিশারী শুধু মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, রণাঙ্গনে লড়েছেন বীরের মতো। ৯ মাসের চলমান মুক্তিযুদ্ধে তার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘জেড’ ফোর্স। যুদ্ধশেষে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অকুতোভয় এ বীরকে সম্মানিত করেছিলেন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উপাধি ‘বীর উত্তম’ উপাধি দিয়ে। করেছিলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান।
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ৩ নভেম্বর ২০১১ নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশী জাতিসত্তার রক্ষাকবচ’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মরহুম উইং কমান্ডার (অব:) এম হামিদুল্লাহ খানের লেখা নিবন্ধ থেকে জানা যায়, মেজরদের শাসন তৎকালীন আর্মি চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ মেনে নিতে রাজি হননি। ফারুক, রশীদ, নূর, ডালিম তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেও ক্যান্টনমেন্টকে তাদের বশে আনতে পারেননি। খালেদ মোশাররফ এক মাস অতিবাহিত হতে-না-হতেই প্রায় প্রতিদিনই ক্যান্টনমেন্টে থাকা ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানবাহন এবং এপিসি (আরমার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) এবং পদাতিক সেনাদের নিয়ে নৈশপ্রহরায় বের হতেন। উদ্দেশ্য বিদ্রোহী মেজরদের সতর্কবার্তা প্রেরণ। মেজররা তাদের ট্যাংকবহর নিয়ে বঙ্গভবন এবং রেসকোর্সে ময়দানে অবস্থান নিয়েছিলেন। এর মধ্যে খালেদ মোশাররফের দূতের সাথে তাদের একটি সংলাপ শুরু হয়। মেজররা বুঝতে পারেন এভাবে বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। অবশেষে ৩ নভেম্বর মেজররা তাদের পরিবারসহ বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ, বিদেশী মুদ্রা নিয়ে একটি প্লেনে করে ব্যাংকক চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সম্মত হন। ইতোমধ্যে চার নেতাকে মোশতাকের নির্দেশে জেলের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়। জেনারেল জিয়াকে নিরাপত্তার অজুহাতে গৃহবন্দী করা হয়। মোশতাককে নজরবন্দী করে রাখা হয় বঙ্গভবনের একটি কক্ষে। রাষ্ট্রপতি করা হয় প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে।
৪ নভেম্বর থেকে খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং নিজেকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন। ঠিক সে সময়ই একটি তৃতীয় শক্তির উদ্ভব ঘটে। এটা ছিল জাসদের সশস্ত্র ক্যাডার প্রধান লে. কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন। তিনি ৭ নভেম্বরের পূর্ববর্তী মাসাধিক কাল ধরে প্রস্তুতি নিয়ে ঘটনার দুই-তিন দিন আগে থেকেই ঢাকাসহ পুরো ক্যান্টনমেন্টে, সেনাছাউনি ও বিডিআরে প্রচারপত্র বিলি করেন। প্রচারপত্রের মূল কথা ছিল, ‘সিপাহি -জনতা ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাইÑ জেসিওর ওপরে অফিসার নাই।’ ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ অলৌকিকভাবে আরেকটি কাউন্টার অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায়। সেনাদের বেশির ভাগ সদস্য এরই মধ্যে উপলব্ধি করে, জাসদের বিপ্লবের চটকদার মনকাড়া মিষ্টি কথার অন্তরালে একটি দেশবিরোধী চাল কাজ করছে। খালেদ মোশাররফ একজন ভারতীয় এজেন্ট। এর আগের দিন খালেদ মোশাররফের ভাই রাশেদ মোশাররফ এবং তাদের মায়ের নেতৃত্বে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে মিছিল করা হয়। সে মিছিল থেকে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগান উত্থিত হয় এবং খালেদ মোশাররফকে অভিনন্দন জানানো হয়।
৬ নভেম্বর মধ্যরাতে লে. কর্নেল (অব:) তাহের তার নিয়ন্ত্রিত জাসদের বিপ্লবী সংস্থার কিছু সিভিলিয়ান ক্যাডারকে সেনা উর্দি পরিয়ে জিয়াকে মুক্ত করার উছিলায় ৬ নম্বর মঈনুল রোডে অবস্থিত জিয়াউর রহমানের বাসভবনে পাঠান। জিয়াউর রহমানকে জীবিত রেখে মার্কসবাদী লেলিনবাদী আদর্শে বিশ্বাসী তাহের তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন সফল হবে না জেনেই জিয়াকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই ওই গ্রুপটিকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা একমত। তারা মঈনুল রোডে গিয়ে দেখেন অন্য একটি গ্রুপ ইতোমধ্যে জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে গেছে। এই গ্রুপটি ছিল সিপাহিদের মধ্যে আধিপত্যবাদবিরোধী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তারা পূর্বাহ্নেই তাহেরের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায়। তারা ২ ফিল্ড আর্টিলারির ইউনিটে তাদের অস্থায়ী অপারেশন হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে। ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমান জেনে গিয়েছিলেন যে ওই গ্রুপটি ২ আর্টিলারির, যার সিও ছিলেন কর্নেল আমিনুল হক। তিনি ছিলেন জিয়ার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত। জিয়া ও তার বেগম সাহেবা করিডোরে বেরিয়ে আসেন। জিয়া কালবিলম্ব না করে ২ ফিল্ড আর্টিলারিতে চলে যান। তখন বেগম জিয়া করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় শুনতে পেলেন, ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহ আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ।’ জিয়া ২ ফিল্ড আর্টিলারিতে পৌঁছার ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যেই তাহের তার লোকজন নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। তাহেরের মতিগতি সুবিধার নয় দেখে জিয়া সুবাদার মেজর আনিসুল হককে ত্বরিত তাহেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে বলেন। জিয়া নিচু স্বরে বললেন, ‘অনেক পলিটিক্স আছে এবং চক্রান্ত হচ্ছে।’ তাহের ইতোমধ্যে নতুন ফন্দি এঁটেছে। তাহের জিয়াকে ২ ফিল্ড থেকে বের করে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চাইলেন। বললেন, ‘আসুন, জাতি আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’ এ দিকে ২ ফিল্ডের সবাই জেনে গেছে বেতার কেন্দ্র তাহেরের সশস্ত্র ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ওখানে যাওয়া মানেই মৃত্যুর ফাঁদে পা দেয়া।
সুবেদার মেজর আনিছ বললেন, ভাষণ দেয়ার জন্য বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বেতার কেন্দ্র আপনার নিয়ন্ত্রণে। আপনি হুকুম দিলেই বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীরা এখানে এসেই ভাষণ রেকর্ড করতে পারে। তাহেরের প্ল্যান ভেস্তে গেল। তাহের তার ভাই সার্জেন্ট ইউসুফ এবং অন্যদের নিয়ে রাগেক্ষোভে টু ফিল্ড ত্যাগ করলেন। ততক্ষণে বেতার কেন্দ্র থেকে রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা হয়েছে। জাতীয়তাবাদী সশস্ত্রবাহিনীর বিজয় সুনিশ্চিত হলো। তারা ক্যান্টনমেন্ট জুড়ে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ল। দৃঢ়কণ্ঠে জাতির উদ্দেশে জিয়া সেদিন বলেছিলেন, সিপাহি-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানে সব ষড়যন্ত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে কেউই নস্যাৎ করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। আপনারা নিঃসঙ্কোচে যার যার কাজে যোগ দিন। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো আধিপত্যবাদী আগ্রাসী শত্রুর কবলমুক্ত হয়ে আপন মহিমায় জ্বলে উঠল।

সাতই নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ সময় সাধারণ সৈনিকেরা জিয়াউর রহমানকে কাঁধে নিয়ে মিছিল করার দৃশ্য দেখা যায়। জিয়ার প্রতি সেনাবাহিনী সদস্যদের এ অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার দৃশ্য দেখে সেদিন ঢাকাবাসী তথা সর্বস্তরের জনগণ উল্লাসে ফেটে পড়ে, রাস্তায় বেরিয়ে মিছিল বের করে সেøাগান দেয়Ñ ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’। এ যেন সেই ’৭১-এর ষোলো ডিসেম্বরের পুনরাবৃত্তি চলন্ত সেনা ট্যাংকের ব্যারেল ধরে ঝুলে আছে সাধারণ জনগণ, সেনাবাহিনীর ট্যাংকে সিপাহিদের সাথে বসে আছে আবালবৃদ্ধবনিতা। ট্যাংক বেরিয়ে আসছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে, রাস্তার দু’ধারে জনতা অভিনন্দন জানাচ্ছে বীর সিপাহিদের। জিয়াউর রহমান যেন আবারো হাজির হলেন জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে, যেমনি জন-গণ-নন্দিত হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বীরের বেশে জনতা তাকে বরণ করে নিলো।
বীর উত্তম জিয়াউর রহমান মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের যে চেতনা হৃদয়ে ধারণ করতেন তার সফল বাস্তবায়ন করে গেছেন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা স্বল্পকালীন সময়ে। জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব মজবুত করার লক্ষ্যে তিনি দেশের সশস্ত্রবাহিনীকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তোলেন। দেশের ৯০ ভাগ মানুষের আকাক্সাকে লালন করতেই সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে) সংযোজন করেন। সাতই নভেম্বরের সিপাহি জনতার যে স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান, তা ছিল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এক অরাজনৈতিক প্রয়াস। জিয়া ছিলেন জনগণের, দেশের, জাতির ক্রান্তিকালের দিশারী। তার প্রতিষ্ঠিত দল তখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি। কোনো দলের পক্ষ হয়ে নয়, দেশ ও জনগণ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে জিয়াকে শাসনক্ষমতার অগ্রভাগে দেখতে চেয়েছিল। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়ার চেয়েও মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম জিয়া এবং সিপাহি জনতার সাতই নভেম্বরের অবিসংবাদিত নেতা স্বমহিমায় আরো উজ্জ্বল আরো দেদীপ্যমান। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বিএনপি শুধু নিজেদের নেতা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলে, তা হবে তাকে অসম্মানিত করার এক হীনপ্রচেষ্টা। জিয়া গণমানুষের, জিয়া দেশমাতৃকার, জিয়া প্রতিটি দেশপ্রেমিকের।
kazi_sayed@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads