শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১২

বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু মন্দিরে হামলা কেন



ম ন জু র আ হ ম দ
চোখে অস্ত্রোপচারের কারণে বেশ কয়েকটা দিন দৃষ্টিশক্তি রহিত ছিলাম। লেখাপড়া বন্ধ ছিল। বন্ধ রাখতে হয়েছিল কলাম লেখা। আমি স্থবির হয়ে রইলেও এরই মধ্যে সময় এগিয়ে গেছে তার নিজস্ব নিয়মে। ঘটনা-দুর্ঘটনা থেমে নেই। অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে পৃথিবী, এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ, অনেক ঘটনা এই সময়ে ঘটেছে বাংলাদেশে। ঘটন এবং অঘটন। অঘটনের মধ্যে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু মন্দিরে হামলার ঘটনা।
বৌদ্ধদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে কক্সবাজারের রামু-উখিয়া এলাকায়। এখানে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের উপাসনালয় ভাংচুর করা হয়েছে। আর হিন্দু মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বৌদ্ধদের ওপর হামলার মতো হিন্দু মন্দিরে হামলা কোনো সংঘবদ্ধ উদ্যোগ ছিল না। এগুলো ছিল বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার এসব ঘটনা সর্বতোভাবেই উদ্বেগজনক ও বিব্রতকর। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের অভিশাপ সেই ইংরেজ শাসনামল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর কালো থাবা বিস্তার করে রয়েছে। এই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতেই ভারতের বিভক্তি এবং পাকিস্তান নামের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। পরে এই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিষ্ঠা লাভ বাংলাদেশের। যে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘোষণা করা হয়েছিল অন্যতম মূলনীতি হিসেবে, কিন্তু এত কিছুর পরও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি এই উপমহাদেশ। ভারতে মাঝেমাঝেই ঘটে চলেছে সংঘাতের ঘটনা। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে ঘটে গেছে বাবরি মসজিদের ধ্বংসলীলা, গুজরাটে মুসলিম নিধনযজ্ঞ। আর এসবেরই ঢেউ এসে লাগে বাংলাদেশে। এদেশেও ঘটে যায় অপ্রীতিকর সব ঘটনা। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তাদের এসব কার্যকলাপের পেছনে ধর্ম কোনো কারণ হিসেবে কাজ করে না। নিজ ধর্মের প্রতি ভালোবাসা বা বিশ্বস্ততা তো নয়ই, এমনকি অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের কারণেও নয়, এর পেছনে কাজ করে মূলত ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ, ধর্মীয় আধিপত্যবোধের অহঙ্কার এবং রাজনীতি। এ রাজনীতি ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয়ভিত্তিক ক্ষেত্রবিশেষে স্থানীয়।
কক্সবাজারের দুটি স্থানে সীমিতভাবে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা ও দেশের কয়েকটি স্থানে হিন্দু মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুরের পেছনে নিশ্চিতভাবেই কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল না। কী উদ্দেশ্যে, কারা এ সব ঘটনা ঘটিয়েছে সরকারিভাবে তা খুঁজে দেখা হয়েছে কিনা জানি না। এ সম্পর্কিত কোনো তদন্ত প্রতিবেদন চোখে পড়েনি, যা চোখে পড়েছে তা হচ্ছে রামু-উখিয়ায় বৌদ্ধদের ওপর হামলাকে ক্ষমতাশীল সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের প্রয়াস। এ হামলার দায় তারা চাপিয়েছে বিরোধী দল বিএনপি এবং বিএনপিদলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্যের ওপর। পক্ষান্তরে বিএনপি এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এর পেছনেও প্রচ্ছন্নভাবে রাজনীতি কাজ করলেও তাদের কিছু অনুধাবণ প্রণিধানযোগ্য। তারা প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। মিছিল করে দলবদ্ধভাবে দীর্ঘ সময় ধরে যে হামলা পরিচালিত হলো, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হলো, প্রশাসন থেকে তা প্রতিহত করা হয়নি কেন? কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে প্রশাসন তখন নির্বিকার রইল কেন?
এ অনুধাবন শুধু বিএনপি তদন্ত দলের নয়, এ প্রশ্ন দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরও। তারাও অভিযোগ করেছেন তাদের এই বিপদের মুহূর্তে প্রশাসনের নির্লিপ্ত থাকার কথা। প্রশাসন কেন এমন ভূমিকা নিল তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। প্রশাসন মানে তো সরকারের শাসনযন্ত্র। প্রশাসন মানেই তো সরকার। প্রশাসনের ভূমিকা মানে তো সরকারের ভূমিকা। এই পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠবে, রামু-উখিয়ায় বৌদ্ধদের ওপর হামলায় সরকার এমন নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করল কেন? তবে কি সরকার এই হামলা ঘটতে দিতে চেয়েছে?
এ কথা অনস্বীকার্য এবং আমরা বারবার এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছি যে সরকারের প্রেরণা ও মদত ছাড়া সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আমি সাম্প্রদায়িক ‘হাঙ্গামা’ বললাম, ‘দাঙ্গা’ নয়। দাঙ্গা হতে পারে দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে। যেমন হয়েছে ইংরেজ শাসনামলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে। কিন্তু সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের পর ভারতে যেমন হিন্দুর কোনো প্রতিপক্ষ নেই, তেমনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মুসলমানের কোনো প্রতিপক্ষ নেই। ভারতে হিন্দুরা একচেটিয়াভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তেমনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মুসলমানরা একচেটিয়া সংখ্যা গরিষ্ঠ। এই তিনটি দেশে সাতচল্লিশের পর থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত যা ঘটেছে এবং এখনও যা ঘটছে, তা সবই একতরফা। সংখ্যালঘিষ্ঠদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠদের একতরফা হামলা। আর এই একতরফা সাম্প্রদায়িক সংঘাত সরকারি সহযোগিতা ছাড়া কিছুতেই অনুষ্ঠিত হতে পারে না। ১৯৬৪-এর জানুয়ারিতে আমরা ঢাকার ‘দাঙ্গা’ দেখেছি। ভারতের কোন প্রান্তের কোন হজরত বাল, সেখানকার দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় ঘটনো হয়েছিল ঢাকার এই বীভত্স হিন্দু হত্যাযজ্ঞ। একটি হিন্দুকেও তখন দেখা যায়নি অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামতে। তাদের ওপর হামলাকারীদের প্রতিপক্ষ হয়ে লড়াই করতে। তখনই দেখেছি আইয়ুব-মোনেম সরকার ও তাদের প্রশাসনের নীলনকশায় ও প্রত্যক্ষ মদতে কেমন করে এই একতরফা হত্যাযজ্ঞ বিস্তার লাভ করেছিল, কেমন করে উর্দুভাষী গুণ্ডা সর্দার আনোয়ারের নেতৃত্বে তার গুপ্তবাহিনী ঢাকা শহরে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। তাদের যাতে প্রতিরোধ না করা যায়, ঢাকার বিক্ষুব্ধ নাগরিক সাধারণ যাতে তাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে না পারে সে জন্য কার্ফ্যু দিয়ে দাঙ্গাকারীদের সরকারিভাবে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। ঢাকার মতোই একই ধরনের সরকারি মদত ও তাদের নীলনকশার কথা জানা যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং গুজরাটে মুসলিম নিধন যজ্ঞের ঘটনায়। শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও বাবরি মসজিদ ভাঙতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে এমন ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আবার গুজরাটের ঘটনায় যে ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে মুসলিম নিধনের হোতা হিসেবে সরাসরি অভিযোগ উঠেছে এবং যিনি বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছেন তিনি সেখারকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন মোদি।
যেখানে প্রতিপক্ষ নেই, সেখানে একতরফাভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করা সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রশ্ন উঠেছে কক্সবাজারে বৌদ্ধদের ওপর হামলার ঘটনায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে। মিয়ানমারে বৌদ্ধরা যে নৃশংসভাবে মুসলমান হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে এবং এখন আবার নতুন করে শুরু করেছে, সে ব্যাপারে সরকার তো প্রথম থেকেই ওয়াকিবহাল। এর প্রতিক্রিয়া যে নাফ নদীর এপারে কক্সবাজারে এসে পড়তে পারে, এ ব্যাপারে কি তাদের কোনো সচেতনতা ছিল না? থাকলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো পদক্ষেপ তারা নেয়নি কেন? নাকি সরকারই চেয়েছে এমন একটি হামলার ঘটনা ঘটাতে?
আর হিন্দু মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা? এ দায় কার ওপর বর্তাবে? তস্করের মতো লোকচক্ষুর অগোচরে যারা এই ঘৃণ্য কাজগুলো করছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের উস্কানি সৃষ্টিতে তত্পর রয়েছে, তাদের ব্যাপারেই বা সরকার কি করছে? তাদের খুঁজে বের করে যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে সরকার কি আদৌ আগ্রহী? নাকি এক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ কোনো হিসাব রয়েছে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads