সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১২

সময়ের দাবি তারেক রহমান



আজিজুল বারী হেলাল
  
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেমন একপেশে, তারেক রহমানবিহীন ভবিষ্যত্ বিএনপিও তেমনি পানসে।’ কথাগুলো বলেছিলেন জনৈক অরাজনীতিক ব্যক্তি।
বিএনপির নির্বাসিত নেতা তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে গত ৮ এপ্রিল বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির তৃতীয় সভায় অধিকাংশ বক্তা আলোচনা করেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইতিহাস থেকে উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আ.লীগ নেতা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে রাতারাতি বাংলার জাতীয় বীরে পরিণত করে। ’৬৯-এর আয়ুববিরোধী তীব্র গণআন্দোলনে শেখ মুজিব জেল থেকে নিঃর্শত মুক্তি পান এবং পরবর্তী নির্বাচনে তার দল ভোটযুদ্ধে জয়ী হয়। বিএনপিরও উচিত হবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া।’
পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খান এবং কেবিনেটের একজন বাঙালি মন্ত্রী পরামর্শ করে ঠিক করে শেখ মুজিবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সবচেয়ে উপযুক্ত পন্থা হচ্ছে ভারতের সমর্থিত কোনো এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। তাদের ধারণা ছিল, এর ফলে শেখ মুজিবের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে; কিন্তু ফল উল্টো দাঁড়াল। মামলার আসামি শেখ মুজিব রাতারাতি বাংলার বীরে পরিণত হলেন। মুজিবের পক্ষে ব্রিটিশ আইনজীবী টি উইলিয়ামস ও পূর্ব পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি এসএম মোর্শেদের সঙ্গে অন্যান্য আইনজীবীর মতো আয়ুবের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোও একদিন আদালতে মুজিবের পক্ষে মামলায় অংশ নেন এবং সরকারের পক্ষে ছিলেন পাকিস্তানের আর এক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদের। এই ঘটনায় শেখ সাহেব কৌতুক করে বলেন, ‘সরকার পক্ষে এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আমার পক্ষেও একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজ করছেন,’ ইত্যাদি।
কিন্তু আদালতের রায়ে শেষ পর্যন্ত মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। মুজিবের পক্ষে আ.লীগ সারাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে অভ্যুত্থান ঘটানোর মামলা থেকে শুধু শেখ মুজিবই অব্যাহতি পাননি, কিছুদিন পরে আয়ুব খানও পদত্যাগে বাধ্য হন।
আয়ুব-মোনায়েমের মতো ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গংরাও তারেক রহমানের রাজনৈতিক ইমেজকে কালিমালিপ্ত করার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক মামলার ফাঁদ পাতে। কিন্তু মিথ্যা মামলা দিয়ে রাজনীতিবিদদের ক্যারিয়ার ধ্বংস বা তাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করা যায় না—এই চিন্তা থেকেই অপশক্তিরা তারেক রহমানের ওপর বর্বর নির্যাতন করে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, যা ছিল ঘৃণ্য ও অমানবিক তত্পরতা। তার পিতা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াকে যেমনি হানাদার বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণে মারতে পারেনি, এখানেও যোদ্ধা জিয়ার রক্ত প্রবাহিত বাংলার অদম্য সন্তানকে অপশক্তিরা পরিকল্পিত হত্যার কাছে আত্মসমর্পণ করাতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আন্তর্জাতিক নেতা লেনিন যেমন রুশ স্বৈরাচার জার কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত ছিলেন, জাতীয়তাবাদী আদর্শের সন্তান তারেক রহমানও প্রাণ নিয়ে নির্বাসিত আছেন সুদূর লন্ডনে। ষড়যন্ত্রমূলক ১/১১’র ফলে সৃষ্ট মইন-ফখর একনায়কতন্ত্রের পোষ্যপুত্ররা বিএনপির ভবিষ্যত্ অদম্য নেতৃত্ব খর্ব করার জন্য মামলার জাল আরও বিস্তার করে একতরফা বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। অর্থাত্ তারেক রহমান এখন রাজনৈতিক বহুবিধ ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সম্মুখীন। সুতরাং বিএনপির ভবিষ্যত্ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কুটিল রাজনীতির জটিল এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করাই অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুর মতো বিএনপির জন্য একটা অত্যাবশ্যকীয় রাজনৈতিক ইস্যু।
রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত করে ক্ষমতা অর্জনের পর বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায় আরও কঠিনতর কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের অধিকার আদায় বা জনকল্যাণে যে বিপ্লব তার সফলতা নির্ভর করে বিপ্লবী চেতনার যথাযথ বাস্তবায়নে, যাকে বলে সামাজিক বিপ্লব। জনকল্যাণে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণবিপ্লব সংঘটিত হলে পরবর্তী সময়ে তার অনুপস্থিতিতে সামাজিক বিপ্লব বাস্তবায়নে দল তথা দেশের ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব বর্তাবে বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে তারেক রহমানের ওপর এটা অনস্বীকার্য। সুতরাং তারেক রহমানের ওপর যে বানোয়াট মামলাগুলো ঝুলছে তা এখন শুধু বিএনপির জন্যই নয়, জনকল্যাণে সচেতন দেশবাসীর কাছেও একটি রাজনৈতিক ইস্যু।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট জনগণের অধিকার আদায়ে ও জনপ্রত্যাশা পূরণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত করার দাবিতে চলমান যে আন্দোলন সেখানে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলার ইস্যু সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েই দাবিগুলো ঘোষণা করা অপরিহার্য। তাতে আন্দোলনের সবচেয়ে সক্রিয় অংশ ছাত্র-যুবক ও আন্দোলনে সহায়ক শক্তি বিএনপি তথা বিরোধী জোটের শুভানুধ্যায়ীসহ অন্যান্য অংশের স্বতস্ফূর্ত উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে আন্দোলনে গতি সঞ্চার করবে। রাজনৈতিক আন্দোলনে সমাজের যে অংশের নিঃশব্দ নীরব ভূমিকা থাকে তারাও এই সরকারের বিদায় চায়। কিন্তু খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ভবিষ্যত্ বিএনপির নেতৃত্ব হিসেবে আন্দোলনে সক্রিয়-সহায়ক-নীরব সব অংশই দলের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়ার প্রতিচ্ছবি তারেক রহমানকেই চায়।
জনকল্যাণই রাজনীতির উদ্দেশ্য। সেই জনকল্যাণে ক্ষমতাসীন আ.লীগ সরকার ব্যর্থ ও জনগণ তাদের প্রতি বৈরী—এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু জনকল্যাণে প্রয়োজন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা। অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে পরাজিত করা। জনগণ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চায়। কিন্তু জনগণের সেই আশার গুড়ে বালি। একনায়কতন্ত্রের পোষ্যপুত্ররা নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করে নিজেদের অধীনে নির্বাচনী খেলার মহাআয়োজনে ব্যস্ত। একইসঙ্গে চলছে বিএনপি তথা দেশের ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা ও একতরফা অভিযোগে বিচারের নামে প্রহসন।
সুতরাং, বহুমাত্রিক এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণকে সংঘবদ্ধ করে রাজপথে আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক যোগাযোগ প্রভৃতি দ্বারা এই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে পরাজিত করা একান্ত কর্তব্য।
জনকল্যাণে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে গণতন্ত্রের এই ত্যাজ্যপুত্রদের বিতাড়িত করে জনমুখী সরকার প্রতিষ্ঠা এবং জনমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিএনপি তথা বিরোধী জোটের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও দেশের ভবিষ্যত্ তরুণ নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা প্রত্যাহারের আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা।
সমগুরুত্বসম্পন্ন এই দ্বিতত্ত্ব অর্থাত্ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা—এই দুই অর্জনই বিরোধী জোট তথা দেশবাসীর কাছে অত্যাবশ্যকীয়। একটি বর্জন অন্যটি অর্জন, এই তত্ত্ব বিষবত্। অথবা একটি অর্জন করে ক্ষমতার মসনদে বসে অন্যটির অনায়াস অর্জন এই তত্ত্বও ততোধিক বিষবত্। সুতরাং চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রায়-অনুচ্চারিত তারেক রহমানের অবৈধ মামলা প্রত্যাহারের জোরালো ইস্যুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে উচ্চকিত হবে এটাই বিএনপি তথা দেশবাসীর প্রত্যাশা।
উল্লেখ করা যেতে পারে, আফ্রিকার কালো মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেলসন ম্যান্ডেলাও শ্বেত স্বৈরাচার কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে এমনকি সন্ত্রাসবাদের অপবাদ নিয়ে দীর্ঘকাল কারাগারে বন্দী ছিলেন। কিন্তু তার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে শুধু তাকেই মুক্ত করেনি, আফ্রিকার কালো ও সাদা মানুষের মধ্যে অপূর্ব সম্প্রীতি গড়ে তুলেছে এবং তাদের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা আজ বিশ্বের তাবত্ জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রেরণা।
azizul_baree@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads