বৃহস্পতিবার, ৬ জুন, ২০১৩

কেমন বাজেট চাই

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ আসছে। এগুলো মোকাবেলা করেই সরকারকে অগ্রসর হতে হবে। অন্য দিকে নির্বাচনের পর কে সরকার গঠন করবেন, তার ওপর নির্ভর করবে বাজেট বাস্তবায়ন। দুটি নির্বাচিত সরকার এই বাজেট বাস্তবায়নে থাকবে। তাই এই সরকার ২০১৩-১৪ সালের জন্য রাজনৈতিক ও নির্বাচনী বাজেট প্রণয়ন করছে।
আগামী বাজেটের জন্য রাজস্ব, বহিস্থ খাত ও সরকারের সুশাসনÑ এ তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশে বর্তমানে সুশাসন নেই বললেই চলে। গণতান্ত্রিক সরকার, কিন্তু আচরণ একদলীয় স্বৈরশাসকের মতো। রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন-পীড়নের কৌশল সরকার নিয়েছে। তাই বাজেটে এর প্রভাব দেখা দেবে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেশ ধীর। এর মূল কারণ প্রশাসনে দুর্নীতি ও দলীয়করণ।
যেসব বিষয় প্রতি সরকারকে মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় আলোচনা করছি।
দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি না হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আয় না বাড়ায় মানুষের ভোগ কমে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার মান বৃদ্ধি, শিল্প খাতে জ্বালানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ হ্রাস বা বন্ধ থাকা। বিগত বছর সরকার ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ ১৮ থেকে বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৫ রেখেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়েছে ১৫ শতাংশের নিচে।
বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দেশে কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করতে হবে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রস্তাব অনুযায়ী মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্ট পল্লী গঠনের বাজেট রাখতে হবে। সাভারের প্রস্তাবিত চামড়া শিল্প এলাকা স্থাপনের বাধা দূর করে বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। শ্রীপুরে ওষুধ শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা বাজেটে বাস্তবায়নের আওতায় আনতে হবে। কারওয়ান বাজারে আইটি পার্ক বাস্তবায়নের পদপে নিতে হবে। হালকা শিল্প স্থাপনের জন্য শিল্প পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। ওই শিল্প পার্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ অবশ্যই রাখতে হবে।
ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক লেনদেন করমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে তা মাত্র ২৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। পোলট্রি শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, হালকা প্রকৌশল, রসায়ন ও ওষুধ শিল্পের জন্য কর অবকাশ সুবিধা অবশ্যই বহাল রাখতে হবে। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করলে এসব ুদ্র শিল্প হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
জাতিকে উন্নত ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে হলে শিা খাতের উন্নতি ছাড়া বিকল্প নেই। বিগত বাজেটে শিা খাতে বাজেট সে অনুযায়ী অনেক কম ছিল। কয়েক বছর ধরে দেশে সাত হাজারের অধিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এমপিওভুক্তির জন্য অপো করছে। বর্তমান সরকার সাড়ে চার বছরে মাত্র এক হাজার ৬০০ শিাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছে। হাজার হাজার শিক, কর্মচারী এমপিও না হওয়ায় আর্থিকভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই আসন্ন বাজেটে এই কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা উচিত।
অন্য দিকে দেশে ৬৫ হাজার গ্রামে কোনো প্রাইমারি শিাপ্রতিষ্ঠান নেই। এসব গ্রামের মানুষের শিার জন্য প্রাথমিক শিাপ্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর চালু রয়েছে। দেশে ৭২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এগুলো চালু রয়েছে। অথচ সরকার ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায় করছে। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় কর চালু নিয়ম ও আইনবিরোধী। তাই এই এসআরও অবিলম্বে প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়য়া ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট কর্তন করা হচ্ছে। অথচ দেশে সরকারি বা বেসরকারি কোনো বাংলা মিডিয়াম স্কুল-কলেজে ভ্যাট নেয়ার বিধান নেই। এ নিয়মও অবশ্যই প্রত্যাহার করা উচিত।
পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করার পরিকল্পনা সরকারকে বাদ দিতে হবে। সব অন্যায়, অবিচার দূর এবং শাস্তির বিধান চালু করে অবিলম্বে আবারো বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
বর্তমান সরকার মতা আসার পরপরই শেয়ারবাজারের ধস নামে। হাজার হাজার বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে পড়েন। শেয়ারবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ব্যাংক, বীমা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য নীতিমালা স্থায়ীভাবে প্রণয়ন করতে হবে। শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলার দ্রুত বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইবুন্যাল গঠন করতে হবে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশনে মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে হবে। ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন অবিলম্বে প্রণয়ন করা দরকার। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য বাজেটেও দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
আমাদের দেশের উন্নয়ন বর্তমানে অবকাঠামো, বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে থমকে গেছে। ছয় বছর ধরে দেশে কোনো ধরনের বড় শিল্প খাতে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। অনেক শিল্প মালিক মেশিনপত্র এনে ঋণের বোঝা পাহাড় বইছেন। কারখানা গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে চালু করতে পারেননি। বাজেটে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘমেয়াদি পদপে থাকতে হবে। কিছু ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে দেশের শিল্প খাতের তেমন উন্নতি হয়নি। অথচ এতে কিছু ব্যবসায়ী বেশ লাভবান হয়েছেন।
গ্যাসের সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। দীর্ঘ চার বছর দেশে কোথাও গ্যাসের সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কোথাও কোথাও গ্যাসের সংযোগ দেয়া হলেও তা দেশের উন্নয়নে তেমন অবদান রাখতে পারেনি। বৃহৎ রিয়েল এস্টেট খাত মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বাজেটে এসব ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।
উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য, তা নয়। অন্যান্য ইস্যুও সমাধান করতে হবে। দেশ রাজনৈতিকভাবে আজ বহু ধারায় বিভক্ত। সরকারকে মনে হয় একটি পুলিশ সরকার ও আমলাবাজ সরকার। জেল-জুলুম, নির্যাতন, ঘুষ, হত্যা, গুম আজ যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। যত বড় বাজেট করি না কেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে কোনো উন্নয়ন টার্গেট অনুযায়ী হবে না। দেশে সুশাসন নেই। সরকার বলছে চমৎকার সুশাসন কায়েম রয়েছে। বিরোধী দল বলছে দেশে আইনের শাসন নেই।
প্রতিদিন মানুষ গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে। কোনো বিচার সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না। অন্য দিকে খুনিরা, আসামিরা রাষ্ট্রপতির মতা বলে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত।
দুর্নীতি আজ আমাদের নিত্যসঙ্গী। পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ইত্যাদির কারণে শেয়ারবাজার জালিয়াতি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত কেঁপে উঠেছে। সরকারের সর্বোচ্চ থেকে দুর্নীতিকে না বলতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদপে নিতে হবে। আগামী বাজেটে দুর্নীতি হ্রাস করতে পদপে গ্রহণের দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ জাতীয় বাজেটে অবশ্যই থাকতে হবে।
বাজেট বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাজেট প্রস্তাবে এজন্য দিকনির্দেশনা খুবই জরুরি। দলীয় চিন্তা-চেতনা পরিত্যাগ করে জাতির স্বার্থে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ সবাই আশা করে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads