শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১২

‘নূর হোসেনের একটাই কথা- মরবো, তবুও গণতন্ত্র চাই’



 নূর হোসেনের পিঠে আঁকা- ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। বুকে লিখা- ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। দুটি বাক্য ইতিহাসের পাতায় এখনও ঝলমলে। সেই লেখা নিয়ে ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে নূর হোসেন গিয়েছিলেন রাজপথে, সচিবালয় ঘেরাও-এ। এ সময় নিহত হন স্বৈরাচারী শাসকের পুলিশ বাহিনীর গুলিতে। নূর হোসেনের বুকে-পিঠে আঁকা-যে ছবিটি ইতিহাস হয়ে আছে, আজও স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনের সেই মুহূর্তকে বাঁচিয়ে রেখেছে সজিব করে। সেই লেখা লিখেছিলেন মতিঝিলের তৎকালীন পপুলার আর্টের ইকরাম হোসেন। তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর। একই বয়সের ছিলেন নূর হোসেনও। কেমন ছিল তখনকার নূর হোসেনের অভিব্যক্তি? কেমন ছিল তার মনের অবস্থা? কি প্রেরণা নিয়েই বা তিনি তার কাছে এমন ঐতিহাসিক স্লোগান লিখতে এসেছিলেন? ইকরাম হোসেন বিস্তারিত বলেছেন মানবজমিন অনলাইনের কাছে। তার মতে, সে সময় যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল সেটি এক কথায় চরম উত্তপ্ত। আগুন জ্বলছিল সর্বত্র। মানুষের মনে ও বাইরে। সবার একটাই লক্ষ্য ছিল, গণতন্ত্র। নূর হোসেন ছিলেন সেই প্রেরণায় বলিয়ান। তিনি জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে গণতন্ত্রের জন্য তার দৃঢ় অঙ্গিকার- উৎসাহ দিয়েছিল সংগ্রামী জনতাকে। লাখো মানুষের প্রেরণা হয়ে তিনি গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে ঝপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তিতে এই আন্দোলনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতীক। তার আত্মত্যাগের পর শেষ পর্যন্ত জয় হয় গণতন্ত্রের। সে দিনের সেই নূর হোসেনের মনে যে গণতন্ত্র পোষা ছিল। ইকরাম হোসেন বলেন, ১০ তারিখ ছিল সচিবালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি। গণতন্তের দাবিতে দেশে তখন উত্তপ্ত অবস্থা। আমরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুবই শঙ্কিত ছিলাম। সবাই মনে প্রাণে চাইছিলাম, স্বৈরাচার নিপাত যাক। আসুক গণতন্ত্র। সামরিক শাসনের ভয়ে অনেকে তখন মুখ খুলছিলেন না বা আন্দোলন সংগ্রামে যোগ দিচ্ছিলেন না। কিন্তু মনে মনে বা গোপনে সবাই চাইছিলেন এরশাদ সরকারের পতন হোক। আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ১০ তারিখের ঠিক দু’দিন আগে- অর্থাৎ ৮ই নভেম্বর বিকালে নূর হোসেন আসেন আমার কাছে। বলেন, তিনি ১০ তারিখ বুকে কিছু লিখে নিয়ে যেতে চান। আমি বললাম, কেন? বলেন, গণতন্ত্রের জন্য। আমাদের গণতন্ত্র চাই। শোষণ চাই না। যে কোন উপায়েই হোক গণতন্ত্র আমাদের আনতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হলে মরবো, তবুও গণতন্ত্র চাই। আমি তাকে বললাম, আপনি যা করতে চাইছেন, বুকে পিঠে লিখতে চাইছেন, এটা তো বিপজ্জনক। পুলিশ-আর্মি আপনাকে মেরে ফেলবে। জীবন বিপন্ন করবেন? তিনি তখন তার ইচ্ছেতে অটুট থাকেন। বলেন, লিখে দিতে হবে। প্রথমে আমি অমত করি। সামরিক শাসনের সময় ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরাও মনে প্রাণে চাইছিলাম গণতন্ত্র আসুক। সামরিক শাসনে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ফলে পরে তার সাহস আর প্রেরণ দেখে আমি রাজি হই। পর দিন আসবেন বলে চলে যান সেদিন। নূর হোসেনের মনে সে দিন যে সাহস আর প্রেরণা দেখেছিলাম তাতে আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে বেশি দিন নেই। গণতন্ত্র মুক্তি পাবেই। যেভাবে মানুষ মরিয়া হয়ে উঠছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না। ইকরাম বলেন, ৯ই নভেম্বর বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি পপুলার আর্টে এসে হাজির হন। সে দিনও তাকে বললাম, দেখেন বিষয়টি ভয়ানক। আপনি কি সত্যিই লিখিয়ে নেবেন আর সেটি নিয়ে রাজপথে সামরিকের বন্দুকের মুখে নামবেন? তিনি বলেন, অবশ্যই। আমাকে লিখে দিন। কি লেখা হবে তিনি একটি কাগজে করে তা লিখে নিয়ে এসেছিলেন। লেখাগুলো ছিল, ‘গণতন্ত্র মক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’। আমি কাঁপাকাঁপা হাতে তা লিখে দিলাম। আমার লিখে দিতে এতো ভয় কাজ করলেও তার মধ্যে কোন ভয় কিংবা দুর্বলতা কাজ করছিল না। মনেই হয়নি তিনি এতো বড় একটি বিপজ্জনক পথে পা দিয়েছেন। যে কোন মুহূর্তে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। তিনি বলেন, লেখা শেষ হলে তিনি ২০ টাকা দিতে চাইলেন পারিশ্রমিক। আমি নিলাম না। বললাম, আমাদের সমর্থন থাকলো আপনাদের পাশে। তিনি চলে গেলেন। ইকরাম হোসেন বলেন, এমন কিছু বাক্য তার বুকে লিখে দিতে আমার ভয় হওয়ার অবশ্য অন্য কারণ ছিল। যে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এসব লিখবো। আমি থাকি সেই বঙ্গভবনে। যেখানে প্রেসিডেন্ট থাকেন। আমরা বড় ভাই ইকবাল হোসেন ছিলেন প্রেসিডেন্টের রানার। আমার বাবা বঙ্গভবনের কর্মচারী। সে জন্য বিষয়টি যদি কোনভাবে জানাজানি হয় তখন আমাদের পুরো পরিবারের ওপর কোন বিপদ নেমে আসে কি না সেই শঙ্কা ছিল আমার মাঝে। কিন্তু নূর হোসেনের উদ্দীপনার কাছে আমার সব শঙ্কা হেরে গেল। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শঙ্কার পরও নূর হোসেনের বুকে পিঠে লিখে দিলাম। তিনি শহীদ হলেন। গণতন্ত্রও মুক্তি পেল। কিন্তু আমি থেকে গেলাম আড়ালে। কেউ জানলোও না, জানতেও চাইল না- কে লিখেছিলেন সেই অমর বাণী দুটি। ওই দিনের পর বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল। গোয়েন্দারা জানতে পারলেন আমি লিখে দিয়েছি। পুলিশ এসে আমার প্রতিষ্ঠান হানা দিল। প্রাণ ভয়ে আমি পরের ৩ বছর আত্মগোপনে ছিলাম। কিন্তু আমার কাজের স্বীকৃতি আমি আজও পাইনি। তিনি বলেন, সেদিনের সেই কাজটি করতে গিয়ে আমার হাত কেঁপেছিল, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমিও নূর হোসেনের মতো একটি সাহসী কাজ করেছিলাম।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads