শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১২

বিপন্ন টকশো, দুর্বিপাকে বাকস্বাধীনতা



ড. বি এম মফিজুর রহমান আল্-আযহারী



সরকারের আত্মোপলব্ধি ও জবাবদিহিতা সুশাসনের একটি পূর্বশর্ত। বস্তুনিষ্ঠ ও সৃজনশীল সমালোচনা জবাবদিহিতার অন্যতম রক্ষাকবচ। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতা ও ভুল-ত্রুটির সঠিক চিত্র ফুটে ওঠে। একই সঙ্গে পাওয়া যায় দেশবরেণ্য চিন্তাশীলদের দিকনির্দেশনাও। এতে সংশোধনের সুযোগ হয় অবারিত। দেশ ও জাতি বিপথগামিতা থেকে বেঁচে যায়। এ প্রক্রিয়ারই আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে টিভি টকশো। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটি একটি পবিত্র অধিকার হিসেবে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সুরক্ষিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ অধিকারটুকুও চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। শীর্ষ প্রশাসন থেকে প্রায়ই এর বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার গর্জিত হয়। বিনিদ্র প্রহরীর মতো জাতীয় সমস্যা পর্যালোচনা করে যারা দায়িত্বশীলদের পথে আলোকসম্পাত করেন, ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পরিবর্তে তাদের জন্য ছুড়ে দেয়া হয় নিন্দিত অভিধা। সবাইকে প্রতিপক্ষ ভাবার একটা প্রবণতা সরকারকে প্রতিনিয়ত যেন তাড়া করছে। এ ধরনের মানসিকতা স্বৈরতন্ত্রের পূর্বাভাস কি না, সে সন্দেহ এখন ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে টকশো নামে টিভি অনুষ্ঠান চরম বিরক্তিকর পর্যায় থেকে সর্বাধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, সরকারি অর্থের হরিলুট, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে অকল্পনীয় দুর্নীতি, প্রশাসনিক স্থবিরতা, শিক্ষাঙ্গনে অচলাবস্থা, সরকারসমর্থিত ছাত্র সংগঠনের প্রকাশ্য অস্ত্রবাজি, প্রতিপক্ষ দমনের নির্লজ্জ-নির্মম মহড়া, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস ও জঙ্গিবাদ আমদানির অপচেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপকৌশল—এসবই হচ্ছে সাম্প্রতিক টকশোর প্রতিপাদ্য বিষয়। কারণ এসব দেখে সমাজসচেতন কেউ বোবা শয়তানের মতো নির্বিকার ও নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। গণতন্ত্রের অর্থ যদি হয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি, তাহলে এসব টকশো তারই প্রতিচ্ছবি। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কেউ এর বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার করতে পারে, তা কল্পনাও কষ্টসাধ্য।
নিষ্ঠাপূর্ণ, লক্ষ্যভেদী, ইতিবাচক সমালোচনাকে মুক্তির মহাদর্পন বললে অত্যুক্তি হবে না। এ কথা রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি—সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। ‘এক মুমিন আরেক মুমিনের আয়না’ রাসুল (সা.)-এর এই শাশ্বত বাণীর যথার্থতা এখানেই নিহিত। খলিফা ওমরের বিখ্যাত উক্তি, ‘যদি আলী না থাকত, তাহলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত’—এ সত্যেরই প্রতিধ্বনি। তবে সমালোচনার উদ্দেশ্য থাকবে শুধু বিশুদ্ধকরণ। প্রেষণা হবে অন্যের কল্যাণ কামনা। কাউকে হেয় বা অপমানিত করা নয়। মূলত এ ধরনের কল্যাণচিন্তা ধর্মের মর্মকথারই অনুরণন—যার ব্যাপকতায় গোটা মানবতা অন্তর্ভুক্ত। হাদিসের ভাষায়, ‘ধর্মের মর্মার্থ হচ্ছে পরার্থপরতা।’ তাই টকশোর নামে অন্যের চোখ উপড়ে ফেলার মানসিকতাকে সুস্থ রুচিবোধ ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক বলা যায় না।
মহত্ ও ন্যায়বান লোকরাই সমালোচনাকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বরণ করে আত্মসংশোধনে ব্রতী হতে পারে। সমালোচনা তাদের কাছে অপমান নয়; বরং মহামূল্যবান উপঢৌকনসদৃশ। এজন্যই ওমর বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি ওই ব্যক্তিকে রহম করো, যে আমার দোষ-ত্রুটিগুলো আমাকে উপহার দেয়।’ খেলাফাতের দায়িত্ব গ্রহণের অব্যবহিত পরে এ সত্যকেই তিনি অকপটে উচ্চারণ করেছিলেন এভাবে, ‘হে লোকসকল! আমার মধ্যে কোনো বক্রতা দেখলে তা সোজা করে দেবে।’ এক লোক তখন তরবারি খাপমুক্ত করে বলেছিলেন, ‘ওমর, তোমার মধ্যে কোনো বক্রতা দেখলে আমরা তোমাকে এ তরবারির তীক্ষষ্টতা দিয়ে সোজা করে দেব।’ উমার তখন আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। বাস্তবেও তিনি এ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি ঘটনার অবতারণা করা যায়— একদিন তিনি জুমার খোতবায় বলেছিলেন, ‘হে লোকেরা! আমার কথা শোন এবং মেনে চল।’ তখন প্রবীণ সাহাবি সালমান ফারেসি প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আগে বলো তোমার গায়ের ওই লম্বা জামাটি কী দিয়ে বানিয়েছো? অন্যথায় আমরা তোমার কোনো কথা শুনব না, কোনো কথা মানব না। এটা তো মনে হয় ইয়ামেনি চাদর—যা আমাদের একটি করে দিয়েছো। তা-ও আবার খাটো। তা দিয়ে তো তোমার মতো লম্বা মানুষের জামা হওয়ার কথা নয়। ওমরতনয় তক্ষণাত্ জবাব দিলেন, ‘আমার চাদরটি আমি বাবাকে দিয়েছি।’
‘জালেম শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণ করা শ্রেষ্ঠ জিহাদ’—রাসুল (সা.)-এর এ মহান বাণী মুমিন মানসকে সবসময় সত্য কথনে আপসহীন রাখে। কারও রক্তচক্ষু বা শোষণ-নির্যাতনের ভয়ে সে প্রকম্পিত হয় না। রাসুলের শিক্ষায় জেনে শুনে অন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করাই হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, যা ইসলামে সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যাত। হজরত উবাই বিন কাব রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ভাইকে সাহায্য করা কি সাম্প্রদায়িকতা?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘না। সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে, জেনে শুনে কোনো জালেম ভাইয়ের পক্ষাবলম্বন করা।’
সংশোধন ধর্মী সমালোচনা তারাই প্রত্যাখ্যান করে—আত্মাভিমান ও স্বৈরাচারী চেতনা যাদের মন-মানসিকতা, বিবেক-বুদ্ধিকে নিষ্ক্রিয় ও বোধহীন করে দিয়েছে। এজন্যই ইসলাম স্বার্থান্বেষী চাটুকারকে ধিক্কার জানিয়েছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে তোমার এমন প্রশংসা করে, যা তোমার মধ্যে নেই, তার মুখের ওপর মাটি ছুড়ে মার।’ এই শ্রেণীর চাটুকারের তৈরি করা কৃত্রিম প্রাচীরের মধ্যে বন্দী হয়ে শাসকগোষ্ঠী জনগণের হৃদয় ছুঁতে ব্যর্থ হয়। পরিণামে শুধু শাসকদেরই পতন হয় না; জনগণও হয় অপূরণীয় ক্ষতির শিকার। সুরা ফাতিহার প্রথমেই আল্লাহ নিজের জন্য সব প্রশংসার কথা ঘোষণা করে মানবতাকে বুঝিয়েছেন, মৌলিক প্রশংসার অধিকার শুধু তাঁরই, আর কারও নয়। এ সত্যের অনুভূতি যার মধ্যে আছে, সে কখনও আত্মপ্রশস্তি প্রীতি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে না। পারে না কল্যাণকামী কোনো সমালোচকের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে।
চিন্তাশীলতা ও বাকশক্তি মানুষের স্বভাবজাত, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। টকশো তারই স্বতঃস্ফূর্ত অনুশীলন। তাছাড়া মানবজীবন পাঁচটি মৌলিক অধিকারের স্বাধীনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হচ্ছে— ধর্ম, জীবন, সম্পদ, জ্ঞান বা আকল ও পৈতৃক পরিচয় তথা মান-সম্মান রক্ষা। টকশো জ্ঞান ও আকল সংরক্ষণ অধিকারের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এ অধিকার ও স্বাধীনতাগুলোর প্রতিরক্ষা করা; ধ্বংসসাধন নয়।
জাতীয় বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা সঙ্কীর্ণ মনোভাব নিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত নয়। দায়িত্বের পরিধি যত বড় হয়, মনকে তত প্রশস্ত করতে হয়। এজন্যই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যাকে বিচারকের দায়িত্বভার দেয়া হয়েছে, তাকে (যেন) ছুরি ছাড়া জবাই করা হয়েছে।’ টকশোরূপী সমালোচনা আজকের প্রেক্ষাপটে এ হাদিসেরই বাস্তব চিত্র। প্রত্যেকের উচিত দায়িত্বের গুরুভার ও অবস্থান বিবেচনা করে কথা বলা। দায়িত্বশীলদের অপরিণামদর্শী মন্তব্য জাতীয় জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে জনগণই সরকারের যথার্থ মূল্যায়ন করবে; চাটুকারদের প্রয়োজন হবে না। যতদিন পর্যন্ত আমাদের দায়িত্বশীলদের মধ্যে এ সত্য অনুভূত না হবে, ততদিন ক্ষমতার পালা বদল হয়তো হবে; কিন্তু জাতির ভাগ্যাকাশের কালো মেঘ কাটবে না। আল্লাহ সবাইকে সুমতি দান করুন।
লেখক : প্রবন্ধকার; সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads