রবিবার, ২ জুন, ২০১৩

দেশের বাস্তব পরিস্থিতি ও পরিত্রাণের উপায়

দেশের সর্বত্র নৈরাজ্য, অস্থিরতা, অরাজকতা, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি। মানুষের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করছে। কেউ কারো প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাশীলও নন। সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র উঁচিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধাওয়া করছেন, হত্যা করছেন। দেশের সাধারণ নিরীহ জনগণও এর থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। দেশের প্রতিটি থানা ও উপজেলাপর্যায় থেকে সর্বোচ্চপর্যায় পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অস্ত্রবাজ, চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজদের দখলে। এ ছাড়া নিরীহ জনসাধারণের জমাজমিও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কোথাও এর প্রতিকার ও সুবিচার পাওয়া পাচ্ছে না। সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। নতুন দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ নেই; বরং বিদেশে অহরহ অর্থ পাচার হচ্ছে। ফলে শিতি ও অর্ধশিতি তরুণদের কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। সরকারদলীয় সমর্থক ছাড়া কোথাও কারো চাকরি হচ্ছে না। মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্র্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। টাকা ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না। সামাজিক অবয় চরম আকার ধারণ করেছে। একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছে। আইনকানুনের কোনো বালাই নেই। যখন ইচ্ছা সরকার যেকোনো পত্রিকা ও টিভি সম্প্রচার বন্ধ করে দিচ্ছে। এক কথায় বলতে গেলে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের গঠনমূলক সমালোচনাও করা যাচ্ছে না। সংবিধান অনুযায়ী সরকার পরিচালিত হচ্ছে না। এমনকি সরকারের মন্ত্রীরাও একই বিষয়ের ওপর একেক সময় একেক ধরনের লাগামহীন ও অশালীন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
দেশে বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, চাকরি নেই, বিনিয়োগ নেই, ন্যায়বিচার নেই, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ। জনগণের আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই; বরং অর্থনীতি, অনেক প্রতিষ্ঠান পঙ্গু, বোবা ও বধির। কোনো ধরনের প্রতিকার বা প্রতিবাদ নেই। সর্বত্র দলীয়করণ ও কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পান্তরে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে, অথবা সামরিক শাসনের আওতায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। সামরিক শাসনও কখনো এত নিষ্ঠুর হয় না। তারাও জনগণের অধিকার বাকস্বাধীনতা উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা করেছেন, অনেককে জেলে আটক রেখে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়েছেন, এসব নেতার কেউ রাজনৈতিক বন্দী নন। প্রায় সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বোমাবাজি, বিস্ফোরকদ্রব্য ব্যবহার, গাড়িতে আগুন, ভাঙচুর ও চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা। সরকার মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হয়তো আটক রেখেছে, না হয় ব্যস্ত রেখেছে। এসব কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিরোধী দলের কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মী নেই। আছে শুধু সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ। সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতাকর্মীরা সবাই শুধু তুলসীর ধোয়া পাতা। তারা সব প্রচার, বিচার ও আইনের ঊর্ধ্বে। পুলিশের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহারের ছবি, বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যা করার ছবি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অস্ত্র হাতে ছবি আজ অবধি কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমান সরকার বিভিন্ন মাদরাসার এতিম ছেলে, কুরআনে হাফেজ ও আলেমদের বাতি নিভিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় নির্বিচারে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হত্যা করেছে। কুরআন শরিফে আগুন দিয়েছে। শাপলা চত্বরের আশপাশে আগুন লাগিয়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিরোধী দল ও হেফাজতে ইসলামের ওপর দোষ চাপানোর হীনপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশ, দেশের কোনো জায়গা থেকে সরকারের এ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই; কারণ তাদের চোখে মুসলমানেরা সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই মৌলবাদী, কারণ সবাই নিজ নিজ ধর্মের মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী। এ ছাড়া এ সরকারের আমলে বিডিআরের ঘটনা ও বর্বর হত্যাকাণ্ড মানুষ কখনো ভুলতে পারবে না। এসব ব্যাপারে কেউ মন্তব্য করলেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয় ও হামলা করা হয়; যা হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ) ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম ও সাগর-রুনির েেত্র। বর্তমানে দেশের মানুষ হতবাক, হতাশাগ্রস্ত ও সর্বস্ব গুমোট ভাব।
শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক, ইউনিপেটু, যুবক ও বিসমিল্লাহ গ্রপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৫০ হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংকে তারল্যসঙ্কট। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিগত সাড়ে চার বছরে সরকার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এক লাখ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে, ঋণ নেয়ার হিসাব সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সাধারণ মানুষের জমানো টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। বিগত বিএনপি সরকারের আমলের চেয়ে বর্তমানে ঋণখেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সোনালী ব্যাংকসহ সরকারি সব ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। অতীতে দেশের অর্থনীতিতে এ ধরনের লুটপাট কখনো হয়নি। এসব টাকার মালিক সাধারণ জনগণ। সরকারের সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু লোকদেখানো অনুসন্ধান করছে। এর মূল কারণ হলো সরকারের সমর্থক বড় বড় হোমরাচোমরা এগুলোর সাথে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। তারা হলো সোনার বাংলার সোনার ছেলে। সরকার বা সরকারি দলের নেতাকর্মীদের কাজে কোনো ধরনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বা আইনকানুন মেনে চলার প্রয়োজন নেই।
দেশের সংবিধান তবিত, সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। বর্তমান সংবিধান জনগণের ন্যায়বিচার ও স্বার্থ রা করতে ব্যর্থ এবং যুগোপযোগী নয়। এখন যুগোপযোগী এবং দেশের প্রকৃত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নতুনভাবে সংবিধান রচনা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দেশে এক ধরনের প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি শিকড় গেড়ে বসেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতেই হবে; অন্যথায় স্বাধীনতার সুফল ও কাক্সিত উন্নয়ন থেকে দেশের জনগণ বঞ্চিত হবে।
বর্তমান সরকার তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে গণবিচ্ছিন্ন এবং বহির্বিশ্বের দেশগুলোর সাথে ধীরে ধীরে সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশের সার্বিক কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট। কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বহির্বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নপর্যায়ে। (উদাহরণস্বরূপ) কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পত্র নিয়েও দুবাই ও কুয়েতের ভিসা নেয়ার জন্য ১২ থেকে ১৫ দিনের বেশি লেগে যাচ্ছে। অথচ কাগজ-কলমে আমরা একে অপরের ভাই ভাই। অন্য দিকে কূটনৈতিক লাল পাসপোর্টের সম্মান নেই। সরকার নির্বিকার, অসহায় ও দন্তহীন। অথচ আমাদের দেশের লোকেরা ক্রীতদাসের মতো ওই সব দেশের উন্নয়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় ওই সব দেশে আমরা সেনাদল পাঠিয়েছি। তাদের দুর্দিনে ও উন্নয়নে নিঃস্বার্থভাবে আমাদের দেশের জনগণ কাজ করেছে। প্রকৃতপে বর্তমান সময়ে আমাদের অবস্থান তুলনামূলক ভারত ও পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি ফিলিপাইনেরও অনেক নিচে অবস্থান করছে। এর মূল কারণ ও দায়ী দেশের অপরাজনীতি। আমাদের মধ্যে কলহ-বিবাদ ও জাতীয় ঐক্যের অভাব। কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি এ অবস্থা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাবো? কখন আমাদের জনগণ সুখে-শান্তিতে ও নিরাপদভাবে জীবনযাপন করতে পারবে?
বর্তমান সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ :
১. শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। ২. জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৩. দলীয়করণ থেকে বেরিয়ে আসা। ৪. দুর্নীতিমুক্ত সমাজ কায়েম করা। ৫. কাক্সিত উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। ৬. দুর্নীতি দমন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করা। তারা যেন সবার প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে পারে, তার জন্য নতুনভাবে বিধিবিধান করা। কমিশনকে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। ৭. বিচার বিভাগকে রাজনীতিমুক্ত রাখা এবং তারা যেন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেন সে জন্য নতুনভাবে বিধিবিধান ও নিয়োগপদ্ধতি সুবিন্যাস করা। ৮. এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা; কারণ এককেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ৯. স্থানীয় সরকারগুলোকে অধিকতর মতা প্রদান ও শক্তিশালী করা। ১০. সংসদ সদস্যদের গম বিতরণ, স্কুল-কলেজের কমিটি গঠনসহ এলাকার ছোটখাটো কর্মকাণ্ডগুলো থেকে বিরত রাখা। ১১. ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুশাসন, অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। নির্বাচন কমিশনকে প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল অন্য দলকে বিশ্বাস করে না, সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এটি নির্বাচিত লোক দিয়ে হতে পারে আবার অনির্বাচিত লোক দিয়েও হতে পারে। তবে তা হতে হবে আলোচনা, গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থার ভিত্তিতে। এ ব্যাপারে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনীতিবিদেরা পপাতদুষ্ট বা খারাপ এ কথা বলা যাবে না।
আমাদের সবাইকে অনুধাবন করতে হবে যে, আমরা এক ভয়াবহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করতে হবে আমরা কি আদৌ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি? গণতন্ত্রের অর্থই হলো জনগণের শাসন; যা বর্তমানে সামগ্রিকভাবে অনুপস্থিত। সারা দেশ বিভিন্ন দিক থেকে পর্বত পরিমাণ সমস্যায় জর্জরিত। কিভাবে আমরা এ সমস্যা থেকে বের হবো, তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি?
বর্তমান সরকারের হাত রক্তে রঞ্জিত। আমাদের সবাইকে অতীতের ভেদাভেদ, সব কর্মকাণ্ড ভুলে গিয়ে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণ, দেশের উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা, কার্যকর পদপে গ্রহণ এবং কথা ও কাজের মধ্যে মিল থাকা; অন্যথায় গণতন্ত্র হবে মূল্যহীন। তাই চাই সবার মনমানসিকতার পরিবর্তন, আন্তরিকতা ও সমস্যা সমধানের সদিচ্ছা।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads