বুধবার, ২১ নভেম্বর, ২০১২

আ’লীগের ওপর রাজনৈতিক সমাজতন্ত্রের আছর


ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গঠন ও বিকাশ লাভ করেছিল। তবে দলীয় ইতিহাসের একটি বড় অংশজুড়ে অর্থনৈতিক নীতির ওপর সমাজতন্ত্রের প্রভাব ছিল। সমাজতন্ত্রের এ প্রভাব ঠিক মার্কসবাদী কমিউনিজমের মতো না হলেও বর্তমানে ইউরোপে যে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল রয়েছে, প্রভাবের ধরনটা অনেকটা সে রকম। তবে মওলানা আবদুুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনের পর সমাজতন্ত্রের প্রভাব বেশ খানিকটা গৌণ হয়ে পড়ে। ’৫০-এর দশকে যখন আওয়ামী লীগ যাত্রা শুরু করে তখন এবং এরপর দুই দশক ধরে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবল প্রভাব ছিল। সাম্যবাদ বা সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে যারা প্রকৃত বিশ্বাসী ছিলেন না, সেসব দলের নেতারাও সাম্য, সুষম বণ্টন, শোষিতের গণতন্ত্র ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন। কোনো কোনো সময় বৈষম্য ও শোষণের বিষয়টি জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিকতাবাদের সাথে মিশে সমাজবাদী বক্তব্যের আবহ নিত।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতারা স্বল্প সময়ের জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্র ও প্রদেশপর্যায়ে ক্ষমতায় গেলেও তাদের রাজনৈতিক আদর্শবাদী চেতনার কোনো প্রতিফলন তখনকার শাসনে দেখা যায়নি। এর পর থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আঞ্চলিক বৈষম্যবিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ দফা ও অসহযোগ আন্দোলনের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্র ছিল উদার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণবিরোধী বক্তব্য এসেছে, যার সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ধারার নেতাদের বক্তব্যের সাথে মিল পাওয়া যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যজনক সমাপ্তির পর সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে সংবিধান বাংলাদেশের জন্য প্রণয়ন করা হয়, সেটি ছিল কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মডেলের সংবিধান। মূল সংবিধানে মৌলিক অধিকারের যে সীমারেখা ঠিক করা হয় তা পৃথিবীর মুক্ত গণতন্ত্র চর্চার অনেক দেশের অনুরূপ। শুধু একটি প্রতিক্রিয়ামূলক অনুচ্ছেদ উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিল। এটি ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সংগঠন প্রসঙ্গে। পাকিস্তানের শাসনকালে বৈষম্যমূলক অনেক অনুচিত পদক্ষেপ ধর্মের নামে হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে ধর্মভিত্তিক সংগঠন নিয়ে এক ধরনের আপত্তি ছিল। অন্য দিকে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারী রাজনৈতিক শক্তির বড় অংশই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অনুসারী ছিল। এ ছাড়া ধর্মের পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য প্রবল থাকলে প্রতিবেশী ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সুগভীর হবে না, এমন একটি উপলব্ধিও কারো কারো থাকতে পারে। এসব কারণে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ধর্মভিত্তিকতার বিষয় এনে জনগণের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারকে সীমিত করা হয়। এর বাইরে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে একটি গণতান্ত্রিক ভাবধারার গ্রহণযোগ্য সংবিধান হিসেবে মনে করা যায়। আর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্রেরই প্রতিফলন লক্ষ করা যায় এই সংবিধানে।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের সংশোধনীগুলো আস্তে আস্তে শাসনতান্ত্রিক চরিত্রে পরিবর্তন আনতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের চরিত্র আমূলভাবে পাল্টে দেয় চতুর্থ সংশোধনী। বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস এই সংশোধনীর পর আর থাকেনি। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস একেবার অর্থনৈতিক নীতিতে সীমিত ছিল। তখন দেশের বড় বড় কলকারখানা ও সেবা খাতকে জাতীয়করণ করা হয়। ‘কমান্ড ইকোনমি’ হয় অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের নিয়ন্ত্রক সূত্র। দেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা বেড়ে গেলে এবং একই সাথে আওয়ামী লীগবিরোধী জনমত প্রবল হতে থাকলে তখনকার সরকারের দমননীতি কঠোর থেকে কঠোরতর হতে থাকে। দমননীতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর যেভাবে উত্থান ঘটে সেটি দেখা যায় এ সময়ে। জাসদ গণবাহিনী গঠন করে, সিরাজ শিকদার ও চীনপন্থী কয়েকটি রাজনৈতিক দল চারু মজুমদার স্টাইলে সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করে রাজনৈতিক ও শ্রেণিশত্রু খতম অভিযান শুরু করে। এমন এক ধরনের পরিস্থিতিতে মস্কোবাদী সমাজতান্ত্রিক চিন্তা মরহুম শেখ মুজিবের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। এ ক্ষেত্রে বিদেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর স্বদেশে অধ্যাপক মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন সিপিবি ও কমরেড মোজাফফরের ন্যাপের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তার। এ সময়ে রাজনৈতিক সমাজতন্ত্র ও এর একদলীয় মডেল ভর করে বুর্জোয়া উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ওপর। সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারা শুরু হয়। এই পট পরিবর্তনের পর বহুদলীয় রাজনীতি শুরু হলে বেগম জোহরা তাজউদ্দিন, ড. কামাল হোসেন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রা শুরু হয়। এর কিছুকাল পরেই বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে উদারনৈতিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসে। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল সময়টি ছিল পাকিস্তানের বাস্তবতায় আর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। এই ব্যবধান সরিয়ে রাখলে বাবা ও মেয়ের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ব্যক্তিত্বের পার্থক্য ছাড়া অন্য কোনো তারতম্য বড় করে দেখা যায় না।
অন্য দিকে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে বৈশিষ্ট্যগতভাবে মোটা দাগে উদার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এই পাঁচ বছরের শাসনকালের সাথে বাকশাল গঠনের আগ পর্যন্ত মরহুম শেখ মুজিবের শাসনকালের সাথেও মিল রয়েছে। তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার যে জাতীয়করণমুখী সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করেছিল, সেখান থেকে সরে এসে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতিমালার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। ’৭০ ও ৯০-এর দশকের জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার প্রভাব দুই আওয়ামী লীগ শাসনে অবলোকন করা যায়।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনের মতো একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ। সংসদে দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার এমন অবস্থা হয় যে, আওয়ামী লীগ চাইলে সংবিধানে যেকোনো পরিবর্তন আনতে পারে। এই পরিবর্তন বাতিলের এখতিয়ার রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের। বর্তমান আমলে আওয়ামী লীগ সরকারের বড় কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টে বাতিল বা অকার্যকর হয়েছেÑএমনটা দেখা যায়নি। এ অবস্থা আওয়ামী লীগের সময়ের পুরো মেয়াদ অব্যাহত থাকতে পারে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের সাথে বর্তমান সরকারের কিছু ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আগের সরকারের সময় দলের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক নেতারা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দলের নীতিনির্ধারণী শীর্ষ ফোরামের সদস্য ছিলেন। শাসক দল ও সরকারে গুরুত্বপূর্র্ণ সিদ্ধান্তে এর প্রতিফলন লক্ষ করা যেত। এবারের সরকারে রাজ্জাক, আমু, তোফায়েল, নাসিমদের স্থান হয়নি। সরকারের শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, পূর্ত, আইন, তথ্য প্রভৃতি মন্ত্রণালয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এসব মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদে এক সময় বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, এমন ব্যক্তিরা রয়েছেন। বর্তমান সরকার মূলত আ’লীগের হলেও বলা হয় এ সরকার মহাজোটের। তবে মহাজোটের সহযোগী সংগঠনের মন্ত্রীর সংখ্যা বর্তমান সরকারে মাত্র তিনজন। তবে একই রাজনৈতিক মনোভঙ্গির মন্ত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি, যারা এর আগে সিপিবি ন্যাপ জাসদ থেকে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে। বৈশিষ্ট্যগতভাবে তাদের চিন্তা ও এজেন্ডার সাথে আওয়ামী লীগের মূল আদর্শ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মিল নেই। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকের বিশেষ পরিস্থিতিতে উদার গণতন্ত্রের ধারা থেকে বিচ্যুত করে সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগকে। সে সময় সংবিধান সংশোধন করে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টে ফেলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়াদে সংবিধান পরিবর্তন করে একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে না। কিন্তু এমন কিছু পদক্ষেপ সরকারি সিদ্ধান্তে দেখা যাচ্ছে যা আওয়ামী লীগের বুর্জোয়া উদার গণতান্ত্রিক চিন্তাদর্শের সাথে মেলে না।
জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে এখনো নিবন্ধিত বৈধ রাজনৈতিক দল। এসব দলের সাথে আওয়ামী লীগ ১৯৯৫-৯৬ সালে একসাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছে। কিন্তু পরবর্তী রাজনৈতিক মেরুকরণে এসব দল হয়ে যায় বিএনপির রাজনৈতিক সহযোগী। ফলে আওয়ামী লীগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ আরো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছে। কিন্তু এসব দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে দু’টি বিপদের বিষয় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিবেচনায় ছিল। এর একটি হলো জামায়াত ও অন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের জনশক্তির একটি বড় অংশ বিএনপিতে গিয়ে তারা সে দলের শক্তিকে অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয়তটি হলো স্বাধীনতার পর জুলুম-নিপীড়ন ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণ থেকে সশস্ত্র গণবাহিনী ও সর্বহারা দলের বিকাশ ও প্রাবল্য যেভাবে দেখা গিয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি ধর্মভিত্তিক দলের মধ্যে দেখা যায় কি না। এ দু’টি শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে ক্ষমতাসীন দলকে এক দিকে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে, অন্য দিকে আইন-শ্ঙ্খৃলার ক্ষেত্রে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার অনিবার্য পদক্ষেপ হয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা অথবা সাংবিধানিক রাজনৈতিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। জনসমর্থনের দিক থেকে একেবারে ুদ্র একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে ১৯৭৫ সালে এটি করতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১২ সালে সে ধরনের লক্ষণ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। ‘জঙ্গি’ হিসেবে জামায়াত ও এর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিএনপি নেতাদের বিচার করার ঘোষণা আসছে প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বক্তব্যেও। দেশের অর্ধেক মানুষকে দমন, উৎখাত ও বিচার করার মাধ্যমে আইনি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু করা সম্ভব হবে না। কেবল বাংলাদেশ অরাজকতার নতুন এক পর্বে প্রবেশের আশঙ্কাই প্রবল হবে। এ ধরনের লক্ষণ এখন কিছু ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত যারা হবে তাদের মধ্যে শীর্ষে যে আওয়ামী লীগ থাকবে, তা শাসক দলের অনেক প্রাজ্ঞ নেতার মূল্যায়নেও দেখা যাচ্ছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads