রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৩

ধর্মীয় অপপ্রচার, গৃহদাহ ও টকশো সমাচার


ভাগীরথীর ¯্রােতপ্রবাহ যেমনই হোক না কেন নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। এতে হতাশ বা বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। জনমত কারো জন্য স্থিতিশীল নয়। খর¯্রােতার মতই প্রবাহমান। কোন রাজনৈতিক শক্তি বা নির্বাচিত ব্যক্তি বা পক্ষ যখন নির্বাচকদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তখনই তাদের জনসমর্থন কমে আসে। এই ব্যর্থতার রকমফেরের উপরই নির্ভর করে জনসমর্থন কমে যাওযার গতি প্রকৃতি। আর কোন শক্তি একবার নির্বাচকদের আস্থা হারালে ভবিষ্যতে তাদের পক্ষে আস্থায় ফিরে আসার সুযোগ একেবারে শেষ হয়ে যায় না। কারণ, জনসমর্থন এবং জনমত চলমান ও গতিশীল। তারা আবার ইতিবাচক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে। যা কোন ক্ষুদ্র বাতাবরণে আবদ্ধ রাখা যায় না বা কোনভাবেই সম্ভবও নয়। জনগণ যখন কোন শক্তিকে তাদের স্বার্থের অনুকূল মনে করতে পারে না, তখনই সে শক্তির বিরুদ্ধে তাদের অভিমত ব্যক্ত করে। লর্ডর্ রাইস জনমতের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলেন, 'ঞযব ধমমৎবমধঃব ড়ভ ঃযব ারবংি সবহ যড়ষফ ৎবমধৎফরহম সধঃঃবৎং ঃযধঃ ধভভবপঃ ঃযব রহঃবৎবংঃ ড়ভ ঃযব পড়সসঁহরঃু' অর্থাৎ জনমত সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের অভিমতের সমষ্টি।
অতিসম্প্রতি দেশে রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা এবং গাজীপুরের কালিগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচন সুসম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে অবশ্যম্ভাবী যে পরিণতি, ঠিক হয়েছেও তাই। এক পক্ষ হেরেছে আর এক পক্ষ জিতেছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। যদি ধরে নেয়া হয় যে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সকল পক্ষই জনগণের আস্থাভাজন। কিন্তু প্রাপ্তভোটের গাণিতিক মারপ্যাঁচে সকল পক্ষ বা উভয় পক্ষই জেতার কোন সুযোগ নেই। বিজয়ী হবে মাত্র এক পক্ষ। আর অন্য সকল পক্ষকেই হারতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সে অমোঘ নিয়মেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা হেরেছেন। কেন হেরেছেন আর কী কারণে জনগণ তাদেরকে নির্বাচিত করা সঠিক মনে করেনি তা অবশ্য জনগণই বলতে পারবে। এতে ক্ষমতাসীনদের আত্মসমালোচনার প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়েছে। মূলত সরকারি দলের এ ভরাডুবির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের প্রতি গণমানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু পরাজিত বা সরকার পক্ষ এ পরাজয়কে কীভাবে মূল্যায়ন করছে তা কিন্তু দেখার বিষয়। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এ নির্বাচন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও সরকারের বিজয় হয়েছে। তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদেরকে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা কারো কাছে সহজবোধ্য বলে মনে হয়নি। বিশেষ করে আমার মত স্বল্পবুদ্ধির লোকের পক্ষে তো বটেই। তিনি ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়কে গণতন্ত্র ও সরকারের বিজয় আখ্যা দিয়ে অন্তত জনগণের কাছে পুলকিত ভাব দেখাচ্ছেন। কিন্তু কথা হলো সরকারি দলের পরাজয় মানেই কী গণতন্ত্রের বিজয়? যদি জনগণ সরকারি দলকে নির্বাচিত করতো তাহলে কী গণতন্ত্রের পরাজয় হতো? মূলত কোন পক্ষের উত্থান-পতনের উপর গণতন্ত্রের জয়-পরাজয় নির্ভরশীল নয়। নির্বাচনে যদি নির্বাচকরা নির্বিঘেœ ও স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ পান এবং নির্বাচনে তাদের মতামতের প্রতিফলন লক্ষ করা যায় তাহলেই গণতন্ত্র ও গণমানুষের বিজয় হয়েছে বলে উল্লেখ করা যায়। বিরোধী দল বা ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের বাইরের শক্তি নির্বাচনে বিজয়ী হলেই নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে এমন কথা বলার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ, ৪ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে অনধিকার চর্চার ঘটনা ঘটেছে। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ১৮টি কেন্দ্র দখল করে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা তাদের প্রার্থীর পক্ষে গণহারে সিল মারার অভিযোগ আছে। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদেরকে পোলিং বুথ থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিয়োগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, সরকারি দল নির্বাচনে অনাকাংখিত ও অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ না করে তাদের প্রার্থীদের পরাজয়ের ব্যবধানটা আরও অনেক বেশি হতো; এমন কী সরকারি দলের সকল প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত ফিরে পাওয়ার কোনই সম্ভাবনা ছিল না।
দেশের ৪টি সিটি কর্পোরেশন ও একটি পৌরসভা নির্বাচনে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের লেজে গোবরে অবস্থা হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী একে গণতন্ত্র ও সরকারের বিজয় বলে আখ্যা দিয়ে দৃশ্যত পুলকবোধ করেছেন। আমাদের মনে হয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মোটেই বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেন নি। তিনি নির্বাচনকে গণতন্ত্রের বিজয় না বলে মূলত দেশের মানুষ নির্বাচনে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছেন এবং বর্ণিত নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে বলে মন্তব্য করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেদিকে না গিয়ে একে গণতন্ত্রের বিজয় বলে আমাদেরকে কোন গণতন্ত্র শেখাতে চেয়েছেন তা কারো কাছেই সহজবোধ্যই মনে হয়নি। আর নির্বাচনে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের কাছে সরকারি দলের প্রার্থীরা অর্দ্ধচন্দ্র খেয়ে কীভাবে সরকার বিজয় লাভ করলো তা তো জনগণের কাছে রীতিমত রহস্যময় হয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী যদি এখানেই শেষ করতেন তাহলে হরিদাসের চামড়া কিছুটা হলেও রক্ষা পেত। কিন্তু তিনি যখন বললেন যে, ‘সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকারের অসারতা প্রমাণ হয়েছে’ তখন কালিদাস বাবু না হেসে পারেন না। কারণ, এতে তিনি আমজনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, তারা বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের বিপুলভাবে বিজয়ী করে সরকারি দলের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। যদি জনগণ সরকারি দলের প্রার্থীদের নির্বাচিত করতো তাহলে তারা বিরোধী দলের অবস্থানকে সমর্থন করতো ? তিনি আমাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, জনগণ সরকারি দলকে বিজয়ী করার জন্যই বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের ভোট দিয়েছে। তাই তো তিনি অবলীলায় বলে ফেলেছেন, জনগণ সময়মত আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। এতে প্রমাণ হয় যে বিরোধী দলকে ফাঁদে ফেলতেই দেশের মানুষ চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করছে।
দেশের যেকোন ঘটনা প্রবাহের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলতে হবে এমন কোন কথা নেই বা তা মোটেই সংগতও নয়। সকল সরকারের একজন বা একাধিক মুখপাত্র থাকেন। মূলত তিনিই বা দায়িত্বপ্রাপ্তরা হন যেকোন বিষয়ে মন্তব্য করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। যতটুকু জানা যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এল জি আর ডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বর্তমান সরকারের মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তাদেরকে আমরা গণমাধ্যমের সাথে সরকারের দৃষ্টিভংগী নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু হালে তাদেরকে সেভাবে মিডিয়ার সামনে দেখা যাচ্ছে না। কারণ, যেকোন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীই খোলামেলা কথা বলেন। সরকার বা দলের কোন মুখপাত্রের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী সরকারের জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ পর্যন্ত সকল দায়িত্ব পালন শুরু করার পর সৈয়দ আশরাফ ও হানিফ সাহেব মনে হয় অনেকটা বেকার হয়ে পড়েছেন। কর্মহীন মুখপাত্ররা হয়তো নতুন করে কর্মের সন্ধানে রয়েছেন বলে মনে হয়!
আসলে আবুল হোসেনের নবাবীর দিন যে খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছে সদ্য সমাপ্ত সিটি ও পৌরসভা নির্বাচনে গণরায়ের মাধ্যমে সেকথারই প্রমাণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র ও সরকারের বিজয় বললেও তিনি সেকথার উপর স্থির থাকতে পারেননি। তিনি নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যাপারে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কথিত সামরিক সমর্থনে বেড়ে ওঠা অপশক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীলদের অশুভ ঐক্যকে দায়ী করেছেন এবং নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের প্রভূত অর্থের অপপ্রয়োগের কথা বলছেন। তার ভাষায় কথিত অপশক্তির নাকি কোন টাকা-পয়সার অভাব নেই। তার এ বক্তব্যের  মাধ্যমে তিনি মূলত সরকারের দু’টি ব্যর্থতার কথা অকাতরে স্বীকার করে নিলেন। তিনি প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন যে, জনগণের ইস্পাত কঠিন ঐক্যের কাছে তার ক্ষমতা নামীয় গণেশ নাকানী চুবানী খেয়েছে। আর তিনি ক্ষমতায় থেকেও নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার রোধ করতে পারেন নি। মূলত এর মাধ্যমে সরকার প্রধান অবলীলায় স্বীকার করে নিয়েছেন যে তিনি বা তার সরকার জনগণকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার বক্তব্যের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনকালে শেখ হাসিনার বা তার সরকারের দায়িত্বে থাকার নৈতিক ভিত্তি হারিয়েছে এবং একটি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সিটি নির্বাচনে পরাজয় সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন পেশ করলেন তার দলের কয়েকটি জেলার ডেলিগেটদের সামনে। তিনি সিটি নির্বাচনে সরকারি দলের পরাজয়কে কথিত ধর্মীয় অপপ্রচার, গৃহদাহ ও টকশোকে দায়ী করলেন। কিন্তু তিনি প্রচার ও অপপ্রচারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারলেন না এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য বলতে হবে। দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে ধর্মীয় অপপ্রচার বলে আখ্যা দিলেন। মূলত ধর্ম নিয়ে আওয়ামী লীগের অতীত-বর্তমান কোন রেকর্ডই সুখকর নয়। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই ধর্মের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ যখনই আওয়ামী লীগের ধর্মদ্রোহীতার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তখনই তারা এসব লোকের বিরুদ্ধে কথিত ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, ধর্মের নামে রাজনীতি, ধর্মব্যবসা ও ধর্মীয় অপপ্রচার হিসাবে আখ্যা দিয়ে এসব ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরুদ্ধে দলন-পীড়ন চালিয়েছে। খোদ মরহুম শেখ মুজিব দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান আন্দোলনের তুখোড় ছাত্রনেতা হলেও ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর গৃহীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি করা হয়েছিল। তাই প্রশ্ন জাগে ধর্মনিরপেক্ষতা যদি রাষ্ট্রের মূলনীতি হবে তাহলে ভারত বিভাজনে কোন প্রয়োজন ছিল? স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সংযোজন করেনি বরং পর্যায়ক্রমে তারা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর একের পর এক আঘাত হেনেছে। দেশে ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে যেকোন ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে কুরআনের আয়াত ‘রাব্বি জিদনী ইলমা’, ঢাকা  বোর্ডের মনোগ্রাম থেকে ‘ইকরা বিসমে রাব্বিকাল লাজি খালাক’, নজরুল ইসলাম হল থেকে ‘ ইসলাম’ এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ অতি যতœসহকারে অপসারণ করা হলো। কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তারা খুব বেশিদিন ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেনি। এক দুঃখজনক ও রক্তাক্ত পট পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। তারা দীর্ঘ ২১ বছর পর দেশের মানুষের কাছে অতীত ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে ১৯৯৬ সালে আবারও ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু তারা অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার কোন তাগিদ বোধ করেনি বরং তারা অতীত বৃত্তেই আটকা পড়েছিল। জনগণ আওয়ামী লীগকে তার জবাবও দিয়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। তারা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে আবার সে পুরোনো আবর্জনার স্তূপে আটকা পড়েছে। তারা সংবিধান থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা তুলে দিয়েছে। কুরআনের আয়াত বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের বিকৃত অনুবাদ করা হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূল নীতি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ করার নামে শিক্ষা থেকে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী থেকে ইসলাম শিক্ষা বাদ দিতে পরিপত্র জারী করা হয়েছে। বর্তমান সরকার কথিত নারী উন্নয়ন নীতিমালার নামে কুরআনের মিরাসী বিধানের উপর হস্তক্ষেপ করেছে। সরকারের এসব আচরণে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ এখানেই তাদের ধর্মবিরোধী অপতৎপরতা বন্ধ করেনি। তারা পরিকল্পিতভাবে নাস্তিক- মুরতাদদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শাহবাগে একত্রিত করে বিরোধী দল দমনের মহড়া দিয়েছে। কিন্তু এর ফসল তারা ঘরে তুলতে পেরেছে বলে মনে হয় না। কারণ, সরকারের সীমাহীন ধর্মবিদ্বেষ আর ধর্মদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা দানের ফলে হেফাজতে ইসলাম নামের এক অরাজনৈতিক সংগঠনের উত্থান ঘটেছে। আর সে উত্থানকে নির্মূল করার জন্যই ৬ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের জন্ম দেয়া হয়েছে তাও সরকারের  জন্য বুমেরাং হয়েছে। এ ঘটনা সারা দেশের ধর্মপ্রাণ ও সচেতন মানুষকে ব্যথিত করেছে। ফলে সদ্য সমাপ্ত ৪টি সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এতে তো ধর্মীয় অপপ্রচার দূরের কথা ৬ মের সত্য ঘটনাতো প্রচারের সুযোগ রাখা হয়নি। কারণ যে দু’টি টিভি চ্যানেল ঘটনার সত্য সংবাদ প্রচার করতো ঘটনার দিনেই সে দু’টি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের জন্য মহাআতংক আমার দেশ তো বেশ আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তাহলে প্রধানমন্ত্রী যে নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য ধর্মীয় অপপ্রচারকে দায়ী করেছেন কারা সে অপপ্রচার করলো তা কারো কাছে বোধগম্য নয়। আসলে সরকারের অপকর্মের পাল্লা এতো ভারী হয়েছে যে কোন প্রকার প্রচার-পাবলিসিটি ছাড়াই জনগণ আত্মসচেতন হয়ে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গণরায় দিয়েছে। মূলত দেশের মানুষ সরকারের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়নি বলেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে পরাজয়ের দায় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়েছেন।
৬ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের রক্তাক্ত অধ্যায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অবাঞ্ছিত মন্তব্য করে জনগণের আস্থা হারিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন নাকি কোন রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি।  হেফাজত কর্মীরা নাকি রং মেখে সং সেজে মরার ভান ধরে রাজপথে শুয়ে ছিল। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে নাকি লাশ উঠে দৌড় দিয়েছে। সুরঞ্জিত বাবু তো দেশের আলেম-উলামাদের ব্যঙ্গ করে বলেছেন, পুলিশের পিটুনী খেয়ে হেফাজত কর্মীরা ‘সুবহান আল্লাহ, সুবহান আল্লাহ’ জিকির করতে করতে দৌড় দিয়েছেন। মূলত এখন সরকার নির্বাচনে জনগণের কাছে অর্ধচন্দ্র খেয়ে বলতে শুরু করেছে যে, শাপলা চত্বরে কোন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু একথাও তাদের স্ববিরোধী। বিভিন্ন টকশোতে আওয়ামী লীগ নেতারা সীমিত পরিসরে প্রাণহানির ঘটনা স্বীকার করেছেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তো অবলীলায় স্বীকার করে বলেছেন,’ কাঁটা তুলতে কিছু রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে’। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম জাতীয় সংসদে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন হেফাজতের সমাবেশে কোন প্রাণহানির ঘটনা গটেনি। কেউ একজনের মৃত্যুর প্রমাণ দিতে পারলে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। আমরা তাকে সবিনয়ে অনুরোধ করবো তিনি যেন তথ্যমন্ত্রীর ‘কাটা তুলতে রক্তপাত’ কথাটার ব্যাখ্যা নেন। তাহলে অন্তত অন্য কাউকে প্রমাণ হাজির করার প্রয়োজন হয় না।
তিনি আরও  বলেছেন সেদিন নাকি বিনা রক্তপাতে হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে নাকি শুধুমাত্র সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ারশেলের সাহায্য নেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের বিবেকবান মানুষের প্রশ্ন মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যেই তাদের উপর এমন অভিযান কেন চালানো হলো ? শাহবাগীরা যদি লাগাতার তিন মাস রাস্তা অবরোধ করে থাকতে পারে তাহলে হেফাজত কর্মীরা কেন কয়েক দিন তা পারবে না? তাহলে কী হেফাজত কর্মীরা বাংলাদেশের নাগরিক নয়? এতেই সরকারের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়। এতে প্রচার-প্রপাগান্ডার কোন প্রয়োজন পড়ে না।
নির্বাচনে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে প্রধানমন্ত্রী গৃহদাহকে দায়ী করেছেন। মূলত সরকার বিগত সাড়ে ৪ বছরে যেভাবে অপশাসন ও দুঃশাসন চালিয়েছে, তাতে তো গৃহদাহ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ, আওয়ামী লীগে এখনও অনেক বিবেকসম্পন্ন ও দেশপ্রেমী লোক রয়েছেন। তারা সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন ও অপকর্ম মেনে না নেয়ার কারণেই গৃহবিবাদ শুরু হয়েছে। আর এ গৃহবিবাদ এক সময় গৃহবিস্ফোরণে রূপ নেয়ার অপেক্ষায় আছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কী ভাবছেন বা কীভাবে সামাল দেবেন তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। কিন্তু বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর জন্য মোটেই সহজ হবে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য টিভি টকশোকে দায়ী করেছেন। আওয়ামী লীগ তো সব সময় গণতন্ত্রের কথা বলে। বাকস্বাধীনতা নাকি তাদের আরাধ্য। আওয়ামী নেত্রী তো নিজেই গণতন্ত্রের মানসকন্যা খেতাব গ্রহণ করেছেন। সে মতে টিভি টকশো বা গণমাধ্যমগুলোতে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সে সমালোচনাও সহ্য করতে মোটেই রাজী নয়। তাইতো টিভি টকশোতে সরকারের সমালোচনা করায় ড. আসিফ নজরুলকে নানান ধরনের হুমকি এবং ড. তুহিন মালিককে উপর্যুপরি হামলার শিকার হতে হয়েছে। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক ও বর্ষীয়ান সাংবাদিক এ বি এম মুসাকে খোদ প্রধানমন্ত্রী এক হাত নিয়েছেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার অন্যতম দিকপাল ড. আকবর আলী খানকেও তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি মধ্য রাতের টিভি টকশোকে সিঁদেল চোরের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু কথা হলো টকশোতে শুধু সরকারের সমালোচনা হয় না বরং সরকারের বিজয় ও সাফল্য গাঁথা প্রচারের জন্য তো সরকারি দলের প্রতিনিধিদেরও উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। আর যে  দু’টি টিভি চ্যানেলকে তাদের আদর্শ বিরোধী মনে করা হতো সে দু’টি তো রীতিমত বন্ধই করে দেয়া হয়েছে।  আসলে টকশোগুলোতে সরকারি দলের প্রতিনিধিরা সত্যের মুখোমুখি হয়ে যুক্তিতর্কের কাছে প্রতিনিয়ত পরাজিত হচ্ছেন। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সরকারি দলের নেতাদের কাছে কোন সদুত্তর না থাকায় নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য টকশোগুলোকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী মূলত ফ্যাসিবাদী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
দেশের মানুষ আগের তুলনায় অনেক সচেতন। প্রচার ও গণমাধ্যমগুলো তো এখন সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তারপরেও মানুষের আত্মসচেতনতার কারণে সরকারি দলের অপপ্রচার দেশের মানুষের কাছে হালে পানি পাচ্ছে বলে মনে হচেছ না। আর এ জন্য তাদের অগণতান্ত্রিক, স্বৈর ও ফ্যাসিবাদী মানসিকতাই দায়ী। আওয়ামী লীগ নির্বাচিত না হলে গণতন্ত্র হয় না এই স্বৈরমানসিকতা তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। যখন আওয়ামী লীগাররা বার কাউন্সিল নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন তখন সহ-সভাপতি বা বার কাউন্সিলের ক্ষমতা খর্ব করার কোন প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সেখানে যখন বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, তখনই ক্ষমতা খর্বের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী ছিলেন তখন তারা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছেন। এখন যখন বিরোধী দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন তখন তাদের মর্যাদা কমিয়ে উপমন্ত্রীর সমমর্যাদা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সরকার যদি মনে করে দেশের মানুষ আওয়ামী মওকাটা বোঝে না তাহলে তারা অবশ্যই ভুল করবে এবং ক্রমেই তারা আরও বেশি গণবিচ্ছিন্ন হবে। আসলে আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগই। তাই তাদের যেকোন বিপর্যয়ের জন্য অন্য পক্ষকে দায়ী করে হয়তো সাময়িক পুলকবোধ করা যাবে। কিন্তু এতে আসন্ন মহাপ্রলয় ঠেকানো যাবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads