মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

৭ নভেম্বরকে জাতীয় দিবসের স্বীকৃতি দিতে হবে


আজ ৭ নভেম্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনী ঐক্যবদ্ধভাবে দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবেরই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। ৩ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনাপ্রধানের পদ দখল করে নিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়েছিল। অভ্যুত্থানটি একদলীয় বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হওয়া সিপাহী-জনতার বিপ্লবে খালেদ মোশাররফ নিহত হন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে হানাহানি ছড়িয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ করা। ষড়যন্ত্রকারীরা সশস্ত্র বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলতে এবং অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযান শুরু করে। তারা শেখ মুজিবের আমলে সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়িত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরকে সামনে রেখে এমনভাবেই অফিসার হত্যার অভিযান চালাতে চেয়েছিল যার পরিণতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে একমাত্র তাহের ছাড়া অন্য কোনো অফিসার থাকতে পারতেন না। ফলে অফিসারবিহীন সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া সহজেই সম্ভব হতো। কিন্তু জেনারেল জিয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও তত্পরতায় ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল সে ষড়যন্ত্র। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করাও সম্ভব হয়নি।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল ৭ নভেম্বরের তথা জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সব দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। একদলীয় সে শাসন ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে নির্বাচন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেছিলেন তিনি। বাকশালের চেয়ারম্যানও তিনিই ছিলেন। অর্থাত্ শেখ মুজিবকে একই সঙ্গে স্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের আজীবন চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না বাকশালের গঠনতন্ত্রে। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের স্বৈরশাসন। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্যও নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়েছিল। সাধারণ নাগরিকের তখন প্রতিবাদ জানানোর কোনো উপায় ছিল না। জাতি বন্দি হয়ে পড়েছিল এক নেতার হাতে। ৭ নভেম্বরের বিপ্লব জনগণকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল।
জেনারেল জিয়াউর রহমান খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরজা। বাতিল হয়ে যাওয়া দলগুলো আবারও রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছিল। আওয়ামী লীগকে ফিরে আসার সুযোগ দেয়াও ছিল জিয়াউর রহমানের অবদান। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনাও জিয়ার সহায়তায় দেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন।
এসবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নভেম্বরের কারণে। ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সফল বিপ্লবই পরিবর্তনের ভিত্তি ও পথ নির্মাণ করেছিল। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার ঐতিহাসিক এ দিনটির ছুটি তো বাতিল করেছেই, পদমর্যাদার অপব্যবহার করে আওয়ামী সেবাদাসদের কেউ কেউ এমনকি খন্দকার মোশতাক এবং স্বৈরশাসক এরশাদের সঙ্গে জিয়াকে ব্র্যাকেটবন্দি করারও অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যা হলো, শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড ও প্রথম সামরিক শাসন জারি থেকে মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের কোনো প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না। জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন ৭ নভেম্বরের বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। ৭ নভেম্বর শুধু স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বই রক্ষা করেনি, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য দরজা খুলে দেয়ার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যও সুদৃঢ় করেছিল। ৭ নভেম্বর না হলে আজকের ক্ষমতাসীনরাও অন্ধকারে হারিয়ে যেতেন। এজন্যই ৭ নভেম্বরকে জনগণ ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে স্মরণ ও সম্মান করে। আমরা সরকারিভাবে ঐতিহাসিক এ দিনটির স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানাই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads