রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১২

দু’শ পত্রিকা বন্ধ : সরকারকে দায় নিতে হবে



‘সব ধরনের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত করা হবে’—বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রকাশিত ইশতেহারে এই প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। মহাজোট সরকারের পৌনে চার বছরের শাসনামলে বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর বাইরে থেকে প্রকাশিত দু’শ সংবাদপত্রের প্রকাশনা। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারের গণমাধ্যম দলন, সরকারি বিজ্ঞাপন না দেয়া, আর্থিক সঙ্কট ও নিউজপ্রিন্টের দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি পত্রিকা বন্ধ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এই কারণগুলো বিচ্ছিন্ন নয় বরং পরস্পর একই সুতোয় গাঁথা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বন্ধ হওয়া সংবাদপত্রের বেশিরভাগই ভিন্নমতের; বিশেষত শাসক দলের নেতাকর্মীদের নানা ধরনের অপতত্পরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এ অবস্থায় এমন ভাবার অবকাশ রয়েছে যে, গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধের পরিধি সঙ্কুচিত হওয়ায় এত বেশি সংখ্যক সংবাদপত্র সরকারের রোষানলের শিকারে পরিণত হয়েছে বা হওয়ার মুখে রয়েছে। তাছাড়া সরকার একদিকে পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করছে, অন্যদিকে আর্থিক সঙ্কটে পতিত হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকাকে সহায়তা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দিচ্ছে। মুখে বললেও সরকার এই সঙ্কীর্ণ মনোভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না।
মহাজোট সরকারের আমলে সঙ্কটের মুখে গণমাধ্যম—এ সংক্রান্ত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি লোকজন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাদের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে গত তিন বছর দশ মাসে সরকার ক্রমাগত পত্রিকার কণ্ঠরোধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংশ্লিষ্ট পত্রিকার কার্যালয় ভাংচুরের মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুরক্ষার প্রথম কথা হচ্ছে পত্রিকা প্রকাশের পথে যেসব অন্তরায় বিদ্যমান সেগুলোর অপসারণ। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে সবাই তা প্রত্যাশা করে। কারণ ‘তথ্যপ্রবাহের অবাধ চলাচল’ কথাটির মানেই হচ্ছে—জাতীয় স্বার্থ, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সপক্ষে থেকে স্বাধীনভাবে তথ্য প্রকাশ করা। সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারের সব ধরনের কার্যক্রম জনগণকে অবহিত করা, সরকারের ভুল-বিচ্যুতি নির্দেশ করা সংবাদপত্রের অপরিহার্য দায়িত্ব। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই সংবাদপত্র নিরবচ্ছিন্নভাবে এই দায়িত্ব পালন করে থাকে। এতে গণতন্ত্র সংহত হয়, সবশ্রেণীর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন ঘটে। এক্ষেত্রে সরকার অসহিষ্ণু হলে, সমালোচনায় ধৈর্য হারালে কার্যত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণতন্ত্র। বর্তমান সরকার সে পথেই হাঁটছে এবং নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের জন্য ঠুনকো অজুহাত দাঁড় করিয়ে খড়গহস্ত হচ্ছে সংবাদপত্রের ওপর। জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি মহাজোট সরকার গঠনের কয়েক মাস পর অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হওয়ার অভিযোগে প্রায় একশ’ পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করে দেয় সরকার। পরে ওই বছর বন্ধ হয়ে যায় আরও কয়েকটি প্রকাশনা। ২০১১ সালে পাঁচটি ও চলতি বছর বন্ধ হয় প্রায় পনেরোটি পত্রিকার প্রকাশনা। সবাই জানেন, একটি সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশের প্রধান শর্ত প্রকাশনা খরচের সঙ্কুলান। এই অর্থ জোগানের সবচেয়ে বড় উত্স বিজ্ঞাপন, বিশেষত সরকারি বিজ্ঞাপন। এক্ষেত্রে সরকার বিজ্ঞাপন দেয়ার ব্যাপারে বৈষম্যনীতি গ্রহণ করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মারণাস্ত্রের মতো কাজ করে। পরিণামে একটি সংবাদপত্র অর্থাভাবে প্রকাশনা গুটিোয় নিতে বাধ্য হয়। স্বভাবতই বেকার হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সঙ্গে জড়িত সাংবাদিক ও অন্যরা। মহাজোট সরকারের আমলে ঢাকার বাইরে দু’শ পত্রিকা বন্ধের কারণে কতজন সাংবাদিক, সংবাদকর্মী চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছেন তার খতিয়ান তুলে ধরে আপাতত কোনো ফায়দা নেই। অভিযোগ আছে, সরকার এসব জেনেই একান্ত নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য এই ‘বিজ্ঞাপন বৈষম্য নীতি’কে প্রাথমিক আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাতেও যখন কাজ হচ্ছে না তখন চলছে নিপীড়ন-নির্যাতন ইত্যাদি অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ। কাজেই শুধু কাগজ ও অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ায় আলোচ্য দু’শ পত্রিকা বন্ধ হয়েছে—এমন ভাবার কারণ নেই। এ সংক্রান্ত একটি তথ্যনিষ্ঠ প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ-এ ৪ নভেম্বর, যার শিরোনাম ‘ঢাকার বাইরে ২০০ পত্রিকা বন্ধ : মহাজোট সরকারের আমলে সঙ্কটে গণমাধ্যম’।
প্রসঙ্গত, একদলীয় শাসন বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে শেখ মুজিব সরকার চারটি পত্রিকা বাদে সব সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছিল। একদলীয় স্বৈরশাসনে গায়ের জোরের কারণে এর একটা যৌক্তিকতা থাকতেই পারে। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রে এই ধারা অনুসরণের কোনো সুযোগই নেই। কারণ বাকস্বাধীনতা তথা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ সচেতনভাবে এই সত্যটির অবমূল্যায়ন করছে। অবস্থান বদলে গেলেও কি মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ এভাবে একে একে পত্রিকা বন্ধ করা বা বন্ধ করার পরোক্ষ কৌশল অবলম্বনের নীতিকে সমর্থন দেবে কিংবা সাংবাদিক নির্যাতন-নিপীড়নের পক্ষে কথা বলবে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads