শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১২

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি



বদরুদ্দিন আহমদ
দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশবাসী শঙ্কিত। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বলতে যা বোঝায় তা ছিল না, তখন চরমপন্থীরা সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। সরকার শুধু তাদের নয়, আওয়ামীবিরোধী মনোভাবাপন্ন মানুষমাত্রই আওয়ামী লীগের ও সরকারের কোপানলে পতিত হয়। ফলে জনগণ সরকারের বিরোধিতায় উঠেপড়ে লাগে। এ সময় রক্ষীবাহিনীর হাতে বহু নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেই সাথে চলতে থাকে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় অবাধ লুটতরাজ। বঙ্গবন্ধু বললেন, চাটার দল দেশটাকে ফোকলা করে দিলো। এদের মূলোচ্ছেদ করতে হলে নাকি একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাই তিনি বাকশাল করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই নতুন শাসনব্যবস্থা চালু করতে সময় পাননি।
এরপর ক্ষমতায় এলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ। বাস্তবতা হলো, তার ৮৭ দিনের শাসনামলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। এ সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ওই দিনই  রাত ২ ঘটিকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদশায় চারজন প্রবীণ নেতাকে অস্ত্রধারীরা নির্মমভাবে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করে দেয়। এর পাঁচ দিনের মাথায় জাসদের কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সাধারণ সৈনিকেরা পাল্টা ক্যু করে খালেদ মোশাররফসহ কয়েকজন সামরিক অফিসারকে হত্যা করে। গণজোয়ার ছিল জিয়ার পক্ষে। কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসান। জিয়াকে সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর হতে হয়। তিনি কর্নেল তাহেরকেও রেহাই দেননি। তিনি ক্ষমতায় এসে সংবিধানের সংশোধনী এনে বাকশাল বাতিল করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। ফারাক্কার পানিপ্রবাহ না পেয়ে বিকল্প হিসেবে তিনি খাল কাটা কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সবচেয়ে বড় কথা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সততা, শ্রম ও বিশ্বাসযোগ্যতায় মানুষ মুগ্ধ ছিল। তিনি আত্মীয়-পরিজনকে কোনো দিন রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করতে দেননি।
কিন্তু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে কয়েকজন আর্মি অফিসার তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে গোটা দেশকে চরম অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। বহু কষ্টে ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার পরিস্থিতি সামাল দেন। তিনি নিজে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আবির্ভূত হন।
সাত্তারকে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এরশাদ দাপটের সাথে দেশ চালাতে থাকেন। তিনি কিছু কাজের জন্য প্রশংসার দাবিদার। যেমন, তার প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ নিঃসন্দেহে একটি উত্তম কাজ। রাস্তাঘাট করাসহ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ তার আমলে হয়েছে, যা অতীতেও কোনো সরকার করতে পারেনি। কিন্তু তিনি দুর্নীতির আবর্তে ঢুকে গেলেন। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি ব্যাপক কারচুপি করেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্ররা প্রথম বিদ্রোহ করে। ডা: মিলন ও নূর হোসেন হত্যার পর জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সেই ছাত্র আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। পরিস্থিতি তার আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। তখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। রাজনীতি একটি দায়িত্বপূর্ণ অঙ্গন। এ অঙ্গনে যারা প্রবেশ করবেন, তাদের ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আসতে হবে। কথাটা বলেছিলেন এক কালের বাংলার অবিসংবাদিত নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। সর্বস্ব ত্যাগ করেই তিনি হয়েছিলেন ‘দেশবন্ধু’। যখন তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন, তখন তার কলকাতার রমা রোডের বিশাল বাড়ি মাতৃসদনের নামে দান করে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘যারা রাজনীতি করবেন, তারা তো দেশের জন্য উৎসর্গকৃত। তাদের নিজের জন্য কিছু থাকতে নেই।’ আর আমরা রাজনীতি করি নিজের পকেট ভারী করার জন্য। মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা না করে নিজের পরিবারের বা গোষ্ঠীর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads