শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১২

মহাজোট সরকারকে ‘তালাক’ বলুন



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
 
এক.
বিবাহবিচ্ছেদ হোক আর ডিভোর্সই হোক, আমরা হরদম ব্যবহার করি ‘তালাক’। তালাক শব্দটি আরবি। আরবি ভাষার অভিধানে তালাক-এর অর্থ ‘পায়ের বন্ধন খুলিয়া ফেলা’ (ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্বাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫২)। অভিধানে এর বেশ কয়েকটি ব্যবহার দেখানো হয়েছে। যেমন—আত তালাকাল বা’ঈরা মিন ইকালিহি। অর্থাত্, সে উটের পায়ের বাঁধন মুক্ত করে দিল। তাল্লাকাল মার’আ, অর্থাত্, সে স্ত্রীকে বিবাহের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিল। এখন বাংলাদেশে বাংলা জবানে কেউ যদি বলে আমি আমার গরুটিকে ‘তালাক’ দিলাম, তাহলে ভুল হবে না। একইভাবে কাজী জহিরের ‘ময়নামতি’ ছবিতে গাওয়া বশির আহমদের বিখ্যাত গান ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’কে সামান্য উনিশ-বিশ করে যদি গাওয়া হতো ‘অনেক সাধের ময়না আমার ‘তালাক’ দিয়ে যায়’—তাহলেও অর্থের কোনো হেরফের হতো না। তবে বাংলাদেশের গানপাগল মানুষ ছোটখাটো ‘টাসিক’ খেত, এই যা। তবে রাজশাহীর ছাত্রলীগের বীর ক্যাডার তাকিমের পায়ের রগ কাটাকে কেউ যদি বলে তাকিমের পায়ের রগ ‘তালাক’ হয়ে গেছে, তা বোধ করি সঠিক হবে না। কারণ ওই বিষয়টা একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড।

দুই.
হালাল বা বৈধ জিনিসগুলোর মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য হলো তালাক। এটা সহিহ হাদিস। আল্লাহ এই তালাক শব্দটিকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন। বাস্তব কারণেই সরাসরি হয়তো না করেননি আমাদের প্রতিপালক, তবে তাঁর তীব্র অনীহার কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন মানুষকে। যাতে তারা এই ‘বৈধ’ কিন্তু ‘জঘন্য’ কাজটি থেকে বিরত থাকে।
যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তালাক দেয়া মাকরুহ। সেজন্য বলা হয়েছে, তালাক যিনি দেবেন তাকে হতে হবে সুস্থ, সাবালক এবং বুদ্ধি-বিবেচনাসম্পন্ন। আবার তালাক যিনি পাবেন তিনি যদি হন নাবালক, দাস বা দাসী এবং বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন তাহলে তালাক বৈধ হবে।
বাংলাপিডিয়ায় এশিয়াটিক সোসাইটি (সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৯) তালাকের কারণ প্রসঙ্গে বলেছে, ‘পূর্বানুমতি ছাড়া স্বামী যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে, সন্তান জন্মদানে অপারগতা, যৌতুক (হয়তো দেনমোহর শব্দটি এখানে হতো) পরিশোধ না করা, স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন যদি নির্যাতন করে’ তাহলে স্ত্রী তালাক দিতে পারে।
এর সঙ্গে যুক্ত হবে স্বামী বা স্ত্রী দু’জনের মধ্যে একজন যদি চরিত্রহীন হন, বিকারগ্রস্ত হন, বিকৃত মস্তিষ্ক হন, মদ্যপ হন, ব্যভিচারী হন, নিয়মিত খোরপোষ প্রদান না করেন, মানবিক আচরণ না করেন, সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীল না হন, উচ্ছৃঙ্খল ও নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন করেন, যদি ঘরে শান্তি না থাকে, যদি মনের মিল না হয়—তাহলে তালাক প্রদান যুক্তিসঙ্গত হয়ে যায়।
তালাকেরও আবার প্রকারভেদ আছে। তালাক তিন প্রকার। রাজ’ঈ, বাইন এবং মুগাল্লাজ। রাজ’ঈ তালাক হবে তখন, যখন তালাকের পর নির্জন বাস হয় একত্রে, যদি তিন তালাকের কম দেয়া হয়, যদি আর্থিক ক্ষতিপূরণ না দেয়া হয়। এই ধরনের তালাকের পর যদি স্বামী-স্ত্রী চান তাহলে তারা আবার সংসার করতে পারেন কোনো প্রায়শ্চিত্ত ছাড়াই। বাইন তালাক হবে তখন, যখন স্বামী-স্ত্রী নির্জন বাস করেনি, কিন্তু তিন তালাক দেয়া হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আবার বিয়ে ছাড়া স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস করতে পারবেন না। মুগাল্লাজ তালাকে স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে না হলে, বিয়ের পর নতুন স্বামীর সঙ্গে নির্জন বাস না হলে, নতুন স্বামী কর্তৃক তালাক না দিলে অথবা তার মৃত্যু না হলে, আবার বিয়ে না পড়িয়ে একত্রবাস চলবে না।
মোট কথা, মানুষ বিয়ে করে দৈহিক ও আধ্যাত্মিক কারণে। প্রেমের জন্য। ভালোবাসার জন্য। শান্তির জন্য। সুন্দর হওয়ার জন্য। আনন্দ লাভ করার জন্য। সন্তান উত্পাদন করার জন্য। সুসজ্জিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক জীবনযাপন করার জন্য। নৈতিকতার জন্য। বৈধতার জন্য। অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য। সেজন্যই বিয়েকে ফরজের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল বা অন্যরা এই বিয়ে পদ্ধতির বিরুদ্ধে যতই তোপ দাগুন, তাতে বিয়ে পদ্ধতিতে চিড় ধরবে না। কারণ মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটি রেখেছে যুগান্তকারী অবদান। মানুষ যে পশু নয়, হিতাহিত বোধবর্জিত কোনো জানোয়ার নয়, সেটা বোঝানোর জন্যও এই পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। সমলিঙ্গের বিয়ে কিংবা ‘লিভ টুগেদার’ যতই বগল বাজাক, বিয়ের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা সেখানে কোথায়? এজন্যই হয়তো বরিস পাস্তেরনাক বলে গেছেন—লাঠি নয়, অস্ত্র নয়, যুগ যুগ ধরে মানুষকে পশু থেকে আলাদা করেছে তার নিজেরই অন্তর্নিহিত এক গান। এই গান মিলনের। পরস্পরকে কাছে টানার। প্রেমের, পরিণয়ের। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার।
বিচ্ছেদ বা তালাক আসলে এসব মহার্ঘ্য উচ্চারণের প্রতিপক্ষ। মিলনে সৌন্দর্য অপার, কিন্তু বিচ্ছেদে কেবল গ্লানি আর হাহাকার। তারপরও জীবনকে যথার্থ করে তোলার জন্য, তার বিকাশের পথকে মসৃণ করার জন্য, তার যাপিত জীবন থেকে সব মলিনতা ও কোলাহল মুছে ফেলার জন্য, তার বেদনার ভার, বঞ্চনার ভার কমানোর জন্যই কখনও কখনও তালাক হয়ে পড়ে অপরিহার্য।

তিন.
ব্যক্তিজীবনেরই সম্প্রসারিত অংশ তার সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন। পরিবার যেমন যাত্রা শুরুর প্রথম ইউনিট বা ধাপ, রাষ্ট্রীয় জীবনও তেমনি তার সর্বোচ্চ স্তর। তারপর আসে বিশ্বময়তার প্রসঙ্গ। অর্থাত্ পরিবারের মতো, মানুষের সংসার জীবনের মতো রাষ্ট্রও বৃহত্তর অর্থে একটা পরিবার, একটা সংসার। পরিবার গড়ে ওঠে পিতামাতাকে কেন্দ্র করে তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে। এর আশপাশে গ্রহের মতো, উপগ্রহের মতো থাকে ভাই-বোন, চাচা-চাচি, ফুফু-ফুপা, মামা-মামি, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ছেলের বউ, মেয়ের স্বামী, কাছের-দূরের আরও অনেকে। এরকম অনেকগুলো পরিবার মিলে গড়ে ওঠে একটা গ্রাম। থানা। জেলা। তারপর রাষ্ট্রীয় জীবন।
সংসার বা পারিবারিক স্তরে বাড়ির কর্তা কে হবে, কে পরিচালনা করবে পরিবারকে তা প্রাকৃতিক নিয়মেই নির্ধারিত হয়ে যায়। নিতান্ত যৌথ পরিবার না হলে এখানে ভোটাভুটির দরকার হয় না। রাজতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই কর্তা বা পরিচালক পরিষদ বা সরকার পরিচালনায় ভূমিকা থাকে না পরিবারের লোকদের, অর্থাত্ জনগণের। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিচালনা পরিষদ বা সরকার নির্বাচনের ক্ষমতা থাকে দেশের জনগণের হাতে। বৃহত্ পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের হাতে। এই সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কে বৃহত্ পরিবারটির পরিচালক হবেন বা সরকার কে হবে, তা ভোটিং ক্ষমতা প্রয়োগ করে ঠিক করে দেয়। ভোটিং ক্ষমতা প্রয়োগের আগে সদস্যরা অর্থাত্ দেশের জনগণ যারা বা যেসব দল প্রার্থী থাকে তাদের ঘোষণাপত্র, কর্মসূচি, ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা, দলটির অতীত কর্মকাণ্ড, বর্তমান আচার-আচরণ যাচাই-বাছাই করে যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে পছন্দের ব্যক্তিটিকে বা দলটিকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। তার হাতে চুক্তি বা শপথের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা অর্পণ করে।
পরিবারের সদস্যরা বা রাষ্ট্রের জনগণ সাধারণত যা চায় তার মধ্যে থাকে তার জীবন ও সমাজের নিরাপত্তা, বাক ও ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যের গ্যারান্টি। চায় প্রগতি, অগ্রগতি, উন্নয়ন। সব ধরনের সন্ত্রাস ও শোষণ থেকে মুক্তি। মুক্ত ও অবাধ চলাচলের সুযোগ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পূর্ণ স্থিতিশীলতা। চায় রাষ্ট্র দুষ্টের দমন করবে। শিষ্টের পালক হবে। জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা ও গুণীর কদর করবে। দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন। চায় শিষ্টাচার ও রুচিসম্পন্ন রাজনীতি। চায় একটি সুখী, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের রাহুমুক্ত দেশ। চোর-ডাকাত, ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, টেন্ডারবাজ, কমিশনবাজ, ভণ্ড, প্রতারক, দলবাজ বুদ্ধিজীবী ও মাদকমুক্ত জীবন। চায় সুস্থ, সুন্দর, কল্যাণময় সংস্কৃতির মমতাময় বিকাশ। তার উঠোন ভরে থাকবে প্রাণের প্রাচুর্য। মাঠ ভরে থাকবে সোনার ধান। তার নদী ভরে থাকবে পানির প্রতাপ। তার গাছে গাছে ডাকবে দোয়েল-শালিক-ফিঙে আর ঘুঘু। ভূত প্রেত দৈত্য দানবের নাচ দেখিয়ে কেউ তাকে উত্খাত করতে এগিয়ে আসবে না নিজের ভিটে থেকে।
কিন্তু যে সরকারকে সে ভোট দিয়েছে, তার ভালো ভালো মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে বিয়ে করেছে, সেই সরকার যদি এসব দিতে ব্যর্থ হয়? সেই সরকার যদি পালনকর্তার বদলে সংহারক ভূমিকায় নাম লেখায়? তার রক্ষক যদি ভক্ষক হয়? সে যদি হিটলার-চেঙ্গিস খানের মতো জালিম হয়? নিপীড়ক হয়, অত্যাচারী হয়? বীভত্স হয়, বিভীষিকাময় হয়? আশীর্বাদের বদলে সে যদি অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়? যদি সে জনগণের স্বার্থবিরোধী কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে? যদি সে রাষ্ট্রের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে? যদি সে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তোলে? রাষ্ট্র যদি সন্ত্রাসীর ভূমিকায় আবির্ভূত হয়? রাষ্ট্র যদি তার জান ও মালের নিরাপত্তা হরণ করে? যদি তার বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে? সরকার যদি নৈতিকতাহীন হয়? চরিত্রহীন হয়? নীতি ও আদর্শহীন যদি হয়? সরকার যদি মিথ্যাবাদী হয়? সরকার যদি বিকারগ্রস্ত হয়? বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন হয়? সরকার যদি ওয়াদা খেলাপকারী হয়? প্রতারক হয়? জালিয়াত হয়? সরকার যদি জনগণকে ইনসাফ থেকে বঞ্চিত করে? খুনিদের পৃষ্ঠপোষক হয়? রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদ যদি তসরুপ করে? তাহলেও কি জনগণ সেই সরকার নিয়ে ঘর করবে?

চার.
গ্রামদেশে মুরুব্বিরা বলতেন, পেট যদি চাপ দেয় তাহলে দেরি না করে তাড়াতাড়ি পায়খানায় যাও। এতে তুমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে, অন্যরাও রক্ষা পাবে দুর্গন্ধ থেকে। নইলে পরিবেশই শুধু দূষিত হবে, আর ক্ষতি হবে তোমার স্বাস্থ্যের।
প্রাচীন প্রবাদে আছে, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। তাতে অন্য ক্ষতি যাই হোক সংসারের শান্তিটা বজায় থাকে। কারণ ব্যভিচারে আসক্ত স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে এক বিছানায় শোয়া এক মহাবিড়ম্বনার বিষয়। এতে শরীর ও মন দুটোই মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়তে পারে।
সেজন্যই ওয়াকেবহাল মহল বলছেন, প্রতিদিনের যন্ত্রণা, যাতনা, দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্ছনা, ক্ষোভ, অপমান, গঞ্জনা সয়ে শরীর ও মনকে, দেশ ও জাতিকে দগ্ধীভূত হতে দেয়ার বদলে এই মহাজোট সরকারকে ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলুন। পরিবেশ দূষিত না করে, দেশকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত না করে, লাঞ্ছনা চেপে না রেখে এ সরকারকে বুকটান করে ‘না’ বলুন। ‘তালাক’ বলুন। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বাইন তালাক বলুন।
কোনো সরকারকে তালাক প্রদানের দুটি পদ্ধতি আছে। এক. পরবর্তী ভোটের জন্য অপেক্ষা করা, দুই. গণঅভ্যুত্থান ঘটানো। দুটোই অনেক দূরে। জাতীয় নির্বাচন আদৌ হবে কিনা কেউ জানে না। আর বিরোধী দলের মহা (!) বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড দেখে গণঅভ্যুত্থানের কল্পনা করাও কষ্টকর।
তাহলে মনে মনে হাজারবার বলুন, তালাক। মুখে বলুন, তালাক। আড্ডায় বলুন, তালাক। সভা-সেমিনারে বলুন, তালাক। সরকারের কর্তাদের ‘তালাক’ ব্যানার টানিয়ে অভ্যর্থনা করুন। তাদের সম্বোধন করুন ‘তালাক’ বলে।

পাঁচ.
‘তালাকনামা’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম ২০১০ সালের মাঝামাঝি। ছাপার জন্য পাঠিয়েছিলাম বহু জায়গায়। সামাজিক অঙ্গীকারহীন, সুবিধাভোগী, আপসকামী, মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ ও ক্ষুদ-কুড়ালোভী অপদার্থ সাহিত্য সম্পাদকরা কবিতাটি ছাপাতে সাহস করেননি। পরে একই বছর প্রকাশিত আমার ‘কে সিরাজদ্দৌলা, কে মীরজাফর’ (শিকড় প্রকাশনা) গ্রন্থে ঠাঁই পায়। আজ দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালে প্রিয় পাঠকদের দরবারে কবিতাটি তুলে দিলাম :

‘তালাকনামা’
তুই আমার উপর কেরদানি ফলাস—
তোর কেরদানির বীজ আমি অপারেশন করে ফেলে দেব।
তোকে আমি এক তালাক দেব।

তুই আমার চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি
তোর দুষ্কর্মের দোসরদের কাছে বন্ধক দিয়ে এসেছিস।
খ্যাতি আর প্রতিপত্তির মোহে তুই বোধবর্জিত অন্ধ,
বাড়ির ভিতর দিয়ে শয়তানের চলাচলের পথ করে দিয়েছিস।
তুই তোর মহাজন বাপকে এনে বসিয়েছিস বেডরুমে।
এখন বলছিস ইজ্জতের চেয়ে বন্ধুত্ব বড়!

তুই গাধার বাচ্চা গাধা।
তোর পাছায় আমি লাথি মারি।

প্রতিদিন তোর পড়শি তোর জমি দখল করে কেটে নেয় সোনার ফসল।
প্রতিদিন ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত হয় সীমানাপ্রাচীর।
প্রতিদিন প্রতিবেশী তোর ভাইদের নির্বিচারে খুন করে—
তোর নদীর পানি আটকে দেয় এজিদ বাহিনী,
তোর বুকের ওপর প্রতিদিন ছড়িয়ে দেয় বিভেদের এসিড।

আর তুই বেশরম।
আর তুই জাত নচ্ছার।
আর তুই পাজির পা ঝাড়া।
সে সব প্রতিকারের বদলে বলছিস—
এর সব কিছুই হচ্ছে পবিত্র ও মহান বন্ধুত্বের নামে।

তোর বাড়ি ভেঙে নিয়ে যায় আগ্রাসন।
হিংসা ও ঘৃণার কুয়াশায় তোর আকাশ বাতাস অস্থির।
তোর আত্মার বিরুদ্ধে তোর দেহ,
দেহের বিরুদ্ধে আত্মার বিষোদগার।
তোর মৃত্তিকা আজ আকাশ বিদ্বেষী—

আকাশ ঢেকেছে উদাসীনতার মেঘ।
আর তুই মৈত্রীর অমিয় সঙ্গীত।
আর তুই অহিংসার চরম উপাসক!
আর তুই জয় হোক বন্ধুত্বের জয় হোক!

তোকে আমি দুই তালাক দেব।

তোকে সবাই জানে তুই দক্ষিণ এশিয়ার মস্তানের চামচা।
তোকে সবাই জানে তুই মহাজনের পা চাটা কুকুর।
তোকে সবাই জানে তুই মেষের চামড়ায় মোড়া ভাড়া খাটা জল্লাদ।

তোর যতো হম্বিতম্বি নিজের বাড়িতে।
তোর জবরদস্তি নিজের ভাইদের উপর।
তোর যতো বাহাদুরি দুর্বলের উপর।

তুই জঘন্য তুই ইতর।
তুই তোর জন্মদাত্রী জননীকে অপবাদে মলিন করেছিস।
নিজের সহধর্মিণীকে তুই মহাজনের শয্যায় যেতে বাধ্য করেছিস!
তুই নপুংসক, তুই অমানুষ!
তুই মীরজাফরের চাইতেও নিকৃষ্ট
তুই মইন-ফখরের চাইতেও বেশি বেশি নেড়ি কুত্তা!

তোকে আমি তিন তালাক দিলাম।

চড়িয়ে চড়িয়ে তোকে আমি নীতিকথা শিখাব।
তারপর সেলাই করে দেব পাছা।
তারপর গোবর মাখিয়ে দেব।

তুই নচ্ছারের নচ্ছার।
তুই গাধার বাচ্চা গাধা।
— তোকে আমি বাইন তালাক দিলাম।

ছয়.
কবিতা দিয়ে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লেখার অভিনব কায়দাটির আবিষ্কারক আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২১ সালে ‘নবযুগ’, ১৯২২-এ ‘ধূমকেতু’ এবং ১৯২৫ সালে ‘লাঙ্গল’ পত্রিকায় তা তিনি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়কার সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের দালাল সংবাদপত্রগুলোকে। তিনি আমাদের গণমুখী সাংবাদিকতারও জনক। সংবাদপত্রের পাতায় স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাকারীও তিনি।
নজরুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তার সাহসে সাহসী হওয়া, তার আলোকে আলোকিত হওয়াও আমাদের কর্তব্য, বিশেষ করে এই দুর্দিনে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
a_hyesikder@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads